ভালো করে গায়ে চাদর জড়িয়ে রাবুমামা বললেন, বুঝলি, সে অনেক বছর আগের কথা। সে সময় আমি একবার এক অতিপ্রাকৃত ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিলাম। আজ পর্যন্ত আমি সেই অতিপ্রাকৃত ঘটনার কোনও গ্রহনযোগ্য ব্যাখ্যা দিতে পারিনি। বলে রাবুমামা চুপ করে রইলেন। মুখ তুলে একবার আকাশের দিকে তাকালেন। আকাশে উথাল-পাথাল জ্যোস্নার মাঠে পরিপূর্ণ একখানি চাঁদ। নভেম্বর মাস; এই সময়ই গ্রামাঞ্চচলের দিকে শীত বেশ জেঁকে বসে। রাত দশটার মতো বাজে। রাবুমামার সামনে রবিন, নীলু আর মুনিয়া চাদরমুড়ি দিয়ে বসে। আজ রাতের খাওয়টা বেশ জম্পেশ হয়েছে। হাঁসের মাংস আর মুগের ডালের খিচুড়ি খেয়ে রাবুমামার গল্প শুনতে ছাদে এসে বসেছে ওরা।
রাবুমামা বললেন, তখন আমি সবে ডাক্তারি পাস করে রাজারহাট শহরে প্র্যাকটিস শুরু করেছি। একবার। মরনাপন্ন এক রোগী দেখতে দূর্গাপুর গিয়েছিলাম; ফিরতে ফিরতে বেশ লেটই হয়ে গিয়েছিল। সাইকেলে বেশ দ্রুতই প্যাডেল মারছি। রাত তখন- এই ধর ন’টা কি দশটা, সেসব দিনে গ্রামেগঞ্জে, বুঝলি, যাকে বলে একেবারে গভীর নিশুতি। এবড়োখেবড়ো পিচ রাস্তার দু’পাশে গজারি গাছ। চারধারে কুয়াশা আর জ্যোস্নার আলো । হর্ন বাজিয়ে বাতাসে পোড়া ডিজেলের গন্ধ ছড়িয়ে আমার পাশ দিয়ে একটি ট্রাক দ্রুতগতিতে চলে যায়। এর পরপরই ‘ধপ’ করে একটা ভোঁতা শব্দ শুনতে পেলাম। চেয়ে দেখি রাস্তার পাশে কে একজন উলটে পড়ে আছে। ট্রাকটা লোকটাকে ধাক্কা দিয়েছে মনে হল। আমার বুকটা ধক করে উঠল। বলে রাবুমামা চুপ করে রইলেন। গল্প বলতে বলতে রাবুমামা হঠাৎ করে চুপ করে যান। এটিই ওনার বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
ওরা উশখুশ করে। নির্জন রাত। দূরে ঝিলাই নদীর ওপর গাঢ় কুয়াশার সামিয়ানা। ওই ঝিলাই নদী চরে ওরা কাল পিকনিক করতে যাবে। ওরা আজই ঢাকা থেকে এসেছে শীতের পিঠা, খেজুরের রস, ঝিলাই নদীর চরে পিকনিক আর রাবুমামার গল্পের টানে। কত যে অদ্ভূত-অদ্ভূত সব জিন-পরির গল্প জানেন রাবুমামা। তা রাবুমামা আজও গল্প বেশ জমিয়ে তুলেছেন।
রবিন শীত একেবারেই সহ্য করতে পারে না। ওর মাথায় একটা নীল রঙের উলের মাঙ্কি টুপি। এখন অবশ্যি চাঁদের আলোয় টুপিটা কালচে দেখাচ্ছে। ও জিজ্ঞেস করে, তারপর কি হল মামা?
বলছি। আমি রাস্তার পাশে সাইকেল থামিয়ে নামতেই কড়া আতরের গন্ধ পেলাম। একজন লম্বা মতন বৃদ্ধ রাস্তায় পড়ে আছেন। ষাটের মতন বয়স। পরনে কালো রঙের শেরওয়ানি আর সাদা রঙের চুরিদার পাজামা। মাথায় রঙিন কিস্তি টুপি। বৃদ্ধের গায়ের রং ধবধবে ফরসা। বেশ সম্ভ্রান্ত চেহারা। দরবেশদের মতন লম্বা পাকা দাড়ি। পাকা জোড়া ভুরু, খাড়া নাক। চোখ দুটি আকিক পাথরের তৈরি যেন। আঙুলেও আকিক পাথরের আংটি। শীতের হাত থেকে বাঁচতে আমার পরনে সোয়েটার, গলায় মাফলার। অথচ শীতের রাতে বৃদ্ধের গায়ে কোনও শীতের পোশাক নেই দেখে খানিকটা অবাকই হলাম। বৃদ্ধকে দ্রুত পরীক্ষা করে দেখলাম। কী ফর্সা হাত আর পা। চাঁদের আলোয় নীল শিরাও চোখে পড়ল। খানদানি বংশের কেউ হবে। বৃদ্ধের শরীর অত্যন্ত হালকা বলে মনে হল। তবে তেমন গুরুতর আঘাত পাননি বলেই মনে হল। আশ্চর্য! তখন ‘ধপ’ করে ভোঁতা শব্দ হল। শব্দটা তাহলে কীসের?
