রেম্রাচাই চৌধুরি বলল, আমার ঠাকুরর্দা মাইসাং চৌধুরি তাঁর বেডরুমে খুন হয়েছিলেন। তুমি কিন্তু মাইসাং ভিলার দোতলার বেডরুমে রাতে থেকো না শোয়েব।
তথাস্তু। আমি বললাম। আমি একটা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লেখায় হাত দিয়েছি। সিদ্ধান্ত নিলাম কমলছড়ি চলে যাব। তখনও বুঝিনি যে কী ভয়ঙ্কর এক বিপদের মুখোমুখি হতে চলেছি ... বুনো শিয়ালের ডাকে আমার শরীরের রক্ত জমে যাবে ...
ঢাকা শহরে বড় হৈহল্লা। লেখাটা শেষ করার জন্য নিরিবিলি একটা জায়গা চাই। আমার বন্ধু রেম্রাচাই চৌধুরিদের কমলছড়িতে একটা ভিলা আছে শুনেছি; ওকে ফোন করলাম। ও অবশ্য এটা-ওটা বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। কমলছড়ির মাইসাং ভিলাটা নাকি ভালো না। অভিশপ্ত। ওদের পরিবারের কেউই নাকি দীর্ঘদিন ধরে কমলছড়ির মাইসাং ভিলায় যায় না। আমি ওর কথায় পাত্তাই দিলাম না। উলটো ওকে বললাম, অভিশপ্ত হলে তো ভালোই। বেশ একটা লেখার প্লট পেয়ে যাব। আমার কমলছড়ি যাওয়ার ব্যাপারে রেম্রাচাই চৌধুরি যেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হয়েছিল।
সিলভার কালারের ফিয়াট পালিওসটা চালিয়ে সিধে কমলছড়ি চলে এলাম। (রেম্রাচাই চৌধুরি ডিটেইস ঠিকানা বলে দিয়েছিল) জায়গাটা খাগড়াছড়ি সদরের বেশ খানিকটা পুব দিকে । মাঝখানে পাথর ভরতি খরস্রোতা একটি পাহাড়ি নদী; সে নদীর নাম চেঙ্গী । সে পাহাড়ি নদীর নির্জন তীর ঘেঁষে বাঁশবনে ঘেরা বেশ উঁচু একটি টিলায় পিচ রাস্তার পাকদন্ডীর পথ ঘুরে ঘুরে উঠে গেছে । দু’ পাশে দীর্ঘ ইউক্যালিপ্টাস গাছ। ফিয়াটটা নিয়ে ওপরে ওঠার সময় ইঙ্গিনের শব্দে শিশির ভেজা পাতার ওপর দিয়ে একটি খরগোশ কি দুটি কাঠবেড়ালী সুরুৎ সুরুৎ এদিক- ওদিক পালিয়ে যাচ্ছিল।
টিলার ওপরে অনেকটা হলদে সূর্যমূখীর বাগান। একপাশে পেঁপে, লিচু, সফেদা আর পাহাড়ি কলার বোঝ ছাড়াও মাল্টা, কমলা, আগর আর কফিগাছও চোখে পড়ল। টিলা থেকে ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া ঢালে আনারসের ক্ষেত। ভিলার পিছনে ঘন বাঁশঝাড় । তার ভিতর দিয়ে একটা সরু পথ। ঝোপঝাড়ে ঢাকা একটা পাকা দালানোর মতন কাঠামো চোখে পড়ল। জিনিসটা যে কী তা ঠিক বোঝা গেল না। তবে বুনো শেয়াল দেখলাম। একসঙ্গে বেশ ক’টা বন্য শৃগাল দেখে অস্বস্তিই লাগল।
আরাকানি স্টাইলের বার্মা টিকের কালো রঙের কাঠের দোতলা বাড়িটিই ‘মাইসাং ভিলা’ । এক তলায় বিশাল বারান্দা, কাঠের মেঝে, বিশাল বৈঠকখানা। আসলে ভিলাটির একতলা আর দোতলায় রুমগুলি বেশ বড়-বড়। বেশ আলোবাতাস খেলে। সবচে বড় কথা হল ভিলাটি ভারি নির্জন। লেখালেখির জন্য ভারি উপযুক্ত।
একতলার বৈঠকখানার দেয়ালে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে বুঝছে পুরনো আমলের একটি গাদা বন্দুক, একটি বুনো শিয়ালের স্টাফ-করা মাথা আর বারো ইঞ্চি একটি বার্মিজ কিরিচ। দেয়ালের অন্য পাশে একজন বৃদ্ধের রঙিন একটি তৈলচিত্র টাঙ্গানো । ইনিই সম্ভবত রেম্রাচাই চৌধুরির ঠাকুরর্দা মাইসাং চৌধুরি । কিছুটা মঙ্গেলয়েড চেহারার বেশ সৌম্যদর্শন বৃদ্ধ। পরনে শেরওয়ানি। মাথায় পাগড়ি। কোমরে তরবারি ঝুলছে। কমলছড়িতে এককালে নাকি রেম্রাচাই চৌধুরির পরিবারের বেশ প্রভাবপ্রতিপত্তি ছিল। মাইসাং চৌধুরিই পরিবারের কর্তা। আরাকানে রতœপাথরের ব্যবসা ছিল। রেম্রাচাই চৌধুরির মুখে শুনেছি ইনিই ব্রিটিশ আমলে মাইসাং ভিলাটি তৈরি করেছেন । রেম্রাচাই চৌধুরি যে ঠাকুরর্দার গল্প করত- তা কিন্তু নয়; বরং কী এক অজ্ঞাত কারণে এড়িয়েই যেত। রেম্রাচাই চৌধুরি পরিবার-পরিজন নিয়ে ঢাকাতেই থাকে। পাকিস্তান আমল থেকেই নাকি তারা কমলছড়ি আসে না। কেন আসে না -সেও এক রহস্য।
