নির্জন উষালগ্ন। হরপ্পা নগরের পূর্ব দিগন্ত রাঙিয়ে সূর্য উঠছে। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের সূর্য; যে সময়ে হরপ্পা নগরের পশ্চিম বইত ইরাবতী নামে একটি নদী, সে নদীর নিস্তরঙ্গ জল এই মুহূর্তে ক্রমেই প্রভাতের সূর্যালোকে রাঙিয়ে উঠছে । গ্রীষ্ম সমাগত প্রায় । উষার সুশীতল বাতাস নগরময় ছড়িয়ে পড়েছে। সড়কের দুই পাশের দীর্ঘ ঋজু বৃক্ষের পাতারা আন্দোলিত হয় । সূর্যালোকে ক্রমেই পরিস্ফূট হয়ে উঠছে হরপ্পার সুউচ্চ নগরদূর্গ, প্রশস্ত সড়ক, সড়কের দুই পাশের ভবনসমূহ এবং অলিগলি। একটি রাত্রির নিকষ আঁধার পেরিয়ে ক্ষীণ কুয়াশার আবরণ ভেদ করে ক্রমশ উষার রক্তিম আভা ফুটে উঠছে খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের একটি নগরে।
সম্প্রতি হরপ্পা নগরের অধিবাসীদের রাত্রিগুলি অনিদ্র উৎকন্ঠায় কাটছে। দিনগুলি কাটছে ভয়ানক উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তায়। নগরবাসীকে ঘিরে ধরেছে মৃত্যুর হিমশীতল আতঙ্ক। আতঙ্কিত নগরবাসী নগরের কেন্দ্রীয় উপাসনালয়ের সামনের সড়কে সমবেত হয়েছে। ইটের তৈরি উপাসনালটি একটি চতুস্কোন উঁচু বেদির ওপর নির্মিত। উপাসনালয়ের সমুখে অপরিসর প্রাঙ্গন। তারই মধ্যিখানে দেবতা শিবের একটি কৃষ্ণবর্ণের প্রস্তরমূর্তি। সে মূর্তির সামনে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে হরপ্পা নগরের প্রধান পুরোহিত শিবা। মাঝবয়েসি পুরোহিতের গড়নটি শীর্ণ এবং খর্বকায়, গায়ের রং কৃষ্ণবর্ণ । পুরোহিত শিবার পরনে সুতির শ্বেতবস্ত্র। মুখচোখ ভাবলেশহীন। প্রধান পুরোহিত শিবাই হরপ্পা নগরের প্রধান শাসক।
কয়েকদিন আগে যখন উপাসনালয়ের প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে পুরোহিত শিবা বলেছিল, হরপ্পা নগরে যাযাবর আরিয়গণের
(আর্য) আক্রমণ আসন্ন। তারা আমাদের অসুর মনে করে, তারা অসুর নগর ধ্বংস করে দেবে। তখন সমবেত জনতার মধ্যে গুঞ্জন উঠেছিল। পুরোহিত শিবা আরও বলেছিল, আরিয়গণের আদি নিবাস পশ্চিমের এক পার্বত্য অঞ্চলে। আরিয়গণ যাযাবর, তারা বণিকদের ঘৃণা করে। তারা তাদের দেবতার নিকট প্রার্থনা করে, হে পূষন, তুমি বণিকদের ধন আমাদের এনে দাও। আরিয়গণ বর্তমানে ইরাবতী নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থান করছে । যে কোনও মুহূর্তে তারা এ নগর আক্রমন করতে পারে।
এরপর নগরময় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। হরপ্পা নগরের অধিকাংশ নাগরিকই বণিক কিংবা কারিগর। নগর প্রতিরক্ষার জন্য কখনোই সুদক্ষ সৈন্যবাহিনী গড়ে ওঠেনি। প্রতিরক্ষা বলতে কেবল নগরের পশ্চিমে সুউচ্চ দূর্গপ্রাচীর। নগরের বাইরে কৃষিক্ষেত্রের কৃষক, জেলে, মাঝি কিংবা ব্যাধ যুদ্ধবিগ্রহে অনভিজ্ঞ। সুতরাং, হরপ্পার নগরবাসী আরিয়গণের আক্রমনের আশঙ্কায় আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে রয়েছে । নগরদূর্গ ধ্বংস করে আরিয়গণ নগরে প্রবেশ করতে সক্ষম হলে যে নগরময় রক্তের নদী বইয়ে দেবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই!