আপনি ব্যথা পাননি তো চাচা? আমি জিগ্যেস করলাম।
না বাবা, আমি তেমন ব্যথা পাইন। বৃদ্ধের কন্ঠস্বর ভারি মধুর। যাকে বলে জলদ গম্ভীর।
আপনি কি দাঁড়াতে পারবেন চাচা? আমি নরম সুরে জিগ্যেস করলাম।
পারব বাবা। বৃদ্ধ বললেন। আতরের গন্ধটা ততক্ষণে আরও গাঢ় হয়ে উঠেছে। আমি বৃদ্ধকে ধরে দাঁড় করাতে- করাতে বিরক্ত হয়ে বললাম, রাতের বেলা এরা এত বেপরোয়া ভাবে ট্রাক চালায়।
বৃদ্ধ মাথা নেড়ে বললেন, থাক বাবা। আমি এখন বাড়ি যেতে পারব। তুমিও এখন বাড়ি যাও । তোমার অনেক দেরি হয়ে গেল।
আমি বললাম, না, না। আমার তেমন দেরি হয়নি। চাচা, আপনার বাড়ি কি কাছেই?
হ্যাঁ বাবা, কাছেই। এই গজারিবনের ভিতরে একটা ডালিম বাগান আছে। সেখানে।
ডালিম বাগান নামটা এর আগে আমি কখনও শুনিনি। আসলে আমি মাস দুয়েক হল রাজারহাটে এসেছি । ভালো করে এদিকটা এখনও চেনাজানা হয়নি । আমি বললাম, আপনি একা যেতে পারবেন তো চাচা?
পারব বাবা।
আমি কি আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেব?
তুমি যাবে আমার বাড়ি?
আপনি বললে নিশ্চয় যাব। কেন যাব না। এতবড় দূর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেলেন।
তোমার আবার দেরি হবে না তো বাবা?
না, না। দেরি হবে কেন। আমি রাজারহাট শহরেই থাকি। তাছাড়া আমি একজন ডাক্তার । আমার একটা দায়িত্ব আছে না?
আমার কথা শুনে বৃদ্ধের মুখচোখ কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি বললেন, তাহলে আমার সঙ্গে এসো । বলে বৃদ্ধ হাঁটতে লাগলেন। আমিও তার পাশে সাইকেলটা ঠেলতে ঠেলতে হাঁটতে লাগলাম ।
বাঁ পাশে গজারিবন। তারই ভিতর দিয়ে সরু পথ। বনটাকে কেন যে গজারিবন বলা হয়- সেটি আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। কেননা গজারিবনে গজারি গাছই কম। বরং সংখ্যায় জারুল ও অর্জুনগাছই বেশি চোখে পড়ল। সে যাই হোক। বনের মধ্যে দুধসাদা চাঁদের আলো বিছানো । পায়ের নীচে অজস্র শুকনো পাতা। পাতার ওপর মচমচ পায়ের শব্দ হয়। ঠান্ডা বাতাসে আতরের গন্ধ পেলাম। গন্ধটা এবার আরও অনেক ঘন। হঠাৎই আমার মনে হল আমাদের সঙ্গে আরও কারা যেন হাঁটছে, অথচ আমি তাদের দেখতে পাচ্চি না। মনের ভুল? আমি চারপাশে তাকালাম। কাউকে দেখতে পেলাম না। তবে শুকনো পাতার ওপর স্পষ্ট অনেক লোকের পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম।
