তাহিয়ার হাতে গোলাপ ফুল দেখে বর্ণা চমকে উঠল। ও অস্ফুট স্বরে বলে, ফুল পেলি কই তুই?
তাহিয়া রিনরিনে গলায় বলল, টেবিলের ওপর পেয়েছি। আম্মু তুমি ফুলটা নেবে ? বলে ফুলটা বর্ণার দিকে বাড়িয়ে দেয়।
বর্ণা এক পা পিছিয়ে আসে। ভীষণ কাঁপছিল ও । আশ্চর্য! তাহিয়া গোলাপ ফুল পেল কই? এ বাড়ির নীচতলার বাগানে তো গোলাপের ঝাড় নেই। ছাদে কি বারান্দায় গোলাপের টবও নেই। তাহলে? ফুলটা টেবিলের ওপর পেয়েছে বলল। টেবিলের ওপর কে গোলাপ ফুল রাখল? আশ্চর্য! তাছাড়া ... না, বর্ণা ওই ব্যাপারটা ভাবতে চায় না ...এত বছর পর ...
কথাটা কি মঞ্জুর কে বলব? না থাক। মঞ্জুর এখন অফিসের কাজে ব্যস্ত। মাসখানেক হল নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলা সদরে বদলী হয়ে এসেছে। নতুন অফিস সেটআপ করার দায়িত্ব ওর ওপরই। সেই সাত সকালে বেড়িয়ে যায়। ফেরে অনেক রাতে।
বর্ণার অবশ্য নিরিবিলি এই মফস্বল শহরটা ভালোই লাগছে। মঞ্জুরের ব্যস্ততা সত্ত্বেও ওরা এরই মধ্যে বেশ কিছু জায়গা ঘুরেও দেখেছে। পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার, পতিসর রবীন্দ্র কাচারিবাড়ি, কুশুম্বা মসজিদ। বলিহার রাজবাড়ি, আলতাদীঘি, হলুদবিহার, আর দুবলহাটি জমিদারবাড়িও দেখার কথা আছে।
নতুন জায়গায় সময় বেশ কেটে যাচ্ছে। তাহিয়া এবার ক্লাস থ্রিতে উঠল। ওর স্কুলটা কাছেই। গলির মুখে বড় রাস্তার ওপর। বর্ণাই মেয়েকে স্কুলে দিয়ে আসে। নিয়েও আসে। অভিভাবকদের সঙ্গে গল্প-টল্প করে সময়টা ভালোই কেটে যায় । খালি বাড়িতে থাকলে শরীর কেমন শিরশির করে। সকালবেলায় অবশ্য একজন মাঝবয়েসি মহিলা আসে । ঘরদোর পরিস্কার করে দেয়, রান্নাবান্নাও করে। তার সঙ্গে কথা বলে কিছু সময় কাটে। অন্য সময়টুকু পার করে তাহিয়াকে পড়িয়ে কিংবা গল্প করে । কিন্তু তাহিয়া গোলাপ ফুল পাওয়ার পর থেকেই সারাক্ষণ গা কেমন ছমছম করছে বর্ণার।
টেবিলের ওপর কে গোলাপ ফুল রাখল?
সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে। দোতলা এই বাড়িটা বেশ পুরনো। ঘরগুলি বেশ বড়- বড় আর অন্ধকার- অন্ধকার। এক এক করে ঘরের আলো জ্বালালো। তাহিয়া ড্রইংরুমে টিভি দেখছিল। এখন সোফার ওপর ঘুমিয়ে পড়েছে। আজান শুনতে পেল বর্ণা। মাথায় কাপড় দিয়ে টিভির সাউন্ড কমিয়ে দিল। ঠিক তখনই কলিংবেল বাজল।
দরজা খুলে দেখল- মঞ্জুর। ওকে দেখেই মঞ্জুর বলল, হ্যাপি বার্থ ডে।
বর্ণা হাসল হাসল। পরক্ষণেই হাসি মুছে গেল। মঞ্জুরের হাতে গোলাপ। মুহূর্তেই বর্ণার মন অস্বস্তিতে ছেয়ে যায়। বলে,আর্শ্চয়! ফুল পেলে কই?
