ঝাঁসির রানী লক্ষীবাঈ। অসম সাহসী, হার না-মানা দৃঢ় মানসিক শক্তির অধিকারী এক নারী। ১৮ বছরে বিধবা, ২২ বছরে মৃত্যু ... কিন্তু তারপরও ইতিহাস মনে রেখেছে এই অতুলনীয় নারীকে ... যিনি স্বাধীন ভারত প্রতিষ্ঠার প্রথম পর্বে রেখেছিলেন অসামান্য অবদান, হয়ে উঠেছিলেন স্বাধীনতাকামী ভারতবর্ষের মানুষের প্রেরণার উৎস ...
মানচিত্রে ব্রিটিশ ভারত। ভারতবর্ষে মুসলিম শাসন এবং ব্রিটিশ শাসনের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। মুসলিমরা বহিরাগত হলেও পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছিল, যে কারণে হিন্দুস্তান হয়ে উঠেছিল তাদের মাতৃভূমি। অপরদিকে বিটিশদের মনোভাব ছিল অত্যন্ত সংকীর্ণ ... তারা ভারতবর্ষকে ভেবেছে উপনিবেশ, এবং ভারতের জনগনকে ভৃত্য। সঙ্গত কারণেই সেই কায়েমী স্বার্থবাদী প্রভূত্বের বিরুদ্ধে রুখে উঠেছিল ভারতবর্ষের সংগ্রামী মানুষ ... যার নেতৃত্বে ছিলেন লক্ষীবাঈয়ের মতো অনন্য সাহসী নারীরা ...
১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ১৯ নভেম্বর বারানসীর কাসি তে রানী লক্ষীবাঈ-এর জন্ম । বাবার নাম মরোপান্ত তামবে এবং মায়ের নাম ভগিরথীবাঈ। এরা ছিল মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মন, পেশায় রাজপুরোহিত। এরা কন্যার নাম রেখেছিলেন মনিকার্নিকা। অবশ্য আদর করে ডাকতেন মানু।
মনিকার্নিকা। (১৮৫৫ সালের ছবি। ) পরবর্তীকালের লক্ষীবাঈ।
মেয়েবেলায় মানু মিশুক এবং সুন্দর দেখতে ছিল বলে আত্বীয়স্বজনেরা ওকে ‘চামেলি’ বলেও ডাকত । শিক্ষাদীক্ষা অবশ্য ঘরেই হয়েছিল মানুর। চার বছর বয়েসে মা মারা যায়। বলতে গেলে বাবার কাছেই মানুষ। বাবা মরোপান্ত তামবে বিথুরেরর পেশোয়া দরবারে চাকরি করতেন। বিথুর জায়গাাটা উত্তর প্রদেশের কানপুর শহরের কাছে। (ক্রিকেটের কারণে কানপুর শহরটি তো আমাদের অজানা নয়। ) ...যাক। বিথুর- এর শাসক ছিলেন রাজা বাজী রাও পেশওয়া। মানু ছিল রাজার চোখের মনি। রাজা মানুকে ‘ছাবেলি’ বলে ডাকতেন । পরবর্তীকালে এই ছাবেলিই হয়ে উঠেছিল অসম সাহসী এক নারীযোদ্ধা।
যাক। এরপর মানুর বাবা মরোপান্ত তামবে ঝাঁসির মহারাজার দরবারে যোগ দিলেন।
মানুর বয়স তখন ১৩।
মানচিত্র ঝাঁসি। এই ঝাঁসিই হয়ে উঠেছিল রানী লক্ষীবাঈ-এর কর্মক্ষেত্র। ঝাঁসিকে তিনি ইতিহাসের পৃষ্টায় অনন্য মর্যাদায় স্থান দিয়েছেন ... ঝাঁসি আর লক্ষীবাঈ যেন অভিন্ন ...আজও ব্রিটিশবিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলন শেষ হয়নি, আজও ঝাঁসির প্রেরণা ফুরোয়নি ...
ঝাঁসির মহারাজার নাম রাজা বাল গঙ্গাধর রাও নিউওয়ালকার। রাজার সঙ্গে বিয়ে হল মানুর। যদিও স্বামীর সঙ্গে বয়েসের ফারাক ছিল চল্লিশ বছর। বিয়ের সময় মানুষ বয়স ১৪ বছর। যা হোক। রাজা মানুর নতুন নাম দিলেন- লক্ষীবাঈ।
ঝাঁসির মহারাজা রাজা বাল গঙ্গাধর রাও নিউওয়ালকার। ইনিই নবপরিণীতা স্ত্রীর নাম বদলে রেখেছিলে লক্ষীবাই। এ নামেই পরিচিত হয়ে উঠেছিলে মানু ...
ঝাঁসির রাজদরবারে মরোপান্ত তামবের প্রভাব ছিল। কাজেই লক্ষীবাঈ স্বাধীনতা ভোগ করত, কেবল অন্দরমহলে আটকে ছিল না। অশ্বারোহনসহ তীরধনুক শিক্ষা করতেন নিয়মিত। এমন কী ঘনিষ্ট সহচরীদের নিয়ে খেলাচ্ছলে গড়ে তুলেছিলেন সৈন্যের দল। তখন কে জানত ... এ অভিজ্ঞতা একদিন বাস্তব সমরে কাজে লাগবে!
