বিশ্বের সবচে প্রাচীন সভ্যতা কোনটি? এই প্রশ্নটি প্রায়ই উঠে আসে। প্রত্নতাত্ত্বিকগন মনে করেন- বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা মেসোপটেমিয়ার সুমেরিয় সভ্যতা । যে সভ্যতার সময়কাল ৪০০০খ্রিস্টপূর্ব থেকে ২০০০ খ্রিস্টপূর্ব। সুমেরিয় সভ্যতা গড়ে উঠেছিল বর্তমান ইরাকের দক্ষিণে । সুমেরিয় সভ্যতা মূলত নগর সভ্যতা। এবং নগর ও সভ্যতার সংযোগ ঘনিষ্ট।
মানচিত্রে প্রাচীন সুমের
সুমের নামটি দিয়েছিল আক্কাদিয়রা। এরা সুমেরিয়দের পরে মেসোপটেমিয়া শাসন করেছিল। আক্কাদিয়রা সেমেটিক, অর্থাৎ নুহ নবীর পুত্র শেম এর বংশধর। আক্কাদিয় সম্রাট সারগন খ্রিস্টপূর্ব ২৩ শতকে সুমের জয় করেছিলেন। আক্কাদিয় ভাষায় সুমের অর্থ: ‘কালো মাথাওয়ালা মানুষ।’ প্রাচীন হিব্র“ভাষীরা ইউফ্রেতিস ও ট্রাইগ্রিস নদীর একেবারে দক্ষিণ প্রান্তের অংশকে বলত ‘শিনার’। কারও কারও মতে ‘শিনার’ শব্দ থেকে সুমের শব্দটির উৎপত্তি।
সুমেরিয় রিলিফ।
সুমেরিয় সভ্যতা ছিল নগর সভ্যতা। নগর গড়ে ওঠার পিছনে সূত্রটি এরকম: Hunters/gatherers became farmers, and farmers became lawmakers and artisans, who transformed scattered villages into civilized cities.
সুমের সভ্যতার ক্ষেত্রেও তাইই হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেতিস নদীর দক্ষিণে উর্বল পলল ভূমিতে সুমেরিয় সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। কিন্তু সুমেরিয়রা কোথা থেকে এসেছিল?
এসেছিল ডিলমুন থেকে।
কোথায় ডিলমুন?
বাহরাইন।
বাহরাইনের মানচিত্র। লক্ষ করুন-উত্তরে ইরাক। বর্তমান ইরাকের দক্ষিণে সুমেরিয় সভ্যতা গড়ে উঠেছিল।
ইরাকের দক্ষিণে উবাইদ নামে একটি গ্রাম আছে। সেই গ্রামে সবচে প্রাচীন সুমেরিয় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। কাজেই আদি সুমের সংস্কৃতি গড়ে তুলেছি উবাইদরা। (বর্তমান বাহরাইন থেকে এরাই দক্ষিণ ইরাকে এসে বসতি গড়ে তুলেছিল) উবাইদ সংস্কৃতির সময়কাল ৫৯০০ থেকে ৪০০০ খ্রিস্টপূর্ব। কুড়ি শতকে উবাইদে খনন কাজ আরম্ভ হয়। তবে এদের সম্বন্ধে বেশি জানা যায়নি। উবাইদরা বাস করত ইরিদু নগরে। সে নগরের আয়তন ছিল ১০০ একরের মতো, জনসংখ্যা কয়েক হাজার। কাজেই ইরিদুকে ঠিক নগর বলা যায় না। তারা বাড়িঘর বানাত কাদা দিয়ে। উপাসনালয় এবং দেবদেবীর মূর্তি গড়েছিল। ১২ টি উপাসনালয় চিহ্নিত করা গেছে। আদি সুমের সমাজে কোনও ধরণের সামাজিক বৈষম্য ছিল না। প্রত্নতত্ত্ববিদগন ইরিদু নগরের সমাধি পর্যবেক্ষণ করে এ সিদ্ধন্তে উপনীত হয়েছেন ।
উবাইদ মৃৎপাত্র। সময় ৪০০০ খ্রিস্টপূর্ব। তার মানে আজ থেকে ৬০০০ বছরের পুরনো তৈজষ। ভাবলে অবাক হতে হয়।
