আমার মাহামহ যে সময়টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সে সময়টায় ভারতীয় উপমহাদেশের হাজারও জাতিসত্ত্বার ভিড়ে বাঙালি মুসলমান তার স্বতন্ত্র আত্মপরিচয় সম্বন্ধে ক্রমেই সচেতন হয়ে উঠছিল। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঐতিহাসিক কারণেই হয়ে উঠেছিল বাঙালী মুসলমানের আত্মবিকাশের পথে একটি অনিবার্য সহায়ক প্রতিষ্ঠান।
আমার মাতামহের নাম সরদার আবদুল্লা। কুড়ি শতকের প্রারম্ভে নওগাঁর একটি অতি সাধারণ দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম । পরিবারটি দরিদ্র, তা সত্ত্বেও তরুণ আবদুল্লার পড়াশোনার খরচ বহন করতে দ্বিধা করেনি। এতে করে আমার মাতৃপুরুষের অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ ঠেলে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার তীব্র আকাঙ্খাটি উপলব্দি করা যায়।
আমার মাতামহ ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস বিভাগে । এই বিভাগ নির্বাচনের পিছনেও বাঙালি মুসলমানের সুমহান ঐতিহ্যকে নিবিড়ভাবে জানবার ঐকান্তিক আগ্রহ ছিল বলেই আমার কাছে মনে হয়েছে। ... বহু বছর পরে আমার মাতামহের ঝাপসা হয়ে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলদে ম্লান সার্টিফিকেটখানি দেখে অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র; আর আমার মাতামহ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাসের প্রথম ব্যাচের ছাত্র। দুটি সময়ের দুস্তর ব্যবধান স্মরণ করতে-করতে আমার মনে হয়েছিল যে বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার সেই প্রাথমিক যুগে আমার মাতামহের পক্ষে ইসলামের ইতিহাসের পাঠ
সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল।
যা হোক। এক সময় পড়াশোনার পালা চুকল। এবার চাকরির অন্বেষন। সময়টা ১৯২৫/২৬ সাল। অবিভক্ত বাংলার অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রে শহর কলকাতা। আমার মাতামহ চাকরির সন্ধানে ছুটলেন কলকাতায় ; একটি চাকরি পেয়েও গেলেন । আয়ের পথ যখন খুলল তখন বিবাহের কথাও ভাবতে হয়। রাজশাহী বিভাগের নওগাঁ জেলায় শান্তাহার নামে একটি রেলস্টেশন আছে। সেই শান্তাহার রেলস্টেশন থেকে নওগাঁ শহরের দিকে সড়ক চলে গেছে। সেই সড়কে মাঝমধ্যিখানে সেকালে ধামকুড়ি নামে একটি গ্রাম ছিল। গ্রামটি আজও আছে। আমার মাতামহের নবপরিণীতা স্ত্রীটি সেই ধামকুড়ি গ্রামেরই কন্যা। নাম: আমেনা খাতুন।
নবদম্পতি সংসার পাতলেন কলকাতায় ।