মাইসাং ভিলা দেখাশোনার জন্য একজন কেয়ারটেকার আছে । ছোটখাটো হলুদাভ গড়নের
মাঝবয়েসি স্থানীয় আদিবাসী লোকটার নামটি ভারি অদ্ভূত - য়ংদ্দ । (জানি না সঠিক বানান লিখতে পারলাম কিনা ) য়ংদ্দ সব্যসাচী ধরণের লোক; বাগানে মালির কাজও করে দেখলাম। টিলার খাড়া ঢালে আনারস ক্ষেতে উবু হয়ে বসে থাকে। ওই গড়ানো ঢালে কীভাবে যে শরীরের ভারসাম্য ধরে রাখে সেটাও একটা বিস্ময়।
আমি আবার ঘন ঘন চা খাই। টি-ব্যাগ আর গুঁড়ো দুধের কৌটো সঙ্গেই এনেছি। চিনি আনতে ভুলে গেছি। য়ংদ্দকে বাজার করার জন্য টাকা দিয়েছি; কাছেই একটা বাজারে গিয়ে বাজার-টাজার করে ফিরে আসার সময় এক কেজি চিনিও নিয়ে এল । লোকটা বাংলা বলতে পারে কিনা সে বিষয়ে আমার খানিকটা সন্দেহই ছিল। তবে বাজারের টাকা ফেরত দেবার সময় বুঝলাম য়ংদ্দ কেবল বাংলা ভালোই বোঝে না, চমৎকার বাংলা বলতেও পারে।
কার্তিক মাসের শুরু। সকাল-সন্ধ্যায় টিলার বাঁশঝাড়ে আর আনারস ক্ষেতের ওপরে হালকা কুয়াশা ছড়িয়ে থাকে। দোতলার পুব দিকের বারান্দায় বসে লিখি। গায়ে উষ্ণ রোদ এসে পড়ে। ভারি আরাম লাগে আমার। কমলছড়ি মাস দুয়েক থাকব। আশা করি ততদিনে লেখাটা শেষ করে ফেলতে পারব।
কমলছড়ি আসার পরদিন সকালেই রেম্রাচাই চৌধুরির ফোন পেলাম। ( মোবাইলে তখনও সামান্য চার্জ ছিল)
কি সোয়েব? অসুবিধে হচ্ছে না তো?
আরে না না। রাজার হালে আছি। তোমাদের এই য়ংদ্দ কিন্তু বেশ।
অস্বাভাবিক কিছু দেখলে নাকি?
না,না। এখনও দেখিনি। কপাল মন্দ হলে যা হয় আর কী!
সাবধানে থেকো কিন্তু।
আচ্ছা, থাকব।
রেম্রাচাই চৌধুরি কিছু বলার আগেই মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে যায়। যাক, সমস্যা নেই। আমি তো ওই জিনিসটা কমলছড়ি পৌঁছেই অফ করে রাখব ভেবেছিলাম।
খুব ভোরে উঠে গায়ে চাদর জড়িয়ে হাঁটতে বেরোই। টিলা থেকে কুয়াশা ছড়ানো পাকদন্ডীর পথ দিয়ে ধীরে ধীরে নেমে আসি নীচে। শব্দহীন নির্জন চেঙ্গী নদীটি ভোরবেলা ছবির মতন স্থির হয়ে থাকে । নদীর পাড়ে পাড়ে বড়-বড় পাথর। তারই একটার ওপর বসে থাকি। অনেকক্ষণ। তরুণ বয়েসে ধ্যান করতাম। সেই নির্মল অনুভূতি অনেক বছর পর আবার ফিরে পেলাম।
চেঙ্গী নদীর পাড় ঘেঁষে একটা পুরাতন বৌদ্ধবিহার। বিহারের তোরণদ্বারের ওপরে এক সিমেন্টের স্ল্যাবের ওপর বাংলায় লেখা: ‘কমলছড়ি মাঝ্যাং বিহার’। দু-একটি অক্ষর ক্ষয়ে গেছে। ঠিকমতো বোঝা যায় না। তোরণদ্বারের বাঁ পাশে বিশাল একটি কৃষ্ণচূড়া গাছ। ভিতরে অপরিসর একটি সিমেন্টের চাতাল। চাতালে অজস্র শুকনো পাতা পড়ে ছিল । উবু হয়ে চটি খুলে ভিতরে পা বাড়ালাম। ধূপ ধূপ একটা মিষ্টি গন্ধ ভাসছিল বাতাসে। বিহারের উত্তর দিকে বড় একটা কক্ষে কাঠের একটি বুদ্ধমূর্তি । প্রায় আট ফুট উঁচু। বুদ্ধমূর্তির সামনে পদ্মাসনে বসে বৃদ্ধ ভিক্ষু। ধ্যানে বসেছেন মনে হল। বৃদ্ধের পরনে লাল রঙের চীবর। মসৃনভাবে মাথা কামানো। গভীর প্রশান্তময় দৃশ্যটা আমার অত্যন্ত ভালো লাগছিল। আমি নিঃশব্দে কক্ষের ভিতরে ঢুকে বৃদ্ধের পাশে বসলাম। চোখ বুজতেই গভীর এক অনুভূতিতে ডুবে গেলাম।
কতক্ষণ যে ধ্যানের মধ্যে কাটল ...
চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি বৃদ্ধ ভিক্ষু আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। চোখে ক্ষীণ বিস্ময়ের রেখা। চওড়া কপালে ভাঁজ পড়েছে। বৃদ্ধের পাশে একটি বড় তামার পাত্র। তাতে টলটলে পানি। পানিতে কয়েকটি পদ্ম পাপড়ি। বৃদ্ধ একটি পদ্ম পাপড়ি তুলে আমার দিকে ছুড়ে দিলেন। কী ঠান্ডা আর সুগন্ধী পাপড়ি। হৃদয়ে গভীর প্রশান্তি অনুভব করলাম। আমি তখনও বুঝিনি যে ওই মন্ত্রপূতঃ পদ্ম পাপড়িটি আমাকে ভয়ঙ্কর এক বিপদ থেকে বাঁচিয়ে দেবে। বৃদ্ধ ভিক্ষু কোনও কথা বলছেন না। কোনও প্রশ্নও করছেন না। তিনি হয়তো মৌনব্রত পালন করছেন। আমি তাকে বিরক্ত না করে একটু পর বিহার থেকে বের হয়ে এলাম ।
আজও খুব ভোরে হাঁটতে বেরিয়েছি। গায়ে চাদর জড়িয়ে কুয়াশার চাদর ছিঁড়ে পাকদন্ডীর পথ বেয়ে নীচে নামছি। একটা বুনো শেয়াল ওদিকে দৌড়ে পালিয়ে গেল। মনের মধ্যে কেমন একটা ক্ষীণ অস্বস্তি হচ্ছিল আমার। রাতে একবার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। তারপর আর ঘুম হয়নি। ঘরে আবছা অন্ধকার। জানালার কাছে চাঁদের আলো। ঘরের মধ্যে কে যেন। য়ংদ্দ? না। দরজা তো বন্ধ। বাতাসে হালকা ধূপের গন্ধ। নারীমূর্তি মনে হল। চেয়ারের ওপর রাখা আমার ব্যাগের ওপর ঝুঁকে কী যেন দেখছে। হ্যালুসিনেশন? বুঝতে পারলাম না। তারপর আর কাউকে দেখতে পাইনি ... রেম্রাচাই চৌধুরির ঠাকুরর্দা নাকি তার বেডরুমে খুন হয়েছিলেন। আমি দোতলার যে ঘরে থাকি সেই ঘরটাই মাইসাং চৌধুরির বেডরুম কিনা বলতে পারব না। কই, য়ংদ্দ তো এ নিয়ে আমাকে কিছু বলল না। ওকি জানে মাইসাং ভিলাটি অভিশপ্ত? কিন্তু, রাতে আমি ঘরে কাকে দেখলাম? আমার মনের মধ্যে অস্বস্তির এই কারণ ...
বড় একটি পাথরের ওপর চেঙ্গী নদীর পাড়ে এত ভোরে একজন লোক বসে আছে দেখে আমি অবাক হলাম। কে লোকটা? মাঝবয়েসি লোকটার গায়ে ছাই- ছাই রঙের নকশাদার বার্মিজ চাদর; মাথায় কমলা রঙের উলের নেপালি টুপি। ছোটখাটো গড়নের লোকটা স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কেউ? ঠিক বোঝা গেল না। ধীরে ধীরে হেঁটে লোকটার কাছে গেলাম। বাঙালি বলেই মনে হল। বেশ কালোই মুখের রং, ভাঙ্গা চোয়ালে খোঁচা খোঁচা পাকা দাড়িগোঁফ। আমাকে দেখে দু’হাত জড়ো করে সাবলীল ভঙ্গিতে বললন, নমস্কার।
আমি মৃদু হেসে মাথা নাড়লাম।
লোকটার দীর্ঘ কালো সরু আঙুল। মধ্যমায় টকটকে লাল রঙের প্রবাল। কী কারণে মনে পড়ে গেল রেম্রাচাই চৌধুরির ঠাকুরর্দা মাইসাং চৌধুরির আরাকানে রত্নপাথরের ব্যবসা ছিল।
লোকটা বলল, আমার নাম যামিনীরঞ্জন। থাকি লংগদু। আমার পূর্বপুরুষ অবশ্য বার্মায় সেটল করেছিলেন। এখন কাঠের ব্যবসা করি। লিজ নেওয়ার জন্যেই এদিককার জঙ্গল দেখতে এসেছি। তা আপনি?
