পুরাণ (The Puranas) শব্দের অর্থ: ‘পুরনো কাহিনি’। কাহিনি বলেই পুরাণে প্রাচীন রাজরাজড়ার কাহিনি, তাদের যুদ্ধবিগ্রহ এবং দেবতা ও ঋষিদের উল্লেখ রয়েছে। ভারতবর্ষজুড়ে পুরাণগুলির জনপ্রিয়তার এও এক কারণ। পুরাণের জনপ্রিয়তার অন্য একটি প্রধান কারণ হল এই যে: বৈদিক যাগযজ্ঞে এবং ধর্মীয় বিষয়ে সাধারণ মানুষের অধিকার ছিল না। বৈদিক ধর্ম এবং সাহিত্যে কেবল ব্রাহ্মণদের অধিকার ছিল। পুরাণ সেই সাহিত্য ও ধর্মকে দ্বিজ ও দাস নির্বিশেষে ভারতবর্ষের আপমর জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল। কোনও কোনও পুরাণে আছে, ইতিহাস ও পুরাণ মূলত নারী ও শূদ্রের জন্য রচিত। কেন? যেহেতু বেদপাঠে এই দুই শ্রেণির অধিকার স্বীকৃত নয় বলে! (দেখুন, ধীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় -এর সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস পৃষ্ঠা, ৯৯)
সেই যাই হোক। ভারতবর্ষের সমাজে পুরাণের গুরুত্ব অপরিসীম। বৃহদারণ্যক উপনিষদে (২/৪/১০) ইতিহাস ও পুরাণকে চার বেদের তুল্য মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এ জন্য পুরাণ কে বলা হয় "পঞ্চম বেদ।" এ প্রসঙ্গে ফয়েজুন্নেছা বেগম লিখেছেন, ‘ বৈদিক সাহিত্য ধর্মকে কেন্দ্র করিয়া গড়িয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু একটি জাতির পূর্ণাঙ্গ পরিচয় শুধু তাহার ধর্মের মধ্যেই মিলে না। একটি জাতি প্রতিষ্ঠালাভের জন্য কি কি করিয়াছে, কি করিয়া বহিঃশক্রর আক্রমন রোধ করিয়াছে, অর্থনৈতিক উন্নতি বিধানের জন্য কিভাবে সংগ্রাম করিয়াছে, নানা সভ্যতা ও সংস্কৃতির ঘাত-সংঘাতে কি করিয়া একটি নব্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির অভ্যুত্থান হইয়াছে-এই সমস্ত জানা না থাকিলে একটি জাতির ইতিহাস জানা যায় না। সেই দিক হইতে বিচার করিলে পুরাণ সাহিত্য প্রাচীন ভারতবর্ষের একটি জীবন্ত ইতিহাস। (সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস; পৃষ্ঠা, ২৮)
পুরাণের সংখ্যা সর্বমোট ১৮টি। যেমন: ব্রহ্মপুরাণ, পদ্মপুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ, বায়ুপুরাণ, ভাগবত পুরাণ, নারদীয় পুরাণ, মার্কন্ডেয় পুরাণ, অগ্নিপুরাণ, ভবিষ্যপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, লিঙ্গ পুরাণ, বরাহপুরাণ, স্কন্ধপুরাণ, বামনপুরাণ, কূর্মপুরাণ, গরুড়পুরাণ, মৎসপুরাণ এবং ব্রহ্মান্ড পুরাণ। এই আঠারোটি পুরাণকে বলা হয় মহাপুরাণ। মহাপুরাণ ছাড়াও অবশ্য আরও ১৮টি উপপুরাণ রয়েছে। যেমন: আদি, নৃসিংহ, বায়ু, শিবধর্ম, দুর্বাসঃ, নারদ, নন্দীকেশ্বর, উশনঃ, কপিল, বরুণ, শাম্ব, কালিকা,মহেশ্বর, পদ্মা, দেব, পরাশর, মরীচি এবং ভাস্বর।
কিন্তু কীভাবে উদ্ভব হল পুরাণের?