আমি আমার মায়ের মুখে শুনেছি-কলকাতায় ভাড়া বাড়িটি ছিল পার্ক সার্কাসের একটা গলির ভিতরে। হলুদ রঙের পুরনো ধাঁচের একটি তিনতলা দালান। ( আমার মায়ের কপালের বাঁ পাশে একটা গভীর কাটা দাগ ছিল। কলকাতার পার্ক সার্কাসের সেই দালানের সিঁড়িতে পড়ে গিয়ে আমার মায়ের কপাল কেটে গিয়েছিল।) ... মাতামহের মেজাজ নাকি কড়া ছিল। তিন পুত্র এবং চার কন্যার জনক হয়েছেন। ছেলেমেয়েরা কি রকম আদবকায়দা শিখছে- সে বিষয়ে সচেতন ছিলেন। আমার মায়ের মুখে একটি ঘটনা বেশ ক’বার শুনেছি। ... আমাদের কলকাতার বাড়ির পাশে একজন মধ্যবয়েসি মহিলা থাকতেন। সেই মধ্যবয়েসি মহিলাকে আমরা বেনুমাসী বলে ডাকতাম। তো বেনুমাসী একদিন আমাদের বাড়ি থেকে পড়ার জন্য একটা বই চেয়ে নিয়েছিলেন । বইটা ফেরত দিতে খানিক দেরি হয়েছিল। তখন হাদি ভাই (আমার ছোটমামা) বেনুমাসীকে কি সব চটাং চটাং কথা শুনিয়েছিল। ব্যাস! আর যায় কই। কথাটা আব্বার কানে যেতেই আব্বা ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন। হাদি ভাইয়ের কোষ্ঠীতে বেত্রাঘাত যোগ ছিল। অতএব ...বলে মা হাসল । পিটুনি খেয়ে তোর ছোট মামা জ্বরে পড়ল ... বেচারা। আমাদের সবার ডায়মন্ড হারবার যাওয়া কথা। গেলাম। কেবল মা জলপট্টি নিয়ে বসে রইল জ্বরগ্রস্থ পুত্রের শিয়রে।
মাঝে-মাঝে জীবনানন্দীয় স্টাইলে আমার মনে হয়-এতকাল পরে যদি আমি হেঁটে যাই কোলকাতার পার্ক সার্কাসের আর খুঁজি সেই হলুদ দালান তাহলে কি সেসব দিনের গুঞ্জন ধরা দেবে আমার উৎসুক চোখমুখে পরে ?
১০/১৫ বছর কাটল কলকাতায়। চল্লিশের দশকের শুরুতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আঁচ পড়ল সে শহরে। যুদ্ধের পর পর ভারতবর্ষজুড়ে গর্জে উঠল ভারতবাসীর স্বাধীনতার আহ্বান, সিদ্ধান্ত হল দেশবিভাগের ... কতকাতা শহরে দাঙ্গায় হিন্দু-মুসলমানের রক্ত ঝরল ...ভারতবর্ষ হয়ে উঠল মুসলমানের জন্য বিপদসঙ্কুল স্থান ...
ভারতীয় উপমহাদেশের নিমর্ম ইতিহাসের চাকায় পিষ্ট অন্য অনেকের মতো অনেকটাই অসহায় খানিকটা উদ্বাস্তু আমার মাতামহ পরিবারসমেত ঢাকায় চলে আসতে বাধ্য হলেন ।
প্রথমে উঠলেন পুরানা পল্টনের দু’রুমের একটা ভাড়া বাড়িতে।
পরে অবশ্য শান্তিনগরে বাড়িসহ জমি কেনার সিদ্ধান্ত নিলেন।
শান্তিনগরের দালানটি একতলা। হলুদ রঙের । সে দালানের সামনে-পিছনে নানা ধরনের গাছপালায় ভর্তি প্রায় আড়াই বিঘা জমি। স্থানীয় লোকেরা বলত বাগানবাড়ি। বাগানবাড়িতে আমজামসহ কত ধরনের যে গাছপালা। মেহেদির ঝোপ, হরবরি গাছ, পেয়ারা গাছ, লিচু গাছ। ছোটবেলায় দেখেছি লিচুগাছে ঝাঁক ঝাঁক টিয়া পাখি এসে বসত । লিচু গাছের ডালে একটা কেরোসিনের টিন আটকানো ছিল। কেরোসিনের টিনের ভিতরে দড়ি দিয়ে বাধা একটা লাঠি। দড়ি ধরে টান দিতেই লাঠির ঢং ঢং শব্দে টিয়া পাখিরা সব উড়ে পালাত।
বাগানবাড়ির মালিক ছিলেন তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের অধ্যাপক সুবোধ ব্যানার্জী। মাতৃভূমি পূর্বপাকিস্তান সহসা শক্রদেশ হয়ে ওঠায় জীবন অনিরাপদ ঠেকছিল। কলকাতায় চলে যাবেন। যাওয়ার আগে আমার মাতামহকে বললেন, আবদুল্লা সাহেব। আপনি যদি বাগানবাড়ি কিনতে নেন তো আমি বিক্রি করতে রাজি আছি। একতলা পাকা দালান বাদে কতগুলি টিন সেডের ঘর ভাড়া দেওয়া আছে। সে ভাড়া আপনারই পাবেন।