হাঁটতে-হাঁটতে বৃদ্ধ তাঁর পরিচয় দিলেন। বৃদ্ধের নাম ইবনে ইয়াসিন। ফলের ব্যবসা করেন । ডালিম বাগান আছে বললেন; বৃদ্ধের তিন ছেলে। গুলজার, গাউস আর গাজী। আর এক মেয়ে । ছেলেরা আখরোখ, কিশমিশ আর আতরের ব্যবসা করে। সুলতানগঞ্জে (জায়গাটা রাজারহাট থেকে দশ মাইল) নাকি তাদের মোকাম আছে । মেয়েই সবচে ছোট, মেয়ের নাম জান্নাত আরা । গত বছরই নাকি জান্নাত আরার বিয়ে দিয়েছেন বৃদ্ধ। আদরের কন্যা। বাপের বাড়িতেই নাকি থাকে। জামাইয়ের নাম শেখ আন্দালিব। সেও সুলতানগঞ্জে নাশপাতি আর পেস্তার ব্যবসা করে।
ইবনে ইয়াসিনকে আমার ভারি সহজ, সরল আর অমায়িক মনে হল। আমি রাজারহাটের আশেপাশে গাঁয়ে রোগী দেখে বেড়াই। তাছাড়া আমি গাঁয়ের ছেলে। আমি জানি ইস্ট পাকিস্তানের গ্রামের মানুষ এমন সহজ, সরল আর অমায়িক হয়।
নীলু জিজ্ঞেস করে, ইস্ট পাকিস্তান মনে? ওর প্রশ্ন শুনে মনে হল ও অবাকই হয়েছে।
রাবুমামা হেসে বললেন, আরে, আমি কী আজকের কথা বলছি নাকি তোদের? বলে চাদরের নীচে হাত হাত ঢুকিয়ে পকেট থেকে কী যেন মুখে ফেলে চিবুতে লাগলেন। এলাচ মনে হল। কে বলবে ইনিই বিখ্যাত ডাক্তার ইফতেখার উদ্দীন চৌধুরি? আমাদের রাবুমামা। রাবুমামার মাথায় কালো রঙের লেদারের একটা অদ্ভূত আকারের লম্বাটে টুপি। রাবুমামা যখন জাপান গিয়েছিলেন টুপিটা তখন নিয়ে এসেছিলেন। এলাচ চিবোতে চিবোতে রাবুমামা বললেন, আমি বলছি নাইনটিন সিক্সটি ফাইভের কথা। তার মানে আজ থেকে এই ধর পয়তাল্লিশ বছর আগেকার ঘটনা। তখনও বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি বুঝলি। পাড়া গাঁ কী রকম নির্জন ছিল। কৃষিজমিতে স্যালো মেশিনেরও যান্ত্রিক শব্দও নেই। পাতার ওপর শিশির পড়ার শব্দও শোনা যেত সেসব দিনে!
মুনিয়া ছড়া/কবিতা লেখে। ও ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল, তারপর কী হল মামা?
বৃদ্ধ ইবনে ইয়াসিন গজারিবনের ভিতর দিয়ে পুরনো একটা দু-মহলা দালানের সামনে এসে দাঁড়ালো। প্রাচীন আমলের বুরুজের মতন বেঢপ সাইজের দালান। একতলা আর দোতলার বারান্দায় গ্রিল রয়েছে দেখলাম। দালানের চারপাশে বেশ ঘন গাছপালা। সামনে সিমেন্টের বড় একটি পরিস্কার মসৃন চাতাল। আশেপাশে অবশ্য ডালিম গাছ দেখলাম না। কোথায় ডালিম বাগান। বাড়ির পিছনে মনে হল।
চাতালে থই থই জ্যোস্না। আমি সাইকেল ধরে দাঁড়িয়ে আছি । আমার খিদে পেয়েছিল। এখন বিদায় নিয়ে চলে গেলেই হয়। রাজারহাট শহরে পৌঁছতে লাগবে মিনিট কুড়ি। আজ রাতে রহমত- এর মুগের ডালের খিচুড়ি আর হাঁসের মাংস রাঁধার কথা।
নীলু জিগ্যেস করে, রহমত কে মামা?
ওহ্, রহমত? রহমত ছিল আমার বাবুর্চি কাম কেয়ারটেকার। ঘরদোর ওই সামলাতো। বেশ রাঁধত ছেলেটি। তখনও বিয়েটিয়ে করিনি। অই রেঁধে-বেড়ে খাওয়াত। মুক্তিযুদ্ধের পর ছেলেটিকে আর দেখিনি রে। বড় ভালো ছেলে ছিল। বলে রাবুমামা চুপ করে রইলেন।
রবিনের তর সইছিল না। ও জিগ্যেস করে, তারপর কী হল মামা?