উপাসনালয়ের সামনের সড়কে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল রাঢ়ঈ। হরপ্পা নগরের ব্যবসায়ী সে । এদিক ওদিক চেয়ে রাঢ়ঈ বলল, আরিয়গণ এ নগর আক্রমন করলে যে বাঁচার পথ থাকবে না ।
আমরা অত সহজে ওদের ছেড়ে দেব না। আমরা তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলব। দৃঢ়কন্ঠে পিপ্পাই বলল। পিপ্পাই শিল্পী, ব্রোঞ্জ দিয়ে নানা ধরনের মূর্তি তৈরি করে।
অহিমঅ, পেশায় যে শস্যাগারের হিসেবরক্ষক, ব্যাক্তিগত জীবনে বড় ধার্মিক, সেই অহিমঅ বলল, আমার বিশ্বাস মহামাতৃদেবীর প্রবল উত্থানে এ নগর রক্ষা পাবে।
রাঢ়ঈ বলল, এই! তোমরা চুপ কর, চুপ কর। পুরোহিত শিবা কী যেন বলছেন।
পুরোহিত শিবা উষার আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো আকাশে দৈব ইঙ্গিত খুঁজছে। হালকা ফিরোজা রঙের আকাশে সাদা মেঘপুঞ্জ ভেসে যাচ্ছে । পুরোহিত শিবা আকাশ থেকে মুখ ফিলিয়ে একবার সমবেত নাগরিকের দিকে তাকাল। তারপর বলল, আরিয়গগণের অধিপতির নাম ইন্দ্র। সে বীর যোদ্ধা, অসুরগণের প্রতি নিষ্ঠুর । আরিয়গণ ইন্দ্রকে স্বয়ং দেবতা মনে করে। ইন্দ্র কে তারা দেবরাজ বলে সম্বধোন করে । ইন্দ্রকে বধ করা সম্ভব হলেই আরিয়গণ ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে। হরপ্পা নগর রক্ষা পাবে।
সমবেত জনতার মধ্যে গুঞ্জন ওঠে।
ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল তামাটে বর্ণের একটি তরুণি । তরুণির নাম দ্রাবিড়া। পুরোহিত শিবার কথায় তার চোখ দুটি জ্বলে ওঠে। আরিয়গণের বিরুদ্ধে প্রবল ঘৃণায় তরুণির শ্যামল মুখ বিকৃত দেখায়। তরুণি দ্রাবিড়ার আদিম রক্তে কোথাও বেজে উঠেছে তালবাদ্য। আবার আদিম বন্য জীবনে ফিরে যেতে দ্রাবিড়া উদ্যত। আরিয়গণের আক্রমন থেকে দ্রাবিড়া ওর অনাগত সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়, স্বামীকে কে বাঁচিয়ে রাখতে চায় । হরপ্পা নগরে বর্বর আরিয়গণের আক্রমন করার কোনও অধিকার নেই! দ্রাবিড়া ইন্দ্রকে হত্যা করবে! দ্রাবিড়ার তামাটে শরীরে আদিম নিষাদ রক্ত ফুঁসে ওঠে।
