বেশ ক’বছর ধরে একটি বাউল গান শুনছি। চড়া বাউলি সুরের কারণে শ্রবণের মুগ্ধতা তো আছেই, অধিকন্তু cryptic বাণীর জন্যও মনে গভীর ভাবনারও উদয় হয় । মনে হয় যেন গানটিতে হাজার বছরের বাংলার দার্শনিক ভাবনার সারৎসার নিহিত; যে বাংলায় দর্শনকে বলা হয় ‘ভাব’ আর দার্শনিকগন ‘ভাবুক’ নামে পরিচিত। আলোচ্য গানটিতে ‘ভাব’ এবং ‘ভাবুক’- এ দুটি বিষয়েরই উল্লেখ রয়েছে। শুধু তাইই নয়- গানটি যেন বাংলার আধ্যাত্বিক ও মানবিক মতাদর্শের manifesto হয়ে উঠেছে । আমরা জানি যে manifesto তে সাধারণত থাকে একটি ঘোষনা। সে রকম একটি ঘোষনা দিয়েই গানটির সূচনা:
মিলন হবে অন্ধকারে
জাত-অজাতের
কাজ কি রে তোর ল্যাম্ফোর আলোতে?
প্রথমেই social consciousness -এর প্রসঙ্গ; যে সমাজ সচেতনতা বাংলার বাউল গানের একটি অনিবার্য দিক। বস্তুত, সংগীতে সমাজমনস্কতার এরকম বিদগ্ধ নজীর অন্যত্র বিরল। স্মরণ করি লালনের একটি গান:
একটা পাগলামী করে
জাত দেয় অজাতেরে দৌড়ে গিয়ে ...
গানটি উনিশ শতকের মাঝামাঝি রচিত। যে সময়টায় জাতপাতের কঠোর অনুশাসনের পাঁকে আকন্ঠ ডুবে ছিল বাংলার সমাজ; তথাপি মূঢ় সমাজপতিদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সাম্যবাদী বাউলগন ‘অজাতেরে’ জাত দিতে উদ্যত হয়েছিল ; এই হলো বাংলার বাউল গোষ্ঠী তথা বাউল গানের সোসাল কনশাসনেস! আমাদের আলোচ্য গানটিতেও সে কারণে অনিবার্যভাবেই জাতপাতের প্রসঙ্গটি উঠে এসেছে। মিলন হবে অন্ধকারে/জাত-অজাতের ... এ রকম একটি বিস্ময়কর
একটি চরণে সমাজনির্মিত একটি অনাকাঙ্খিত বিভেদের দেয়াল ভাঙার স্পস্ট ইঙ্গিত ফুটে উঠেছে। তথাপি মনে এই প্রশ্নেরও উদয় হয়- আসলে কি এই চরণে সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে মিলনের কথা বলা হয়েছে? নাকি এই চরণটির অন্যতর নিগূঢ় তাৎপর্য রয়েছে? ‘ল্যাম্ফোর আলো’ সম্ভবত মানবসভ্যতা; যে ‘ল্যাম্ফোর আলো’ øিগ্ধ কিরণ বিতরণের পরির্বতে ছড়ায় আর্সেনিক-বিষ! বাউল সভ্যতাকে ‘ল্যাম্ফোর আলো’ বলে তাচ্ছিল্য করেছে, যেটি আমাদের ভাবায়। সভ্যতা নামক কনক্রিটদৈত্যের আগ্রাসনের ফলে মানবাত্মা নিয়ত পিষ্ট হচ্ছে বলেই কি মানবসভ্যতা বাউলের কাছে অনাকাঙ্খিত? মিলন হবে অন্ধকারে ... তা হলে এই অন্ধকার কি প্রাক-সভ্যতার নিওলিথ অন্ধকার? কিংবা ব্রিটিশপূর্ব সবুজ নির্জন জীবনান্দীয় বাংলা? কে বলতে পারে?
পরবর্তীতে আমরা দেখব এই জাত-অজাতের মিলন একটি আধ্যাত্বিক স্তরে উত্তীর্ণ হয়েছে।
অন্ধকারে রূপের পুরী
মিলনে তার কারিকুরি,
যে দেখেছে সেই মাধুরী
সবুরিতে ...
