মৃত সাগরের পাড়ে কামরান গুহা।
The Essenes are known to be among the first groups to condemn slavery, and they are supposed to have bought slaves with the aim of freeing them. Tore Kjeilen
আজ থেকে দু-হাজার বছর আগে কামরান গুহায় এসসেনএস নামে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রধান আস্তানা ছিল । এসসেনএস সম্প্রদায়ের উদ্ভব এবং বিকাশকাল ছিল খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দ অবধি। নিভৃতচারী এই তরিকার সদস্যগণ কঠোর সংযম ব্রত পালন করতেন এবং মূলধারার ইহুদিসমাজ এড়িয়ে চলতেন।Pristine Christianity বা আদিখ্রিস্টান ধর্মের শিকড়টিও ওই কামরান গুহার সাধুগণের ভাবাদর্শের মধ্যেই নিহিত ছিল। কেননা, স্বয়ং যিশু ছিলেন কামরান গুহার একজন সাধু।
পরবর্তীতে সাধু পলের ব্যাখ্যায় যিশুর মূল স্বরূপটি অনেকটাই পালটে গিয়েছিল এবং মধ্যযুগে স্বয়ং যিশুর সত্তায় ট্রিনিটি তত্ত্ব আরোপ করা হয়েছিল। এমন কী এসসেনএস সম্প্রদায় মৃতের পনুরুত্থানে বিশ্বাস না করলেও মৃতের পুনুরুত্থানের বিষয়টি খ্রিস্টধর্মের বিশ্বাসের পর্যায়ভুক্ত হয়ে পড়ে।
উপরোক্ত কারণে আদি খৃস্টধর্মের স্বরূপ উপলব্দি করতে হলে আমাদের কামরান গুহার সাধুগণের তত্ত্বদর্শনটি উপলব্দি করা জরুরি। ফিলিস্তিন এবং সিরিয়ায় মোট চার হাজার এসসেনএস সাধু ছিলেন। সাধুদের মূল আস্তানা ছিল মৃত সাগর বা ডেড সি-র পাড়ে ওই কামরান গুহায়।
প্রাচীন ফিলিস্তিনের মানচিত্রে কামরান- এর অবস্থান। এখানেই ছিল এসসেনএস সম্প্রদায়ের প্রধান আস্তানা।
কিছু সংখ্যক ঐতিহাসিকের মতে কামরান গুহার এসসেনএস সাধুদের উদ্ভব হয়েছিল ইহুদি হাসিদিয় সম্প্রদায় থেকে। ঐশী বিধানের প্রতি প্রাচীন ফিলিস্তিনের হাসিদিয়রা প্রবল অনুরক্ত ছিল। এ কারণে তাদের মতাদর্শ ঠিক রাজনৈতিক ছিল না। Sabbath উদযাপনের খুঁটিনাটি নিয়ে তৎকালীন যুগে যে তীব্র বিরোধের সৃষ্টি হত-তাতে হাসিদিয়দের মৃত্যু অবধি ঘটত।
প্রাচীন ফিলিস্তিন
পরবর্তীকালে হাসিদিয়রা এসসেনএস তরিকায় বিলীন হয়ে যায়, যে এসসেনএসরা নিজেদের ‘মানবজাতির শেষ দিবসের অল্পসংখ্যক নির্বাচিত সদস্য’ বলে মনে করতেন । কেননা, তাদের মতবাদে পৃথিবী ধ্বংসের পূর্বাভাসমূলক বা apocalyptic ধারণাটি ছিল প্রবল। অর্থাৎ তাঁরা কেয়ামতে বিশ্বাস করতেন। তাঁরা আরও বিশ্বাস করতেন যে, ইয়াওয়ে ( হিব্রু ঈশ্বর) এবং বেলিয়াল (পৃথিবী ও অন্ধকারের শক্তি=শয়তান?) -এর মধ্যে প্রচন্ড যুদ্ধ আসন্ন। ওই যুদ্ধে এসসেনএস রা ঈশ্বরের পক্ষের সৈন্য। (এসব ধর্মীয় কল্পকাহিনীর কারণে J. R. R. Tolkien (লর্ড অভ দি রিংয়ের লেখক)- এর জন্য প্লটের অভাব হয়নি এবং হলিউডেও মুভি নির্মাণের জন্য থিমের অভাব হয় না) যাই হোক। ঈশ্বরের সৈন্য কামরান গুহার সাধুগণ সেই অত্যাসন্ন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত!