আমি আমার পরিচয় দিলাম।
যামিনীরঞ্জন বলল, বসুন না।
বড় একটি পাথরের ওপর আমি পা ঝুলিয়ে বসলাম। এই নির্জন ভোরে কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না যদিও- তবে আমি লেখালেখি করি বলেই হয়তো মধ্যমায় টকটকে লাল রঙের প্রবাল পরা লোকটা সম্বন্ধে ভারি কৌতূহল হচ্ছিল আমার।
যামিনীরঞ্জন জিজ্ঞেস করল, তা, আপনি এদিকে কোথায় এসেছেন?
আমি উঠেছি এই কাছেই। মাইসাং নামে একটি ভিলায়।
যামিনীরঞ্জন চমকে উঠল মনে হল। তারপর অদ্ভূত চোখে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। আমি লোকটাকে আশ্বস্ত করার জন্য চট জলদি বললাম, এখানকার চৌধুরি পরিবারে ছোটছেলে রেম্রাচাই চৌধুরি আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু। আমি একটা উপন্যাস লেখায় হাত দিয়েছি। শহরের হৈহল্লা আমার ভালো লাগছিল না। লেখাটা শেষ করব বলে নিরিবিলি একটা জায়গা দরকার ছিল আমার । রেম্রাচাই চৌধুরিদের কমলছড়িতে একটা ভিলা আছে জানতাম । ওর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে সিধে কমলছড়ি চলে এলাম।
কবে এসেছেন? যামিনীরঞ্জনের কন্ঠস্বর কেমন গম্ভীর শোনালো।
এসেছি গত পরশু বিকেলে। বললাম। চারিদিকে তাকালাম। দূরে চেঙ্গী নদী নদীতে একটি সাম্পান। ধূসর কুয়াশার ভিতর দৃশ্যটা কেমন অলৌকিক দেখায় । একটা সিগারেট ধরাবো কিনা ভাবলাম।
হুমম। বুঝেছি। তা আপনি মাইসাং চৌধুরি নাম শুনেছেন তো? যামিনীরঞ্জন জিগ্যেস করলেন।
হ্যাঁ, হ্যাঁ। শুনেছি। তিনি রেম্রাচাই চৌধুরির ঠাকুরর্দা।
হ্যাঁ। এই কমলছড়িতে এককালে মাইসাং চৌধুরি বিস্তর প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। আগে তার পরিবার মাটিরাঙ্গা ছিলেন । পরে কমলছড়ি চলে আসেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্মায় বাঙালি কুলি সরবরাহ করে মাইসাং চৌধুরি বিস্তর অর্থসম্পদের মালিক হন। কমলছড়িতে টিলা ইজারা নিয়ে একটি ভিলা তৈরি করেন। বলে যামিনী রঞ্জন চুপ করে রইল। একটু পর এদিক -ওদিক চেয়ে লোকটা বলল, আমি আমার বাপ-ঠাকুর্দার কাছে শুনেছি মাইসাং চৌধুরি লোকটা নাকি আধা-উন্মাদ ধরনের ছিলেন। বুনো শিয়াল পুষতেন। যে জন্য স্থানীয় লোকেরা মাইসাং চৌধুরির টিলাকে বুনো শিয়ালে টিলা বলে। মাইসাং ভিলার পিছনে বাঁশবনে ভিতরে একটি দালানে মধ্যরাতে গুপ্ত তান্ত্রিক সাধনা করতেন মাইসাং চৌধুরি । অবশ্য অতি গোপনে । এই সাধনাই তার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ায়।
কি ভাবে? আমি কৌতূহল বোধ করি। গল্পের আবহ পাচ্ছি। আমি কেবল বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীই যে লিখি তা নয়, রহস্য গল্পও লিখি।
বলছি। যামিনীরঞ্জন বলল। ধীরে ধীরে চারধারে রোদ ফুটে উঠছিল। চেঙ্গী নদীর পাড়ের গাছপালায় কাকপাখিরা ডাকছিল। নদীতে একটা সাম্পানে একজন কিশোর দাঁড়িয়ে লগি ঠেলছিল । আমার একবার মাঝ্যাং বিহারে যাবার ইচ্ছে ছিল। বুদ্ধমূর্তির সামনে লাল রঙের চীবর পরা বৃদ্ধ ভিক্ষুর ধ্যানরত গভীর প্রশান্তময় দৃশ্যটা আমাকে টানছিল।