বৈদিক ব্রাহ্মণগণ বলেন: বেদ ব্রহ্মার মুখ নিঃসৃত বাণী। বেদ-এর সঙ্গে ব্রহ্মার মুখ থেকে পুরাণও নিঃসৃত হয়েছিল। ব্রহ্মার মুখ নিঃসৃত বাণী অষ্টাদশ পুরাণে সঙ্কলন করেছেন মহাত্মা ব্যাসদেব । উল্লেখ্য যে এই ব্যাসদেবই মহাভারতের রচয়িতা। এবং এই মহাত্মার পূর্ণ নাম কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস।
এবার পুরাণের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে আলোচনা করা যাক। পুরাণের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে একজন ইউরোপীয় পন্ডিত লিখেছেন: Puranas usually give prominence to a particular deity, employing an abundance of religious and philosophical concepts. They are usually written in the form of stories related by one person to another. The Puranas are available in vernacular translations and are disseminated by Brahmin scholars, who read from them and tell their stories, usually in Katha sessions (in which a traveling Brahmin settles for a few weeks in a temple and narrates parts of a Purana, usually with a Bhakti perspective).পুরাণ সম্বন্ধে এটি ইউরোপীয় perspective. এই বিষয়ে ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গিটি কীরকম দেখা যাক। পুরাণের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে বিষ্ণুপুরাণের একটি উল্লেখযোগ্য শ্লোক রয়েছে। সেটি হল:
র্সগশ্চ প্রতির্সগশ্চ বংশো মন্বস্তরাণি চ।/
বংশানুচরতিং চৈব পুরাণং পঞ্চলক্ষনম্ ।
এর অর্থ হল: সৃষ্টি, প্রলয়ের পর নতুন সৃষ্টি, ঋষি ও দেবতাগণের বংশবর্ণনা, মনুগণের শাসনকাল, এবং রাজগণের বংশের বর্ণনা-এই পাঁচটি বিষয় নিয়ে পুরাণ রচিত।
পুরাণ রচিত হয়েছিল পৌরাণিক কালে।
পৌরাণিক কাল হল ভারতবর্ষের ইতিহাসে বৌদ্ধ পরবর্র্তী সময়। ৩০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ৬০০ খ্রিষ্টাব্দ অবধি এই সময়কালের বিস্তার। এই সময়টিকে আর্যভারত ও হিন্দুভারতের মধ্যবর্তী কাল হিসেবে গণ্য করা হয়। এই সময়কালেই বর্তমান হিন্দুধর্মের ভিতটি রচিত হয়েছিল। যদিও পুরাণে প্রাক-বৌদ্ধ শৈবধর্ম (শৈবদের উপাস্য হলেন শিব ) বৈদিক আর্যধর্ম, জৈন ধর্ম বৌদ্ধ ধর্ম এবং লোকায়ত বিশ্বাসের সমন্বয় সাধন করা হয়েছিল। এ কারণেই উইকিপিডিয়ায় পুরাণের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে বলা হয়েছে:The Puranas are a genre of important Hindu, Jain and Buddhist religious texts, notably consisting of narratives of the history of the universe from creation to destruction, genealogies of kings, heroes, sages, and demigods, and descriptions of Hindu cosmology, philosophy, and geography.
ওই পৌরাণিক কালেই ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুণরুত্থান ঘটেছিল।