ওহ্, হ্যাঁ। আমি শিশুর কান্নার ট্যাঁ ট্যাঁ শব্দ শুনতে পেলাম। বৃদ্ধ হেসে বললেন, আমার ছোট মেয়ে জান্নাত আরার ছেলে । গতকালই হয়েছে। আল্লাহর রহমতে আমার নাতীর শরীরস্বাস্থ্য ভালাই আছে। বলে ইবনে ইয়াসিন ওপাশে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এই অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা তখনও বুঝিনি। আমি চারপাশে তাকালাম। তখনও আমি জানতাম না যে কুড়ি বছর পর ওই কান্নারত শিশুর সঙ্গে আমার আবার দেখা হবে। এনি ওয়ে। আমি তখনই দেখতে পেলাম ...
কি দেখতে পেলে মামা?
ডালিম বাগান। চাঁদের আলোয় পরিস্কার দেখতে পেলাম চাতালজুড়ে বিশাল একটা ডালিম বাগান । ডালিম গাছে থরে থরে ডালিম ধরে আছে। আশ্চর্য! বাগানের ঠিক মাঝখানে একটা কুয়াশা মোড়ানো দীঘির জলে ধবধবে সাদা রঙের একটি রাজহাঁস ভেসে আছে। আশ্চর্য! এত রাতে দীঘিতে রাজহাঁস কেন? হঠাৎই কুয়াশা সরে যেতেই দেখতে পেলাম ... দীঘির ওপাশে শ্বেত পাথরের একটা প্রশস্ত সিঁড়ি ধাপে ধাপে উঠে গেছে মসজিদের একটি সুপরিসর প্রাঙ্গনে। মসজিদের দেয়ালে চিনি টিকরির কাজ। সোনালি রঙের মিনার ঘিরে অজস্র কবুতর উড়ছে।
এসো বাবা। ঘরের ভিতরে গিয়ে বসি। এইখানে বড় ঠান্ডা। ইবনে ইয়াসিনের কন্ঠস্বরে স্ববিৎ ফিরে পেলাম।
আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। শরীরজুড়ে কেমন যেন মৃদু একটা শিরশিরানি বোধ করছিলাম। কোনও মতে বললাম, ইয়ে চাচা, মানে ... আমি তাহলে এখন যাই। বলে আমি আড়চোখে চাতালের দিকে তাকালাম। চাতালে কেবল কুয়াশায় আবছা চাঁদের আলো। একটু আগে দেখা ডালিম বাগান, দিঘী, রাজহাঁস ও মসজিদের দৃশ্য মিলিয়ে গেছে।তখন ভুল দেখলাম না তো?
ইবনে ইয়াসিন বললেন, আরে, যাবে কেন বাবা । এত কষ্ট করে গরিবের বাড়ি এলে । একটু শরবত খাও, পানটান খাও।
না, না। কষ্ট কীসের। তাছাড়া আমি তো পান খাই না চাচা।
পান না খেলে। এসো, একটু বস। ইবনে ইয়াসিন অত্যন্ত আন্তরিক স্বরে বললেন।
পূর্ব বাংলার গ্রামের লোকজন এরকম আন্তরিকই হয়। একটু ক্ষণ বসেই যাই, নইলে কষ্ট বৃদ্ধ পাবেন। আমার তখন তরুণ বয়েস, বুঝলি। তোদের মতনই অত হিসেব করে চলতাম না। এনি ওয়ে। ইবনে ইয়াসিন একটু পর আমাকে একতলায় একটা বড় কামরায় নিয়ে গেলেন। এক পাশে বড় একটা টেবিল। টেবিলের ওপর একটা হ্যাজাকবাতি জ্বলেছিল । কামরায় খাটপালঙ্ক নেই। মেঝেতে নীল রঙের পুরু মখমলের কার্পেট বিছানো । তার ওপর মোটাসোটা একটা জাজিম পাতা। জাজিমের ওপর একটি নরম তাকিয়া। কামরার সবুজ রঙের দেয়ালে মক্কা শরিফের ছবি। ছবির ওপরে গুলেনার।
রবিব জিগ্যেস করল, গুলেনার কি মামা?
