ফেব্রুয়ারির ১১ তারিখ থেকে এপ্রিলের ১৬ তারিখ এই দু'মাস ৫ দিনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন তিনজন শিক্ষার্থী। প্রতিটি হত্যাকাণ্ড নিয়েই কিছুদিন মিডিয়ায় মাতামাতি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় গঠন করেছে তদন্ত কমিটি। মামলা হয়েছে। পুলিশ তদন্তে নেমেছে। তারপর সব চুপচাপ। কেন এই হত্যাকাণ্ডগুলোর কোনো সুরাহা হয়নি? এ প্রশ্ন অনেকের মনেই জেগেছে কিন্তু জবাব নেই। আজকের এ লেখায় মূলত এ প্রশ্নটির জবাব নিয়েই হাজির হয়েছি। ধারাবাহিকভাবে তিনটি হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত ঘটনা ও ঘটনার নেপথ্য কাহিনী-যেগুলোর অধিকাংশ কোনো মিডিয়াতে আসেনি-সে বিষয়গুলো তুলে ধরবো। কেন বার বার হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটছে এবং কারা এসব ঘটাচ্ছে এ লেখায় পাঠকের কাছে তা পরিষ্কার হবে বলে আশা করা যায়।
মহিউদ্দিন হত্যাকাণ্ড
আগে প্রেক্ষাপটটা বলে নেয়া দরকার। ২০০৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসে। তারপর থেকেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি প্রফেসর ড. বদিউল আলমের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনে নামে ছাত্রলীগ। বদিউল আলম যে সীমাহীন দুর্নীতি করেছিলেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ছাত্রলীগের ভিসি বিরোধী আন্দোলনের পেছনে এটি একটি উছিলা ছিল মাত্র। ছাত্রলীগ নিজেই আকণ্ঠ অপরাধের মধ্যে জড়িয়ে আছে, সেখানে বদিউল আলমের দুর্নীতি তাদেরকে আন্দোলনে নামাবে এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। যদি তাই হতো তাহলে আরো আগেই তারা আন্দোলনে নামতো। যখন তাদের সরকার ক্ষমতায় এসেছে তখন তারা নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিকে ভিসি বানানোর জন্যই মূলত আন্দোলনে নামে। অবশেষে বদিউল আলম বিদায় নিয়েছেন।
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রফেসর ড. আবু ইউসুফ আলম ভিসির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। স্বভাবতই ছাত্রলীগ আশা করেছিল এবার তাদের আবদারগুলো (হলে অবস্থানরত বৈধ-অবৈধ সব শিবিরকর্মীকে হটানো, ছাত্রলীগ কর্মীদেরকে যে কোনো পন্থায় হলে উঠানো, বিশ্ববিদ্যালয়ের টেন্ডার পাইয়ে দেয়াসহ নানা আবদার) পূরণ হবে। কিন্তু বিধিবাম। যদিও তিনি তাদের কিছু কিছু আবদার (যেমন হলে সিট বরাদ্দের ক্ষেত্রে ৩০% মু্ক্তিযোদ্ধা কোটার নামে প্রকারান্তরে ছাত্রলীগকেই সিট প্রদানের ব্যবস্থা) পূরণ করেছেন। কিন্তু তাদের অধিকাংশ আবদার মেনে নিতে রাজী হলেন না তিনি। ফলে ছাত্রলীগ পড়েছে শাঁখের করাতে- তারাই আন্দোলন করে এই ভিসিকে এনেছে, এখন তিনিই তাদের আবদার শুনছেন না।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে কোনোভাবেই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে না পেরে ক্যাম্পাসকে অস্থিতিশীল করে তোলার পরিকল্পনা নেয় ছাত্রলীগ। প্রশাসনকে বেকায়দায় ফেলে দিয়ে তাদেরকে পদত্যাগে বাধ্য করে পছন্দ মতো কাউকে প্রশাসনে বসানোর চিন্তা থেকেই এ পরিকল্পনা নেয়া হয়। সে লক্ষ্যে সিরিজ হত্যার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বিপাকে ফেলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ছাত্রলীগের এরশাদ গ্রুপ।