সুমের সভ্যতার প্রথম নগর উরুক। উরুকের অবস্থান ছিল ইরিদু নগরের ৫০ মাইল উত্তরে। মনে রাখতে হবে-খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দে ইরিদু এবং উরুব নগরের অনেক কাছে ছিল পারস্য উপসাগর । যে কারণে আদি সুমের সভ্যতায় সামুদ্রিক প্রভাবের কথা ভাবা যেতে পারে। উরুক নগরের উল্লেখ ওল্ড টেস্টামেন্টে রয়েছে, উরুক কে বলা হয়েছে- ‘ইরেখ’। উপরোন্ত, উরুক ছিল কিংবদন্তীর বীর গিলগামেশ এর নগর। খ্রিস্টপূর্ব ২৩ শতকে আক্কাদিয় বীর সারগন উরুক- এর রাজা লুগালযাজেসি কে পরাজিত করে সমগ্র মেসোপটেমিয়া জয় করেছিলেন। উরুক নগরের জনসংখ্যার আধিক্য ছিল। উচুঁ প্রাচীর বেষ্টিত নগরটিতে ছিল বহু কক্ষ বিশিষ্ট কাদার তৈরি দ্বিতল ভবন। সমগ্র মেসোপটেমিয়া থেকে ভাগ্যান্বষণে কারুশিল্পী, ভাস্কর, বণিক ও পুরোহিত উরুক নগরে আসত।
উরুক। খনন কার্য চলছে।
কালক্রমে সুমেরে অনেকগুলি নগর গড়ে উঠেছিল। কয়েকটি সুমেরিয় নগরের নাম:
(১) ইরিদু। (২) উরুক। (৩) উর। (৪) লারসা। (৫) কিশ। (৬) নিপপুর। (৭) সিপপার।
(৮) লাঘাশ।
এই নগররাষ্ট্রগুলি ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম। খিস্ট্রপূর্ব ২০০০ অবধি কোনও ঐক্য গড়ে উঠেনি। নগররাস্ট্রগুলি একে অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করত। তবে সুমেরের অভিন্ন শক্র- উত্তরের আক্কাদ ও পূর্বের ইলাম রাজ্যে বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করত।
উর নগর। এই ছবিটি দেখে তৎকালীন সুমের সভ্যতার নগর সম্বন্ধে মোটামুটি একটি ধারণা পাওয়া যায়। নগর ঘিরে ছিল সুউচ্চ নগরপ্রাচীর। নগরপ্রাচীরের রক্ষনাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল রাজার । নগরের মাঝখানে উপাসনালয়।
কৃষিভূমির কাছাকাছি সুমেরিয় নগররাষ্ট্রগুলি গড়ে উঠেছিল। সুমেরিয়রা বার্লি, গম, খেজুর ও সবজি চাষ করত। সেই সঙ্গে গরুছাগল ভেড়া ও গাধা পালত। ভেড়ার পশম দিয়ে তৈরি করত পোশাক । কৃষিকাজের পাশাপাশি সুমেরবাসী ব্যবসা করত। পারস্য উপসাগরীয় রাজ্যগুলি সঙ্গে তাদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল। ওখান থেকে হাতির দাঁত ও অন্যান্য বিলাস সামগ্রী আনত। সুমেরিয়রা ব্রোঞ্জের ব্যবহার শিখেছিল, পাশাপাশি সোনা ও রূপার অলঙ্কারও ব্যবহার করত। মৃৎপাত্র তৈরি করতে শিখেছিল । ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বের দিকে পাথর মসৃন করার কৌশল রপ্ত করেছিল, ফলে পাথরের মূর্তি নির্মাণ সহজ হয়েছিল।
সুমেরিয় মুখোশ
সুমেরের সামাজিক কাঠামো ছিল সমসাময়িক অন্যান্য সমাজের তুলনায় ব্যাতিক্রমী। সুমেরিয় নগরবাসীর জীবন ছিল উপাসনালয়কেন্দ্রিক এবং নগরের শাসক ছিল পুরোহিতশ্রেণি। পরে অবশ্য পুরোহিতশ্রেণির ক্ষমতা হ্রাস পায়, এবং রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে যোদ্ধাশ্রেণির কর্তৃত্বও বৃদ্ধি পায়। যা হোক। প্রথমদিকে নগরের নাগরিকদের মনে করা হত দেবতার ভৃত্যদাস। জীবনের অনিশ্চয়তা পুরোহিতশ্রেণির অবস্থানকে সুদৃঢ় করেছিল। দুর্যোগ দেখা দিলে পুরোহিতরা অন্য দেবতাকে দুষতেন। নাগরিকরা তাদের জীবন রক্ষার জন্য দেবতার বেদি প্রাণ উৎসর্গ করার শপথ করত। নাগরিকরা ছিল উপাসনালয়-স¤প্রদায়। যোদ্ধা-সৈন্যরা এদের রক্ষা করত। কারুশিল্পীরা পন্য তৈরি করত উপাসনালয় এবং যোদ্ধা-সৈন্যদের জন্য।