তবে সেটি কিন্তু খুব সহজে হয়নি। কেননা, এ সময়ে প্রাক-বৈদিক শিব বুদ্ধের স্থলাভিষিক্ত হন। বিষ্ণুর উপসনার পাশাপাশি শিবের উপাসনাও প্রচলিত ছিল। (দেখুন: ড. আর এম দেবনাথ; সিন্ধু থেকে হিন্দু পৃষ্ঠা;১৬৭) এভাবে বৈদিক ধর্ম এবং অবৈদিক লৌকিক ধর্ম বিশ্বাসের সংমিশ্রণ হিন্দুধর্মে ঘটেছিল। ঐতিহাসিক আর. সি মজুমদার এ কারণেই হিন্দুধর্মকে বিচিত্র বর্ণের মর্মরপ্রস্তর কাচের টুকরো দিয়ে তৈরি আস্তরণের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এই ধর্মে প্রাচীন এবং নবীন, উচ্চ এবং নীচ ধর্মবিশ্বাসের সংমিশ্রণ ঘটেছিল। এই ধর্ম কোনওকিছুকেই বর্জন করেনি, বরং সামাজিক পরিবর্তন থেকে উদ্ভূত নিত্যনতৃন উপাদান চিরকাল গ্রহন করেছে।’ (দেখুন, সুনীল চট্টোপাধ্যায়; প্রাচীন ভারতের ইতিহাস (দ্বিতীয় খন্ড) পৃষ্ঠা; ১৭৩)
যা হোক। হিন্দুধর্মের অন্যতম ভিত্তিই হল পুরাণ।
এবার অষ্টাদশ মহাপুরাণ সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল:
ব্রহ্মপুরাণ: পুরাণটি মূলত দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথমভাগে সূর্য ও চন্দ্র বংশের বিবরণ, পার্বতীর বিবাহ, জন্ম ইত্যাদির বর্ণনা আছে। উত্তরভাগে রয়েছে শ্রীকৃষ্ণচরিত, বর্ণাশ্রমধর্ম ইত্যাদির বিবরণ ।
পদ্মপুরাণ: এ পুরাণটি পাঁচ খন্ডে বিভক্ত। সৃষ্টিখন্ড, ভূমিখন্ড, স্বর্গখন্ড, পাতাল খন্ড ও উত্তর খন্ড। সৃষ্টিখন্ডে পার্বতীর বিবাহ ও তারকাসুরের কাহিনি বর্ণিত আছে। ভূমিখন্ডে বৃত্র, বেনরাজা, নহুষ, যযাতি প্রভৃতির বিবরণ আছে; স্বর্গখন্ডে কাশী, প্রয়াগ প্রভৃতি তীর্থস্থান সমূহের বর্ণনাসহ সমুদ্রমন্থন প্রভৃতির কাহিনি রয়েছে। পাতাল খন্ডে রাম ও রাবনের কাহিনি এবং কৃষ্ণলীলার বর্ণনা রয়েছে। উত্তর খন্ডের বিষয় বিভিন্ন তীর্থের মাহাত্ব্য এবং একাদশীর ফল। পৌরাণিক যুগে তীর্থস্থানের মাহাত্ম বাড়ছিল। তবে বৈদিক যাগযজ্ঞ একেবারে পরিত্যক্ত হয়েছিল তা বলা যায় না। এ প্রসঙ্গে সুনীল চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন:‘রাজার রাজ্যাভিষেক সময় যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান হত। তবে সাধারণ মানুষ বৈদিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলছিল।’ (প্রাচীন ভারতের ইতিহাস (দ্বিতীয় খন্ড); পৃষ্ঠা, ১৭৬)
বিষ্ণু পুরাণ: দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাবে ধ্রুব, পৃথু, ভরত প্রভৃতি চরিত্র আলোচিত হয়েছে। দ্বিতীয় ভাগে ধর্মশাস্ত্র, অর্থশাস্ত্র, বেদান্ত, জ্যোতিষ প্রভৃতি আলোচিত হয়েছে। প্রাচীন ভারতে অর্থ মোক্ষ ও কামকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অর্থশাস্ত্রের মধ্যে কৌটিল্যে অর্থশাস্ত্র অন্যতম; ধর্মশাস্ত্র কিংবা মোক্ষশাস্ত্রের মধ্যে বেদান্ত দর্শন অন্যতম এবং কামশাস্ত্রের মধ্যে বাৎসায়নের কামশান্ত্র উল্লেখযোগ্য। জ্যোতিষশাস্ত্র যে ভারতবর্ষে জীবনধারায় গুরুত্বপূর্ন সেটিও পুরাণ থেকে জানা যায়।
বায়ুপুরাণ: এটিও দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথমভাগে দানধর্ম, রাজধর্ম, প্রভৃতি বিষয় এবং দ্বিতীয় ভাগে বিভিন্ন তীর্থমাহাত্ম আলোচিত হয়েছে। পৌরাণিক যুগে (৩০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ৬০০ খ্রিষ্টাব্দ) বৈদিক যাগযজ্ঞের বদলে তীর্থদর্শন এবং পূজার প্রচলন বাড়ছিল। এ প্রসঙ্গে পূর্বেই সামান্য ইঙ্গিত দিয়েছি। ড. আর এম দেবনাথ লিখেছেন, ‘হিন্দুর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তীর্থের