বাগানবাড়ি কেনার ব্যাপারে আমার মাতামহ নাকি তত উৎসুক ছিলেন না। আমার মাতামহ খানিকট উদাসীন এবং অ-বৈষয়িক ছিলেন। অবশ্যি আমার মাতামহী অতটা উদাসীন্য দেখাতে পারেননি। নারী বলেই পারেননি। ছেলেমেয়েরা সব ছোট। ওদের একটা ভবিষ্যৎ আছে না। মেয়েদের কারোরই এখনও বিয়ে হয়নি। স্কুলকলেজে পড়ছে সব । আমার মাতামহী আমার মাহামহকে বাগানবাড়ি কেনাতে রাজি করাতে সিদ্ধান্ত নিলেন। জন্মের পর থেকেই মাতামহী কে দেখছি। কম কথা বলা চুপচাপ বৃদ্ধা । যেন মৌনব্রত অবলম্বন করছেন। গায়ের রং ধবধবে ফরসা। আমার বন্ধুরা ঠাট্টা করে বলত-ব্রিটিশ। অথচ, আমার মাতামহীর জন্ম হয়েছিল নওগাঁর ধামকুড়ি নামে এক অজ পাড়াগাঁয় । মাতামহীর সফেদ মৌন অবয়বের অন্তরালে যে এক অটল ব্যক্তিত্ব ছিল সেটি বুঝেছিলাম ঠিকই।
যা হোক। আমার মাতামহ দলিলে স্বাক্ষর করলেন।
বাগানবাড়ির নতুন নাম রাখলেন: দারুস সালাম।
আমার মাতামহ তাঁর পুত্রকন্যাদের আরবি নামই রেখেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাসে পড়েছেন। আরবি কি জানতেন? আমি নিশ্চত নই। যা হোক। আমার বড় খালার নাম অবশ্য পুস্প। আর আমার মায়ের নাম শেফালি। এঁদের দুজনেরই অবশ্য আরবি নাম আছে। যথাক্রমে, হামিদা এবং লুৎফুন্নেসা। আসলে এমনই হয়। এবং এমনটা ভুলবশত হয়নি- এটি মাটির ব্যাপার। যেমন, আমার মা আমার মাতামহীকে ‘মা’ বলে ডাকলেও বললেও আমার মাতামহর প্রসঙ্গে ‘আব্বা’ বলতেন। ‘আব্বা’ শব্দটি প্রাচীন ফিলিস্তিনের আরামিয় ভাষার শব্দ। শব্দটির অর্থ: পিতা। আরামিয় ভাষাটি ছিল যিশুখ্রিস্ট মাতৃভাষা। যিশু ঈশ্বরকে ‘আব্বা’ সম্বধোন করতেন।
যা হোক। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে আমার মাতামহ স্ত্রী আর সাত সন্তান কে নিয়ে দারুস সালাম-এ নতুন জীবন শুরু করলেন।
দারুস সালামের পাশে একটা সরু গলি । গলিটা মসজিদের দিকে খানিকটা বেঁকে চলে গেছে । মুসল্লিরা শুক্রবার মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়তে যেতেন। শুক্রবার সকালে আব্বা আমাদের গলি ঝাঁট দেওয়ার কাজে লাগিয়ে দিতেন। আমাদের গলির ময়লা পরিস্কার করতে বলতেন। বাড়িতে অবশ্য বেতনভুক্ত বুয়া ছিল, দারোয়ান ছিল । তবু ছেলেমেয়েদের দিয়েই নামাজীদের মসজিদে যাবার পথটি সাফসুতরো করাতেন আব্বা। আমার লেগে পড়তাম পরিস্কারের কাজে। কারও হাতে ঝাড়–, কারও হাতে ঝাঁটা। তোর ছোটমামার উৎসাহ ছিল বেশি। কুয়া থেকে বালতিতে করে পানি এনে গলিতে ছিটাত। ... একবার। কুরবানী ঈদের সময়। আব্বা মসজিদে ঈদের নামাজ পড়ে ফিরে এসেছেন। পথে কার কাছে যেন শুনলেন পাড়ায় কাদের বাড়িতে অর্থাভাবে কুরবানী হচ্ছে না। আব্বাকে বিচলিত করেছিল। কুরবানী দিলেন। তারপর কুরবানীর বেশির ভাগ গোশতই তোর বড় মামাকে সেই বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। তাতে আমাদের ঈদের আনন্দ সামান্য ভাঁটা পড়লেও আব্বা যে মনে শান্তি পেয়েছিলেন ...