সুমেরিয় নগররাষ্ট্র গুলি ইউফ্রেতিস এবং টাইগ্রিস নদীর পাড়ে গড়ে উঠত
সুমেরিয়দের বিশ্বাস ছিল- দেবতাদের আনন্দ দিতেই তাদের বেঁচে থাকা। তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের সরূপটি ছিল বহু ঈশ্বরবাদী। যেমন, এন ছিলেন স্বর্গের দেবতা, এনকি পানির, কি ছিলেন পৃথিবীর, বাতাসের দেবতা ছিলেন এনলিল, মাতৃদেবী ইশতার ছিলের শিকার ও উর্বরা শক্তির দেবী। নাননা ছিলেন চন্দ্রদেবতা।
জিগুরাট। এই ছবির দিকে তাকালে সুমেরিয়দের ধর্মীয় বোধের পাশাপাশি গাণিতিক জ্ঞানের পরিচয়ও পাওয়া যায়।
এই দেবদেবীরাই নাকি সুমেরের রীতিনীতি তৈরি করেছিলেন-যা সুমেরবাসী মানতে বাধ্য ছিল। সুমেরিয় উপাসনালয়ের নাম জিগুরাট। এক এক নগরে এক এক দেবতার অধিষ্ঠান ছিল। যেমন, উর নগরে জিগুরাটটিতে চন্দ্রদেবতা নাননার আরাধনা হত।
সুমেরিয় দেবতা
প্রাচীন সুমেরিয়রাই আবিস্কার করেছিল লিখন পদ্ধতি। নিপপুর নগরের কথা উল্লেখ করেছি। সে নগরে খনন কার্য চালিয়ে প্রতœতাত্ত্বিকরা কয়েক হাজার লিপিফলক (ট্যাবলেটস) আবিস্কার করেছেন। অনুমান করা হয় সুমেরিয়ায় প্রাথমিক লিখনী আরম্ভ হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩,৫০০ নাগাদ। লিখন পদ্ধতি মানে- কোনও বিষয়ের ছবি এঁকে অর্থ বোঝানো হত। যেমন, হাত পা মাথা কিংবা গরু ভেড়া ছাগল। তবে পরে অবশ্য বর্ণমালায় প্রতীকি শব্দ যুক্ত হয়। ভেজা কাদায় কাঠি ঢুকিয়ে ছবি আঁকা হত।
নীচের ভিডিওটি সুমেরিয় লিখন পদ্ধতি বুঝতে সাহায্য করবে।
সুমেরিয় লিখন পদ্ধতি।
খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ নাগাদ সুমেরিয়দের কৃষিজমিতে লবণাক্ততার সমস্যা তৈরি হয়েছিল। উদ্বায়ী পানি কৃষি জমিতে নুনের স্তর ফেলত। আর ফেঁপে ওঠা পানির কারণে কৃষিজমিতে আরও লবন জমত। কাদায় তৈরি ফলকলিপিতে সুমেরিয়রা লিখেছিল: পৃথিবী সাদা হয়ে উঠছে। গম লবণ আদপেই সহ্য করে না। যব কিছু হলেও করে। যে কারণে কাদায় তৈরি ফলকলিপিতে সুমেরিয়রা লিখেছিল: আমাদের খাদ্যাভাস পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। পরে লবণাক্ত জমিতে বার্লিও আর তেমন জন্মাত না। সুমেরিয়বাসী মুখোমুখি হল ক্ষুধার। ভুগল অপুষ্টিতে, ভুগল রোগে। সুমের দূর্বল হয়ে পড়ল।
মানচিত্র। সুমের। উত্তরে আক্কাদ রাজ্য
খ্রিস্টপূর্ব ২৩ শতকে সুমেরের উত্তরে আক্কাদ রাজ্যের উত্থান ঘটছিল। কিশ নগরে সেমেটিকরা শাসন করছিল। ২২০০ অব্দে এ রকম এক শাসকের পেয়ালাবাহক সে শাসককে উৎখাত করে আক্কাদিয় রাজ্য বিস্তার করে। নিপপুরে সুমেরিয় রাজাকে পরাস্ত করে। নিপপুর নগরের দেবতা ছিলেন এনলিল। নিপপুর বিজয়ী দাবি করে- তাঁকে এনলিল সাহায্য করেছেন।
ইনিই আক্কাদিয় সেমেটি সম্রাট সারগন দ্য গ্রেট!
তথ্য নির্দেশ:
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১০ দুপুর ১:০৫