ধারণা অনাদি কাল থেকে চালু নয়। ড. সুকুমারী ভট্টাচার্যের মতে (দি ইন্ডিয়ান থিয়গনি;ব্রহ্মা বিষ্ণু অ্যান্ড মহেশ্বর) আর্যদের মধ্যে চালু যজ্ঞের পরিবর্তেই তীর্থের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা জানি আর্যরা যজ্ঞ করত। এক সময় এই যজ্ঞের এক বীভৎস রূপ নেয়। কথিত আছে যে উত্তর ভারতের বর্তমান অভিশপ্ত চম্বল নদী পরীক্ষিত নামে এক রাজা কর্তৃক সম্পাদিত যজ্ঞের পশু রক্তেই সৃষ্ট হয়েছে। (সিন্ধু থেকে হিন্দু; পৃষ্ঠা, ৯০/৯১)
ভাগবত পুরাণ: ভাগবত পুরাণ সমন্ধে বিশিষ্ট বাঙালি পন্ডিত ধীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন: ‘ভাগবত পুরাণসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠরচনা, সংস্কৃত সাহিত্যের প্রসিদ্ধ কবিকৃতি এবং বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের প্রামাণ্য ধর্মগ্রন্থ। বৈষ্ণব দর্শনের তত্ত্ব, ভগবান শ্রীকৃষ্ণরূপী বিষ্ণুর মাহাত্ব্য ও জীবনচরিত এই গ্রন্থের প্রতিপাদ্য বিষয়। ... দ্বাদশ স্কন্ধে বিভক্ত ৩৩৫ অধ্যায়ে সম্বলিত সমগ্র গ্রন্থে প্রায় ১৮০০০ শ্লোক রয়েছে। বৈষ্ণব সম্প্রদায় ভাগবত পুরাণ বৈষ্ণব ধর্মের মূল প্রামাণ্য গ্রন্থরূপে পাঠ করেন। আবার সাহিত্যবিচারে ভাগবত প্রথম শ্রেণির কাব্য।’( সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস; পৃষ্ঠা; ১০৮)
নারদীয় পুরাণ: এটিও দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগে মোক্ষধর্ম সম্বন্ধে এবং দ্বিতীয়ভাগে প্রয়াগ, বৃন্দাবন প্রভৃতি তীর্থস্থানের আলোচনা রয়েছে।
মার্কন্ডেয় পুরাণ: এই পুরাণটিতে পুরুরবা, কৃষ্ণ, হরিশ্চন্দ্র প্রমূখ কাহিনি বর্ণিত হয়েছে।
অগ্নিপুরাণ: জ্যোতিষ অলঙ্কারশাস্ত্র পশুচিকিৎসা, ছন্দশাস্ত্র, ব্যাকরণ প্রভৃতি অগ্নিপুরাণের বিষয়। এর মধ্যে পশুচিকিৎসার বিষয়টি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষন করে। অবশ্য বৌদ্ধ ভিক্ষুরা খ্রিষ্টের জন্মের ৩০০ বছর পূর্বে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় পশুদের জন্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
ভবিষ্যপুরাণ: হিন্দুদের ধর্মীয়জীবনে এক অনিবার্য বিষয় হল ব্রত। ভবিষ্যপুরাণে বৈষ্ণব, শৈব ও সৌর সম্প্রদায়ের বিশেষ বিশেষ ব্রতর বর্ণনা রয়েছে। ব্রতহীন হিন্দুকে কল্পনা করা যায় না। এই বিষয়টি থেকেও হিন্দুদের ধর্মীয়জীবনে পুরাণের গুরুত্ব উপলব্দি করতে পারি।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ: পুরাণটি চার খন্ডে বিভক্ত। এর বিষয় ব্রহ্মা, প্রকৃতি, গনেশ এবং কৃষ্ণজন্ম। ব্রহ্মা খন্ডে নারদ ও ব্রহ্মার বিষয়ে আলোচনা রয়েছে । প্রকৃতি খন্ডে রয়েছে প্রকৃতির মাহাত্ম বর্ণনা। গনেশ খন্ডে গনেশের সঙ্গে পরশুরামের যুদ্ধ বর্ণিত হয়েছে । কৃষ্ণজন্ম খন্ডের বিষয় শ্রীকৃষ্ণের লীলা। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণেই সর্বপ্রথম রাধার উল্লেখ পাওয়ায়। পুরাণটি বাংলায় বেশ জনপ্রিয়। এর কারণ কি হতে পারে? গুপ্ত এবং বৌদ্ধযুগ থেকেই বাংলায় বৈষ্ণব ধর্ম অত্যন্ত জনপ্রিয়। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের তৃতীয় খন্ডের বিষয় গনেশ । তবে গানপত্য ধারাটি বাংলায় অত জনপ্রিয় নয় বলে আমি মনে করি। পুরাণটি ২য় খন্ডের বিষয় প্রকৃতি। এটি কি সাংখ্যদর্শনের প্রকৃতি নাকি ভূপ্রকৃতি? যাই হোক। বাংলায় ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের জনপ্রিয়তার কারণ অনুমান করা যায়। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ টি সম্ভবত অষ্টম শতকে বাংলায় রচিত হয়েছিল।