দ্রাবিড়া যদিও হরপ্পা নগরেরই নাগরিক, তবে তার জন্ম হয়েছিল হরপ্পা নগরের বাইরে সরস্বতী নদীর পাড়ের এক গভীর বনভূমি তে। দ্রাবিড়ার পিতা শবর ছিল নিষাদ গোত্রের দক্ষ শিকারী । তার নিক্ষিপ্ত শর কখনোই লক্ষ্যভ্রষ্ট হত না। বালিকা বয়েসেই পিতার কাছেই ধনুকে তীর যোজনার দীক্ষা নিয়েছিল দ্রাবিড়া। কালক্রমে নিপুনা শিকারী হয়ে ওঠে কিশোরী দ্রাবিড়া । কাঁধে তীরধনুক নিয়ে বনপথে হরিনীর মতো দ্রুতপদে ছুটত । সে দৃশ্যের বর্ণনা দিয়ে এক নিষাদ কবি তাঁর শ্রুতিকাব্যে লিখেছে-
তামাটে বর্ণের কিশোরী দ্রাবিড়া
পরনে বৃক্ষের হরিৎ বল্কল;
চকিতা হরিণীর গতিতে ছুটত
নিবিড় বনপথে ছড়িয়ে বিদ্যুৎ।
এক দৈব ঘটনায় অরণ্যচারী কিশোরী দ্রাবিড়া হরপ্পাবাসী হয়েছিল। বৈশাখ মাসের ভোরবেলা। দ্রাবিড়ার পিতা শবর সরস্বতী নদীর পাড়ে এক দীঘলকান্তি শ্যামল তরুণ কে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখল। শবর তরুণকে উদ্ধার করে বনমধ্যে তার পর্ণকুটিরে নিয়ে আসে । পরে নিবিড় শশ্রুষায় তরুণের চেতনা ফিরে এলে তাকে কাঠের পাত্রে গরুর উষ্ণ দুধ খেতে দেয় দ্রাবিড়া; তরুণের অর্ধনগ্ন কোমল শরীরের দিকে মন্ত্রমুগ্ধ চেয়ে থাকতে থাকতে কিশোরী দ্রাবিড়ার রক্তে উঠেছিল কামনার ঝড় । জানা গেল-তরুণের নাম মঋঅ; হরপ্পা নগরের নাগরিক সে; পেশায় বণিক, গত রাত্রিতে যে ঝড় উঠেছিল- তাতেই সরস্বতী নদীতে নৌকা ডুবে গেছে। মহামাতৃদেবীর কৃপায় মঋঅ বেঁচে ফিরেছে। এখন দ্রাবিড়াকে সেও দেখে মুগ্ধ । ব্যাধ শবর এর কাছে সে তার কন্যাকে যাচ্ঞা করে। অরণ্যচারী শবর নিষাদ ছিল বলেই ছিল উদার; অসম বিবাহে সে সম্মত হয় । তরুণ বণিক মঋঅ দাবিড়াকে বিয়ে করে হরপ্পা নগরে নিয়ে যায় । এরপর দ্রাবিড়ার নগরজীবন শুরু হয় বটে তবে আরণ্যক জীবনের শিক্ষা কখনোই বিস্মৃত হয়নি দ্রাবিড়া । এরপর দ্রাবিড়ার স্বামী মঋঅ পশ্চিমদেশে বাণিজ্যে যায়। এর পরপরই আরিয়গণ হরপ্পা নগরে আক্রমনে উদ্যত হয়। দ্রাবিড়া গর্ভবতী । দ্রাবিড়ার মাতৃসুলভ কল্পনায় শিশুরা খেলা করে। দাবিড়া মনে মনে ঠিক করে রেখেছে ওর মেয়ে হলে নাম রাখবে সরস্বতী; আর ছেলে হলে? শবর। বর্বর আরিয়গণের আক্রমনে শবর ও সরস্বতীর জীবন আজ বিপর্যস্ত।
শর নিঃক্ষেপ করে আরিয়গণের দেবরাজ ইন্দ্র কে হত্যার শপথ নেয় দ্রাবিড়া।