যামিনীরঞ্জন বলল, ব্রিটিশ আমলের কথা। আমি আমার বাপঠাকুর্দার কাছে শুনেছি। আরাকানের ¤্রােহং নগর থেকে থিরিথুধম্মা নামে এক আরাকানি বৌদ্ধ তান্ত্রিক কী কারণে কমলছড়ি পালিয়ে এসেছিল। থিরিথুধম্মার সঙ্গে ছিল অমঙ্গলী নামে এক অত্যন্ত রূপবতী এক যুবতী । অমঙ্গলী ছিল থিরিথুধম্মার সাধনসঙ্গিনী। থিরিথুধম্মা তান্ত্রিক বৌদ্ধ শুনে মাইসাং চৌধুরি তাকে মাইসাং ভিলায় আশ্রয় দেন। মাইসাং চৌধুরির বয়স তখন প্রায় সত্তর। এসব কথা আমি আমার বাপঠাকুর্দার কাছে শুনেছি। সত্যমিথ্যা বলতে পারব না। বলে যামিনীরঞ্জন চুপ করে রইল।
তারপর? আমি ততক্ষণে গল্পের মধ্যে ঢুকে গেছি। কিছুটা আঁচও করতে পারছি। দীর্ঘদিন গল্প লিখলে এ ধরণের ক্ষমতা জন্মায়।
তারপর মানে ... ইয়ে আর কী ...মাইসাং চৌধুরি নাকি উদ্ভিন্ন যৌবনা অমঙ্গলীর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন । ওই বয়েসে ... মানে বুঝতেই পারছেন ... পথের কাঁটা দূর করতে মাইসাং চৌধুরি পরিকল্পনা আঁটতে থাকেন।
কথাটা শুনে আমার ভ্রুঁ কুঁচকে যায়। এটাই তাহলে গল্পের ক্লাইমেক্স? বেশ কমন প্লট।
যামিনীরঞ্জন বলল, যামিনীরঞ্জন নামে মাইসাং চৌধুরির এক পোষা গুপ্তঘাতক ছিল।
যামিনীরঞ্জন? আমি খানিকটা অবাক হয়ে বললাম।
হ্যাঁ। যামিনীরঞ্জন। বলে লোকটা মাথা নাড়ল।
আপনার ... আপনার নামও তো যামিনীরঞ্জন। বলে লোকটার আঙুলের প্রবালের দিকে তাকালাম।
যামিনীরঞ্জন হাসল। আহা, জগতে কত লোকের নামই তো যামিনীরঞ্জন। আহ্, শোনেন না তারপর কী হল। কার্তিক মাসের এক শীতের রাত। যামিনীরঞ্জন ধারালো বার্মিজ কিরিচ দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ঘুমন্ত থিরিথুধম্মার ধড় থেকে মাথা আলাদা করে ফেলে। তারপর বিভৎস মৃতদেহটা মাইসাং ভিলার পিছনে বাঁশবনে ফেলে রাখে । পাহাড়ি শেয়ালরা তার ক্ষতবিক্ষত শরীর ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়। বলতে বলতে কেমন ফুঁসে ওঠে লোকটা। মুখচোখ কেমন কুঁচকে গেছে।
আমি চমকে উঠলাম । আপনি ... আপনি এসব জানলেন কি করে?
যামিনীরঞ্জন কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল, আহা, তখন আমি বললাম কী। বললাম না আমি এসব বাপঠাকুর্দার মুখে শুনেছি। সত্যিমিথ্যা জানি না।
আমি চুপ করে থাকি। ক্লাইমেক্সটা হঠাৎ করেই বিভৎস রূপ নেয়াতে অস্বস্তি বোধ করতে থাকি।
যামিনীরঞ্জন বলল, কার্তিক মাসের সাত তারিখ রাতে যামিনীরঞ্জন থিরিথুধম্মা কে খুন করে । ওদিকে কী হল শুনুন। অমঙ্গলী থিরিথুধম্মার সাধনসঙ্গিণী ছিল বটে, তবে থিরিথুধম্মার মৃত্যুর পর অমঙ্গলী বৃদ্ধ চৌধুরির মনোরঞ্জনে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু, কী এক অজ্ঞাত কারণে থিরিথুধম্মার মৃত্যুর এক বছর পরই ওই কার্তিক মাসেরই সাত তারিখ রাতে ধারালো বার্মিজ কিরিচ দিয়ে হাতের শিরা কেটে অমঙ্গলী আত্মহত্যা করে।