টুটপাড়ার মোড়ে একটা ছেলে বিক্রি করছিল । ভাবলাম তোমাকে উইশ করব। এই নাও ধরো।
ফুল নিতে নিতে বর্ণা বলল, আরে, আমার জন্মদিন তো কাল।
জানি। বলে মঞ্জুর ঘরে ঢুকল। ব্রিফকেস রেখে চেয়ারে বসল। জিগ্যেস করল, তাহিয়া কখন ঘুমিয়েছে?
এই তো ঘন্টাখানে হল। থাক ঘুমাক। বলে রান্নাঘরে এল বর্ণা। গোলাপ ফুলের দিকে তাকালো। জন্মদিনের প্রথম উপহার। বর্ণা কে কেমন অন্যমনস্ক দেখায়। জন্মদিন এলেই বাবাকে মনে পড়ে যায় ওর । মেয়ের জন্মদিন নিয়ে বাবার যে কী উৎসাহ ছিল। বাবা নিজেই মেয়ের জন্মদিনের সকালে খেজুরের গুড়ের পায়েস রান্না করতেন। কী চমৎকার রান্নার হাত ছিল বাবার। জন্মদিনে বাবা বন্ধু দীনবন্ধু হাই স্কুলের বাংলার শিক্ষক অজিত স্যারকে দাওয়াত দিতেন।বর্ণার বান্ধবীরাও সব আসত। ... কী অদ্ভূত সুন্দর ছিল নীলফামারীর সেই মেয়েবেলা। বাবা ছিলেন নীলফামারী জাদুঘরের কিউরেটর। ছেলে আর মেয়েকে কী ভালোই- না বাসতেন । বর্ণা আর অলককে নিয়ে কত জায়গায় যে ঘুরে বেড়াতেন । ধর্মপালের রাজবাড়ি, ময়নামতি দুর্গ, সৈয়দপুরের চিনি মসজিদ, কুন্দুপুকুর মাজার, দুন্দিবাড়ী স্লুইসগেট ...মা যে নেই তা মা মরা দুই অনাথ শিশুকে মোটেও বুঝতে দিতেন না ...
একটা কাঁচের গ্লাসে পানি ভরে তাতে গোলাপ ফুল ভিজিয়ে ডাইনিং টেবিলের ওপর এনে গ্লাসটা রাখল বর্ণা।
মঞ্জুর জুতা খুলতে খুলতে বলল, কাল ছুটি নিয়েছি, বুঝলে। সকাল- সকাল সোজা আলতাদীঘি ন্যাশনাল পার্ক চলে যাব । সারাদিন ঘুরে বেড়াব।
উত্তর না-দিয়ে মঞ্জুরের দিকে অদ্ভূত চোখে তাকালো বর্ণা। সারা শরীর কাঁপছে ওর ... ফরসা মুখটা আতঙ্কে নীল হয়ে গেছে। বর্ণা টের পাচ্ছে ওর মাইগ্রেনের ব্যাথাটা ফিরে আসছে ...
রাত এগারোটার মত বাজে। শোওয়ার ঘরে আবছা অন্ধকার। তাহিয়া বিছানার এক কোণে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে। মঞ্জুর বারান্দায়; দিনের শেষ সিগারেট খাচ্ছে। ও ঘরে সিগারেট খায় না।
বর্ণা বিছানায় শুয়ে আছে।কপালের দু'পাশের শিরা টিপটিপ করছে। সন্ধ্যার পর থেকে মাথা ধরে আছে ওর। এখনও ছাড়ছে না। দুটো প্যারাসিটামল খেয়েছে। কাজ হয়নি।
সিগারেট শেষ করে মঞ্জুর শোওয়ার ঘরে আসে। বর্ণার পাশে শোয় বিছানায়। বর্ণাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে।
বর্ণা বলে, কাল আলতাদীঘি না গেলে হয় না মঞ্জুর?
কেন?
