‘ডিজ্যুস যুগ নিয়ে আজাইড়া প্যাঁচাল’ নামে ডিজুইস যুগ/জেনারেশনের হাল-হাকিকত নিয়ে নাফিস ইফতেখার কয়েকদিন আগে একটি পোস্ট দিয়েছেন। রিভিউ টাইপের চমৎকার এই পোস্টটিতে তিনি দেখিয়েছেন ডিজুইস যুগের ভালো-মন্দ দিকগুলো- অবশ্য একান্তই তার বিবেচনায়। অনেক কথা উঠে এসেছে সেখানে। তবে ডিজুইস জেনারেশন মোটা দাগে আমাদের মধ্যে কি কি পরিবর্তন এনেছে শুধু তাই দেখলে চলবে না। এর পেছনে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সর্বোপরি অর্থনৈতিক স্বার্থের বিষয়টি দেখাও খুবই জরুরি।
ডিজুইস সংস্কৃতি আমাদের মানসিকতা, রুচি, চিন্তা-চেতনায় একটা আমূল পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছে। তরুণ সমাজের একটা বিরাট অংশকে তারা তাদের মত করে চিন্তা করতে শিখিয়েছে। এই জেনারেশন চিন্তা করে তারুণ্য মানে রাত জেগে কথা বলা। তারুণ্যের শক্তি হলো ‘এক হৃদয়, ৯ প্রেম’ (ভাষাটা ঠিক মনে নেই তবে ডিজুইসের একটা বিজ্ঞাপন প্রায় এরকমই ছিল)। করপোরেট কোম্পানি আমাদের শেখাচেছ আড্ডা, গান, সবকিছু এখানেই- হারিয়ে যাও। যৌবন মানে- দেশের জন্য কোন কর্তব্য নাই, সমাজের জন্য কোন দায়বোধ নাই- আড্ডা আর গানে হারিয়ে যাওয়া!
ডিজুইস জেনারেশন গড়ে তোলার পেছনে মূলত কোন উদ্দেশ্যগুলো কাজ করছে? নিচের এই উদ্বৃতি সেগুলো পরিষ্কার হবে:
“.... দুটো দিক ধরিয়ে দেবার চেষ্টা করি। প্রথম দিক হল আমরা দেখছি প্রকট ও প্রবলভাবে মোবাইলে তরুণ-তরুণীদের পরস্পরের সঙ্গে সারারাত আলাপ করবার ছাড় বা তাদের হাতে হাতে মোবাইল ফোন তুলে দিয়ে অপ্রয়োজনীয় কথা বলার প্রচার চালানো হচ্ছে। অপ্রতিরোধ্য এই আগ্রাসন। ফোন করবার প্রতিটি পয়সার সিংহভাগই চলে যাচ্ছে বিদেশী কোম্পানির কাছে। সেই টাকা বিদেশী মুদ্রায় রূপান্তরিত হয়ে চলে যাচ্ছে বিদেশে। একটি গরিব দেশের কষ্টে অর্জিত বিদেশী মুদ্রা চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। ........
যে তরুণ মোবাইলে কথা বলে সে কি জানে যে বিদেশ থেকে যাঁরা কষ্ট করে টাকা কামিয়ে দেশে পাঠান তিনি আরেকজন তরুণ- মালয়েশিয়ার রাবার বাগানে, কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের লু হাওয়ার মধ্যে কোন কনস্ট্রাকশন কোম্পানির শ্রমিক? কিংবা আরেকজন তরুণী- জর্দানে বাড়ির মেইড বা নার্স? ঘামে রক্তে আয় করা খেটে খাওয়া মানুষের টাকা- যে আয়কে উৎপাদনশীল খাতে নিয়ে গিয়ে বাংলাদেশকে দ্রুতবেগে সমৃদ্ধির পথে নেওয়া ছিল আমাদের কাজ, তা না করে আমরা শ্রমিকদের রক্তে ঘামে আয়ের টাকা মোবাইল ফোনে অকথা-কুকথা বলে বহুজাতিক কোম্পানির হাতেই কি তুলে দিচ্ছি না আবার? রাজনীতি শূন্যতা শুধু নয়- বাংলাদেশকে উৎপাদনবিমুখ করবারও একটা প্রয়াস চলছে। চলছে তরুণ-তরুণীদের নব্য এক সংস্করণ গড়ে তুলবার, বানাবার, যারা উৎপাদনে কোন ভূমিকা রাখবে না- কিন্তু যাদের জীবনযাপন টিকিয়ে রাখবার জন্য দেশের ভেতরে ও বাইরে শ্রমিক ও কৃষকদের রক্ত ও ঘাম পায়ে ফেলতে হবে। এই বাংলাদেশই কি আমরা চেয়েছি?
