রাঙী মারমার টঙঘরটা বান্দরবান জেলার প্রত্যন্ত এক পাহাড়ি গ্রামে। বান্দরবান শহর থেকে যাত্রা শুরু করে থানচি উপজেলা হয়ে ওই পাহাড়ি গ্রামের দিকে যেতে হয়। শুভ্র সম্বন্ধে কঠিন সত্যটা ওই আদিবাসী কিশোরীকে জানাতে হবে। আমি আর সালেহীন এখন সেই গ্রামেই যাচ্ছি ...
আমরা যখন বান্দরবান থেকে থানচি পৌঁছলাম তখন মধ্যাহ্ন । চারদিকে শীত-দুপুরের শীত-মাখানো ঝলমলে রোদ ছড়িয়ে ছিল। চান্দের গাড়ির থেকে নামার পর সালেহীন একটা সিগারেট ধরালো। ওকে ভীষণ বিমর্ষ দেখাচ্ছে। হয়তো আমাকেও। সালেহীনের পরনে কালো রঙের পুলোভার, নীল জিন্সের প্যান্ট; পায়ে কেডস। কাঁধে ব্যাগ। আমারও তাই, তবে আমার সোয়েটারের রংটা নীল। আর আমার কাঁধের ব্যাগে শুভ্রর স্কেচবুকটা রয়েছে। শুভ্র আমাদের বন্ধু ছিল। ওর জন্যই আজ আমরা রেমাক্রিবাজারে রাঙীদের গ্রামে চলেছি । রেমাক্রিবাজার জায়গাটা থানচি ইউনিয়নের পুব দিকে, "ভূস্বর্গ" তিন্দু ছাড়িয়ে। তার পরই বিখ্যাত নাফাখুম ঝরনা। নাফাখুম ঝরনার সৌন্দর্য দেখব বলে এ পথে আমি, সালেহীন আর শুভ্র এর আগেও বেশ ক’বারই আসা-যাওয়া করেছি। আজ অবশ্য আমাদের সঙ্গে শুভ্র নেই। আজ আমরা শুভ্রকে ছাড়াই সাঙ্গু নামে এক পাথুরে নদীর বুনো রূপ দেখব।
গত রাতটা আমরা কাটিয়েছি বান্দরবানের একটা হোটেলে । তারপর সকাল ন’টায় উঠেছি চান্দের গাড়িতে। বান্দরবান থেকে থানচির দূরত্ব ৮২ কিলোমিটার। এই সড়কের সবচাইতে উঁচু পয়েন্ট হচ্ছে পিক ৬৯, এইটার উচ্চতা ২৭০০ ফুট! নীচের দিকে তাকিয়ে হার্টের রোগীর রীতিমতো ভয় খাওয়ার কথা। অনেকবারই আমি বান্দরবান-থানচি সড়কে যাওয়া-আসা করলেও আমার অ্যাক্রোফোবিয়া নেই বলে কখনোই আমার নীচের দিকে তাকিয়ে ভয় করেনি । অথচ আজ কী কারণে নীচের দিকে চোখ যেতেই আমার শরীর হিম হয়ে গেল । মাস কয়েক আগে থানচিতে ভয়াবহ এক অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে গেল -সে কারণেই সম্ভবত ...
