ভালো করে গায়ে চাদর জড়িয়ে রাবুমামা বললেন, সে অনেক বছর আগে কথা বুঝলি । সে সময় আমার একবার সুপারন্যাচারাল এক্সপিরিয়েন্স হয়েছিল । আজ পর্যন্ত আমি যার কোনও ব্যাখ্যা দিতে পারিনি। বলে রাবুমামা চুপ করে রইলেন। মুখ তুলে একবার আকাশের দিকে তাকালেন। আকাশে পরিপূর্ণ একখানি চাঁদ। উথাল-পাথাল জ্যোস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর । নভেম্বর মাস; গ্রামাঞ্চচলের দিকে এই সময়ই শীত বেশ জেঁকে বসে। রাত দশটার মতো বাজে।
রাবুমামার সামনে রবিন, নীলু আর মুনিয়া চাদরমুড়ি দিয়ে বসে। ওরা আজই ঢাকা থেকে কুসুমপুরে এসেছে শীতের পিঠা, খেজুরের রস, ঝিলাই নদীর চরে পিকনিক আর রাবুমামার গল্পের টানে। কত যে জিন-পরির গল্প জানেন রাবুমামা। তা রাবুমামা আজও বেশ গল্প জমিয়ে তুলেছেন। আজ রাতের খাওয়টা বেশ জম্পেশ হয়েছে।হাঁসের মাংস আর মুগের ডালের খিচুড়ি খেয়ে রাবুমামার গল্প শুনতে ছাদে এসে বসেছে ওরা।
রাবুমামা বললেন, তখন আমি সবে ডাক্তারি পাস করে রাজারহাট শহরে প্র্যাকটিস শুরু করেছি। সেই উনিশ শো পয়ষট্টি সালের কথা বুঝলি। একবার। সেসব দিনে তো আর মোবাইল ফোন ছিল না, এমন কী আজকের মতো ঘরে ঘরে ল্যান্ডফোনও ছিল না । সন্ধ্যায় টেলিগ্রাম পেলাম যে মার - মানে তোদের নানী গুরুতর অসুস্থ । আমার বুকটা ধক করে উঠল। কোনওমতে নাকেমুখে কিছু গুঁজে রাজারহাট রেলস্টেশনে ছুটলাম। রেলস্টেশনে পৌঁছতে- পৌঁছতে রাত দশটা। রাত দশটা কুড়িতে নবীগঞ্জের ট্রেন আসার কথা । ওদিকে কী কারণে ট্রেন লেইট ছিল। কী আর করা। আমি প্ল্যাটফর্মের ওপর একটা ফাঁকা বেঞ্চিতে বসলাম। নভেম্বর মাস। স্টেশন নির্জন হয়ে ছিল। লোকজনের ভিড় একেবারেই ছিল না। প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা। সামনে দু জোড়া শূন্য রেললাইনের ওপর জ্যোস্না আর কুয়াশার চাদর। মার কথা ভেবে উদ্বিগ্ন ছিলাম। তোদের নানী বুঝলি তখন আমার বিয়ের জন্য ভারি অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু আমার মফস্বলের হাত-পা ঝাড়া জীবনই ভালো লাগছিল বলে মার অনুরোধ বারবার ফিরিয়ে দিচ্ছিলাম। সেই জন্যই মা অসুখে পড়লেন কিনা এই ভোবে আমার রীতিমতো টেনশন হচ্ছিল। রাত এগারোটা বাজল। আমি বিরক্ত হয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। ঠিক তখনই ওদের ওপর আমার চোখ পড়ল। বলে রাবুমামা চুপ করে রইলেন। গল্প বলতে-বলতে রাবুমামা চুপ করে যান। এটিই ওনার বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
ওরা উশখুস করে। নির্জন রাত। দূরে ঝিলাই নদীর ওপর কুয়াশার সামিয়ানা। রবিনের মাথায় একটা নীল রঙের উলের মাঙ্কি টুপি। এখন অবশ্যি চাঁদের আলোয় টুপিটা কালচে দেখাচ্ছে। রবিন শীত একেবারেই সহ্য করতে পারে না। ও জিজ্ঞেস করে, তারপর কি হল মামা?