ইরাবতী নদীর পশ্চিম তীরে প্রসারিত প্রান্তর। তারই এক প্রান্তে ইন্দ্র একটি কৃষ্ণবর্ণের বলিষ্ট অশ্বের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। কৃষ্ণবর্ণের অশ্বের লাগাম ধরে ছিল একটি উদ্ভিন্ন যৌবনা স্বর্ণকেশী তরুণি । তরুণির নাম মৈত্রায়ণী । ফরসা দীর্ঘাঙ্গি মৈত্রায়ণী ইন্দ্রের শয্যাসঙ্গীনি । পশুচর্মের পোশাক পরিহিতা মৈত্রায়ণীর উদ্ধত যৌবন টলটল করে। আরিয়দেশ (ইরান) থেকে দীর্ঘ যাত্রায় ইন্দ্রের অনুবর্তিনী ছিল মৈত্রায়ণী । ইন্দ্রের সঙ্গে অবিরত সঙ্গমের পরও ইন্দ্রের প্রতি মৈত্রায়ণীর আকর্ষন ম্লান হয়নি। মৈত্রায়ণীর তৃষ্ণা মেটে না; তবে সম্প্রতি মৈত্রায়ণীর মনের ভিতরে জমে উঠেছে আশঙ্কার মেঘ । পশুচারী যাযাবর আরিয় গোষ্ঠীতে বহুবিবাহ স্বীকৃত। সম্প্রতি ইন্দ্র এক বন্য প্রকৃতির যুবতীর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। যুবতীর নাম বধ্রিমতী । বধ্রিমতীর ওপর ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠেছে রুদ্রাণী । সম্ভবত এ এক নতুন আবেগ। যাযাবর আরিয়সমাজের ধর্মটি বহু ঈশ্বরবাদী হলেও বর্তমানে আরিয় ঋষিগণের চিন্তায় ক্রমশ এক ঈশ্বরের অস্পষ্ট কল্পনা ফুটে উঠছে; সেরকমই আরিয়সমাজে পুরুষের বহুনারীগমন সত্ত্বেও একমুখী প্রেমের উত্তরণ ঘটছে। বধ্রিমতীর ওপর মৈত্রায়ণীর ঈর্ষা তাই প্রমাণ করে ...
আরিয়গণের অধিপতি ইন্দ্রর গড়ন দীর্ঘকায় এবং বলিষ্ট, তার পরনে পশুচর্মের পোশাক; মাথায় লোহার শিরস্ত্রাণ। তারই ফাঁকে কাঁধ অবধি নেমে আসা সোনালি রঙের চুল সূর্যের আলোয় ঝলমল করে। ঈষৎ চৌকো রক্তিম মুখে চোখ দুটি ক্ষুরধার । লালচে দাড়ির নীচে দৃঢ় চোয়াল। প্রথম দর্শনে ইন্দ্রকে অন্যান্য আরিয়গণের চেয়ে স্বতন্ত্রই মনে হয়। ইন্দ্রর কাঁধে তীরধনুক, হাতে লোহার ফলাযুক্ত একটি ক্ষুরধার বজ্র (অস্ত্র) ।
ইন্দ্র ইরাবতী নদীর পশ্চিমপাড়ে নগরদূর্গের দিকে চেয়ে আছে । দূরের ওই অনার্য অসুর নগর ধ্বংস করে আরিয়দের অপরিমেয় ধনসম্পদ এনে দেবে ইন্দ্র। এর আগেও অসুর নগর ধ্বংস করেছে ইন্দ্র। আরিয়সমাজে তাঁর উপাধি ‘পুনন্দর’। অর্থাৎ, ‘নগর ধ্বংসকারী’। যখন রাত্রিকালে আরিয়গণ পবিত্র অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করে ইন্দ্রের বন্দনাগীত গায় আর সোমরস পান করে, তখন ইন্দ্রের অহং তৃপ্ত হয়। হ্যাঁ, আজ দূরের ওই অনার্য নগর ধ্বংস করে আরিয়দের অপরিমেয় ধনসম্পদ এনে দেবে ইন্দ্র!
