গত পরশু শম্পারা লিভারপুল থেকে দেশে এসেছে। আজ সকালে ওরা শিবপুর রওনা হয়ে গেল । শম্পার শ্বশুরবাড়ি শিবপুর। জাহানারা বাদে এ বাড়ির আর সবাই ওদের সঙ্গে গেল । মাকেও যাওয়ার জন্য শম্পা অবশ্য খুব করে ধরেছিল । ব্লাড প্রেসারের কথা বলে এড়িয়ে গেলেন জাহানারা । মাকে ছাড়া যাবে না বলে একবার মেয়ে একবার বেঁকেও বসল। জাহানারা তার সিদ্ধান্তে অটল রইলেন।
ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন জাহানারা। বিশেষ করে শীতকালের কুয়াশা ছড়ানো নির্জন গ্রাম্যপথ ধরে হেঁটে যেতে প্রচন্ড রকমের ভালোবাসেন জাহানারা। তবুও এ বছরের শীতে ঢাকার বাইরে কোথাও যাওয়া হয়নি তার । সংসারে হাজারও ঝুট-ঝামেলা লেগেই আছে। কাল রাতে হঠাৎ করেই পারুলের জ্বর এল। নাপা এক্সট্রা খাইয়ে দিয়েছেন একটা । জ্বর আজ সকালেও ছেড়ে যায়নি। দুপুরের মধ্যে জ্বর না-ছাড়লে ডাক্তার সুরাইয়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলবেন। ভদ্রমহিলা নীচতলার ফ্ল্যাটে থাকেন। সম্পর্ক ভালো।
এ ফ্ল্যাটের স্টোররুমে জানালা নেই। রান্নাঘরের দিকের দরজা অবশ্য খোলা। কম পাওয়ারের একটা বাল্ব জ্বলে আছে। মেঝেতে একটা ময়লা তোষক পাতা। তার ওপর শুয়ে আছে পারুল। জ্বরে আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে মেয়েটি । জানুয়ারি মাস। পারুলের গায়ের ওপর একটি ময়লা লেপ। পারুলের মাথার কাছে একটা মোড়া। তার ওপর উবু হয়ে বসে পারুলের জ্বরতপ্ত কপালে জলপট্টি দিচ্ছেন জাহানারা । মেঝের ওপর পানি ভর্তি নীল রঙের একটা প্লাস্টিকের মগ।
জাহানারা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। শিবপুর না যাওয়াতে শম্পার মন খারাপ হল। পাঁচ বছর পর দেশে এল, মাত্র সপ্তাহ দুয়েক থাকবে। আবার কবে আসে, না-আসে। শম্পার শ্বশুরশাশুড়ি আবার কি মনে করেন। তা ছাড়া শীতের চিনাদি বিলটিও এক নজর দেখার ইচ্ছে ছিল । শম্পার শ্বশুরবাড়ি শিবপুরের দুলালপুর ... কাছেই বিস্তীর্ণ চিনাদি বিল। শম্পার বিয়ের পর বেশ ক’বারই গিয়েছিলেন দুলালপুর । প্রত্যেক বারই ভরা বর্ষার এক বুক কাজল কালো জল নিয়ে চিনাদি বিল গর্ভবতী নারীর মতো গম্ভীর হয়ে ছিল । জাহানারার উৎসাহে শম্পার শ্বশুর আফসান চৌধুরী নৌভ্রমনের এন্তেজাম করেছিলেন ... শীতকালে একবার দুলালপুর যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। নানা কারণে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এই মাঘ মাসের শীতে বিলটি কি জলশূন্য হয়ে আছে? ... দিগন্ত অবধি সর্ষের ক্ষেতের ওপর নিশ্চয়ই শীতের সোনালি রোদ্দুর ছড়িয়ে আছে ... হালকা কুয়াশা জড়ানো চরাচর সুনসান করছে ... দূরে কুয়াশা ঘেরা আবছা দিগন্ত ... আহা ! এই মুহূর্তে বিল পাড়ে দাঁড়ালে গায়ে ঝরত শীতের নরম রোদ সোনালি গুঁড়ো ...
কলিংবেলের আওয়াজে চিন্তাসূত্র ছিন্ন হল।
কে এল এ সময়?
দুধওয়ালা কি?
জলপট্টিটা পারুলের কপালে রেখে উঠে দাঁড়ালেন জাহানারা । ... উহ্, মাগো। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলেন ... চোখে সামান্য অন্ধকার হয়ে এলেও সামলে নিলেন। আজকাল বসা থেকে উঠতে কষ্ট হয়। মধ্যবয়েসের শরীরের এখানে-ওখানে নানা রকম যন্ত্রণা আর অস্বস্তি। মেদবহুল কোমরের কাছে টন টন করে, চাপ পড়ে তলপেটের কাছে।
ব্যথা চেপে রান্নাঘর এসে কিচেন ক্যাবিনেট খুলে সসপ্যান নিলেন । তারপর ডাইনিং রুমে এলেন । ঘড়ির দিকে চোখ গেল। বেলা বারোটার মতো বাজে । শম্পারা এতক্ষণে নিশ্চয়ই শিবপুর পৌঁছে গেছে। ...শম্পার শ্বশুর আফসান চৌধুরীরা দুলালপুরের সম্ভ্রান্ত পরিবার। চৌধুরী বাড়ির হলদে রঙের একতলা দালানটি বেশ পুরনো । একতলার রেড অক্সাইডের লাল রঙের বিশাল বারান্দা । বারান্দার সামনে আতা, ডালিম, হরবরি ও লেবু গাছ। নারকেল গাছে ঘেরা ছাদটিও বেশ ছড়ানো ... শম্পারা কি এই মুহূর্তে সেই ছাদে দাঁড়িয়ে মাঘের শীত মাখা সোনালি রোদ্দুর ভর্তি চিনাদি বিলের অবারিত সর্ষে ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে আছে? নাকি রোদ ছড়ানো লাল রঙের বারান্দায় দাঁড়িয়ে শম্পা ওর শ্বশুরকে কৈফিয়তের সুরে বলছে, ‘মাও আসত, হঠাৎ প্রেসার উঠল মার।’ ...আহ্! কাল ভোরে গ্লাস- গ্লাস খেজুরের রস খাবে ওরা ... ভোরাতে উঠে শম্পার শাশুড়ি গ্রামের মেয়েদের নিয়ে কত রকমের পিঠেপুলি যে বানাতে বসবেন ... আহা ! শিবপুরের মানুষ বড় অতিথি পরায়ন। শম্পার শাশুড়ির রান্নার কোনও তুলনা হয় না ... সেই যে একবার ভরা বর্ষার দিনে মুগের ডালের খিচুড়ি আর ঝাল ঝাল হাঁসের মাংস রেঁধেছিলেন ... সেই অপূর্ব স্বাদ আজও মুখে লেগে আছে!
দরজাা হাতলে হাত রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন জাহানারা ... আজ আধ কেজি দুধ বেশি নিতে হবে। ফ্রিজে পাউরুটি আছে। জ্বরে মেয়েটার মুখ তেতো হয়ে আছে ... জাহানারা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কতই-বা বয়েস হবে মেয়েটির? তেরো কি চৌদ্দ । বছর দুয়েক আগে পেটের দায়ে ফরিদপুর থেকে ঢাকা শহরে এসেছিল কাজের সন্ধানে ... ফরিদপুরের কোন্ অজ গ্রামে মাকে ফেলে এসেছে মেয়েটা ... জ্বরগ্রস্থ মেয়েকে ফেলে শিবপুর বেড়াতে যাই কি করে ... ব্লাড প্রেশার না ছাই ...