এমনি। বরং চল, কাল আমরা দুবলহাটি জমিদারবাড়ি যাই। ওখানে তো এখনও যাওয়া হয়নি। বাবার মুখে শুনেছি দুবলহাটি জমিদারবাড়ির দালানগুলি নাকি অসাধারণ।
মঞ্জুর বলে, আহা বুঝলাম তো। কিন্তু,দুবলহাটি জমিদারবাড়ি পরে গেলেও তো চলবে। আমার তো এখনই ধামইরহাট থেকে ট্রান্সফার হয়ে যাচ্ছে না।
বর্ণা বলল, সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু, ... শুনেছি, আলতাদীঘি যেতে নাকি কাঁচা রাস্তায় অনেকক্ষণ হাঁটতে হয়। তাহিয়া অত হাঁটতে পারবে না।
মঞ্জুর বলল, আহা, তাহিয়া হাঁটতে না পরলে ওকে কোলে নেওয়া যাবে। এতদিন হল ধামইরহাট এসেছি, এখনও আলতাদীঘি ন্যাশনাল পার্ক যাওয়া হল না শুনে অফিসের কলিগরা আমাকে এক হাত নিল। আলতাদীঘির কাছেই এক গ্রামে আমাদের অফিসের একজন স্টাফ-এর এক আত্মীয়ে বাড়ি । ছেলেটির নাম নাসির। নাসির তাদের টেলিফোন করে জানিয়ে দেবে। ওখানেই কাল দুপুরে আমরা খাব।
ওহ। তাহলে সব ঠিক করেই এসেছে। বর্ণা খানিকা ফুঁসে ওঠে বলল।
সাইপ্রাইস! সাইপ্রাইস! মাই ডিয়ার। বলে বর্ণাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মঞ্জুর। কানের লতিতে আলতো করে চুমু খায়।
বর্ণা চুপ করে থাকে।শরীর শিরশির করছিল। তবে বুকের ভিতর ভীষণ আলোরণও টের পাচ্ছিল।
একটু পর মঞ্জুর ঘুমিয়ে পড়ে।
বর্ণা জেগে থাকে। অন্ধকার ঘরে গোলাপ ফুলের হালকা গন্ধ । আশ্চর্য! মুখ ফিরিয়ে দেখল-বারান্দার পর্দা বাতাসে নড়ছে। বর্ণার মনে হল পর্দার ওপাশে কে যেন দাঁড়িয়ে ...
আলতাদীঘি ন্যাশনাল পার্কটা ধামইরহাট উপজেলা সদরের ৫ কিলোমিটার উত্তর দিকে। একটা ব্রিজের পর কাঁচা রাস্তা। রাস্তার দু'পাশে বাঁশঝাড় আর গাছপালা। লালমাটির উচুঁ-নীচু রাস্তায় কিছুক্ষণ হাঁটার পর দু'পাশে ঘন শালবন চোখে পড়ে। তবে শালবনে রোদ সরাসরি পড়েনি। লতাপাতায় জড়িয়ে মাটিতে পড়েছে। দেখে মনে হয় যেন লাল মাটিতে জ্যোস্না বিছানো।
মঞ্জুর হাত তুলে মেয়েকে বলল, ওই যে দেখ মা। কী সুন্দর।
তাহিয়া লাল মাটির ওপর রোদের চিকড়ি-মিকড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ। অনেক সুন্দর বাবা।
বর্ণা আজ কালো রঙের জামদানী পড়েছে। বার্থ ডে গিফট। মঞ্জুর আগেই কিনে রেখেছিল। শাড়িটা বর্ণার গায়ের ফরসা রঙের সঙ্গে দারুণ মানিয়েছে। আশেপাশের মেয়েরা ওর দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছিল।
তাহিয়া বেশ টইটই করেই হাঁটছিল। বর্ণা খানিকটা অবাক। তবে আজ সকালে টেবিলের ওপর গোলাপ পায়নি বলে খানিকটা নিশ্চিন্ত।মাইগ্রেনের ব্যাথাটাও সেরে গেছে ওর।
তাহিয়া হাত তুলে বলল, ওটা কি বাবা?
কোনটা মা?
ওই যে, অনেক উঁচু, আর লাল রঙের।
ওহ্। ওটা? বুঝেছি। ওটা হল উইপোকার ঢিবি। বলে মঞ্জুর ওর প্যানাসনিকটা দিয়ে উইপোকার ঢিবির একটা স্ন্যাপ নেয় ।
তারপর হঠাৎই অফিসের এক কলিগের কথা মনে পড়তেই বলল, জান, তাহিয়া । বৃষ্টি পড়লেও না ওই উইপোকার ঢিবি নষ্ট হয় না।
সত্যি?