লিঙ্গ পুরাণ: এই পুরাণটি দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগের বিষয় শিবের সঙ্গে পার্বতীর বিয়ে। দ্বিতীয়ভাগে সূর্যপূজা, শ্রাদ্ধবিধি প্রভৃতি আলোচিত।
বরাহপুরাণ: এটিও দুই খন্ডে বিভক্ত। পুরাণটির আলোচনার বিষয় রুদ্রগীতা, অগস্ত্যগীতা এবং ধর্মলক্ষণ। (এই ৩টি বিষয় সম্বন্ধে আমার কোনও ধারণা নেই)
স্কন্ধপুরাণ: পরাণটি সাত খন্ডে বিভক্ত। মাহেশ্বর খন্ড, বৈষ্ণব খন্ড, ব্রহ্ম খন্ড, কাশী খন্ড, অবন্তী খন্ড, নাগর খন্ড ও প্রভাস খন্ড।
বামনপুরাণ: এটি দুই খন্ডে বিভক্ত। এর বিষয়বস্তু পার্বতীর জন্ম, তপস্যা এবং বিবাহ।
কূর্মপুরাণ: এটিও দুই খন্ডে বিভক্ত। প্রথম খন্ডে বর্ণাশ্রম, ধর্ম কৃষ্ণ চরিত্র বর্ণনা এবং দ্বিতীয় খন্ডে ঈশ্বরীগীতা বর্ণনা রয়েছ।
গরুড়পুরাণ: এটিও পূর্ব ও উত্তর খন্ডে বিভক্ত। পূর্ব খন্ডে জ্যোতিষ ও সামুদ্রিক বিষয়ের (!)আলোচনা, রামায়ণ, হরিবংশ, আয়ুর্বেদ প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে । উত্তর খন্ডে মৃত্যুর পূর্বে ও পরের কর্তব্য সম্বন্ধে আলোচনা।
মৎসপুরাণ : এই পুরাণের বিষয় মনুমৎসের কাহিনি। মানে মৎসরূপ অবতীর্ণ ভগবান বিষ্ণু কর্তৃক মনুকে রক্ষা করার কাহিনিই মৎসপুরাণে মূল বিষয়। ব্যাখ্যা করছি। ব্রাহ্মণ্য ধর্ম অনুসারে ব্রহ্মা জগৎ সৃষ্টি করেন। সেই জগতে বিষ্ণুর নিদ্রাভঙ্গ হয়। বিষ্ণু উচ্চতম স্বর্গে বাস করেন। এবং সেখান থেকে জগতের ওপর নজর রাখেন। কখনও বিশ্বে অমঙ্গল বৃদ্ধি পেলে তিনি নানা আকারে অথবা অবতাররূপে ধরায় অবতীর্ণ হন এবং অমঙ্গল দূর করার উদ্দেশ্যে মনুষ্য জগতে প্রবেশ করেন। একবার প্রবল বন্যায় জগৎ প্লাবিত হয়েছিল। বিষ্ণু তখন মাছের রূপ ধরে মনু এবং সাতজন ঋষি এবং বেদ রক্ষা করেন।
ব্রহ্মান্ড পুরাণ: এই পুরাণটি পূর্ব, মধ্য ও উত্তর এই তিন ভাগে। ব্রহ্মান্ড পুরাণে ঊর্ধ ও অধলোকের বর্ণনা, সপ্তদ্বীপের বর্ণনা, যযাতি ও কার্তবীর্যের উপাখ্যান, ভাবীমানবের চরিত্র, জীবের গতি ব্রহ্মতত্ত্ব প্রভৃতি আলোচিত হয়েছে।
অষ্টাদশ সমহাপুরাণের সংক্ষিপ্ত আলোচনা শেষে দেখা যায় পুরাণ মূলত প্রাচীন ভারতবর্ষের জীবনধারাই প্রতিফলন । এ কারণে পুরাণের ঐতিহাসিক গুরুত্ব সহজেই উপলব্দি করা যায়। মৎসপুরানে বলা হয়েছে যে, বেদপন্থীরা পুরাণগুলির মধ্য থেকে ইতিহাস পাঠ করেন। পুরাণে শিশুনাগ, নন্দ, মৌর্য, শুঙ্গ, অন্ধ্র ও গুপ্ত প্রভৃতি রাজবংশের উল্লেখ রয়েছে, যা প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় ইতিহাস রচনার অন্যতম উৎস। এ ছাড়া স্কন্ধপুরাণে বেনারস এবং এর আশেপাশের মন্দিরের বর্ণনা রয়েছে। কেবল তাই নয়, পুরাণে কোনারকের সূর্যমন্দিরের উল্লেখ রয়েছে।
কিন্তু ইতিহাস ও পুরাণের মধ্যে পার্থক্য ঠিক কোনখানে?
