এ প্রসঙ্গে কথা আরও কিছু হল। সে কথায় পরে আসছি। তার আগে আমার গত মার্চের ‘শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীতটির কথা ও সুর যে কারণে অবিকল রবীন্দ্রনাথের’ শিরোনামের পোস্টের কিছু অংশ তুলে ধরছি। .... এবারের বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এই দ্বীপরাষ্ট্রটির সংগীত ও নৃত্য পরিবেশনা অনেকেরই ভালো লেগেছে। ভাষা অন্যরকম হলেও সুর যেন চেনা চেনা মনে হয়েছে। যা হোক। বিশ্বকাপ উপলক্ষেই শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীতটি মন দিয়ে শোনা হল। এবং বেশ বিস্মিত হলাম। তার কারণ - শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীতটি সুর অবিকল রাবীন্দ্রিক মনে হল । মনে হল যেন অন্য ভাষায় রবীন্দ্রনাথেরই কোনও গান শুনছি। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে ভারি বিস্মিতও হলাম ... শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীতের কথা লিখেছেন শ্রীলঙ্কার প্রখ্যাত সংগীত পরিচালক ও কবি আনন্দ সামারাকুন। সুরও তিনিই করেছেন। গানটি ‘নমো নমো শ্রীলঙ্কা মাতা’ বা ‘মা শ্রীলঙ্কা আমরা তোমায় প্রণাম করি।’ নামে পরিচিত। সামারাকুন ১৯৪০ সালে গানটি রচনা করেন এবং ১৯৪৬ সালে সেটি রেকর্ড করা হয়। ১৯৫১ সালে গানটি শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীতরূপে গ্রহন করা হয়। ...আনন্দ সামারাকুন জন্মসূত্রে ছিলেন খ্রিস্টান। তাঁর পুরো নাম ইগোডাহাঞ্জ জর্জ উইলফ্রেড আল উইস সামারাকুন। পড়াশোনা করেছেন কোটির (তৎকালীন শ্রীলঙ্কার রাজধানী) খ্রিস্টান কলেজে। পরে ওই কলেজেই সংগীত ও চিত্রকলার শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ছবিও আঁকতেন সামারাকুন। রবীন্দ্রনাথের টানে ভারতে এসেছিলেন। মাস ছয়েক শান্তিনিকেতনে পড়েছেনও। পরে আবার শ্রীলঙ্কায় ফিরে আসেন। বৌদ্ধধর্ম গ্রহন করেন এবং পূর্বেকার নাম বদলে রাখেন আনন্দ সামারাকুন। ...এসব ঘটনা ১৯৩৮ সালের আগে। কাজেই অনুমান করা যায় শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথকে দেখেছিলেন। আগেই বলেছি ... বিশ্বকাপ উপলক্ষেই শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীতটি মন দিয়ে শোনা হল। বেশ বিস্মিত হলাম। তার কারণ - শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীতটি সুর অবিকল রাবীন্দ্রিক মনে হল । মনে হল যেন অন্য ভাষায় রবীন্দ্রনাথেরই কোনও গান শুনছি। ... এ প্রসঙ্গে জনৈক ইতিহাসবিদ লিখেছেন ... He (অর্থাৎ, আনন্দ সামারাকুন) was very much influenced by Rabindranath Tagore while in India and his fascination and the desire to imitate the great Indian musician would go on to take him in the direction of creating a musical tradition for the Sri Lankan people...এতে বোঝা যায় আনন্দ সামারাকুন রবীন্দ্রকাব্যে উজ্জীবিত হয়েই শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীত ‘আপা শ্রীলঙ্কা, নম নম নম নম মাতা রচনা করেছিলেন।