বলছি। আমি যে বেঞ্চিতে বসে সিগারেট টানছিলাম তার একটু দূরে আরেকটি বেঞ্চিতে একটা কয়েকজন কে বসে থাকতে দেখলাম। পায়ের কাছে লাগেজ। আশ্চর্য! ওর কখন এল? বুঝলি, ওদের আমার একই পরিবারের বলে মনে হল। আর পরিবারটি কে কেন যেন আমার পাকিস্তানি মনে হল। কালো রঙের সালোয়ার কামিজ পরা দীর্ঘাঙ্গী এক তরুণির ওপর আমার চোখ আটকে গেল । তরুণির রুপ দেখে আমি থ মেরে গেলাম। গায়ের রং দুধে আলতা গায়ের রং। কিছুটা বাদামী চুল। ঘন জোরা ভুঁরু। মায়াবী চোখ। ধবধবে গলায় মুক্তার মালা। মেয়েটি কামিজের ওপর ঘিয়ে রঙের কার্ডিগেন পরে ছিল। জর্জেটের সাদা ওড়ানাটা মাথার ওপর ঘোমটার মতো করে জড়ানো । মেয়েটির পাশে একটা নীল রঙের বড় ফ্লাক্স । এমন রূপসী মেয়ে আমি এর আগে কখনও দেখিনি। মেয়েটির পাশে বসে ছিলেন মাঝবয়েসি একজন ভদ্রলোক। ভদ্রলোক (সম্ভবত কুর্তার ওপর) গায়ে বাদামী রঙের কাশ্মিরী দামি শাল জড়িয়েছেন। মাথায় লাল রঙের ঝুঁটিওয়ালা তুর্কি টুপি। ভদ্রলোকের গায়ের রং ধবধরে ফর্সা, ভরাট মুখে চাপা দাড়ি। দাড়িতে মেহেদি লাগিয়েছেন বলে মনে হল। সব মিলিয়ে বেশ অভিজাত চেহারা। ভদ্রলোকের পাশে ফুলপ্যান্ট আর সাদা রঙের সোয়েটার পরা ফুটফুটে চেহারার একটি দশ-বারো বছরের বালক বসে; মাথায় ক্যাপ। বালকটির পাশে বোরখা পরা একজন মহিলা বসে । মহিলা সম্ভবত বালকটির মা। মহিলার মুখে নেকাব। বাঙালি মেয়েরা সুন্দরী হলেও ওই মেয়েটির মধ্যে মধ্যপ্রাচীয় একটা ব্যাপার ছিল। যে কারণে পরিবারটিকে আমার পাকিস্তানি বলেই মনে হয়েছিল। তবে আমার মনটা ভীষণ দমে গেল।
কেন মামা? তোমার মন দমে গেল কেন? মুনিয়া জানতে চাইল।
বুঝলি না? সময়টা নাইনটিন সিক্সটি ফাইভ। পাকিস্তান আমল। পশ্চিম-পাকিস্তানিদের শাসন-শোষনের বিরুদ্ধে বাঙালিদের অসন্তোষ দিনদিন বাড়ছিল। তাই।
তাই তোমার মনটা দমে গেল?