থানচি পৌঁছোনোর আগে বলিপাড়া নামে একটি জায়গায় কিছুক্ষণের জন্য চান্দের গাড়িটা থেমেছিল। ওখানে আমরা চা-টা খেয়ে নিয়েছিলাম। একটা সিগারেট ধরিয়ে খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে থাকা একটা দীর্ঘ কৃষ্ণচূড়া গাছের গুঁড়ি পেশাব করে ভিজিয়ে দিয়েছিল সালেহীন। আমি তখন দূর পাহাড়ের ধোঁওয়ার কুন্ডলীর দিকে তাকিয়ে আমার সনি এরিকসনটা কানে ঠেকিয়ে রাফিয়া আন্টির সঙ্গে কথা বলছিলাম। ( থানচি অবধি টেলিটকের নেটওয়ার্ক অ্যাক্টিভ।) রাফিয়া আন্টি হলেন শুভ্রর মা । থানচি থেকে রেমাক্রিবাজার অবধি নৌপথ অত্যন্ত বিপদজনক। রাফিয়া আন্টি সেটা জানেন। সে কারণে বললেন, তোমাদের দুজনকে এমন একটা কাজে পাঠালাম যে এখন আমার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। আবার না-পাঠিয়েও মনে ঠিক স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। আমি বললাম, আন্টি, আমরা রাঙীদের গ্রামে ঠিকই পৌঁছে যাব দেখবেন। আপনি অহেতুক টেনশন করবেন না।
এই কথার পর নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় ওপাশের কথা শোনা গেল না। ...
থানচি পৌঁছনোর পর চান্দের গাড়ি থেকে নেমে সালেহীন একটা সিগারেট ধরালো । আজকাল ওর সিগারেট খাওয়া অনেক বেড়ে গেছে। হয়তো শুভ্রর স্মৃতি ওকে তাড়া করছে। ওর কপালে এখনও ব্যান্ডেজ বাঁধা । শরীরে ক্ষত এখনও পুরোপুরি শুকায়নি। সেই কুয়াশার ভোরে ওদের বাসটা খাদ থেকে গড়িয়ে পড়ার আগে সালেহীন কী ভাবে ঝাঁপ দিয়েছিল বলেই বেঁচে গিয়েছিল। বাসে অনেক ভিড় ছিল। শুভ্র বাসের ভিতরে ছিল। পরে ওকে আর ঠিক চেনা যায়নি ...
হাঁটতে- হাঁটতে আমরা সাঙ্গু নদীর পাড়ে চলে এলাম। পাহাড়ি এই নদীটা বরাবরই আমার ভালো লাগে। আজ রৌদ্র ঝলমল নদীটি দেখে মন ভারি খারাপ হয়ে এল। এই পাহাড়ি নদীটাকে শুভ্র বড় ভালোবাসত। চমৎকার ছবি আঁকত শুভ্র । সাঙ্গুর প্রায় শ’খানেক ছবি এঁকেছিল শুভ্র। ছবি এঁকে সাঙ্গুর প্রতি ওর গভীর ভালোবাসা প্রকাশ করেছিল। শুভ্রর এই এক অভ্যেস ছিল, যাকে ভালো লাগত তার ছবি আঁকত ...
থানচি বাজারটা সাঙ্গু নদীর ওপাড়ে । বাজার অবধি চান্দের গাড়ি যায় না। মাত্র ব্রিজ তৈরি করা হচ্ছে। সাঙ্গু পার হলাম নৌকায়। কি কনকনে শীত রে বাবা! রীতিমতো জমে যাচ্ছি। অথচ মাথার ঠিক ওপরেই জ্বলজ্বল করছে আস্ত একটা মাঝ-ডিসেম্বরের সূর্য। শুভ্র থাকলে কী হইচই-ই না করত এই সময়। পানি ছিটিয়ে আমাদের ভিজিয়ে দিত। সালেহীন কিছুটা রাশভারী গম্ভীর প্রকৃতির । ও রেগে যেত নিশ্চয়ই। দু-জনের মধ্যে খালি ঝগড়া বাঁধত এটা-ওটা নিয়ে।