লক্ষীবাই।
১৮৫১ সালে লক্ষীবাই একটি পুত্রসন্তান প্রসব করেন। রাজা সে পুত্রের নাম রাখেন দামোদর রাও। রাজা অসম্ভব ভালোবাসতেন পুত্রকে। যদিও শিশুটি মারা যায়। রাজা শোকগ্রস্থ হয়ে পড়েন। অসুখে পড়েন। যা হোক। রাজা আনন্দ রাও নামে একটি শিশুকে দত্তক নেন । পরে অবশ্য শিশুটির নাম রাখা হয়েছিল দামোদর রাও । যাহোক। ২১ নাভেম্বর ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে ঝাঁসির মহারাজা রাজা বাল গঙ্গাধর রাও নিউওয়ালকার মারা যান।
সতীদাহ প্রথা। ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে নির্মম প্রথাটি ব্রিটিশরা বাতিল করে। নইলে স্বামীর সঙ্গে লক্ষীবাঈকে সহমরণ যেতে হত। অথচ এই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধেই লক্ষীবাঈকে রুখে দাঁড়াতে হয়েছিল। একে কি বলা যায়?
আনন্দ রাও যেহেতু ঝাঁসির রাজপরিবারের রক্তের সন্তান ছিল না সে হেতু তৎকালীন গর্ভনর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি প্রবর্তিত Doctrine of Lapse ( বাংলা মনে পড়ছে না) অনুযায়ী ঝাঁসি ব্রিটিশ প্রশাসনের নিয়ন্ত্রনে চলে যায়। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে লক্ষীবাঈকে ৬০,০০০ রুপি পেনশন দেওয়া হয় এবং তাঁকে ঝাঁসির দূর্গ ত্যাগ করতে বলা হয়।
গর্ভনর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি। ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে স্কটল্যান্ড ক্যাসলে জন্ম গ্রহন করেন। পড়াশোনা করেছেন অক্সফোর্ডে। ২৫ বছর বয়েসে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য হন। ১৮৪৮ সালের ১২ জানুয়ারি ভারতের গর্ভনর জেনারেল নিযুক্ত হন। এরপর ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দ অবধি - এই ৮ বছর ভারত শাসন করেন। এ সময় কুখ্যাত Doctrine of Lapse নীতি অনুযায়ী প্রকৃত উত্তরাধিকারী না থাকলে রাজ্যটি ব্রিটিশদের অধীন হয়ে পড়ত। এই ডকট্রিন অভ ল্যাপস- এর কারণেই ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষে সিপাহী বিপ্লব সংগঠিত হয়।
লক্ষীবাঈ পেনশন ভাতা প্রত্যাখ্যান করে ব্রিটিশ আইনবিদের সঙ্গে পরামর্শ করা সিদ্ধান্ত নেন। পরে লন্ডনের আদালতে শুনানীর জন্য মামলা দায়ের করেন। ব্রিটিশ আলাদত ভারতবর্ষের নেটিভদের আবেদন শুনবে কেন! তারা রানীর আপিল খারিজ করে দেন। রানীকে ঝাঁসি দূর্গ পরিত্যাগ করতে বলা হল। কিন্তু ঝাঁসিকে মুক্ত রাখতে দৃঢ় শপথ নিলেন লক্ষীবাঈ। এবং রানীর সামনে এক অভূতপূর্ব সূযোগ চলে আসে। কেননা, ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষজুড়ে ব্রিটিশবিরোধী সিপাহী বিপ্লব আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
ঝাঁসি দূর্গ । লক্ষীবাঈ এখানেই ব্রিটিশবিরোধী প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন।
ঝাঁসি দূর্গ । আজও এ দূর্গের প্রতিটি পাথর যেন সেই গৌরব এবং আত্মত্যাগের কথাই বলে ...