হুমম। আসল কথা হল মেয়েটি কে আমার ভারি পছন্দ হয়েছিল। আর তোর নানীও চাইছিল আমি বিয়ে থা করি। কিন্তু মেয়েটি পাকিস্তানি হলে তো আর বিয়ে সম্ভব না। তাই আমার মনটা দমে গিয়েছিল।
ওহ্ ।
ঘড়িতে দেখি রাত বারোটার মতো বাজে। তখনও ট্রেনের টিকিটির দেখা নেই। একটু পর হল কী জানিস। সেই ভদ্রলোক উঠে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন।ভদ্রলোক বেশ লম্বা।আমি আত আতরের কড়া গন্ধ পেলাম। তবে পরিচিত গন্ধ না। ভদ্রলোক বিরক্ত হয়ে বললেন, দেখুন তো, কী মুশকিল। ট্রেন লেইট। এদিকে শীতটা কী রকম বাড়ছে দেখুন। ওদিকে আমাদের আবার যত শিগগির সম্ভব রায়নগর পৌঁছতে হবে। মানে আমার শাশুড়ি হঠাৎ স্ট্রোক করেছেন কিনা। এই ঘন্টাখানেক আগে দুঃসংবাদটা পেলাম।
ভদ্রলোকের বাংলা উচ্চারণ শুনে আমি নিশ্চিন্ত হলাম। ভদ্রলোকের কথায় বিন্দুমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানি টান নেই। আমি বললাম, সরকারি ট্রান্সপোর্টের কথা আর বলবেন না। গত সপ্তাহে পীরের হাটে রোগী দেখতে গিয়েছি। কী বলব- রোকনপুর স্টেশনে ট্রেন সাড়ে তিন ঘন্টা লেইট। শেষ পর্যন্ত বেচারা মরেই গেল।
বাবা। তুমি ডাক্তার? ভদ্রলোকের কন্ঠস্বর বেশ আন্তরিক শোনালো।
জ্বী। আমি রাজারহাটে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করছি।
ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে বললেন, আমার নাম উবাইদ মালিক।
আমি হাত মেলালাম। নরম তুলতুলে শীতল হাত। অতিরিক্ত কোমল। আমি অবাক হলাম।
ভদ্রলোক আমার পাশে বসলেন। ভদ্রলোকের নামটা শুনেও আমার কেমন খটকা লাগল। আরবি নাম। নাম কেবল ‘উবাইদ’ কিংবা ‘মালিক’ হলে খটকা লাগত না। তাছাড়া ভদ্রলোক ‘উবাইদ’ উচ্চারণ করলেন। উচ্চারণ কি ওবায়েদ হবে? তবে উবাইদ মালিক-এর কথাবার্তায় ওনাকে বাঙালিই মনে হল। শিয়া মুসলিম নয় তো?অথবা বিহারী? মনটা আবার দমে গেল। এরা শিয়া বা বিহারী হলে তো মা কিছুতেই বিয়েতে রাজি হবেন না।
বিয়ে মানে? নীলু জিজ্ঞেস করে।
ততক্ষণে আমি মনে মনে উবাইদ মালিক -এর মেয়েকে বিয়ের জন্য প্রস্তাব দেব বলে ঠিক করে ফেলেছি।
উবাইদ মালিক বললেন, বাবা, তুমি তাহলে রাজারহাটেই থাক?
জ্বী, চাচা। রাজারহাট শহরে। রাহাপাড়া পানির ট্যাঙ্কির কাছে।যেখানে নদী গবেষনার ইন্সিস্টিটিউট-এর যে নতুন ভবন হচ্ছে ।
হ্যাঁ, হ্যাঁ। জায়গাটা আমি চিনি। রাজার হাটে আমার এক মামা থাকেন। আব্বাস মামা আফগানিস্তান থেকে আখরোট আর নাশপাতি ইমপোর্ট করেন। আর আমি থাকি মিঞাবাড়ির বালাই দীঘির পাড়। ওখানেই আমাদের পৈত্রিক ভিটে।
উবাইদ মালিক- এর কথা শেষ হল না সেই ছোট ছেলেটি দুটি কাপ নিয়ে এল। নীল রঙের বড় চিনেমাটির কাপ। কাপে চা আছে মনে হল। কী অদ্ভূত সুন্দর নিষ্পাপ বালক। টলটলে হলদেটে গায়ের রং। চায়ের কাপ দুটো আমাদের দিয়েই ছেলেটি আবার দৌড়ে চলে গেল। উবাইদ মালিক চায়ের কাপে চুমুক দিলেন দেখে খটকা লাগল। কারণ চায়ের কাপে তখনও ধোঁওয়া উঠছিল।ভদ্রলোক অত গরম চায়ে চুমুক দিলেন কীভাবে? আশ্চর্য!