থানচি বাজারটা তেমন জমকালো নয়। সরু পাকা রাস্তা। দু-দিকে মামুলি দোকানপাট। টের পেলাম খিদে পেয়েছে। এখুনি কিছু একটা খেয়ে নিতে হবে। রেমাক্রিবাজার পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা ঘনাবে। হাতের বাঁয়ে একটা ভাতের হোটেল। ঢুকলাম। হোটেল মানে বেড়ার ঘর আর কী । কাঠের পুরনো চলটা-ওঠা টেবিল-বেঞ্চ। বেড়ায় একটা সাদা কাগজে মেনু লিখে সেঁটে রেখেছে। বন্য শুকর (শূকর) -৬০ টাকা ; গুইসাপ-৪০টাকা; মুরগী (র) চাটনী- ৪০টাকা; হাঙ্গর মাছ- ৩৫ টাকা; বন্য আলু+ শুটকি (শুঁটকী?) ২০ টাকা; টকগুলা + শুটকি; ২০ টাকা...আমি মুরগীর চাটনি নিলাম। সালেহীন নিল হাঙ্গর মাছ আর মুরগীর চাটনি। শুভ্র থাকলে নির্ঘাৎ বুনো শূকর কিংবা গুঁইসাপ নিত। আমাদেরও জোর করত নিতে। শুভ্রর পাহাড়ি খাবারে বেজায় উৎসাহ। গত বছর রাঙী মারমার রান্না তেলাপোকার চচ্চড়ি, খরগোশ ভর্তা আর শামুকের জেলি খেয়ে শুভ্র তো মহা উল্লসিত হয়ে উঠেছিল ।
পাহাড়ি লালচে ভাতে বিশ্রি গন্ধ পেলাম। জুমের চাল বলেই হয়তো। আর তামাকের গন্ধও পেলাম। এসব অবশ্য আমার গা সওয়া হয়ে গেছে। সত্যি কথা বলতে কি- আমি প্রায় একরকম বাংলাদেশের আদিবাসী সংস্কৃতি ভালোবেসেই ফেলেছি। শুভ্র নামের ওই পাগলাটে বন্ধুটাই এ ভালোবাসার পথ দেখিয়েছে। আকাশের মতো উদার ছিল শুভ্রর হৃদয়। বাংলাদেশের পাহাড়ের রূপসৌন্দর্য আর আদিবাসী জনমানুষকে হৃদয়ের গভীর থেকে ভালোবাসত।
খাওয়ার পর থানচি ঘাটে এলাম। নদীর পাড়টি বেশ ঢালু। কারা যেন পাড়ে বেশ কয়েকটি নৌকা তুলে রেখেছে। ঘাটেও সার সার নৌকা। নৌকাগুলি বেশ সরু আর লম্বা । উঁচু গলুইটি দাঁড়কাকের ঠোঁটের মতো বাঁকানো। বেশির ভাগ নৌকাই ছইবিহীন। তবে ছইনৌকাও চোখে পড়ল। আর শ্যালো ইঞ্জিন চালিত নৌকাও আছে।
সময়মতো রওনা হতে পারলে আমরা সন্ধ্যার আগেই রেমাক্রিবাজার পৌঁছতে পারব। রেমাক্রিবাজারে ইউনিসেফের একটা গেস্টহাউজ আছে। পাশেই বিজিবি ক্যাম্প। নিরাপত্তার সমস্যা নেই। এর আগেও আমরা তিন্দু আর রেমাক্রিবাজারে দু-তিনবার এসেছি। তেমন সমস্যায় পড়তে হয়নি।