অথচ গতকাল কবি মুজিব মেহেদী বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম -এর যে লিঙ্কটি পাঠিয়েছেন তাতে ক্লিক করে জানলাম সম্পূর্ন ভিন্ন কথা। রক্তিম দাশ লিখেছেন ...শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীত ‘আপা শ্রীলঙ্কা, নম নম নম নম মাতা, সুন্দর শ্রী বরনী’র মূল রচয়িতা ও সুরকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলাদেশের আগে এটাই ছিল কবির লেখা কোনো গানের দ্বিতীয় জাতীয় সঙ্গীতে রূপন্তর। সে হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা’ কবি রচিত তৃতীয় জাতীয় সঙ্গীত। ভাবতে অবাক লাগলেও ঘটনাটা সত্যি। তবে এর একটি চমকপ্রদ ইতিহাস আছে। ব্রিটিশ লঙ্কা মানে আজকের শ্রীলঙ্কা থেকে আনন্দ সমরকুন ১৯৩০ সালে শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীতে কলা ও সঙ্গীত বিভাগে পড়তে এসেছিলেন। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ছাত্র। ১৯৩৮ সালে তিনি গুরুদেবের কাছে তার দেশের জন্য একটি গান লিখে দেবার জন্য অনুরোধ করেন। প্রিয় ছাত্রের এই অনুরোধ ফেরাতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ। বাংলায় লিখে দিলেন ‘নম নম শ্রীলঙ্কা মাতা’। সুর করে গানটি তুলেও দিলেন আনন্দকে। ১৯৪০ বিশ্বভারতীর শিক্ষা শেষ করে কবিগুরুর এই গানটি নিয়ে দেশে ফিরে গেলেন আনন্দ সমরকুন। ১৯৪৬ সালে গানটি সিংহলিভাষায় অনুবাদ করে একটি রেকর্ড বের করলেন শ্রীলঙ্কায়। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে শ্রীলঙ্কা স্বাধীনতা পেল ১৯৪৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। ১৯৫০ সালে নতুন দেশের জাতীয় সঙ্গীত ঠিক করার জন্য স্যার এডউইন ওয়াসজারএটনির নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠিত হয়। এ সময় আনন্দ তার অনূদিত ‘নম নম শ্রীলঙ্কা মাতা’ গানটি এ কমিটির কাছে দেন। কমিটি ১৯৫১ সালের ২২ নভেম্বর এই গানটিকেই শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। মোট ৪৪ লাইন আর ২ মিনিট ৩৫ সেকেন্ড গানটির সময়সীমা। এভাবেই প্রিয় ছাত্রকে লিখে দেওয়া কবিগুরুর মূল গানটির অনুবাদ হয়ে গেল আরও একটি দেশের জাতীয় সঙ্গীত।
আনন্দ সমরকুন এবং আনন্দ সমরকুন অনূদিত ‘নম নম শ্রীলঙ্কা মাতা’র পান্ডুলিপি। (এই ছবিটি রক্তিম দাশ-এর ফিচারে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর. কম - এ ছাপা হয়েছে )
যেহেতু রবীন্দ্রনাথ এবং শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীতের সম্পর্ক নিয়ে বেশ কিছুদিন যাবৎ গভীর ভাবে ভাবছি সেহেতু রক্তিম দাশ এর রিপোর্ট পড়ে দারুণ নাড়া খেলাম । যদি রক্তিম দাশ-এর তথ্য সঠিক হয় তা হলে রবীন্দ্রনাথই শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীতের রচয়িতা। অন্য কেউ নন! এই তথ্যটির মর্ম এতই গভীর যে- যে কোনও রবীন্দ্রভক্তের রক্তস্রোত চঞ্চল হয়ে ওঠার কথা। কিন্তু এমন একটি ঐতিহাসিক এবং গুরুত্বপূর্ন তথ্য আমরা বাঙালিরা এত বিলম্বে পেলাম কেন? তিন-তিনটি দেশের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা হওয়া তো চাট্টিখানি কথা না। তা ছাড়া জাগতিক অমানিশায় রবীন্দ্রনাই যখন বাঙালি জীবনের ধ্রুতারা এবং যখন দক্ষিণ এশিয়ায় দেশগুলির আঞ্চলিক দূরত্ব কমিয়ে আনার নিরন্তর উদ্যেগ চলছে তখন এরকম একটি রবীন্দ্রকেন্দ্রিক আবিস্কার (আবিস্কারই বলব) তো উপমহাদের পরিপ্রেক্ষিতে প্রবল উৎসাহব্যঞ্জক ...