হ্যাঁ। সত্যি।
আলতাদিঘীর সবচে কাছের গ্রামটির নামও আলতাদিঘী। গ্রামের বেশির ভাগ বাড়িই মাটির । অনেক বাড়িই আবার দোতলা। বাড়ির সামনে পেঁপেগাছ। ছবির মতন পরিস্কার নিকানো উঠান। শীত পড়তে শুরু করেছে। আকাশ ধূসর। দূরের দিগন্তরেখায় এই সকালেও কুয়াশার ঘের।
মঞ্জুরের অফিসের স্টাফ নাসিরের আত্মীয়র বাড়িটিও দোতলা। অবস্থা বেশ স্বচ্ছল বলেই মনে হল। নাসিরের এক খালাতো ভাইয়ের নাম সাঈদ। লম্বা চওড়া কালো মতন কিশোর। নওগাঁ কলেজে পড়ে। যত্ন করে বসিয়ে গুড়ের সন্দেশ আর পেঁপের শরবত খেতে দিল সে।
সাঈদই ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে সব দেখাল।
গ্রামের পরই শালবন ঘেরা আলতাদীঘি। টলটলে কালো জলের বিশাল দীঘি। দেখে অনেক প্রাচীন বলে মনে হয়। দীঘির জলে পদ্মফুল চোখে পড়ে । একটি দুটি হাঁস ভেসে বেড়াচ্ছে।
তাহিয়া হাত তুলে দেখিয়ে বলল, বাবা দেখ। কী সুন্দর পাখি।
সাঈদ হেসে বলল, ওগুলি হল অতিথি পাথি। শীত পড়তে শুরু করেছে বলে আসতে শুরু করেছে।
আলতাদীঘির টলটলে কালো জলের বিস্তার দেখে বর্ণার শরীর শিরশির করতে থাকে। যে জলসম্ভারকে ও ভয় পায়, ঘৃনা করে-কখনও ভাবেনি সেই জলের সম্ভারের পাশে একদিন এসে ও দাঁড়াবে।
আলতাদীঘির দৈর্ঘ্য কত হবে জান সাঈদ? মঞ্জুর জিজ্ঞেস করে।
সাঈদ বলল এক কিলোমিটারের মতন হবে স্যার। ওই যে, ওই দিকে ইন্ডিয়ার বর্ডার।
ওয়াও।
দীঘিতে নৌকা আছে। দাঁড়টানা নৌকা। মঞ্জুর ওদের নিয়ে নৌকায় উঠতে চাইল। বর্ণা কিছুতেই নৌকায় উঠবে না।
মঞ্জুর বলল, থাক, তাহলে।
ও লক্ষ করেছে আলতাদীঘির পাড়ে আসার পর থেকেই বর্ণা কেমন গম্ভীর হয়ে আছে।
দুপুরের সাঈদদের বাড়িতে কালোজিরার ভর্তা, নিরামিষ, লেবু-নারকেল দিয়ে হাঁসের তরকারী, আমের টক আচার আর দই খেয়ে সন্ধ্যের আগেই ধামইরহাট শহরে ফিরে এল ওরা ।
রাতে শোওয়ার ঘরে গোলাপ ফুলের হালকা ঘ্রান পেল বর্ণা। নিমিষে মনটা অস্বস্তিতে ছেয়ে যায়। ঘরে আবছা অন্ধকার। তাহিয়া বিছানার এক কোণে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে। মঞ্জুর বারান্দায়। সিগারেট খাচ্ছে।
গোলাপ ফুলের ঘ্রান এই মুহূর্তে ঘন হয়ে উঠেছে। বর্ণা চোখ বন্ধ করে। বিশাল প্রাচীন আলতাদীঘির টলটলে কালে জলের বিস্তার ভেসে ওঠে। ও কেঁপে ওঠে। দীঘির জলের পদ্মবনের নীচে একটি বালকের লাশ। ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়।
ঠিক তখনই মঞ্জুর ফিরে আসে। বর্ণার পাশে শোয় বিছানায়। বর্ণা তামাকের গন্ধ পায়। ও ফিসফিস করে বলে, মঞ্জুর?
বল।
আজ আমি আলতাদীঘি যেতে চাইনি কেন জান?
কেন?
অলক নামে আমার এক ভাই ছিল। ও যখন স্কুলে পড়ত ... ক্লাস সেভেনে। আমি সে বছর এসএসসি দেব। আলতাদীঘি পিকনিকে এসেছিল অলক।
তারপর?