১৮৫৭ সালে ১০ মে। মিরাট-এ সিপাহী বিপ্লবের আগুনের সর্ব প্রথম স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠেছিল । আগেই বলেছি, সিপাহী বিপ্লবের অন্যতম কারণ ছিল ডালহৌসির কুখ্যাত ‘ডকট্রিন অভ ল্যাপস’। কারণ, স্থানীয় রাজার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার ফলে ভারতীয় সিপাহীরা চাকরি হারাচ্ছিল। ফলে চাকরিচ্যূত সিপাহীদের মধ্যে বাড়ছিল হতাশা এবং ক্ষোভ।
১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের সিপাহী বিপ্লব। সে সময় একটি গুজব ছড়িয়েছিল ... ব্রিটিশ সৈন্যদের ব্যবহৃত এনফিল্ড রাইফেলের নতুন বুলেট শূকর-এর চর্বি দিয়ে মোড়ানো। ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীতে ভারতীয় নেটিভরা ছিল। মুসলিম সৈন্যদের শূকর নিষিদ্ধ। যা হোক। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ নতুন বুলেট নিষিদ্ধ করে। এবং সৈন্যবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার উদ্যেগ গ্রহন করে। যদিও সিপাহীরা বহু সংখ্যক ব্রিটিশ সৈন্য এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারীদের হত্যা করে।
সিপাহী বিপ্লব অন্যতম কেন্দ্র হয়ে ওঠে ঝাঁসি । রানী লক্ষীবাঈ বিক্ষুব্দ সৈনিকদের ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংহত করতে থাকেন। অন্যান্য স্থানীয় রাজাদের সাহায্য কামনা করেন।
ভারতবর্ষের মানচিত্রে ঝাঁসির অবস্থান
রানী লক্ষীবাঈ নিয়মিত সৈন্যের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবকদের সমন্বয়ে প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তুলতে থাকেন। যে সৈন্যবাহিনীতে নারীরা যোগ দিয়েছিল। অভিজ্ঞ সেনাধ্যক্ষরা রানীর পাশে দাঁড়াল।
রানীর প্রতি পরবর্তী কালের ভারতীয় স্থপতির শ্রদ্ধা
স্যার হিউ রস- এর নেতৃত্বে ১৮৫৮ সালের জানুয়ারি মাসে ব্রিটিশ সৈন্যরা ঝাঁসির অভিমূখে এগুতে থাকে। রানী অত্যন্ত কার্যকরী এক প্রতিরক্ষা গড়ে তোলেন। ব্রিটিশরা ঝাঁসি অবরোধ করে। ২ সপ্তাহ ধরে চলে সংঘর্ষ। ব্রিটিশরা ঝাঁসি দূর্গে ভয়াবহ গোলা বর্ষন করতে থাকে । (এটি ব্রিটিশরা এখনও করে যাচ্ছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। এখন করছে লিবিয়ায়। অবশ্য এ কথা বলার মানে এই নয় যে আমি গাদ্দাফির পক্ষে ... ) ...যাক। ঝাঁসি অবরোধকালে নারীরা সৈন্যদের জন্য খাদ্য ও অস্ত্রবহন করে। স্বয়ং রানী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার তত্ত্বাবধান করেন। অবশ্য মাত্র ১,৫৪০ সুশৃঙ্খল সৈন্য নিয়ে ব্রিটিশরা ঝাঁসি দখল করে নেয়। রানী পুরুষের ছদ্মবেশে রাতে অন্ধকারে সেই দত্তক পুত্রটিকে নিয়ে দেওয়াল টপকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন, যে ছেলেটিকে ঝাঁসির সিংহাসনে বসানোর জন্য জীবন বাজী রেখেছিলেন।
ব্রিটিশরা ঝাঁসি জয় করে বাবা মরোপান্ত তামবে কে ফাঁসি দেয়! এবং রাজ্যটিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে সংযুক্ত করে।
ভারতবর্ষের মানচিত্রে গোয়ালিয়রের অবস্থান । রানী লক্ষীবাঈ এখানেই নিহত হন।
লক্ষীবাঈ কালপি নামক স্থানে শিবির স্থাপন করেন। অন্যান্য বিদ্রোহীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়। ...এর মধ্যে অন্যতম ছিলেন তাতয়া তোপি। যা হোক। ব্রিটিশরা ঘিরে ফেলছিল। আর যুদ্ধ করে জেতা সম্ভব হচ্ছিল না। ব্রিটিশরা উন্নত প্রযুক্তির অধিকারী। বিজ্ঞানকে তারা ব্যবহার করেছে মারণাস্ত্র তৈরির কাছে।
... ঐ বছরই ১৭ জুন লক্ষীবাঈ গোয়ালিয়র যুদ্ধে নিহত হন।
তিনি পুরুষবেশে ছিলেন। তাঁর অনুগত সৈন্যরা মৃতদেহটি গোপনে সরিয়ে ফেলে দ্রুত চিতায় তুলে দেয়। কেননা, ব্রিটিশ সৈন্য কর্তৃক লাঞ্ছিত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। লক্ষীবাঈ সম্বন্ধে এক ইউরোপীয় উৎসে বলা হয়েছে ...
Because of her bravery, courage, and wisdom, and her progressive views on women's empowerment in 19th century India, and due to her sacrifices, she became an icon of Indian independence movement. The Rani was memorialized in bronze statues at both Jhansi and Gwalior, both of which portray her on horseback.
শিল্পীর চোখে অশ্বারোহী রানী। রানী লক্ষীবাঈকে নিয়ে লেখা হয়েছে অজস্র গল্পকাহিনী আর আঁকা হয়েছে অজস্র ছবি ...
রানীর প্রতি ভারতবর্ষের শ্রদ্ধা
তথ্যসূত্র:
Click This Link
Click This Link
http://en.wikipedia.org/wiki/Rani_Lakshmibai
ছবি: ইন্টারনেট