ইরাবতী নদীর পাড়ে আজ ভোর থেকে অশ্ববলী যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হচ্ছে । যজ্ঞে অশ্ব বলি দিয়ে মৃত অশ্ব ইরাবতীর জলে নিঃক্ষেপ করা হচ্ছে। মৃত অশ্বের ওপর দিয়ে নদী পার হবে আরিয়সৈন্যগণ। নদীপাড়ে হোমাগ্নির আগুন প্রজ্জলিত করা হয়েছে। সুললিত কন্ঠে সূক্তপাঠ করছেন এক বৃদ্ধ ঋত্বিক-
‘ হে অশ্বিনৌ তোমরা আমাদের পর্যাপ্ত ধন দাও। যেমন দেয় পরস্ত্রীতে আসক্ত কামুক তার অভিলষিতাকে। হে অশ্বীরা, বেদীর ওপরে কে তোমাদের অভিমুখী হয়? বণিকদের মন ভেজাও, পূষন, ওদের ধন আমাদের এনে দাও। হে পূষন, তোমার ‘আরা’ অস্ত্র দিয়ে পণিদের হৃৎপিন্ড বিদ্ধ কর, ওদের ধন আমাদের এনে দাও। যারা আর্যব্রত (যজ্ঞ) করে না তারা মরুক। ওদের ধন আমাদের এনে দাও।’
আজই অসুরনগর আক্রমন করবে দেবরাজ? রুদ্রাণী জিজ্ঞাসা করে।
হ্যাঁ।
মৈত্রায়ণী কি বলতে যাবে - দূর থেকে ঋশ্ব এবং বধ্রিমতী কে পাশাপাশি দুটি ঘোড়ার পিঠে চড়ে এগিয়ে আসতে দেখল। ঋশ্বর কাঁধে বজ্র। বধ্রিমতীর কাঁধে তীরধনুক। ঋশ্ব আরিয়সৈন্যদলের সেনাধ্যক্ষ । সে দেবরাজ ইন্দ্রের স্নেহভাজন। বলিষ্ট দেহের অধিকারী ঋশ্ব অসুর-বধে অত্যন্ত দক্ষ। বধ্রিমতীও। সম্প্রতি বধ্রিমতী কে আরিয়সৈন্যদলের উপ-সেনাধক্ষ নিযুক্ত হয়েছে। আরিয়গণ তাদের আদিবাসস্থান পরিত্যাগ করে পূর্বদিকে অগ্রসর হচ্ছে। যাত্রাপথে আরিয়গণ ‘দাস’, ‘দস্যু’ এবং ‘অসুরগণের’ সঙ্গে সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হচ্ছে। সুতরাং আরিয়সমাজে যোদ্ধাগণ সম্মানিত। বধ্রিমতী সুদক্ষ সাহসী যোদ্ধা, সেকারণে আরিয়সমাজে জনপ্রিয়। শর নিঃক্ষেপে বধ্রিমতী আরিয়গণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। বধ্রিমতীর শর নিঃক্ষেপ অব্যর্থ । ছুটন্ত অশ্বপৃষ্ঠে আরূঢ় হয়েই বধ্রিমতী উড়ন্ত পাখি কি দূরবর্তী বৃক্ষের ফল অনায়াসে বিদ্ধ করতে পারে। মৈত্রায়ণীর কেবল রূপই সম্বল, তার গৌড়বর্ণের শরীরটি কোমল, মেদুর । বুনো প্রকৃতির বধ্রিমতী অঙ্গপ্রতঙ্গ দৃঢ়, যদিও লাবণ্যহীন। বস্তুত, রুক্ষ তাম্রবর্ণের এক অদম্য যোদ্ধা বধ্রিমতী ।
বধ্রিমতীর প্রতি ঈন্দ্রের আকৃষ্ট হওয়ার এই কি কারণ?
দ্রাবিড়া দৃঢ় পায়ে হাঁটছিল। গন্তব্য হরপ্পা নগরের পশ্চিমের দূর্গপ্রাচীর। যত শীঘ্র সম্ভব সেখানে পৌঁছতে চায় দ্রাবিড়া, আরিয়গণ ইরাবতী পার হওয়ার আগেই । দ্রাবিড়ার কাঁধে ধনুক, তূণে কালো পালকের বিশাক্ত তীর। এই মুহূর্তে দ্রাবিড়া যেন অতীতের নিষাদজীবনে ফিরে গেছে। ইট-পাথরের নগর হয়ে উঠেছে নিষাদারণ্য ...