ঘাটে মাঝির তল্লাস করতেই রহিম মাঝি উদয় হল। মাঝবয়েসি মানুষটি বেশ লম্বা । হালকাপাতলা গড়নের। গায়ের রংটি কালো। একমুখ দাড়ি। আমরা যে রেমাক্রিবাজার যাব, সে কথা রহিম মাঝিকে বললাম। শেষ অবধি
দু-জনের ২২০০ টাকায় রফা হল। রেমাক্রিবাজার অবধি রহিম মাঝিই আমাদের গাইড। প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় যাওয়ার আগে বিজিবি-র অনুমোদন নিতে হবে। মাঝিদের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের সম্পর্ক ভালো । অনুমোদন আমাদের তরফ থেকে রহিম মাঝিই নিয়ে নেবে। একটা কাগজে আমার আর সালেহীনের নাম, ঠিকানা, বাসার ফোন নাম্বার লিখে রহিম মাঝি কে দিলাম । রহিম মাঝি ছুটল পারমিশন আনতে। এরই ফাঁকে আমরা ১০০ টাকায় এক কাঁদি কলা কিনে নৌকায় তুলে ফেললাম।
অনুমোদন নিয়ে ফিরে এসে রহিম মাঝি নৌকা ছাড়ল। আমি চারপাশে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম। নদীর দু’পাশেই সবজে রঙের অনুচ্চ পাহাড়। কোথাও পাহাড়ের ঢাল থেকে প্রশস্ত বড় পাথর বেড়িয়ে এসে নদীর পানিতে মিশে গেছে । সাঙ্গু খরস্রোতা পাথুরে নদী। রহিম মাঝি উজান বেয়ে চলেছে। তার হাতে লগি। তার সহযোগী মিজানের হাতে বৈঠা। সাঙ্গুর গভীরতা সব জায়গায় সমান না। কোথাও হাঁটু অবধি, কোথাও আবার চল্লিশ ফুটের মতো। নদীর মাঝে শ্যাওলা ধরা ছোটবড় পাথর । মাঝে মাঝে পাথরে নৌকা ঘঁষা খাচ্ছিল। শীতে পানি কম থাকায় মাঝেমাঝেই নৌকা আটকে যাচ্ছে। তখন নৌকা থেকে নেমে আমাদের নৌকা টানতে হচ্ছিল । পায়ের পিছল নীচে নুড়িপাথর। দু-পা এগুনো ভীষণ কষ্ট। আর কী কনকনে ঠান্ডা পানি রে বাবা । আমরা কেউই শুভ্রর মতো নই, আমরা মন্দ পরিস্থিতি নিয়ে আনন্দ করতে পারি না। আমাদের খালি রাজ্যির অভিযোগ! ... আমি নৌকার দড়ি টানতে টানতে শুভ্রর কথা ভাবছি আর রাঙীর কথা ভাবছি। মেয়েটি নিশ্চয়ই আমাদের দেখে ভারি অবাক হয়ে যাবে। যখন ওকে শুভ্রর স্কেচবইটা দিয়ে বলব, ‘এই নাও, দেখ শুভ্র তোমার কী সুন্দর ছবি এঁকেছে।’ শুভ্র যে রাঙীর ছবি এঁকেছিল -এই কথাটা আমি জানতাম না। কথাটা আমি রাফিয়া আন্টির কাছে শুনেছি। শুনে আমি ভীষণই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। শুভ্র অবশ্য প্রচুর ছবি তুলত। ওর একটা ১৬ মেগার ক্যানন মার্ক ফোর ক্যামেরা ছিল। ওটা দিয়েই মিনিটে-মিনিটে চারপাশের ছবি তোলা ছিল শুভ্রর অভ্যেস। কিন্তু, শুভ্র রাঙীর ছবি আঁকল কখন? আমাদের তো কিছুই বলেনি ও। ভারি আশ্চর্য ছেলে তো বাবা! ...