উবাইদ মালিক বললেন, এই ছেলেটি আমার ছোট ছেলে, নাম শাদিদ। আমার মেয়েই বড়। ওর নাম আফসানা । ক্লাস টেন পর্যন্ত স্কুলে পড়েছে। এখন ঘরে বসেই আরবি ফারসি পড়ছে। বলে ভদ্রলোক দাড়িতে হাত বোলাতে লাগলেন। ওনার বিবির নাম যে খুশনুদ খানম কথায় কথায় সেটিও জানিয়ে দিলেন। খুশনুদ খানম- এর মা-ই স্ট্রোক করেছেন।
কয়েক বার ফুঁ দিয়ে চায়ের কাপে ছোট্ট চুমুক দিলাম। অসাধারণ টেস্ট। কী বলব! মশলা মেশানো ঘন দুধের চা। বুঝলি এমনটা এর আগে কখনও খাইনি। দুধটা উটের দুধ মনে হল।
রবিন জিজ্ঞেস করে, মামা, তুমি কীভাবে বুঝলে যে ওটা উটের দুধ ছিল?
ওহ! আমি স্কাউটিং করতাম। কলেজে পড়ার সময় একবার দলবল নিয়ে তাজাকিস্তানে গিয়েছিলাম। ওখানেই ফেরগানা উপত্যকায় জীবনে প্রথম উটের দুধ খেয়েছিলাম।
ওহ্ ।
আমি মশলাদার চায়ে ছোট্ট চুমুক দিয়ে বললাম, ইয়ে চাচা, মানে ... মানে আমি আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।
চায়ের চুমুক দিয়ে উবাইদ মালিক বললেন, বল, বাবা, বল।
আমি কী বলব বুঝতে পারছি না। মধ্যরাতের স্টেশনে প্রায় অপরিচিত কাউকে তার মেয়েকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তাব দেয়াটা কি অশোভন দেখায় না? তবে আফসানা মেয়েটি এতই রূপবতী যে আমার সমস্ত বুদ্ধি বিবেচনা কেমন যেন গুলিয়ে গিয়েছিল। তাছাড় পরিবারটিও বেশ চমৎকার। আন্তরিক। কেমন চা খাওয়ালো। উবাইদ মালিকও বেশ অমায়িক আর আন্তরিক।
আমি বললাম, চাচা, আমাদের বাড়ি নবীগঞ্জের দরগাবাড়ি। আমাদের কিছু পৈত্রিক সম্পত্তিও আছে। তবে আমার বাবা নেই, তিনি ডাকবিভাগে চাকরি করতেন। আমার মা অবশ্য বেঁচে আছেন। আমিই পরিবারের বড় ছেলে। আমার দুই ছোট বোন আছে। ওরা স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করছে।
বেশ তো। বুঝলাম।
আমি...আমি
হ্যাঁ বাবা, বলো।
আমি ... আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই।
আমার এই কথায় ভদ্রলোকের মুখ কেমন গম্ভীর হয়ে উঠল। ধবধবে ফর্সা মুখে শ্রাবণের মেঘ জমে উঠল যেন। তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। ভিড়শূন্য মধ্যরাতে স্টেশন শুনশান করছিল। ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে কুয়াশা ছড়িয়ে ছিল। দু জোড়া রেললাইনের ওপর জ্যোস্না আর কুয়াশার চাদর মোড়ানো।
উবাইদ মালিক আমাকে জিগ্যেস করলেন, তুমি আফসানাকে বিয়ে করতে চাও?
জ্বী। চাচা।
সে তো সম্ভব নয়।
মধ্যরাতের নির্জন স্টেশনে বিনা মেঘে বজ্রপাত হল যেন। আমার মাথা কেমন টলে উঠল। আফসানা মেয়েটি এত সুন্দর। আমি কোনওমতে বললাম, সম্ভব নয়? কেন? আমার কন্ঠস্বর কেমন যেন ফ্যাঁসফ্যাঁসে শোনালো। আমি চা কী খাব। কাঁপা- কাঁপা হাতে কাপটা বেঞ্চির ওপর রেখে দিলাম।
ভদ্রলোক গম্ভীর মুখে চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, এক বিশেষ কারণে আমি আফসানাকে তোমার হাতে তুলে দিতে পারব না।
কেন? আপনার কি শিয়া চাচা?