অবরুদ্ধ হরপ্পা থমথম করছিল । সড়ক প্রায় জনশূন্য। আরিয়গণের আক্রমণের আশঙ্কায় মানুষের কর্মকোলাহল স্তিমিত হয়ে গেছে। যদিও হরপ্পা নগরের অতীত গৌরব বহুকাল হল ম্লান হয়ে গেছে। যাযাবর আরিয়গণের আক্রমনে বাণিজ্যপথ অবরুদ্ধ হওয়ায় বাণিজে অবনতি ঘটেছে। কেবল নৌপথে বাণিজ্য সচল রয়েছে । (মঋঅ নৌপথেই পশ্চিমদেশে গেছে।) বাণিজ্য ছাড়াও নিদারুণ অবনতি ঘটেছে কৃষির । হরপ্পা নগরের বাইরে জমি আর আগের মতো উর্বর নেই। জমিতে পলির বদলে বালি জমছে। সরস্বতী নদীও ধীরে ধীরে মজে যাচ্ছে। সরস্বতী নদীর পাড়ের নগরগুলি জনশূন্য বিরাণ হয়ে পড়েছে । মহামাতৃদেবী কি কুপিতা হয়েছেন? হাঁটতে হাঁটতে ভাবে দ্রাবিড়া। হরপ্পা ধনী বণিকের নগর । নগরের নাগরিক বিলাসব্যসনে মত্ত। হরপ্পা সুপরিকল্পিত নগর হলেও বর্হিশক্র আক্রমনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি।
দ্রাবিড়া যখন পশ্চিম দূর্গপ্রাচীরের কাছে পৌঁছালো তখন প্রায় পূর্বাহ্ন। চারদিকে প্রখর রৌদ্র ঝলমল করছিল। ইটের তৈরি আকাশ ছোঁয়া দূর্গপ্রাচীর। প্রাচীর ঘেঁষে প্রশস্ত সিঁড়ি উপরে উঠে গেছে । দ্রাবিড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে। টের পায় গর্ভের জলের ঘরে ভ্রুনরূপী অনাগত শিশুর আন্দোলন। সরস্বতী কিংবা শবর। শিশু দুটিকে যে করেই হোক বাঁচাতেই হবে। ইন্দ্রকে হত্যা করতেই হবে!
সিঁড়ি যেখানে শেষ সেখানে একটি ক্ষুদ্র প্রকোষ্ট রয়েছে। প্রকোষ্টটি দেয়ালহীন কেবল চারদিকে চারটি স্তম্ভ আর ছাদ । প্রকোষ্টে পা রাখতেই দ্রাবিড়ার শরীর ভয়ঙ্কর ভাবে কেঁপে ওঠে । যদি শর লক্ষভ্রষ্ট হয়? দ্রাবিড়া মহামাতৃদেবীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায়। আজ বাতাস তীব্র নয়। তীর লক্ষভ্রষ্ট হবে না।
দূর্গপ্রাচীরের প্রকোষ্টে দাঁড়িয়ে ছিল দাশ্বন। আঠারো-উনিশ বছরের শ্যামবর্ণের কিশোর। দাশ্বন পুরোহিত শিবার নিযুক্ত পর্যবেক্ষণকারী; দূর্গপ্রাচীরের প্রকোষ্টে দাঁড়িয়ে আরিয়গণ গতিবিধি লক্ষ রাখছে। পুরোহিত শিবার নিযুক্ত আরও একজন পর্যবেক্ষণকারী রয়েছে। অঋঈ। অঋঈ এখন পুরোহিত শিবার কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে গিয়েছে। অঋঈ ফিরে এলে দাশ্বন পুরোহিত শিবার কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে যাবে।
কি খবর রে দাশ্বন? বলে পশ্চিমদিকে তাকায় দ্রাবিড়া।