ওহ্। বেশ গোছানো প্লট। আমি গল্প লিখে আনন্দ পাই, আর যামিনীরঞ্জন গল্প বলে আনন্দ পায়। এ ধরণের কল্পনাপ্রবণ মানুষ আমি এর আগেও ঢের দেখেছি।
যামিনীরঞ্জন বলে চলেছে, অমঙ্গলীর আত্মহত্যার পর মাইসাং চৌধুরি নাকি উন্মাদ হয়ে উঠেছিলেন। মাইসাং ভিলার পিছনে বাঁশবনে আনারস ক্ষেতে মূল্যবান রত্নপাথর ছড়াতেন। পাহাড়ি শিয়ালের ডাক শুনলে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে বন্দুক দিয়ে গুলি ছুঁড়তেন। অমঙ্গলীর আত্মহত্যার ঠিক এক বছর পর কার্তিক মাসের সাত তারিখ রাতে একটি ছায়ামূর্তি ঘুমন্ত মাইসাং চৌধুরি বুকে বার্মিজ কিরিচ ঢুকিয়ে খুন করে। বলে চুপ করে রইল। আমি চেঙ্গী নদীর জলের শব্দ শুনছি। দীর্ঘশ্বাস ফেলব কিনা ভাবছি।
একটু পর নিরবতা ভেঙে যামিনীরঞ্জন বলল, মাইসাং চৌধুরি, থিরিথুধম্মা আর অমঙ্গলী ... এরা তিনজন আজও কার্তিক মাসের সাত তারিখ রাতে মাইসাং ভিলায় ফিরে আসে।
কথাটা শুনে আমি চমকে উঠলাম না। কারণ এই কথাটা বিশ্বাসযোগ্য না। মৃত ব্যাক্তির ফিরে আসা ভৌতিক কাহিনীর খুবই একটা কমন প্লট। যা একুশ শতকের লেখকেরা এড়িয়েই যান। তবে ক্যামেরার কাজ ভালো হলে এ ধরনে হরর ফিলম বেশ উপভোগ্যই হয়।
যামিনীরঞ্জন উঠে দাঁড়াল। গায়ে ভালো করে চাদর জড়িয়ে বলল, আজ কার্তিক মাসের সাত তারিখ। আজ মধ্যরাতে মাইসাং চৌধুরি, থিরিথুধম্মা আর অমঙ্গলী মাইসাং ভিলায় জাগ্রত হবে। আপনি আজই এখান থেকে চলে যান। নইলে বিপদে পড়বেন । বলে লোকটা ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে লাগলেন। একটু পর কুয়াশায় মিলিয়ে গেল।
আমি পাথরের বসে থাকি। মনের মধ্যে ক্ষীণ অস্বস্তি পাক খাচ্ছে। মাঝ্যাং বিহারে যাওযার ইচ্ছে ছিল। মনটা দূষিত হয়ে যাওয়ায় আজ আর মাঝ্যাং বিহারে যাব না ঠিক করলাম। মনের মধ্যে অস্থিরতা নিয়ে মাইসাং ভিলায় ফিরে এলাম।
বাথরুম থেকে ফিরে একটা সিগারেট ধরালাম। তারপর দোতলায় বারান্দায় বসলাম। আটটার মতন বাজে। কার্তিক সকালের টলটলে রোদ। বাতাসে সূর্যমূখি ফুলের গন্ধ। য়ংদ্দ চা নিয়ে এল। তাকে কেমন গম্ভীর দেখালো। তার হলদে মুখটি কেমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল। কী যেন বলতে চায়। যামিনীরঞ্জন আজ যে গল্পটা বলল তা কি য়ংদ্দ জানে? য়ংদ্দ কদ্দিন ধরে মাইসাং ভিলা তে আছে?
সকাল বেলাটায় লিখে কাটল। মহাকাশের দূরতম এক সৌরজগতের এক গ্রহে পৃথিবীর নভোচারীরা অবতরণ করেছে। এদের মধ্যে বাঙালি নভোচারী সায়েম হকও রয়েছে । গ্রহটির একটি ডিজিটাল নাম দিয়েছি। এক্সটিএক্স-থ্রি।এই অবধি লিখেছি। কাহিনীতে এখনও ক্লাইমেক্স আনতে পারছি না। ক্লাইমেক্স ছাড়া গল্প জমবে না। লিখতে- লিখতে যামিনীরঞ্জনের গল্পটা কখন ভুলে গেছি ...