অন্ধকারে কোথাও একটি রূপের নগর রয়ে গেছে। সেটি কি মানুষের অর্ন্তজগৎ? গহন আঁধারে যেখানে আলো ফুটে থাকে? স্মরণ করি লালন এর একটি গান:
কি সন্ধানে যাই সেখানে আমি
মনের মানুষ যেখানে,
আঁধার ঘরে জ্বলছে বাতি
দিবারাত্রি নাই সেখানে ...
‘আঁধার ঘরে জ্বলছে বাতি’ আর ‘অন্ধকারে রূপের পুরী’ কি অভিন্ন ভাবনার প্রকাশ? ‘অন্ধকার’ শব্দটির প্রয়োগ অনিবার্য এক রহস্যময়তার সৃষ্টি করেছে। অন্ধকার ডার্ক ম্যাটারের বিশাল রাজ্যে যেমন সূর্যকেন্দ্রিক এই সৌরজগৎটি আলোয় উদ্ভাসিত, সে রকমই কি অন্ধকারে কোথাও এক রূপের প্রাসাদ রয়ে গেছে? যে রূপের দেশে অন্যতম কৃত্য হল মিলন; এবং সেই মিলনের ফলে উদ্ভূত হয় এক অপার মাধুরীর। কিন্তু কার সঙ্গে মিলন? মনের মানুষের সঙ্গে মিলন। কে সেই মনের মানুষ? লালন বলেছেন, ‘মিলন হবে কত দিনে, আমার মনের মানুষের সনে।’ মনের মানুষের সঙ্গে মিলনই বাউলের মূল সাধনা। বাউলের কেউ কেউ অন্তর জগতে সেই মিলনের মাধুরী-মাধুর্য আস্বাদ করেছে, তবে সে রকম সম্ভব হয়েছে কেবল দীর্ঘ এক সাধনার পরই। সহজে যে সে sublime phenomena-র উদ্ভাসন সম্ভব নয়, তা আমরা বুঝতে পারি। কিন্তু কেন বাউলের এই কঠোর সাধনা দীর্ঘ? হৃদয়কে নির্মল ও সুন্দর করার জন্যই। বাংলার আলীপন্থি মারাফতি একটি গানে এই বিষয়টি প্রকাশিত হয়েছে এভাবে:
দয়াল বাবা কেবলাকাবা আয়নার কারিগর
আয়না বসায়া দে মোর কলবের ভিতর।
হৃদয়ে অধরার ( ultimate reality–র) অস্তিত্ব অনুভূত হলে মানুষ নিজের ক্ষুদ্রতা উপলব্দি পারে। তারপর সেই পরিবর্তিত নতুন মানুষ হয়ে উঠতে পারে সহজ ও সুন্দর।
সহজ মানুষ ভজে দেখ না রে দিব্যজ্ঞানে
পাবি রে অমূল্য নিধি বর্তমানে (লালন)
সহজের সাধনা করলে ব্যাক্তি মানুষের পাশাপাশি সমাজও হয়ে উঠতে পারে যন্ত্রণাশূন্য-সুন্দর।
এই হলো বাংলার বাউলের সাধনার মূল স্বরূপ।
দেখে সে ভাব কইতে মানা
ভাবুক বিনে কেউ জানে না
ভাবেতে হয় লেনাদেনা
ভাবেরই সাথে ...
বাংলা বাউলরা গুপ্ত গোষ্ঠীর সদস্য । বাউলের সাধনা অরূপকে মূর্ত করে উপলব্দি করবার সাধনা বলেই তা গুপ্ত সাধনা। সচরাচর বাউলের উপলব্দি জনসমাজে প্রচার হয় না। তার কারণ, বাউলের সাধনমার্গে আমজনতার হয়তো আগ্রহ নেই, জনস্রোত সেসব বুঝবে না। এ জন্যেই বলা হয়েছে: দেখে সে ভাব কইতে মানা/ ভাবুক বিনে কেউ জানে না। এ কথা তো সত্য যে, ভাব বা philosophy তে একমাত্র ভাবুক বা চিন্তাবিদ ছাড়া কেউই তেমন আগ্রহ বোধ করে না। কিন্তু, ভাবের চর্চা করলে কি হয়? ভাবের চর্চা করলে পরস্পরবিরোধী ideologies কাছাকাছি আসে। ভাবেতে হয় লেনাদেনা ভাবেরই সাথে ..এতে বিরোধ সংঘাতের পরিমান কমে আসে।
কাকা মহসিন অকপটে
বিনাকাজে বেড়াই ছুটে
অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে
ধরেছে ভূতে ...