কিন্তু রক্তিম দাশ এর রিপোর্টের বড়ই দূর্বল।
তার প্রধান কারণ রক্তিম দাশ এই বিস্ফোরক সংবাদটির যথাযথ উৎস নির্দেশ করেন নি । এবং তথ্যের যথার্থ উৎস না-উল্লেখ করার বিষয়টি সত্যিই পীড়াদায়ক। ঠিক এই প্রসঙ্গটিই উল্লেখ করে কবি মুজিব মেহদী গতকাল ফেসবুকে লিখলেন ...কিন্তু মুশকিল হলো, নিউজে তথ্যের কোনো সোর্স দেওয়া হয় নি, যা দিয়ে আমরা ক্রসডচেক করে দেখতে পারি এর সত্যাসত্য। উইকিপিডিয়া এবং শ্রীলংকা গভর্নমেন্টের সাইটেও তো আনন্দ সামারাকুনের কথাই বলা হচ্ছে! ... আমি লিখলাম ... আমারও তো একই কথা। ... খেয়াল করে দেখবেন পান্ডুলিপির ভাষা সিংহলী ( আনন্দ সমরকুন অনূদিত ‘নম নম শ্রীলঙ্কা মাতা’র পান্ডুলিপি) । এটা তো আনন্দ সামারাকুনেরই হতে পারে। কেননা, তিনি কেবল সংগীত পরিচালক ছিলেন না, কবিতার চর্চাও করেছেন। এটা সত্য যে শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীতটি রবীন্দ্রনাথ দ্বারা ভীষণই প্রভাবিত। তা বলে সেটি যে রবীন্দ্রনাথেরই লেখা আর এদ্দিন পর এ বিস্ফোরক তথ্যটি কলকাতার সূত্রে সাদামাটা ভাবে বাংলানিউজ ওয়ালা উপস্থাপন করলেন-আমার বিস্ময় এখানেই। এর উত্তরে মুজিব মেহদী লিখলেন ... গুরুত্বপূর্ন পয়েন্ট। এটা এমনই একটা তথ্য যে, এটির উন্মোচন এত ম্যাড়ম্যাড়েভাবে হতেই পারে না। এতদিন পর এরকম একটা আবিষ্কার সম্ভব হলে এ অঞ্চলের মিডিয়াগুলোতে হৈচৈ পড়ে যাবার কথা ছিল। শুধু এ অঞ্চলেই বলি কেন, তিন তিনটা দেশের জাতীয় সংগীত রচয়িতাকে নিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোরও তো মাথা খারাপ হয়ে যাবার কথা, তাই না! ...লিখলাম: আমি আপনার সঙ্গে সম্পূর্ন একমত। কাজেই এ বিষয়ে আরও খোঁজ খবর করতেই হয়। আসলে তেমনটি হলে বিশ্বমিডিয়ায় খবর আসত। ... মুজিব মেহদী লিখলেন ... দেখুন, কোনো কূলকিনারা করা যায় কি না।
এখন তো দেখছি সত্যিই রক্তিম দাশ এর রিপোর্টটির কূলকিনারা করতেই হয় ...
সূত্র:
Click This Link
(সরাসরি পেজটি না-এলে ওপরের মেনু থেকে ফিচার এ ক্লিক করুন)
এই প্রসঙ্গে আমার গত ১৯ মার্চের পোস্ট।
Click This Link
রবীন্দ্রনাথের ছবি ... ইন্টারনেট ...
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে এপ্রিল, ২০১১ দুপুর ২:৩০