দুপুরে খেতে বসে দেখি য়ংদ্দ ছোট ছোট পাহাড়ি আলু দিয়ে বনমোরগের মাংস রেঁধেছে । ঝাল ঝাল স্বাদ । লালচে ধোঁওয়া ওঠা জুমভাতের সঙ্গে মাখিয়ে খেতে ভালোই লাগছিল। বুনো জলপাইয়ের আচার ভাতের আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল।
লেখায় বিষম ঘোর লেগেছিল। লিখে- লিখেই দুপুর আর বিকেলটা কেটে গেল। সন্ধ্যার ঠিক আগে-আগে আজকের মতো লেখা শেষ করলাম। নীচের বাগানের সূর্যমূখীর ঝাড় খুব টানছিল। ভাবছি নীচে নেমে একবার বাগানে যাব কিনা। ঠিক তখনই চা নিয়ে এল য়ংদ্দ । একটা সিগারেট ধরালাম। য়ংদ্দ কী এক বুনোপাতা মিশিয়েছে চায়ে; লেবু -লেবু স্বাদ। আশ্চর্য! দুধ চায়ে কেমন লেবু-লেবু স্বাদ! বেশ লাগছিল কিন্তু চুমুক দিতে। দুধটাও টকে যায়নি।
সন্ধ্যার পর টলটলে পূর্ণিমার আলো ছড়িয়ে পড়ল । বেশ কুয়াশা ছড়িয়েছে। আমি সাধারণত সন্ধ্যার পর লিখি না। তাছাড়া মাইসাং ভিলায় ইলেকট্রিসিটিও নেই। বারান্দায় শীত করছিল। ঘরে এসে গায়ে চাদর জড়িয়ে একটা ইজিচেয়ারে বসেছি। য়ংদ্দ কূপি জ্বালিয়ে এনে টেবিলের ওপর রাখল। সন্ধ্যার পর মশা তাড়ানোর জন্য ধূপও জ্বালায় । এদিকটায় মশার ভীষণ উৎপাত। দক্ষিণ এশিয়ায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। অবশ্য ঢাকা থেকে প্রয়োজনীয় ঔষুধপত্র সবই এনেছি।
ধূপের মালসাটি বিছানার কোণে রেখে য়ংদ্দ এসে আমার সামনে দাঁড়াল। কী যেন বলতে চায় মনে হল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কিছু বলবে?
য়ংদ্দ চুপ করে মাথা নীচু করে রইল। তারপর বলল, আপনি আজ এইখান থেইকে চইলে যান বাবু।
চলে যাব। কেন? আমি অবাক।
য়ংদ্দ ইতস্তত করে। তারপর বলল, আপনে এইখান থেইকে এখনি চইলে যান বাবু।
কী বলছ তুমি।মৃদু ধমক দিলাম লোকটাকে। আমার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল। ধমক খেয়েও লোকটা ভড়কে গেল না। বরং বলল, নাইলে বিপদে পড়িবেন।
আমি য়ংদ্দর ওপর বিরক্ত হলাম। কী কারণে চলে যাব সেটাই তো বলছে না। ও স্থানীয় কুসংস্কারগ্রস্থ মানুষ। ওর কথায় আমি যাব কেন? আমার কেমন জেদ চেপে যায়। আজ ভোরে যামিনীরঞ্জন বলল, আজ কার্তিক মাসের সাত তারিখ। আজ রাতে মাইসাং ভিলায় মাইসাং চৌধুরি, থিরিথুধম্মা আর অমঙ্গলী জাগ্রত হবে। আপনি ভিলা থেকে চলে যান। আশ্চর্য! য়ংদ্দও আমাকে চলে যেতে বলছে। ভাবলাম এদের কথায় এখন ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে ফিয়াট পালিওসটা চালিয়ে সিধে কমলছড়ি থেকে ঢাকায় চলে গেলে ব্যাপারটা হাস্যকর দেখাবে না ?
ভোরে উঠে হাঁটাহাঁটি করি বলে আমি সাধারণত রাত দশটার মধ্যেই খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ি। তার আগে বিছানায় শুয়ে লেখাটায় একবার চোখ বুলাই । মাথার কাছে টেবিলের ওপর কুপি জ্বলেছিল। ম্লান আলোয় পড়ছি। হাতে একটা বল পয়েন্ট। নতুন আইডিয়া এলে লিখে রাখি। এলোমেলো ভাবে লিখছি ..., এক্সটিএক্স-থ্রি গ্রহেরই অন্য একটি অঞ্চলে অপেক্ষাকৃত উন্নত সভ্যতার আরেকটি নভোচারীর দল অবতরণ করবে। লৌহযুগে। ওদেরও স্মৃতি থাকবে এক্সটিএক্স-থ্রিবাসীর মনে । লিখিত ভাষার আবিস্কার পর তারা স্মৃতিকথা লিখে রাখবে। পরবর্তীতে এক্সটিএক্স-থ্রি গ্রহে উন্নত সভ্যতার বিকাশ হয়। আমাদের স্মৃতিকথাই একমাত্র সত্য- এই দাবিতে এক্সটিএক্স-থ্রিবাসী দুটি দলে বিভক্ত হয়ে যাবে ... লেখাটায় টেকনিক্যাল তেমন কিছু নেই। মহাকাশের দূরতম এক সৌরজগতের একটি গ্রহে ঘটনা ঘটছে বলেই বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী। এক্সটিএক্স-থ্রি গ্রহের সভ্যতার অগ্রগতি ... সামাজিক প্রতিষ্ঠানের বিবর্তন ... বিস্ময়কর বৈজ্ঞানিক উন্নতি ... আণবিক শক্তির আবিস্কার ...স্মৃতিকথা নিয়ে বিভেদ ...