সেই দুর্ঘটনার পর আমি শুভ্রদের কলাবাগানের বাড়িতে যাই। (সালেহীন তখনও হাসপাতালে ছিল।) শোকে স্তব্দ-হিম ঘরদোর। এরই ফাঁকে রাফিয়া আন্টি আমার কাছে এসে বসলেন। চশমা পরা ফরসা গম্ভীর মুখ। একটা কলেজে পড়ান রাফিয়া আন্টি । তিনিই আমাকে শুভ্রর আঁকা রাঙীর ছবি দেখালেন। দেখে আমি তো অবাক। আমার তখন সব মনে পড়ে যাচ্ছিল। নাফাখুম ঝরনার আসল সৌন্দর্য দেখার সময় শীত নয়, বর্ষাকাল। গত বছর বর্ষাকালে আমরা যখন রেমাক্রিবাজারে এসেছিলাম- তখন একবার ঘোর বৃষ্টির মধ্যে পড়েছিলাম। সে সময় আমরা রাঙীদের টঙঘরে আশ্রয় নিয়েছিলাম। নিপাট সরলতায় ভরা ফরসা ফুটফুটে নিষ্পাপ মুখ । রাঙী তার বুড়ো বাপের সঙ্গে মাটি থেকে বেশ উঁচুতে একটা টঙ ঘরে থাকত । রাঙীর বাপের নাম উসসুরী মারমা। চমৎকার রান্নার হাত রাঙীর। খরগোশ ভর্তা, শামুকের জেলি আর তেলাপোকার চচ্চড়ি ছাড়াও আমাদের কত কী যে রান্না করে খাইয়েছিল রাঙী। জুম চালের লালচে ভাত, মুরগীর চাটনি, চিংড়ির ঝোল,আলু দিয়ে শুটকি মাছ। আরও কত কী। আমরা শহরে ফিরে ফেসবুকে সেসব ছবি আপলোডও করেছি । উচ্ছ্বসিত মন্তব্যে পৃষ্ঠা ভরে উঠেছিল। আসলে বাংলাদেশি তরুণ প্রজন্ম আজকাল ট্রাইবাল কালচারকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। কিন্তু, রাঙীর ছবি শুভ্র আঁকল কখন? কেন আঁকল? শুভ্র যাকে ভালোবাসত, তার ছবিই আঁকত ...তাহলে?
রাফিয়া আন্টি আমাকে দোতলায় শুভ্রর ঘরে নিয়ে গেলেন। শুভ্রর স্মৃতিময় ঘরটা কেমন হিম হয়ে ছিল। দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা ওর কালো রঙের ইয়ামাহা অ্যাকুয়েস্টিক গিটার, দেয়ালে শুভ্রর বড় একটা হাস্যজ্জ্বল সাদাকালো ছবি, বাঁ পাশে বইয়ের তাক, টেবিল, তার পাশে ডিভিডির র্যাক, বিছানার ওপর একটা ১৪ ইঞ্চি ডেল এক্সপিএস, জানালার পাশে ক্যানভাস; সবই আগের মতোই আছে, কেবল কবিস্বভাবের মানুষটিই নেই।
রাফিয়া আন্টি আমাকে একটা স্কেচবুক দিয়ে বললেন, দ্যাখো তো মৃদুল, এই মেয়েটিকে তুমি চেন কিনা?
স্কেচবুক ভরা রাঙীর স্কেচ। আমি চমকে উঠলাম। হ্যাঁ, চিনি। মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম।
কে ও?
রাঙী মারমা। বান্দরবান থাকে ।
ওহ্ । ও কি শুভ্রর ব্যাপারটা জানে? মানে ...
না।
রাফিয়া আন্টি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, শুভ্রর এই স্কেচবইটা কি তুমি ওকে দিয়ে আসতে পারবে?