লর্ড অভ দি রিংয়ের একটি দৃশ্য।
কামরান গুহার সাধুগণ মূলত ছিলেন প্রেমবাদী। তারা ঈশ্বর, পুণ্য এবং মানুষের প্রতি তীব্র প্রেম অনুভব করতেন। তারা ধর্মীয় কারণে পশু কুরবানীর ঘোর বিরোধী ছিলেন। এ ছাড়া তাঁরা সাধু বলেই হয়তো অস্ত্র নির্মাণ করা কিংবা ব্যবসাবানিজ্যও এড়িয়ে চলতেন। ফিলিস্তিনের জনজীবনেও তাঁরা অংশ নিতেন না। অবশ্য তারা কঠোরভাবে শনিবারের কর্মবিরতি দিবস অর্থাৎ Sabbath পালন করতেন । (সপ্তাহের এই বিশেষ দিনটিতে ইহুদিগণ প্রার্থনা করে কাটান) ওই দিনটিতে কামরান গুহার সাধুগণ জেরুজালেমের প্রধান উপাসনালয় ( টেম্পল অভ জেরুজালেম) থেকে দূরে থাকতেন। কেন? নির্বোধ পুরোহিতের অধীনে ওই প্রার্থনাগৃহে প্রকৃত প্রার্থনার চেয়ে অসার ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা বেশি হত বলে? যাই হোক। এসসেনএস সাধুগণ শনিবারের দিনটিতে তোরা (ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রথম পাঁচটি অধ্যায়) পাঠ করে কাটাতেন । এ ছাড়া তারা পরিস্কার-পরিচ্ছতার ওপর জোর দিতেন; শপথ করা বা কসম কাটারও বিরোধী ছিলেন।(কারণটি অনুমান করা যায়) ... এছাড়া কামরান গুহার সম্পদের ওপর সম্প্রদায়ের সকলের সমান অধিকার ছিল। প্রত্যেক সদস্য চাহিদা অনুযায়ী যা দরকার, তা পেতেন।
এই দৃশ্যমান কঠোরতা সত্ত্বেও প্রাচীন ফিলিস্তিনের সাধুদের মন কঠোর হয়নি
কামরান গুহার এসসেনএস সাধুরা ছিলেন আত্মনির্ভরশীল। কামরান গুহায় বিশাল আকারের মনস্টারি বা মঠ ছিল না। আয়ের প্রধান উৎস ছিল চাষাবাদ এবং কুঠির শিল্প। অর্থাৎ এসসেনএস সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক কার্যক্রম ছিল তৎকালীন ফিলিস্তিনের অন্যান্য গ্রামের মতোই। কৃষিকাজ এবং কুঠির শিল্প থেকে সামান্য যা আয় হত, তারই একটি অংশ বাঁচিয়ে তাঁরা দাস কিনে তাদের মুক্ত করে দিতেন। এ প্রসঙ্গে নরওজিয় ঐতিহাসিক Tore Kjeilen লিখেছেন The Essenes are known to be among the first groups to condemn slavery, and they are supposed to have bought slaves with the aim of freeing them. ( এবং এই পোস্টটি লিখবার মূল কারণ এটি ...কল্পনা করি একজন এসসেনএস সাধু তীব্র তাপদাহের মধ্যে জমি চষছেন। একদিন রুখু মাটিতে ফসল ফলবে। তারই বিনিময়ে যে অর্থ জুটবে তার একাংশ দিয়ে মুক্ত হবে এক দাস! আমাদের মনে রাখা দরকার সময়টা রোমান শাসন। তাহলে কে শ্রেষ্ঠ? একজন এসসেনএস সাধু না রোমান শাসক? যে রোমান শাসকদের কথাই আমরা বেশি করে বলি ... আসলে মানবতাবাদের চর্চা কোনও গোষ্ঠী কিংবা জাতির একার বিষয় নয়, যুগে যুগেই মানবতাবাদের চর্চা হয়েছে। আমাদের কর্তব্য ইতিহাসের পৃষ্ঠার সে সব মানবিক অধ্যায়গুলিকে হলুদ দাগে চিহ্নিত করা, যা অত্যন্ত জরুরি। কেননা মানবতাবাদের চর্চা আজও অব্যাহত রয়েছে .. যে মুহূর্তে আমি এই পোস্টটি লিখছি, ঠিক সেই মুহূর্তেই মানবতাবাদীগণ নিরাপত্তা কর্মী এবং সরকারের পেটোয়া বাহিনীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ঢাকার শাহবাগে জড়ো হয়েছেন শিক্ষাকে সম্পূর্ণরূপে অবৈতনিক করার আন্দোলনে ...এবং এই অনিবার্য কার্যক্রমটি যে বাংলাদেশের অন্যান্য অনেক ঘটনাবলী থেকে অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ ... এটি সঠিকভাবে উপলব্দি করাই ইতিহাসের অন্যতম এক শিক্ষা ... )
কামরান- এ নিভৃতচারী মানবতাবাদী সাধুদের হেঁটে যাওয়ার পথ।