উবাইদ মালিক বললেন, না বাবা। আমরা সুন্নী।
তাহলে বিহারী?
না, বাবা। আমরা দীর্ঘকাল ধরে ইস্ট পাকিস্তানেই বাস করছি। পারস্য থেকে আমাদের পূর্বপুরুষ খাজা ইবরাহিম আজম বাংলায় এসেছিলেন পারস্যের প্রখ্যাত সুফি সাধক দরবেশ শাহ মোল্লা মিসকিন- এর সঙ্গে ।
তাহলে? আমার কন্ঠনালী ভীষণ শুকিয়ে আসছিল।
আমরা জিন। উবাইদ মালিক বললেন। ভদ্রলোকের কন্ঠস্বর কেমন গম্ভীর শোনালো।
জিন! মানে? আশ্চর্য! কী বলছেন উবাইদ মালিক। আমার মনে হল মধ্যরাতের এই নির্জন স্টেশনটি একটা প্রকান্ড হিমঘরে ঢুকে গেছে। প্রকান্ড বড় একটা শব্দহীন হিমঘরে। আর আমি প্রগাঢ় নৈঃশব্দে হিসসিম খাচ্ছি। বার বার তলি য়ে যাচ্ছি ... আবার ভেসেও উঠছি।
আপনার জিন মানে? আমার কন্ঠস্বর খানিকটা উত্তেজিত শোনালো।
উবাইদ মালিক মৃদু হেসে বললেন, হ্যাঁ। আমরা জিন। জান তো পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তাঁর ইবাদতের জন্য জিন এবং ইনসান সৃষ্টি করেছেন।
আমি মাথা নাড়লাম। আমার হাতের তালু ঘামছিল। এত শীতের মধ্যেও কন্ঠনালী শুকিয়ে কাঠ। আমার জন্ম পূর্ব বাংলার একটি মুুসলিম পরিবারে। পারিবারিক ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যে বড় হয়েছি। জিনের অস্তিত্ব যে অস্বীকার করি তাও না। কিন্তু, তাই বলে-... আমি আফসানাদের দিকে তাকালাম। ওরা তিনজনই এদিকে তাকিয়ে রয়েছে। ওরা আমাদের কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছে বলে মনে হল। আশ্চর্য! আফসানা ওর মাকে নীচু স্বরে কী যেন বলছে ।
উবাইদ মালিক বললেন, পবিত্র কোরআন মজীদে প্রায় ১২৮ বার শয়তান এবং জিনদের আলোচনা করা হয়েছে। সূরা তুর- এর ৫৬ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করছেন: আমি জিন ও মানবসম্প্রদায়কে একমাত্র আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।
আমি খানিকটা অসহিষ্ণু কন্ঠে বললাম, এসব আমি জানি। কিন্তু, আমি ... আমি আপনাকে পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু ... কিন্তু একজন ইনসান তো ... মানে আমি ... মানে মানুষ তো জিনদের মুলুকে এইভাবে যেতে পারে না।
উবাইদ মালিক মাথা নাড়লেন। চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। তারপর কাপটা বেঞ্চির ওপর নামিয়ে রেখে বললেন, হ্যাঁ। আল্লাহতায়ালার হুকুমে জিনদের কিছু আলাদা কেরামত আছে বৈ কী । সূরা হিজর- এর ১২৭ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন: আমি ইতিপূর্বে জিনদেরতে অগ্নিশিখা হতে সৃষ্টি করেছি।
ভদ্রলোক কথাগুলি এমনভাবে বলছেন যেন ধর্মীয় মাহফিলে বক্তব্য রাখছেন। আমি অস্থির হয়ে বললাম, এসব আমি জানি। কিন্তু, আপনারা কি সত্যিই এই পৃথিবীতেই বাস করেন?