আমি মাথা নাড়লাম।
রাফিয়া আন্টি বললেন, আমি মনে করি এই স্কেচবইটা ওর কাছেই থাকা উচিত। রাফিয়া আন্টির কন্ঠস্বর কেমন করুণ শোনালো।
তিন্দু ছাড়িয়ে আমরা যখন রেমাক্রিবাজারে পৌঁছলাম তখনও আকাশে শেষবেলার কিছু আলোর রেশ ছিল। আমরা নৌকা থেকে নেমে এলাম। ঠিক হল কাল আবার রহিম মাঝি আমাদের থানচি নিয়ে যাবে। আজ রাতটা রহিম মাঝি আর মিজান এখানেই কোথাও কাটিয়ে দেবে ।
এর আগেই দেখেছি যে এই রেমাক্রিবাজার জায়গাটা একেবারেই ‘অজ’ না। এখানে ইউনিসেফের রেস্ট হাউজ ছাড়াও আছে বিজিবি ক্যাম্প, আছে সৌরবিদুৎ; বাজারে মিনারেল ওয়াটার, সফট ড্রিঙ্কস, চিপস-বিস্কুট-এসবও কিনতে পাওয়া যায় । ১০-১৫ টাকা দিলে মোবাইল চার্জও করা যায়। এখান থেকে নাফাখুম ঝরনা ২ ঘন্টার হাঁটাপথ।
রেমাক্রিবাজারে বেশ ভিড়। বেশির ভাগই শহুরে তরুণ-তরুণি। এদিক-ওদিক অনেক তাঁবুও পাতা হয়েছে। দূর থেকে একটা তাঁবুর সামনে শিবলীকে দেখতে পেলাম। আমাদের দেখে শিবলী হাত নাড়ল ।বুয়েটে শুভ্রর ক্লাসমেট ছিল শিবলী । ‘আহ্নিক’ নামে একটা ব্যান্ডে বেজ গিটার বাজায়। আরও অনেকেই ঢাকা থেকে এসেছে। বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গা থেকেও এসেছে। ব্লগ, ফেইসবুক আর পত্রপত্রিকায় নাফাখুম ঝরনা নিয়ে প্রচুর লেখার কারণেই হঠাৎই নাফাখুম ঝরনাটি বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। তরুণ প্রজন্ম খানিকটা ঝুঁকি নিয়েই প্রিয় মাতৃভূমির নৈসর্গিক সৌন্দর্য আবিস্কারে নেশায় ছুটে এসেছে প্রত্যন্ত এই পাহাড়ি জনপদে । তিন্দু, রেমাক্রি এবং নাফাখুনের নাম এরই মধ্যে "বাংলার ভূ-স্বর্গ" হিসেবে পরিচিতি পেয়ে গেছে।
ইউনিসেফের রেস্টহাউজটা একটা টিলার ওপর। ওটা অলরেডি বুকড। সামনের বারান্দাটিও এরই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা দল দখল করে নিয়েছে। এ দিকে দ্রুত সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। এখান থেকে রাঙীদের গ্রাম অবশ্য ঘন্টাখানেকের হাঁটা-পথ। মাঝখানে অবশ্য বেশ ক'টা টিলা পেরোতে হয়। আকাশে আজ পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে বটে, তবে ঘন কুয়াশার কারণে পাহাড়ি পথে ঝামেলা হতে পারে। আজ রাতটা বরং এখানেই কোথাও কাটিয়ে দেওয়া যাক । কাল ভোরে রওনা হলেই চলবে। শিবলীরা সঙ্গে করে তাঁবু এনেছে। ওর সঙ্গে কথা বলব কিনা ভাবছি। ঠিক তখনই সালেহীন বলল, চল, ক্য কি নু মারমার বাড়ি যাই। ভদ্রমহিলা নিশ্চয়ই আমাদের জন্য একটা ব্যবস্থা করতে পারবেন।
ওহ!। তাই চল।
ক্য কি নু মারমা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের মহিলা মেম্বার। গত বর্ষায় যখন রেমাক্রিবাজারে এসেছিলাম তখন ভদ্রমহিলার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। মধ্যবয়সিনী ক্য কি নু মারমা রাঙীদের কেমন যেন ঘনিষ্ট আত্মীয়াও হন। ভদ্রমহিলা ভারি অমায়িক। ভালো বাংলা জানেন।