গুলেনার হল ডালিম ফুল।
ওহ্ ।
উষ্ণ কামরায় কেমন মিষ্টি সুরভি ছড়িয়ে ছিল। আগরবাতিই মনে হল। হ্যাজাকের আলোয় দেয়ালে আমার ছায়া পড়েছে। তবে বৃদ্ধের ছায়া নেই! আমি অবাক হল না। আমি কোথায় এসেছি ততক্ষণে অবচেতন মনে টের ঠিকই পেয়ে গেছি।
বৃদ্ধ বললেন, বস, ডাক্তার । আরাম করে বস। কন্ঠস্বর অত্যন্ত আন্তরিক শোনালো।
আমি বসলাম।
আহা, জুতা খুলে পা তুলে জাজিমের ওপর আরাম করে বস। নাদিরা বিবির খানা তৈরি। নাদিরা বিবি হল জান্নাত আরার আম্মাজান। বলে ইবনে ইয়াসিন ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেলেন। বেড়িয়ে গেলেন না বলে অদৃশ্য হলেন বলাই ঠিক হবে।
আমি জুতা খুলতে- খুলতে ভাবলাম-খানা তৈরি মানে? আমি তো অবাক। এত রাতে কে রান্নাবান্না করবে? গ্রামের লোকজন তো সন্ধ্যের পরই খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ে করার কিছু থাকে না বলে। সেসব দিনে টিভিও ছিল না। জাজিমের ওপর বসলাম আরাম করে। বুঝলাম এরা আমাকে না-খাইয়ে ছাড়বে না। তখনকার দিনে মোবাইল ছিল না যে রহমত কে ফোন করে বলব ... তুই খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়। আমার ফিরতে দেরি হবে।
হঠাৎ চেয়ে দেখি ঘরের মেঝের ওপর কে যেন দাঁড়িয়ে। বেশ লম্বা একটি বালক। বারো-তেরো বছরের অপরুপ চেহারা। আশ্চর্য! ও এ ঘরে কখন ঢুকল? বালকটির শরীর ধবধবে ফরসা। পেলব। চোখে যেন ‘ক্যাটস আই’ বসানো বুঝলি। আয়ত চোখের চারধারে সোনালি রঙের কাজল। বালকের পরনে ফিরোজা রঙের শেরওয়ানি আর ঘিয়ে রঙের চুরিদার পাজামা। বালকটিকে আমার কেমন যেন লাজুক মনে হল। বালকের হাতে একটি রূপার রেকাবি। রেকাবিতে একটি বড় কাঁচের গ্লাস। বালকটি গ্লাস তুলে আমার দিকে বাড়িয়ে দেয়। গ্লাসে লাল রঙের টলটলে ঠান্ডা তরল। গ্লাস নিতে নিতে আমি ভাবলাম- এই অপরূপ ছেলেটি কে?
ইবনে ইয়াসিন বললেন, আমার মেজোছেলে গাউস। এ তার ছোট ছেলে। এর নাম ইরফান। সালাম দাও ইরফান, ডাক্তার সাহেবকে সালাম দাও।
ইরফান আমাকে সালাম দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল! আমি অবাক হলাম। তখন দীঘিতে রাজহাঁস ভাসছিল, সোনালি মিনারের মসজিদ দেখলাম। কিছুই বুঝতে পারছি না। সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
ইবনে ইয়াসিন বললেন, একটু শরবত খাও বাবা।
আমি আল্লাহর নাম নিয়ে শরবতে চুমুক দিলাম। অপূর্ব স্বাদ। কী বলব। ডালিমের শরবত। এমন টেস্টি শরবত আমি এর আগে খাইনি। পরবর্তী জীবনে কত দেশে গিয়েছি, অমন টেস্টি লিকুইড আর খাইনি। এনি ওয়ে। চেয়ে দেখি ইবনে ইয়াসিন আমার সামনে একটা কাঁচের বাটি রাখল। তাতে পানি। পানি গরম মনে হল। পানিতে গোলাপের কয়েকটি পাপড়ি ভাসছিল। তার মৃদু সুরভি ছড়িয়েছে।
পরের মুহুর্তে ইবনে ইয়াসিনের হাতে একটি বড় চিনামাটির বাটি দেখতে পেলাম। বাটিতে পোলাও। ধোঁওয়া উঠছে। বৃদ্ধের পিছনে আরও পাঁচ-ছ জন অপরুপ চেহারার লম্বা আর ফরসা বালক দাঁড়িয়ে। বালকদের সবার পরনে বেগুনি শেরওয়ানি আর ঘিরে রঙের চুরিদার পাজামা। চোখের চারপাশে সোনালি রঙের কাজল। প্রত্যেকর হাতেই একটা করে বড় প্লেট বা বাটি। একজন একটা খালি প্লেট আমার সামনে রাখল। আরেকজনের প্লেটে দুটি আস্ত মুরগির রোস্ট তো আরেক জনের বাটিতে রেজালা; খাসীর রেজালা বলে মনে হল। আরেকজনের বাটিতে মাংসের ভুনা; গরুর মাংস বলে মনে হল। একজনের প্লেটে টিকিয়া, একজনের প্লেটে সালাদ। আমি কিছু বলার আগেই বালকগুলি জাজিমের ওপর প্লেট আর বাটিগুলি রেখে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ইবনে ইয়াসিন বললেন, খাও বাবা খাও । বিসমিল্লা কর। যা পার আল্লাহ্র নামে খেতে শুরু কর। তোমার বাবা খিদে পেয়েছে।
আমার যে খিদে পেয়েছে তা বৃদ্ধ জানল কি করে। আন্দাজ করেছেন। কিন্তু আমি খাব কী-কে এসব রাঁধল? এই বাড়িতে কি কোনও অনুষ্ঠান ছিল? গতকালই ইবনে ইয়াসিনের ছোট মেয়ে জান্নাত আরা মা হয়েছে বললেন। কিন্তু বালকগুলিই- বা কে? ওরা গেলই বা কোথায়? ওরা কি বৃদ্ধের নাতি?