দরজার কাছে খুট করে শব্দ হল। মুখ তুলে তাকালাম। ঘরের মধ্যে তিনটে আবছা ছায়ামূর্তি আমার দিকে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলাম। এর আগে এদের কখনও দেখিনি তা সত্ত্বেও মাইসাং চৌধুরি, থিরিথুধম্মা আর অমঙ্গলী কে চিনতে পারলাম। ... আমি জানি ওরা মিথ্যে। ছায়া। মরিচিকা। যামিনীরঞ্জনের গল্প থেকে উঠে এসেছে। এই মুহূর্তে আমার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। কে যেন মাথার ভিতর থেকে বলল ... সোয়েব পালাও। ঘরে গিয়ে গাড়ির চাবি নাও। নীচে ফিয়াট পালিওসটা যাও দেরি করো না ...আমি উঠে দাঁড়ালাম। তারপর দাঁড়িয়ে থাকলাম। মাইসাং চৌধুরি থিরিথুধম্মা আর অমঙ্গলী আমার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। আমি দাঁড়িয়েই থাকলাম। ভীষণ ঘামছি। তৃষ্ণা টের পেলাম। য়ংদ্দ ! বলে আমি চিৎকার করে উঠলাম। আমার গলায় স্বর ফুটল না।
আমার ঘুম ভেঙে গেল ...
ঘরে অন্ধকার। কূপি কখন নিভে গেছে। জানালার কাছে জ্যো¯œার আলো। বাতাসে হালকা ধূপের গন্ধ। এখন ক’টা বাজে? টেবিলের ওপর হাতঘড়িটা আছে । আন্দাজে হাত বাড়ালাম। তিনটে বাজতে দশ মিনিট। লেখাটা পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। টেবিলের ওপর একটা জগ আর গ্লাস। অসম্ভব তৃষ্ণা পেয়েছে। পানি খেলাম।
আজ রাতে আর ঘুম হবে না। গায়ে চাদর ধরিয়ে একটি সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় চলে এলাম। আকাশে পূর্ণিমার ধবধবে সাদা আলোয় কুয়াশার মিশেল । বেশ শীতও করছি। ভিলার পিছনে ঘন বাঁশঝাড়ের দিক থেকে পাহাড়ি শেয়াল ডাক ভেসে এল। ডাকে শরীরের রক্ত জমে যায়। ভালো করে তাকিয়ে নীচে য়ংদ্দ কে দেখলাম। আশ্চর্য! এত রাতে য়ংদ্দ ওখানে কি করছে? য়ংদ্দর ঠিক পাশে যামিনীরঞ্জন দাঁড়িয়ে । আমি চমকে উঠলাম। লোকটা য়ংদ্দ কে কী যেন বলছিল। কিন্তু, ওখানে ... ওখানে যামিনী রঞ্জন কেন? কুয়াশায় কী যেন নড়ছিল। ভালো করে চেয়ে দেখি বুনো শেয়াল। একটি-দুটি নয- অজস্র। গুণে শেষ করা যাবে না। আমি সিগারেটে টান দিতে ভুলে গেছি। কুয়াশা ফুঁড়ে তিনটি ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এল। আমি চমকে উঠলাম। আমার হাত থেকে সিগারেট খসে পড়ল। এদের আমি এর আগে কখনও দেখিনি। তবে মাইসাং থংজা, থিরিথুধম্মা আর অমঙ্গলী কে চিনতে ভুল হল না। অমঙ্গলী মুখ তুলে ওপরে তাকালো। আমাকে দেখছে? আমি আর ওই দৃশ্য এই মুহূর্তে মায়াছায়া মিথ্যে মরিচিকা ভাবতে পারলাম না । আমি জানি এবার আমার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে না। আমি তিনটি প্রেত দেখতে পাচ্ছি। যারা অনেক অনেক দিন আগে নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি করে মরে গিয়েছিল। ঠিক তখুনি আমার মাথার ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল ... সোয়েব! পালাও। ঘরে গিয়ে গাড়ির চাবি নাও। তারপর নীচে নেমে যাও। দেরি করো না। যাও। আমি ঘরে চলে এলাম। টেবিলের ওপর গাড়ির চাবি নেই। আমার বুক ধক করে উঠল ...কাঠের সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। কারা যেন উঠে আসছে। আমার পা আটকে আছে। দরজার ওপাশে বুনো শেয়ালরা ভয়ানক গর্জন । আমার চোখে অন্ধকার ঘনিয়ে এল ....
আমার চোখেমুখে গরম লাগছিল টের পেলাম । চোখ খুলে একটা গাছ দেখতে পেলাম । ডালপালার ফাঁকে সূর্যের আলো। গাছটা কৃষ্ণচূড়া বলে মনে হল। কাকপাখিরা সব ডাকছিল। টের পেলাম মাঝ্যাং বিহারের ঠান্ডা চাতালের ওপর শুয়ে আছি। আমি এখানে এলাম কী করে? আমার পাশে লাল রঙের চীবর পরা সেই বৃদ্ধ ভিক্ষু বসে আছেন। বৃদ্ধের পাশে একটি তামার পাত্র। তাতে টলটলে পানি। পানিতে কয়েকটি পদ্ম পাপড়ি। বৃদ্ধ ভিক্ষু আমার চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে দিলেন। কী ঠান্ডা সুগন্ধী পানি। হৃদয়ে গভীর প্রশান্তি অনুভব করলাম ...