বর্ণা চুপ করে থাকে।অন্ধকারে গোলাপ ফুলের ঘ্র্রান পায়।
তারপর কি হল? মঞ্জুরের কন্ঠস্বর কেমন অসহিষ্ণু শোনায়।
বর্ণা জিগ্যেস করে, তুমি ... তুমি ঘরে গোলাপ ফুলের গন্ধ পাচ্ছ মঞ্জুর?
হ্যাঁ।
অলক ভোরবেলা আমায় গোলাপ ফুল এনে দিত । আমাদের নীলফামারীর বাড়িটা ছিল অনেক পুরনো । পিছনে কালীবাড়ির মাঠ, তারপর প্রতিমা বিদ্যানিকেতন। আমি অবশ্য ওই স্কুলে পড়িনি। বাবা ছিলেন নীলফামারী জাদুঘরের কিউরেটর ... অলক গোলাপ ফুল ভালোবাসত। ও ভোরবলা
কালীবাড়ির মাঠ পেরিয়ে কই যেন চলে যেত। ভালো করে রোদ ওঠার আগেই গোলাপ ফুল নিয়ে ফিরে আসত। ... ও কোথায় গোলাপফুল পেত তা কখনও বলেনি, জিজ্ঞেস করলে হাসত কেবল ...ও ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় স্কুলের সহপাঠীদের সঙ্গে আলতাদীঘিতে পিকনিকে গেল। বাবা ওকে ছাড়তের না। অলক পড়ত দীনবন্ধু হাই স্কুলে। ওই স্কুলের বাংলার শিক্ষক অজিত স্যার ছিলেন বাবার বন্ধু ।
তারপর?
তারপর অলক ... অলক আলতাদীঘি ডুবে মারা যায়। ও ... ও নৌকা থেকে পড়ে গিয়েছিল। ওর ... ওর লাশ পাওয়া যায়নি।
ওহ্ ।
বর্ণা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে, অলকের মৃত্যুর পর আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। সেই প্রথম মাইগ্রেনের ব্যাথা টের পেলাম। কোনওমতে এসএসসি পরীক্ষা দিলাম। বাবাও মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করতেন না। ভাগ্যিস সেসব দুঃসহ দিনে অজিত স্যার আমার পাশে ছিলেন । তারপর ... তারপর অদ্ভূত সব ঘটনা ঘটতে লাগল।
কী!
আমি আর বাবা ঘরে গোলাপ ফুলের গন্ধ পেতাম।আর আর মনে হত ঘরের মধ্যে কে যেন অথচ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। একে অলক -এর শোক, তার ওপর অশরীরীর উৎপাত।আমাদের দিনগুলি রাতগুলি অসহ্য হয়ে উঠছিল ... যা তোমাকে বোঝাতে পারব না। অজিত স্যার এক তান্ত্রিক ডেকে এনেছিলেন। লাভ হয়নি। বরং অশরীরীর উৎপাত বেড়ে গিয়েছিল। বাবা অতিষ্ঠ হয়ে চাকরি ছেড়ে দিলেন। তারপর আমরা বগুড়ায় চলে এলাম।
তারপর?
তারপর আর গোলাপ ফুলের গন্ধ পাইনি, অশরীরীর উৎপাতও হয়নি। গতকালই অনেক দিন পর তাহিয়ার হাতে গোলাপ ফুল দেখে চমকে উঠলাম।
তাহিয়ার হাতে! মানে?
হ্যাঁ। কাল দুপুরে। তুমি তখন অফিসে। আমি ওকে বললাম ফুল পেলি কই? ও বলল, টেবিলের ওপর পেয়েছি। অলকও আমার ঘরের টেবিলের পর গোলাপ ফুল রেখে যেত যখন যখন ও বেঁচে ছিল। ও যখন মরে গেল তখনও টেবিলের ওপর গোলাপ ফুল দেখতাম । মঞ্জুর?
বল।
আমার মনে হল পর্দার ওপাশে বারান্দায় কে যেন দাঁড়িয়ে ...
মঞ্জুর মাথা তুলে বারান্দার দরজার দিকে তাকালো।
বর্ণা চাপাস্বরে বলে, তোমার...তোমার কি মনে হচ্ছে পর্দার ওপাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে?
হ্যাঁ।
বর্ণা ফিসফিস করে বলল, আমাদের এখন এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে মঞ্জুর।