খাও বাবা, খাও। খাবার ঠান্ডা হয়ে যায়।
আমার আর সন্দেহ নেই যে এরা সবাই জিন। তবে খারাপ জিন বলে মনে হল না। কেমন নিজেদের পরিচয় দিচ্ছেন। ভয় দেখানোর চেস্টা করছেন না। মনে হয় না এরা আমার তেমন ক্ষতি-টতি করবে। তবে জিনেদের খাওয়া কি ঠিক হবে? না খেয়েও তো উপায় নেই। আল্লাহ ভরসা। আমি গরম পানিতে হাত ধুয়ে প্লেট টেনে নিলাম। ইবনে ইয়াসিন প্লেটের ওপর পোলাও তুলে দিয়ে আস্ত একটা মুরগির রোস্ট তুলে দিলেন। বলে রাবুমামা তাঁর স্বভাব অনুযায়ী চুপ করে রইলেন।
মুনিয়া জিগ্যেস করে, জিনদের রান্না খেলে তুমি মামা?
হ্যাঁ। খেলাম।
রান্না কেমন হয়েছিল মামা?
তোফা। আর কী বলব। অমন অপূর্ব রান্না আর আমি এত বয়েসেও খাইনি। সেদিন রাতে আমার যে কী হল- এমন খিদে পেয়েছিল আমাকে আস্ত ভেড়ার রোস্ট দিলেও খেয়ে সাবার করে ফেলতাম। মনে হয় ডালিমের শরবতটা ছিল ক্ষুধা বর্ধক অ্যাপিটাইজার। ওহ্ হ্যাঁ। শেষে মিষ্টিও খেতে দিল। আমি আবার ওই বয়েসে মিষ্টির ভীষণ পোকা ছিলাম। মিষ্টির সাইজ দেখে আমি তো থ। ইয়া বড় বড় কালোজাম। একেকটা টেনিস বলের সমান। আর স্বাদের কথা আর কী বলব। প্লেট ভরতি পোলাও, মুরগির রোস্ট, টিকিয়া, খাসীর রেজালা, গরুর মাংসের ভুনা, সালাদ সব খেয়ে শেষ করে ফেলেছি দেখে আমার ভারি তাক লেগে গিয়েছিল।
আমার খাওয়া শেষ হলে পর ইবনে ইয়াসিন জিগ্যেস করলেন, রান্না কেমন হয়েছে বাবা?