আমরা পাশাপাশি কুয়াশার ভিতরে হাঁটছি। হাঁটতে-হাঁটতে কখন আমরা ক্য কি নু মারমার বাড়ির উঠানে চলে এলাম। পাশাপাশি বেশ কয়েকটা ঘর। ক্য কি নু মারমার বাড়িটি দোতলা। গত বর্ষায় এ বাড়িরই চিলেকোঠায় রাত্রিযাপন করেছিলাম। থাকার জন্য জনপ্রতি ২০০ টাকা করে দিয়েছিলাম । রেস্টহাউজে অবশ্য রেট ৫০/৬০ টাকা ।
ক্য কি নু মারমা বাড়ির ছাদে সোলার প্যানেল বসিয়েছেন দেখছি। বাড়ির পিছনে ঘন গাছপালার আভাস। চারদিকেই ঘন কুয়াশা ছড়িয়ে আছে । তারই মধ্যে মধ্য ডিসেম্বরের পরিপূর্ণ চাঁদ কিরণ ঢালছে নীচের এই নির্জন পাহাড়ি জনপদে । কেবল ঝিঁঝির ডাক সে নির্জনতাকে ভেঙে ফেলতে চাইছে। উঠানের মাঝখানে কারা যেন আগুন জ্বেলে গোল হয়ে বসে আছে। কে যেন গান গাইছে। কন্ঠস্বর বৃদ্ধের মনে হল। গানের ভাষা অচেনা ঠেকল। অনেকটা বেদেদের সাপ ধরার মন্ত্রের মতন সুর ।
ক্য কি নু মারমার বাড়ির দরজায় একটি কিশোরী মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। অবিকল রাঙীর মতন দেখতে। আমি চমকে উঠলাম। কে এ? গতবার তো দেখিনি। আমাদের দেখেই মেয়েটি বাড়ির ভিতরে চলে গেল। যেন জানত আমরা আসব।
একটু পর ক্য কি নু মারমা এলেন। হালকাপাতলা শরীর। উচ্চতা মাঝারি। ফরসা গোলপানা মুখ। আমাদের দেখেই ভদ্রমহিলা চিনতে পারলেন। হাসলেন।
ম্যাডাম, আজ রাতটা কি আপনার এখানে থাকা যাবে? সালেহীন জিগ্যেস করে।
হ্যাঁ। আসেন, ভিতরে আসেন। বলে ভদ্রমহিলা হাসলেন।
ছোট ঘর। ম্লান সৌর-আলো জ্বলে ছিল। বাতাসে ধূপের গন্ধ ভাসছিল। একপাশে একটা খাট। তারই পাশে দোতলায় যাওয়ার ছোট্ট সিঁড়ি। ঘরটা বেড়ার । বেড়ায় সাইনু প্রু মারমার একটা বড় ছবি টাঙানো। প্রখ্যাত ওই প্রমীলা ফুটবলারকে দেখেই চিনলাম । ঘরের মেঝেটি মাটির। দুটো কাঠের চেয়ার। আমরা কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে চেয়ারে বসলাম। গভীর ক্লান্তি ঘিরে ধরেছে। রাঙীর মতো দেখতে সেই কিশোরী কোথায় গেল? মেয়েটি দেখতে অবিকল রাঙীর মতো কেন? গভীর কৌতূহল আমাকে ঘিরে ধরেছে।
সালেহীন ওর মানিব্যাগ বের করে ক্য কি নু মারমা কে একটি পাঁচশ টাকার নোট দিল। ভদ্রমহিলা নোট নিয়েই ঘুরে দাঁড়ালেন। তারপর ‘ মেঘা ’ ‘মেঘা ’ বলে কাকে যেন ডাকতে ডাকতে ভিতরে চলে যান। হয়তো রান্নার আয়োজন করবেন। কে মেঘা? ওই কিশোরী নয়তো?
বেশ খিদে পেয়েছিল। কনকনে ঠান্ডা পানিতে হাত মুখ ধুয়ে সামনে খবরের কাগজ বিছিয়ে দুজন খাটের ওপর বসেছি। ক্য কি নু মারমা আমাদের প্লেটে ধোঁওয়া ওঠা গরম ভাত বেড়ে দিলেন। ছোট রাঙা আলু দিয়ে মুরগীর ঝোল রেঁধেছেন। মুখে দিয়ে দারুণ স্বাদ। ভদ্রমহিলা মুরগীর ভর্তাও করেছেন। খেতে খেতে একবার দরজার দিয়ে জ্যোস্না ছড়ানো উঠানে চোখ গেল। অগ্নিকুন্ড ঘিরে এখনও লোকজন বসে রয়েছে। বৃদ্ধার গান অবশ্য শোনা গেল না।
খাওয়ার পর ক্য কি নু মারমা বললেন, আপনাদের এক বন্ধু ছিল না? চশমা পরা, লম্বা চুলদাড়ি-সে কই, আসে নাই?