তখন একবার বলেছি, বাংলায় দর্শনকে বলা হয় ‘ভাব’ আর দার্শনিকগন ‘ভাবুক’ নামে পরিচিত। আলোচ্য গানটিতে ‘ভাব’ আর ‘ভাবুক’- এ দুটি বিষয়ের পরিচয় পাওয়া যায়। এবার ভাবুকের পরিচয়। এ গানের কথক মহসিন বাউল নিজেকে ‘কাকা’ সম্বোধন করে তুমুল রসবোধের পরিচয় দিয়েছেন। তবে বেশ বোঝা যাচ্ছে যে মহসিন বাউল জীবন সম্বন্ধে তত সিরিয়াস নন। কারণ তিনি লিখেছেন: কাকা মহসিন অকপটে / বিনাকাজে বেড়াই ছুটে ...কেন তিনি জীবন সম্বন্ধে সিরিয়াস নন? তিনি কি জীবনের গভীর কোনও উপলব্দিতে পৌঁছে গেছেন? সম্ভবত। তাঁকে অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে ভূতে ধরেছে ...এই অন্ধকার কি কি মানুষের অর্ন্তজগৎ? গহন আঁধারে যেখানে আলো ফুটে থাকে? সে অন্ধকারে একটা কিছু দেখে চমকে উঠেছেন। লালনের একটি গানে আমরা পাই-
যে খানে শাঁইর বারামখানা
শুনিলে প্রাণ চমকে উঠে
দেখতে যেন ভূজঙ্গনা (সাপ) ...
অন্তরে অধরার মূর্তরূপ উপলব্দি করে মহসিন বাউলের জীবনের দায়িত্ব ফুরিয়েছে বলেই জীবন সম্বন্ধে তিনি আর সিরিয়াস নন? হতে পারে। কাকা মহসিন অকপটে / বিনাকাজে বেড়াই ছুটে ...এই চরণটির আরও একটি ব্যাখ্যা সম্ভব। লালন বলেছেন:‘ছাড় ফিকিরি, কর ফকিরি।’ আমি আগেই বলেছি, ‘ল্যাম্ফোর আলো’ সম্ভবত যন্ত্ররাক্ষস মানবসভ্যতা; যাকে বাঁচিয়ে রাখতে নিয়ত ফিকিরি (ধান্ধাবাজী) করতেই হয়। ফিকিরি ছাড়তে বলে লালন খোদ সভ্যতাকেই disable করে দিতে চান নি তো! আমাদের সময়ে উত্তরাধুনিক শিল্পের বলয়ে যেমন ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধীতা’র কথা শোনা যায়-তেমনি? লালন বাংলার বাউলদের রাজা। শিষ্যরা তো তাঁর আদর্শের জিকির তুলবেই।
পুরো গানটি:
মিলন হবে অন্ধকারে
জাত-অজাতের
কাজ কি রে তোর ল্যাম্ফোর আলোতে?
অন্ধকারে রূপের পুরী
মিলনে তার কারিকুরি
যে দেখেছে সেই মাধুরী
সবুরিতে ...
দেখে সে ভাব কইতে মানা
ভাবুক বিনে কেউ জানে না
ভাবেতে হয় লেনাদেনা
ভাবেরই সাথে ...
কাকা মহসিন অকপটে
বিনাকাজে বেড়াই ছুটে
অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে
ধরেছে ভূতে ...
এমপি থ্রি ডাউনলোড লিঙ্ক
Click This Link
উৎসর্গ: জুবেরী।