আমি সুপারি চিবুতে চিবুতে বললাম, তোফা চাচা তোফা।
ইবনে ইয়াসিন খুশি হয়ে বললেন, সবাই নাদিরা বিবির রান্নার প্রশংসা করে। আমার প্রথম ঘরের বিবি শামসি বেগম জবরদস্ত মশলাদার দুম্বার বিরিয়ানি রাঁধতে পারতেন। বলে ইবনে ইয়াসিন অদৃশ্য হলেন।
আমি আর অবাক হব কী। বরং চারধারে যা ঘটছে তা উপভোগই করছি। শামসি বেগম-এর জবরদস্ত মশলাদার দুম্বার বিরিয়ানি খেতে পারলাম না বলে আমার খানিকটা আফসোসই হচ্ছিল।
একটু পর ইবনে ইয়াসিন ফিরে এলেন। কোলে রঙিন বুটিদার কাপড়ে জড়ানো একটা পুঁটুলি। ট্যাঁ ট্যাঁ করে শব্দ হচ্ছে। বুঝলাম এক দিন বয়েসি নবজাতক নাতীকে নিয়ে এসেছেন। ইবনে ইয়াসিন বললেন, আমার মেয়ে জান্নাত আরার ইচ্ছা আপনি ওর ছেলের একটা নাম দিবেন।
আমি? আমি অবাক হয়ে বললাম। আমার কেমন ঘুম ঘুম লাগছিল। আসলে জম্পেশ খাওয়া হয়েছে তো।
হ্যাঁ। আপনি। বলে অদ্ভূত কায়দায় হাঁটু গেড়ে আমার সামনে বসে আমাকে নাতীর মুখ দেখালেন ইবনে ইয়াসিন। শিশুর মুখ দেখে আমি চমকে উঠলাম। গাঢ় নীল রঙের ছোট্ট মুখ। আশ্চর্য! শিশু বয়েসে এদের রং নীল হয়? কাঁধ অবধি সোনালি চুল। কবুতরের ডিমের সমান অক্ষিগোলক। তবে চোখের মনি কাকের ডিমের মতন নীলচে। চোখের চারপাশে সোনালি রঙের কাজল। বলে রাবুমামা চুপ করে রইলেন ।
নীলু জিগ্যেস করল, বাচ্চার নাম তুমি কী রাখলে মামা?
শাহাজাদা।
শাহাজাদা?
হ্যাঁ। শাহাজাদা।ওই নামটাই কেন যেন মনে এল।
তারপর ? রবিন জিগ্যেস করে।
তারপর আর কী। নাতীকে নিয়ে ইবনে ইয়াসিন অদৃশ্য হলেন। ততক্ষণে আমার বেশ ঘুম পাচ্ছিল। কখন যে জাজিমের ওপরই ঢলে পড়েছিলাম। সকালবেলায় ঘুম ভেঙে দেখি রাজারহাটে আমার পরিচিত ঘরের বিছানায় শুয়ে আছি। ঘরে গাওয়া ঘিয়ের গন্ধ ম ম করছে। রহমত রান্নাঘরে পরোটা ভাজছে। আমি চেঁচিয়ে রহমতকে ডাকলাম । রান্না ঘর থেকে এসে রহমত বলল, জ্বী ছার, বলেন।
এখুনি তুই নীচে গিয়ে একবার দেখ তো। আমার সাইকেলটা আছে কিনা।
একটু পর রহমত ফিরে এসে বলল, জ্বী, ছার। সাইকেল ঠিক আছে।
আমি নিশ্চিন্ত হয়ে পাশ ফিরে চোখ বুজলাম।
তারপর?
তারপর? তারপর কুড়ি বছর কেটে গেছে। রাজারহাট থেকে শ্যামগঞ্জ গিয়ে বছর কয়েক প্র্যাকটিস করলাম। তারপর এই কুসুমপুরে এলাম। জায়গা-জমি কিনলাম। এই বাড়িটা করলাম। এক তলায় চেম্বার। আল্লাহর রহমতে হাত যশ ভালোই। তো, নাইনটিন এইট্টি ফাইভের কথা। একদিন সকালবেলায় নীচতলার চেম্বারে বসে আছি। রোগীর তেমন প্রেশার ছিল না। লম্বা এক তরুণ চেম্বারে ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গে আতরের গন্ধ পেলাম। কেমন পরিচিত গন্ধ। আমার ভুরু কুঁচকে উঠল। তরুণের বয়স কুড়ি /একুশ বছর হবে। কী অপরুপ মুখ! ফরসা পেলব শরীর। চোখের চারধারে সোনালি রঙের কাজল। পরনে বেগুনি রঙের শেরওয়ানি আর ঘিয়ে রঙের চুরিদার পাজামা। হাতে কী যেন। ভালো করে চেয়ে দেখলাম মিষ্টির হাঁড়ি।
আমি বিস্ময় চেপে তরুণকে ইঙ্গিতে বসতে বললাম। তারপর প্রেসক্রিপশনের প্যাডটা টেনে স্বভাবসুলুভ ভঙ্গিতে জিগ্যেস করলাম, শুনি, কি সমস্যা?
আমার কোনও সমস্য নেই স্যার। তরুণটি বলল।
সমস্যা নেই মানে ? আমি মুখ তুলে তরুণের মুখের দিকে তাকালাম। টিউবলাইটের আলো এসে পড়েছে। কী আশ্চর্য কমনীয় মুখ। রূপটান ব্যবহার করে বলে মনে হল।
তরুণটি বলল, আমি ... আমি শাহাজাদা স্যার।
তুমি শাহজাদা মানে? আমি আকাশ থেকে পড়লাম। চেনা চেনা মুখ। চেনা চেনা আতরের গন্ধ পাচ্ছি। । তবে মনে করতে পারছি না সবটা।
আমি ইবনে ইয়াসিনের নাতি স্যার।
আমার বিস্ময় কাটছিলই না। পালটা প্রশ্ন করলাম, আমি ইবনে ইয়াসিনের নাতি মানে?