আরিয়গণ নদী পাড় হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দাশ্বন বলল। কন্ঠস্বর অবরুদ্ধ।
সূর্যালোকে ইরাবতী নদীর জল ঝলমল করছিল। নগরদূর্গের ঠিক নীচেই নদী। পাড়ে আছড়ে পরা জলের শব্দ শোনা যায়। নদীর পাড়ে কয়েকটি নৌকা। যাত্রীশূন্য। ওপর পাড়ে অবারিত প্রান্তরে অজস্র আরিয় নারীপুরুষ। আর ঘোড়া। আর ঘোড়ায় টানা রথ। দীর্ঘকায় গৌড়বর্ণের আরিয়গণের পরনে চামড়ার পোশাক। । নদীর পাড়ে ধোঁওয়ার কুন্ডলী। মৃত ঘোড়ার স্তূপ। দ্রাবিড়া সেই দিকে চেয়ে আছে। চোখে অবিশ্বাস।
দ্রাবিড়া কাঁধ থেকে ধনুক নামিয়ে নেয়। তূণ থেকে তীর। শিশক সাপের বিষমাখানো তীর, লহমায় মৃত্যু আনে; তীরের পুচ্ছে কৃষ্ণকায় হংসবলাকার কালো পালক।
ইন্দ্র কোথায়?
দ্রাবিড়ার চোখ বহু নীচে দূরে তার অনাগত সন্তানের হত্যাকারীকে খুঁজছে ...
ইন্দ্রের কাছে এসে ঘোড়া থেকে নামে ঋশ্ব । মাথা ঝাঁকিয়ে ইন্দ্রকে অভিবাদন জানায়। বধ্রিমতীও ঘোড়া থেকে নেমে ইন্দ্রকে অভিবাদন করে। বধ্রিমতী চোখের দিকে তীব্র চোখে তাকায় মৈত্রায়ণী, যেন বধ্রিমতীকে অগ্নিদগ্ধ করে দেবে। মৈত্রায়ণী অবশ্য জানে-বধ্রিমতী প্রতিশোধ নেবে না। মৈত্রায়ণীর পিতা ঋষি সামদেব শ্রুতিগ্রন্থ বেদের ভাষ্যকার। মৈত্রায়ণীর ক্ষতি করলে আরিয় গোষ্ঠীর যে ঘোর অমঙ্গল হবে- বধ্রিমতী তা জানে।
ঋশ্ব বলে, দেবরাজ, অশ্বাবলী যজ্ঞ সমাপ্ত প্রায় প্রায় । আরিয়গণ নদী পার হতে প্রস্তুত। তারা আপনার নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছে।
ইন্দ্র সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে। তারপর অশ্বের দিকে এগোয়, অশ্বে আরূঢ় হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে তীব্র আর্তনাদ করে ঢলে পড়ে ইন্দ্র । তার কন্ঠনালীতে একটি কালো পালকের তীর বিদ্ধ। । মৈত্রায়ণী চিৎকার করে ওঠে । তারপর ইন্দ্রের বুকে ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে উচ্চস্বরে কাঁদতে থাকে । বধ্রিমতী দূরের অসুর নগরের দিকে চকিতে ফিরে তাকায় । কাল বিলম্ব না করে হাঁটু গেড়ে বসে, তার আগেই ধনুকে তীর যোজনা করে ফেলেছে ... দূর্গপ্রাচীরের দিকে লক্ষ করে তীর ছোড়ে বধ্রিমতী । দূর্গ প্রাচীরের ওপর থেকে নীচের ইরাবতীর জলে একটি নারীদেহ পড়ে যেতে দেখে বিস্মিত হয় বধ্রিমতী ।
বৈদিক সূক্তের সূত্র:
সুকুমারী ভট্টাচার্য; প্রাচীন ভারত: সমাজ ও সাহিত্য