হ্যাঁ। আমাদের মতো আরও অনেকেই বাস করে।
আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। দূর থেকে হুইশেলের আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমি ফাঁকা রেললাইনের দিকে তাকালাম। একটু পরই মাঝরাত্রির নির্জনতা খানখান করে ভেঙে দিয়ে একটি প্যাসেঞ্জার ট্রেন এসে থামল। প্ল্যাটফর্মে খুব যে যাত্রী নামল তা কিন্তু নয়। উবাইদ মালিক আর তার পরিবার কে আমি আর দেখতে পেলাম না। কখন অদৃশ্য হল? উবাইদ মালিক রায়নগর যাবেন বলেছিলেন। তারা ঠিক ট্রেনেই উঠল কিনা তাও আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। আমার কেমন যেন ঘোর লেগেছিল। রাজারহাট স্টেশনের গার্ড আমার পরিচিত। সে এসে আমাকে বলল, স্যার, ট্রেন এসে গেছে। তার কথায় আমার ঘোর ভাঙল। চেয়ে দেখি-বেঞ্চির ওপর চায়ের কাপটা নেই! উবাইদ মালিক কি নিয়ে গেছেন? কখন নিলেন? এসব ভাববার সময় নেই। ট্রেনটা আবার হুইশেল দিয়েছে। এক্ষুনি ছাড়বে। আমি ঝুঁকে ব্রিফকেস তুলে নিয়ে দৌড়ে একটি কম্পার্টমেন্টে উঠলাম। কামরায় অবশ্য উবাইদ মালিক কিংবা তার পরিবারের কাউকে দেখতে পেলাম না। বলে রাবুমামা চুপ করে রইলেন।
এতক্ষণ রবিন, মুনিয়া আর নীলু গল্পটা রুদ্ধশ্বাসে শুনছিল। মুনিয়া জিজ্ঞে করে, তারপর কি হল মামা?
তারপর? তারপর কুড়ি বছর কেটে গেল। রাজারহাট থেকে শ্যামগঞ্জ গিয়ে বছর কয়েক প্র্যাকটিস করলাম। তারপর কুসুমপুরে জমি কিনে এই বাড়িটা করলাম। তো, নাইনটিন এইটি ফাইভের কথা। একদিন রাতে ন’টার দিকে চেম্বার থেকে বাড়ি ফিরেছি । খেতে বসেছি। এমন সময় ফোন বাজল। আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু শুভময় দস্তিদারের বড়ছেলে পল্লব কাঁদতে কাঁদতে ওর বাবার মৃত্যুসংবাদ জানাল। আমার মনটা গভীর বিষাদে ভরে উঠল। শুভময়ের বাড়ি ধনুদিয়া, কুসুমপুর স্টেশনের তিন স্টেশন পরেই । শেষবারের মতো বন্ধুকে একবার দেখার জন্য আমি ভীষণ অস্থির হয়ে উঠলাম । কোনওমতে নাকে-মুখে কিছু গুঁজে কুসুমপুর রেলস্টেশনের দিকে ছুটলাম। রেলস্টেশনে পৌঁছতে পৌঁছতে দশটা বাজল। রাত সাড়ে দশটায় ট্রেন। নভেম্বর মাস। স্টেশন নির্জন হয়ে ছিল। কুয়াশা ছড়ানো প্ল্যাটফর্মটি ফাঁকা। লোকজনের একেবারেই ভিড় ছিল না। ট্রেন আসতে দেরি হবে শুনে বিরক্ত হয়ে আমি প্ল্যাটফর্মের ওপর একটা ফাঁকা বেঞ্চিতে বসলাম। সামনে রেললাইনের ওপর কুয়াশা আর জ্যো¯œা মিলেমিশে পড়ে আছে। শুভময়ের জন্য আমার ভীষণ খারাপ লাগছিল। এত বছরের সর্ম্পক। আমার কলেজ জীবনের বন্ধু। কবিতা লিখত। সেই কিনা শেষ পর্যন্ত ওকালতি পেশা বেছে নিল! তবে আপদ-বিপদ দৌড়ে আসত শুভময়; ওর সঙ্গে আমার কত স্মৃতি, আহ্, জীবন! বিষন্ন