ম্যাডাম আপনি কি শুভ্রর কথা বলছেন?
ক্য কি নু মারমা মাথা নাড়লেন।
যা বলার সালেহীনই বলল। ভদ্রমহিলা অনেকক্ষণ গুম হয়ে রইলেন। যেন গভীর শোক অনুভব করছেন । ঘরের ভিতরে ঝিঁঝির ডাক তীব্র হয়ে উঠল। সেই সঙ্গে কুন্ডুলী পাকিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়ল শীত।
তারে ফেলে আইছেন দেখি অবাক হইছি। যাক। মেঘায় দোতলায় আপনাগো বিছনা কইরা দিব। এখন যান, শুইয়া পড়েন।
কাল ভোরে আমাদের ডেকে দেবেন। আমি বললাম।
আচ্ছা।
সালেহীন কী মনে করে বলল, কাল ভোরে আমরা রাঙীদের বাড়ি যাব।
ক্য কি নু মারমার ফরসা মুখটি নিমিষে কালো হয়ে উঠল। অস্ফুট কন্ঠে বললেন, রাঙী? রাঙী তো বাঁইচা নাই। মহিলার কন্ঠস্বর কেমন খসখসে শোনাল।
চমকে উঠলাম। বেঁচে নেই মানে?
রাঙী মইরা গেছে।
কিভাবে? আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। যে শহুরে তরুণ ওকে মনে মনে ভালোবেসেছিল সেই রাঙী কি তাহলে তার কাছেই চলে গেল?
ক্য কি নু মারমা বললেন, রাঙীর জ্বর হইছিল। দুই দিন ভুইগা মরল।
আমার শরীর মুহূর্তেই ভিজে যায়। ভিতরে সাংগু নদীর অজস্র পাথর গড়িয়েপড়তে থাকে।
সালেহীন মাথা নীচু করে আছে। কাঁপছে। আমি টের পাচ্ছি। ওহ্ । রাঙী তাহলে বেঁচে নেই। কথাটা রাফিয়া আন্টিকে বলা যাবে না-আন্টি ভীষণ কষ্ঠ পাবেন।
ক্য কি নু মারমা বললেন, মেঘায় হইল রাঙীর জমজ ভোন ।
গতবার দেখিনি যে।
রাঙীরা তিন ভোন। গত বর্ষায় আপনারা যখন রেমাক্রিবাজারে আইছিলেন তখন মেঘায় ওর বড় ভোনের শ্বশুরবাড়িত বেড়াইতে গেছিল। রাঙী মারা যাইবার পর ওর বাপেও মইরা যায়। আমি মেঘা রে নিয়া আসছি।
পরদিন ভোরে আমরা রেমাক্রিবাজারে ঘাটে নৌকায় উঠলাম।
সাঙ্গু নদীর পাড়ে ঘন কুয়াশার ভিতরে দাঁড়িয়ে ছিল মেঘা।
আমরা শুভ্রর স্কেচবইটা সাঙ্গুর জলে না ভাসিয়ে দিয়ে ওর হাতেই তুলে দিয়েছি।
উৎসর্গ: রাশমী
এই গল্পটা লিখতে যেসব ব্লগের সাহায্য নিয়েছি:
Click This Link
Click This Link
Click This Link
Click This Link
http://www.sachalayatan.com/amlan/36897
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জানুয়ারি, ২০১২ সকাল ১১:৩১