ক্ষুদ্র হলেও কামরান গুহায় এসসেনএস সম্প্রদায়টি ছিল সুসংগঠিত । গুহার আশেপাশে সেচ ও পানির সরবরাহ ছিল। অধিকাংশ সাধুগণ ছিলেন অবিবাহিত পুরুষ। যেহেতু কামরান-তরিকায় কৌমার্যব্রত পালনের রীতি ছিল। তবে সাধুদের অনেকই বিবাহ করতেন; এবং তাঁদের পরিবারপরিজনও ছিল। তবে তাদের সবাই যে কামরান গুহায় বাস করতেন তাও নয়; অনেক এসসেনএস সাধু ফিলিস্তিনের বিভিন্ন নগরে বাস করতেন।
কামরান গুহার একটি বিশাল কক্ষের ধ্বংসাবশেষ।এই কক্ষে বসেই মানবতার চর্চা হত।
এসসেনএস সম্প্রদায়ের যে কোনও নতুন সদস্যকে তার সমস্ত সম্পদ সম্প্রদায়কে অর্পন করতে হত। এর পর এক বছর তাকে থাকতে হত পরীক্ষাধীন ( অর্থাৎ এ এক বছর হল প্রোবেশনাল পিরিয়ড)। এর পরের দু বছর ছিল শিক্ষানবিশি পর্ব। এই সময় নতুন সদস্যটি পূর্ণ সদস্যের সঙ্গে বসে আহার করতে পারত না। তবে তাকে প্রচুর পড়াশোনা করতে হত। সাধকরা সাধারণত কৌতূহলী স্বভাবের হয়ে থাকেন। বইপত্রের প্রতি তাঁদের আকর্ষণ থাকে । এসসেনএসগণ কামরান গুহায় বিস্তর বইপুস্তক সংগ্রহ করেছিলেন। ওল্ড টেস্টামেন্টের (অর্থাৎ পুরনো বাইবেলের) টীকাভাষ্য লিখেছিলেন।
কামরান গুহার অবস্থান ডেড সির পশ্চিম পাড়ে। বর্তমানে যায়গাটি ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক নামে পরিচিত।
খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে রোমান শাসনযন্ত্র ফিলিস্তিনে বসবাসরত ইহুদিদের ওপর নানাবিধ নির্যাতন চালাত। এর মধ্যে অন্যতম হল অত্যধিক করারোপ । সুতরাং খ্রিস্টীয় ৬৬ সালে রোমানদের অপশাসনের বিরুদ্ধে প্রথম ইহুদি বিদ্রোহটি সংগঠিত হয় -অর্থাৎ ঘটনাটি ঘটেছিল যিশুর ক্রশবিদ্ধ হওয়ারও প্রায় তিরিশ বছর পর। এরপর ৬৮ সালে রোমান সৈন্যরা কামরান গুহায় অনুপ্রবেশ করে ধ্বংস করে। এসসেনএস সাধুদের ওপর নির্মম হত্যালীলা চালায়। সাধুসন্ন্যাসীদের ওপর সম্রাটগণের নির্যাতন তো নতুন কিছু নয়। তারপরও গভীর আত্মিক শক্তি ছিল বলেই মধ্যপ্রাচ্যে এসসেনএস সম্প্রদায়টি টিকে ছিল। মানুষ যদিও কামরান গুহার কথা পুরোপুরি বিস্তৃত হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের পর বিশ্ববাসী আবার কামরান গুহার কথা জানতে পারল।
ডেড সি ক্রল
১৯৪৭ সাল। মৃত সাগরের পাড়ে কামরন-এর ১১ টি গুহায় হিব্রু এবং আরামিয় ভাষায় লেখা কতগুলি প্রাচীন পান্ডুলিপি আবিস্কৃত হয়। পান্ডুলিপির বেশির ভাগই পার্চমেন্টে লেখা, কিছু আবার প্যাপিরাসে।পন্ডিতেরা এসব পান্ডুলিপির নাম দিয়েছেন ডেড সি ক্রল । পান্ডুলিপিগুলির মধ্যে হিব্রু বাইবেলের প্রাচীনতম সংস্করন পাওয়া যাওয়ায় ডেড সি ক্রল-এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। কেবল হিব্রু বাইবেলই নয় – তার বাইরেও সব মিলিয়ে ৯৭২টি পান্ডুলিপি আবিস্কৃত হয়েছে। যা কামরান গুহার সাধুদের সংগ্রহে ছিল। সে যাই হোক। পরিশেষে এটুকু কেবল বলা যায় যে কামরান গুহার সাধুদের ব্যাক্তিগত বিশ্বাস সম্বন্ধে আমরা দ্বিমত পোষন করতে পারি বটে তবে তাঁদের মানবতাবাদী হৃদয়টি কোনওক্রমেই উপেক্ষা করতে পারি না।
নির্জনে ধ্যানরত কামরান গুহার এক সাধু; হয়তো স্বয়ং যিশু ...
ছবি। ইন্টাররেট
তথ্যসূত্র:
Click This Link
http://www.newadvent.org/cathen/05546a.htm
http://www.essenespirit.com/
http://www.essenespirit.com/who.html
http://www.essene.com/
http://looklex.com/e.o/essenes.htm