শাহাজাদা নামে তরুণটি বলল, কেন আপনার মনে নেই অনেক বছর আগে
এক রাতে ট্রাকের সঙ্গে আমার নানা ইবনে ইয়াসিনের ধাক্কা লেগেছিল।
আপনি নানার প্রাথমিক চিকিৎসা করলেন। তারপর আমাদের ডালিম বাগানের বাড়িতে গেলেন। নানীর হাতের রান্না খেলেন। তারপর আমার নাম রাখলেন। আমার মায়ের নাম জান্নাত আরা স্যার। কেন আপনার মনে নাই?
আমার মনে আছে। আমি শীতল কন্ঠে বললাম। ভিতরে ভীষণ কাঁপুনি টের পাচ্ছি। এও কি সম্ভব?
শাহজাদা বলল, কুসুমপুরে আমি ব্যবসার কাজে এসেছিলাম স্যার। আপনার মনে নাই আমার আব্বা আন্দালিব সুলতানগঞ্জে নাশপাতি আর পেস্তার ব্যবসা করতেন। আব্বার ব্যবসা এখন আমিই দেখাশোনা করছি। ভাবলাম কুসুমপুর যখন এসেছি তখন আপনার সঙ্গে একবার দেখা করেই যাই।
বেশ। তো, তোমার নানা কেমন আছে?
ভালো। নানা গতবছর একটা বিয়ে করছেন।
ওহ্!
আমি এখন যাই সার। ওরা অপেক্ষা করছে। বলে শাহজাদা অদৃশ্য হয়ে গেল।
আমি অনেক ক্ষণ চেম্বারে বসে ছিলাম। মুসলমান বলে জিন বিশ্বাস করি তাই বলে এভাবে জিন দেখব ভাবতেই পারিনি। ব্যাপারটা আমার কাছে আজও এক অস্বাভাবিক অভিজ্ঞতা মনে হয়। সে যা হোক। তারপর আমি মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে ওপরে উঠে এলাম। টেনিস বলের সমান মিষ্টির সাইজ দেখে তোর মামী তো অবাক। অবাক আমিও । তোদের মামী মৃদু সমালোচনা করে বললেন, ধ্যাত, কালোজামের সাইজ এত বড় হয়? কোন্ দেশের রুগী? আমি এড়িয়ে গেলাম।
নীলু বলল, শাহাজাদা জিন ছিল মামা?
রবিন মৃদু ধমক দিয়ে বললেন, আহ! রাবুমামা তাহলে এতক্ষণ কী বলল । শাহাজাদা জিন না হয়ে যায়ই না।
মুনিয়া বলল, মামা।
বল।
তুমি তখন বললে না যে হর্ন বাজিয়ে একটি ট্রাক চলে যায়।
হ্যাঁ।
তারপর বললে হঠাৎ দেখি রাস্তার পাশে একজন বৃদ্ধ পড়ে আছে। তাকে ট্রাক ধাক্কা দিল মনে হয়।
হ্যাঁ।
জিনদের কি ট্রাক ধাক্কা দিতে পারে মামা? ওরা না আগুনের তৈরি?
হুমম। আমিও কথাটা নিয়ে অনেক ভেবেছি। সত্যিই ওদের অনেক ক্ষমতা। আমি নিজের চোখে দেখেছি। যখন- তখন তারা অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। ওই যে বললাম, সে রাতে আমি রাজারহাটের ডালিমবাগানে যা দেখেনি তা আমি আজ অবধি গ্রহনযোগ্য ব্যাখ্যা দিতে পারিনি।
নীলু বলল, এর কুড়ি বছর পর তুমি আবার ইবনে ইয়াসিনের নাতী শাহাজাদাকে দেখলে।
হুমম।
রবিন কী বলতে যাবে-রাবুমামা ওকে থামিয়ে বললেন, চল, এখন শুয়ে পড়ি। অনেক রাত হয়েছে। আর বেশ শীতও পড়ে গেছে। কাল আবার ঝিলাই নদীর চরে পিকনিক। সকাল সকাল বেরুতে হবে ... চল ...
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে নভেম্বর, ২০১২ বিকাল ৪:৩৩