এসব এসবই আমার মায়ের মুখে শোনা ...
শুনতে শুনতে আমার মাহামহ সম্পর্কে একটা আবছা ছবি ফুটে উঠছিল।
একদিন যেন সে ছবিটা পূর্ণ হয়ে উঠল ...
খুব ভোরে উঠে আব্বা মসজিদে ফজরের নামাজ পড়তে যেতেন। যখন বাড়ি ফিরে আসতেন ততক্ষনে কাকপাখিরা সব জেগে উঠত। রোদের ফিকে আলো ঝরত বাগানের গাছপালায়। পাঁচিল ঘেঁষা শিউলি গাছ ছুঁয়ে সে আলো ঝরত শিশির ভেজা ঘাসে। বকুল ডালে দোয়েল আর টুনটুনি আড়মোড়া ভাঙত। সকালের আহারের খোঁজে এখুনি উড়াল দেবে। আব্বা আমাদের সাত ভাইবোনকে ডেকে ডেকে ঘুম থেকে তুলতেন । আমরা ঘুমচোখে উঠলে আমাদের লাইন করে দাঁড়াতে বলতেন । লাইনে দাঁড়িয়ে আমরা চোখ কচলাতাম । মনে মৃদু ক্ষোভ আর বিরক্তি। ধুৎ, রোজ-রোজ এসব সহ্য হয়। আব্বা কেন যে এত সকালে ডেকে তোলে। এখনও তো ভালো করে সকালই হয়নি। ... আব্বা বইয়ের
আলমারীতে সামনে দাঁড়িয়ে। বইয়ে ঠাসা আলমারী । ইসলামের ইতিহাসের পাঠ্যবইও ছিল আলমারীতে । আব্বা বইয়ের তাক থেকে একটা বই তুলে নিলেন হাতে । রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি। তারপর ধীরে সুস্থে বেতের চেয়ারে বসলেন। আমরা লাইন করে দাঁড়িয়ে আছি। আব্বার পরনে চেকলুঙ্গি আর সাদা পাঞ্জাবি। ছোটখাটো গড়ন। ফরসা। মাথায় টুপি। চওড়া কপাল। ধবধবে দাড়ি। গীতাঞ্জলি চোখের সামনে নিয়ে, খুলে, আমাদের দিকে একবার তাকিয়ে পৃষ্ঠা উল্টিয়ে বলতেন, বল তোমরা - আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে ।
আমরা সমস্বরে বলতাম- আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে ।
তোর ছোটমামা ‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে’ বলতে বলতে সামনের দিকে ঢলে পড়ত।
আব্বা বলতেন বল - সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে ।
আমরা সমস্বরে বলতাম - সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে ।
জানালার বাইরে তখন ভোরের পাখির কলতান। ১৯৫৪ সাল। ঘরে সোনালি রোদ ঢুকেছে। সে রোদ পড়েছে আমাদের ঘুমঘুম মুখচোখে, গীতাঞ্জলি হাতে বেতের চেয়ারে বসে থাকা আব্বার প্রসন্ন মুখেচোখে। আব্বা পাঠ করছেন -
নিজেরে করিতে গৌরব দান
নিজেরে কেবলি করি অপমান,
আপনারে শুধু ঘেরিয়া ঘেরিয়া
ঘুরে মরি পলে পলে ।
সকল অহংকার হে আমার
ডুবাও চোখের জলে ।
উৎসর্গ: সরদার আবদুল্লা। যাঁকে কখনও চোখে দেখি নি, তবুও স্নেহ ঠিকই টের পাই ...
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে এপ্রিল, ২০১১ রাত ১১:৫৫