১ ঠিক তখনই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিহত হয় এক জন ছাত্রলীগ কর্মী। মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি! একে কেন্দ্র করে চবি ক্যাম্পাসকে উত্তপ্ত করে তোলে ছাত্রলীগ। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এই সুযোগে যে কোনো এক জন শিবিরকর্মীকে হত্যা করা হবে। এতে শিবিরকেও শায়েস্তা করা হবে আবার প্রশাসনকেও বেকায়দায় ফেলে দেয়া যাবে। ম্যানেজম্যান্ট ৩য় বর্ষে অধ্যয়নরত শিবিরের কর্মী মোহাইমিনকে খুন করার পরিকল্পনা নেয়া হয়।
ফেব্রুয়ারির ১১ তারিখ রাতে শহর থেকে ক্যাম্পাসে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ষোল শহর রেল স্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন মোহাইমিন। পাশের একটি দোকানে বসে চা খাচ্ছিলেন মোহাইমিন। পাশেই বসে ছিলেন ট্রেনের জন্য অপেক্ষারত রাজনীতি বিজ্ঞান মাস্টার্সের ছাত্র মহিউদ্দিন। মহিউদ্দিন সম্প্রতি তাবলীগ করা শুরু করেছেন। টাখনুর উপরে ছিল তার প্যান্ট। মুখে দাড়ি রাখাও শুরু করেছেন।
ছাত্রলীগের কিলার সাকিব, রাকিবসহ আরো কয়েকজন পরিকল্পনা মতো আসে মোহাইমিনকে খুন করার জন্য। মোহাইমিনকে দু’চার ঘা লাগাতেই আমি না, আমি না বলে দৌড়ে পালিয়ে যান তিনি। মহিউদ্দিন পালিয়ে যাওয়ায় তারা আক্রমণ করে মহিউদ্দিনকে। ধারণা করা হচ্ছে, টাখনুর উপরে প্যান্ট আর মুখে দাড়ি দেখে শিবির কর্মী সন্দেহে তাকে আক্রমণ করে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। পাথর দিয়ে থেতলে দেয় পুরো শরীর। মৃত্যু নিশ্চিত করে চলে যায় তারা। মূলত মহিউদ্দিন ছিলেন মিস টার্গেটের শিকার।
তার পরের ঘটনা সবার জানা। চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী মিডিয়ার তথ্য সন্ত্রাস চলতে থাকে। মহিউদ্দিনের পরিবার থানায় মামলা করে। পুলিশ তদন্তে নামে। কিন্তু তদন্তে যখন ধরা পড়লো এটি ছাত্রলীগের কাজ। তখন থেকে পুলিশ একেবারে চুপ। চট্টগ্রামের স্থানীয় একটি পত্রিকায় হত্যাকান্ডের প্রকৃত ঘটনার কিছুটা ইশারা পাওয়া যায়। চট্টগ্রামের সবচেয়ে জনপ্রিয় দৈনিক আজাদীতে একটি খবর ছাপা হয়েছিল ফেব্রুয়ারির ১৭ তারিখে। পাঠক এখানে খবরটা দেখতে পারেন।
পাদটীকা:
১। চবিতে ছাত্রলীগ মূলত ২টি গ্রুপে বিভক্ত। জামশেদ গ্রুপ ও এরশাদ গ্রুপ। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মহিউদ্দীন সমর্থিত গ্রুপ হলো চবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এরশাদ গ্রুপ। অন্যদিকে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামীলীগ নেতা আ জ ম নাছির সমর্থিত গ্রুপ হলো চবি ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি জামশেদ গ্রুপ। চবি ছাত্রলীগের সভাপতি কাজী মাজহার ঢাকা চলে যাওয়ায় জামশেদ নিজেকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি দাবি করে; কিন্তু এরশাদ গ্রুপ তা স্বীকার করে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে এতদিন জামশেদ গ্রুপের কর্তৃত্ব ছিল। কিন্তু বর্তমান ভিসি মেয়রের ঘনিষ্ট হওয়ায় এরশাদ গ্রুপ ক্যাম্পাসে কর্তৃত্ব ফলাতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেনে ছাত্রলীগের বগিভিত্তিক সংগঠনগুলো যথা- ভার্সিটি এক্সপ্রেস ও ’সিএফসি’ও (আগে নাম ছিল clorofloro carbon এখন নাম পাল্টিয়ে হয়েছে choose friend with care) - এই দুই গ্রুপে বিভক্ত।