নিশ্চয়ই ব্যবসা বাণিজ্যে রপ্তানি করেও আমরা বিদেশী মুদ্রা আয় করি। প্রশ্ন হচ্ছে এই আয়কে আমরা বিনিয়োগে নেব নাকি শুধু বহুজাতিক কোম্পানিই এই দেশে ব্যবসা করবে? আমাদের ছেলেমেয়েদের কি বড় শিল্পপতি বা বড় প্রতিষ্ঠান গড়বার প্রতিভা নাই? এর আগে আমি বলেছি যে যদি এডিবির টাকায় টাটা কোম্পানি বাংলাদেশে ব্যবসা করতে চায় আর এডিবি টাটার জন্য দেনদরবার করে তাহলে টাটাকে আমাদের কী দরকার? এই বিনিয়োগ কি আমরা করতে পারি না? নিশ্চয়ই পারি। তাহলে এডিবি বা বিশ্বব্যাংক সরাসরি আমাদের সহায়তা করুক। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থ সংরক্ষণ করে। নানান ছলচাতুরিতে গণসমৃদ্ধির পথ রুদ্ধ করে দেওয়া তাদের কাজ। এটাই পরাশক্তিগুলোর নীতি।
এই দিকটি যদি বুঝি তাহলে এটাও বুঝব আমাদের ছেলেমেয়েরা রাত নাই দিন নাই ফালতু মোবাইলে কথা বলুক এই বিশেষ সংস্কৃতি এতো বিপুল আয়োজনে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে প্রচারের কী উদ্দেশ্য? ফালতু কথার মতো আমাদের তরুণ-তরুণীদের মধ্যেও একটা ফালতু উৎপাদনবিমুখ বকোয়াজ জেনারেশন গড় উঠুক- এটাই কি আমরা চাই? তারা সারাদিন বাজে কথা বলুক আর মোবাইল কোম্পানি লুটেপুটে খাক! আমাদের আয় করা বিদেশি মুদ্রা বিদেশি কোম্পানির কাছেই আবার চালান করে দিক ডিজুইস! বাংলাদেশে কি বিনিয়োগ হবে না? ব্যবসা হবে না? অবশ্যই হবে। তবে ব্যবসা যদি কেউ করে করবে একমাত্র বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানি। বিনিয়োগও হবে তাদের। আমরা তাদের চাকর-বাকর হবো। আমরা তাদের গোলাম হয়ে ধন্য হয়ে যাবো? এটাই কি আমাদের স্বপ্ন? কী স্বপ্ন দেখাচ্ছে এই সকল কোম্পানি সেটা তাদের বিলবোর্ড ও গণমাধ্যমে পত্রপত্রিকার বিজ্ঞাপন দেখুন। যদি অনুভূতি বলে কারো কিছু অবশিষ্ট থাকে তবে গা শির শির করে উঠবে। চতুর্দিকে ভয়াবহ প্রচারণার জাল পাতা হয়েছে যেন এদেশে কোনো প্রজন্ম গড়ে না ওঠে যারা স্বপ্ন দেখতে জানে। যারা দেশকে গড়তে জানে। .......
না, আমি বলছি না আমাদের কমিউনিকেশন দরকার নাই, ফোন থাকবে না। অবশ্যই থাকবে। কিন্তু কী কাজে তাকে আমরা ব্যবহার করব? আমরা কি এই ভাবেই আমাদের দেশকে কোম্পানিগুলোর লুণ্ঠনের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করবে? সংযোগ বা কমিউনিকেশন অব্শ্যই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র- সেই ভাবে কি মোবাইল সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছে বাংলাদেশে। আমি এখন ‘ডিজুইসেই একটি বিজ্ঞাপনের দিকে তাকিয়ে আছি। ভাষা, প্রস্তা ও বক্তব্য দেখুন- “দুনিয়ার ‘সুখ’ অনলি অন মাই ডিজুইস: ম্যাসেজিং, মিউজিক, ফ্রেন্ডস এন্ড মাচ মোর’। কতো কম সময়ে বাজে কথার কালচার কায়েম করে কোটি কোটি ডলার হাতিয়ে নেওয়া যায় সেই লুটপাটকেই আমরা অবাধে কায়েম করতে দিচ্ছি। গণমাধ্যমে মোবাইলের এই ভাবমূর্তিই আমরা প্রতিষ্ঠা করছি। একই সঙ্গে বানাচ্ছি এক দঙ্গল ডিজুইস জেনারেশন। তারা কারা, দেখতে কেমন- তাদের হাবভাব ভামমূর্তি ডিজুইসের বিজ্ঞাপনেই আমরা দেখছি। ........
দুনিয়ার সুখ অনলি অন মাই ডিজুইসের ছেলেমেয়েরা মালয়েশিয়ার রাবার বাগানে কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের কনস্ট্রাকশন ফার্মে গায়ে গতরে খেটে রক্তে ঘামে আয় করে না। কিংবা নিউ ইয়র্ক বা টরেন্টোতে ট্যাক্সি চালিয়ে কিংবা ইংল্যান্ডে বা ইউরোপে হোটেলে বাসন মেজে আয় করে না। ডিজুইস জেনারেশন খরচিয়া জেনারেশন- তাদের কাজ বাংলাদেশের খেটে খাওয়া তরুণরা যা কিছু বিদেশ থেকে আয় করে আনে তা ‘সুখ’ পাবার আশায় মোবাইল ফোনে খরচ করে দেওয়া। বহুজাতিক কোম্পানির টাকশালে ফিরতি জমা দিয়ে দেওয়া”। (ক্ষমতার বিকার ও গণশক্তির উদ্বোধন: ফরহাদ মজহার)
ডিজুইস জেনারেশনের জীবন-যাপনটা কেমন? সাইফ শেরিফের ব্লগে ‘মেধাহীন ‘করপোরেট’ মেরুকরণ, গড্ডালিকার নর্দমা, ডিজুস তারুণ্য’ পোস্টটি পড়লে এ সম্পর্কে কিঞ্চিত আঁচ পাওয়া যাবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মে, ২০১০ দুপুর ১২:৫৫