এর উত্তরে বলা যায়: ইতিহাস হল পুরাণসাহিত্যে প্রসিদ্ধ কাহিনিগুলির পরিশুদ্ধ রূপ। এই পরিশুদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি অর্জিত হয়েছিল ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের সময়ে। উনিশ শতকে ভারতীয় ঐতিহাসিকগণ ভারতবর্ষের অতীতের দিকে তাকিয়েছিলেন যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। এ ক্ষেত্রেও বাঙালি ঐতিহাসিকরা ছিলেন অগ্রগণ্য।
সে যাই হোক। পুরাণের সাহিত্যমূল্যও কম নয়। পুরাণ-পরবর্তী যুগের সাহিত্যে পুরাণের প্রভাব পড়েছিল অনিবার্যভাবেই । এ ছাড়া পুরাণরচয়িতাগণ ছিলেন জীবনবাদী, এবং তাঁরা অনিন্দ্য মধুর ভাষায় মানুষকে বাঁচার প্রেরণা দিতেন।এ প্রসঙ্গে ফয়েজুন্নেছা বেগম লিখেছেন, ‘ পুরাণগুলিতে মাঝে মাঝে যে বর্ণনামূলক অংশ আছে তাহার ভাব এবং ভাষার গভীরতা আমাদের চিত্ত হরণ করে।’ (সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস; পৃষ্ঠা, ৩৩) কবি কালিদাস তাঁর ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ লিখেছেন পুরাণের দুষ্যন্ত ও শকুন্তলার উপাখ্যান অবলম্বন করে।
কালিদাসের ‘বিক্রর্মোবশীয়ম’ নাটকের কাহিনিটিও পৌরাণিক। অষ্টম শতকে রচিত ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণেই রাধাকৃষ্ণের প্রেমকাহিনিটি প্রথম উল্লেখিত হয়। যে আবেগপ্রবণ মধুর ভাবনাটি সংস্কত ও বাংলা সাহিত্য প্লাবিত করেছে। আজও।
বিংশ শতকের গোড়ার দিকে পাশ্চাত্য পন্ডিত ফ্রেডেরিক এডেন পারগিটার প্রথম পুরাণ সম্বন্ধে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষন করেন । তিনি বলেন প্রাচীন ভারত কে উপলব্দি করার ক্ষেত্রে পুরাণের ভূমিকা
অবদান রাখতে পারেন । অপর একজন পশ্চিমা পন্ডিত থিয়োডোর গোল্ডস্টাকার অবশ্য হিন্দুধর্মের অধঃপতনের জন্য অবশ্য পুরাণকে দায়ী করেছেন। এ প্রসঙ্গে ফয়েজুন্নেছা বেগম লিখেছেন, ‘তাঁহার এই উক্তির সত্যতা বিচার করা কঠিন। কারণ মহাকালের প্রবাহে হিন্দুধর্ম নানা মত ও বিশ্বাসকে গ্রহন করিয়াছে, বর্জনও করিয়াছে, কোনও মতকেই স্থায়ী আসনে প্রতিষ্ঠা করে নাই। (সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস; পৃষ্ঠা, ২৮)
তথ্যসূত্র:
ফয়েজুন্নেছা বেগম; সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস
ধীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়; সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস
সুনীল চট্টোপাধ্যায়; প্রাচীন ভারতের ইতিহাস (দ্বিতীয় খন্ড)
ড. আর এম দেবনাথ; সিন্ধু থেকে হিন্দু