বোধ করছিলাম বলে একটা সিগারেট ধরিয়েছি ... তখনই আমি ওদের দেখতে পেলাম। একটু দূরে একটি বেঞ্চিতে বোরখা পরা এক মহিলা আর সাফারি স্যুট পরা একজন পুরুষ বসে আছে । মধ্যবয়েসি পুরুষটি দীর্ঘদেহি এবং সুদর্শন। ধবধবে গায়ের রং। বোরখা পরা মহিলাটি পুরুষটির স্ত্রী কিনা তা ঠিক আমি বুঝতে পারলাম না। নেবাক পরা মহিলাটির ঠিক পাশে বেঞ্চির ওপর নীল রঙের বড় একটা ফ্লাক্স । দৃশ্যটায় কী যেন ছিল-আমি কিছুটা চমকে উঠলাম। বারবার ওদের দিকে তাকাচ্ছিলাম। একটু পর পুরুষটি উঠে কোথায় যেন গেল। হয়তো স্টেশন মাষ্টারের কাছে ট্রেনের খবর নিতে কিংবা টয়লেটে। পুরুষটি চলে যেতেই বোরখা পরা মহিলাটি ফ্লাক্স থেকে কাপে চা ঢেলে হাতে চায়ের কাপ নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকেই এগিয়ে আসতে লাগল। আমি তো অবাক। মহিলাটি যখন আমার সামনে এসে দাঁড়াল, ঠিক তখুনি আমি মিষ্টি একটা গন্ধ পেলাম; অনেকটা হাসনাহেনার গন্ধের মতন। কি ব্যাপার? মহিলাটি আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে কেন? মহিলার হাতে চায়ের কাপই বা কেন? ওকি আমাকে চেনে?
মহিলাটি নেকাব সরিয়ে নিল। আমি চমকে উঠলাম। আফসানা! গায়ের রং দুধে আলতা গায়ের রং। কিছুটা বাদামী চুল। ঘন জোরা ভুঁরু। মায়াবী চোখ। নীলাভ মনি। ধবধবে গলায় মুক্তার মালা। কুড়ি বছর। অবিকল।
মিষ্টি রিনরিনে কন্ঠে আফসানা বলল, আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
আপনি ভালো আছেন কি?
হ্যাঁ। আমি মাথা নেড়ে বলাম। সারা শরীর কেমন অসাড় ঠেকছিল।
এই নিন। চা খান।
আমি কাঁপা- কাঁপা হাতে চায়ের কাপ নিলাম। আশ্চর্য! নীল রঙের বড় চিনেমাটির কাপ।
আফসানা মিটমিট করে হাসছিল। নীল রঙের চোখের মনি ঝিকঝিক করছিল। মিষ্টি রিনরিনে কন্ঠে বলল, ওই যে একটু আগে যাকে দেখলেন ... ওর নাম খুররম। ও আমার স্বামী হয়।
আমার কিছু একটা বলা দরকার। চুপ করে থাকলে খারাপ দেখায়। আমি বললাম, উবাইদ মালিক ... মানে আপনার বাবা ভালো আছেন?
হ্যাঁ। আব্বাজান আল্লাহতায়ালার হুকুমে সহি সালাততেই আছেন ।
কয়েক বার ফুঁ দিয়ে চায়ের কাপে ছোট্ট চুমুক দিলাম। সেই অসাধারণ টেস্ট, সেই মশলা মেশানো দুধ চা। আমার কেমন স্বপ্নের মতন মনে হল। আমি বললাম, ছোট এক ভাই ছিল না?
ওহ্, আপনি শাদিদ- এর কথা বলছেন তো ?
হ্যাঁ, হ্যাঁ শাদিদ। এবার মনে পড়েছে। আমি মাথা নেড়ে বললাম।
ওর তো শাদী হয়ে গেছে। ওর বউ গুলরুখ তো খুব ভালো মেয়ে হয়। একটা ছেলেও তো হল গুলরুখ -এর । ছেলের নাম রেখেছে কামরান।
ওহ!
আফসানা বলল, আমরা যাচ্ছি কাশিপুর । কাশিপুর আমার শ্বশুরবাড়ি হয়।
ওহ। আমি চায়ের কাপটা বেঞ্চির ওপর রাখলাম।
আপনি বিয়ে করেছেন?
হ্যাঁ। মৃদু হাসার চেষ্টা করলাম। হাসি ঠিকঠাক ফুটল কিনা কে জানে।
ক’জন ছেলেমেয়ে আপনার ?
এক ছেলে এক মেয়ে।
আফসানা বলল, আমার একটাই মেয়ে। ওর নাম সেহরিন। জানেন সেহরিন না ওর দিদার কাছে থাকে। আমি এখন যাই। ওই যে খুররম ফিরে আসছে। আফসানার কথা শেষ হল না-দূর থেকে হুইশেলের আওয়াজ শুনতে পেলাম। একটু পর মাঝরাত্রির নির্জনতা খানখান করে ভেঙে দিয়ে ট্রেন এসে থামল। খুব বেশি যাত্রী নামল না অবশ্য। চোখের নিমিষে আফসানা আর খুররম অদৃশ্য হল। তারা ট্রেনেই উঠল কিনা বুঝতে পারলাম না। আমার কেমন ঘোর লেগেছিল। চেয়ে দেখি বেঞ্চির ওপর কাপটা নেই! কাপটা আফসানা কি নিয়ে গেছে? কখন নিল? এসব ভাববার সময় নেই। ট্রেনটা আবার হুইশেল দিয়েছে। এক্ষুনি ছাড়বে। আমি ঝুঁকে ব্রিফকেস তুলে নিয়ে দৌড়ে একটি কম্পার্টমেন্টে উঠলাম। কামরায় অবশ্য আফসানা কিংবা খুররম কাউকে দেখতে পেলাম না। বলে রাবুমামা চুপ করে রইলেন।
মুনিয়া বলল, মামা?
বল।
আমার কিছু খটকা লাগছে।
রাবুমামা বললেন, কি খটকা বল? বলে চাদরের নীচে হাত হাত ঢুকিয়ে পকেট থেকে কী যেন বার করে মুখে ফেলে চিবুতে লাগলেন। এলাচ মনে হল। কে বলবে ইনিই ডাক্তার ইফতেখার উদ্দীন চৌধুরি? আমাদের রাবুমামা। রাবুমামার মাথায় কালো রঙের লেদারের একটা অদ্ভূত আকারের লম্বাটে টুপি। রাবুমামা যখন জাপান গিয়েছিলেন টুপিটা তখন নিয়ে এসেছিলেন।
মুনিয়া বলল, গল্পের শুরুতে তুমি বললে না আফসানা কামিজের ওপর ঘিয়ে রঙের একটি কার্ডিগেন পরেছিল যখন ওকে তুমি প্রথমবার দেখলে তখন?
হ্যাঁ। রাবুমামা এলাচ চিবোতে চিবোতে বললেন।
তারপর উবাইদ মালিক কুর্তার ওপর বাদামী রঙের কাশ্মিরী শাল জড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু, জিনদের কি শীত লাগে মামা? ওরা না আগুনের তৈরি?
হুমম। আমিও এই প্রশ্নগুলি নিয়ে অনেক ভেবেছি।ওই যে তখন আমি বললাম না, অনেক বছর আগে আমার একবার সুপারন্যাচারাল এক্সপিরিয়েন্স হয়েছিল । আজ পর্যন্ত আমি যার কোনও বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দিতে পারিনি।
মুনিয়া বলল, তারপর আফসানা জিগ্যেস করল তুমি বিয়ে করেছ কিনা। তার মানে আফসানা জানত না তুমি বিয়ে করেছ কিনা। তাহলে জিনদেরও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে?
হ্যাঁ। থাকতে পারে। রাবুমামা মাথা নেড়ে বললেন।
নীলু বলল, বিশ বছর পর তুমি আবার আফসানাকে দেখলে। আশ্চর্য! জিন মেয়েটার বয়স বাড়েনি।
হুমম।
রবিন কী বলতে যাবে-রাবুমামা ওকে থামিয়ে বললেন, চল, এখন শুয়ে পড়ি। অনেক রাত হয়েছে। আর বেশ শীতও পড়ে গেছে। কাল আবার ঝিলাই নদীর চরে পিকনিক। সকাল-সকাল বেরুতে হবে ...চল ...