somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিনজা: সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত

২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০১০ দুপুর ২:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নিনজা। কালো পোশাকে ঢাকা মুখ, কেবল চোখ দেখা যায়, হাতে কাটানা কিংবা কুসারিগামা কি শুরিকেন; চকিতে তার ছায়া সরে যায় পাথুরের প্রাঙ্গনের ওপর, কিংবা মাকড়শার মতো দেয়াল বেয়ে উঠতে দেখা যায়, বেড়ালের মতো লঘুপদে ছাদের ওপরে হেঁটে যায় দ্রুত ...নিচের কোনও ঘরে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে জাপানী সামুরাই যোদ্ধা; তার দেহরক্ষীরা ইতোমধ্যেই নিহত। ... শব্দহীন বেডরুমের দরজা সরে যায় । চাঁদের আলোয় ঝিকমিক করে ওঠে সুতীক্ষ্ম কাটানার ব্লেড। তারপর ...কমিক বই কিংবা নিনজা কার্টুন/মুভিতে এরকম ভয়ানক গা ছমছমে দৃশ্য প্রায়শ চোখে পড়ে। আততায়ী নিনজা যোদ্ধা অতি গোপনে কালো পোশাক পরে প্রতিপক্ষ সামুরাই যোদ্ধাদের হত্যা করছে এমন সুকৌশলে ... যেন নিনজা যোদ্ধার আয়ত্বে রয়েছে হত্যার যাদুকরী শিল্প। এই নিনজা যোদ্ধাই পপুলার কালচারের আইকন হয়ে উঠেছে ...মাঝে মাঝে মনে হয় তার কি ইতিহাস ...




নিনজা।




জাপানের মানচিত্র।জাপানের উত্তর-পুরে চিন। যে বৃহৎ দেশটি সুপ্রাচীন কাল থেকেই জাপানকে নানা ক্ষেত্রে প্রভাবিত করেছে। এমন কী নিনজা যোদ্ধাদের উদ্ভবের পিছনেও রয়েছে কয়েক জন চৈনিক সামরিক কর্মকর্তা ও সন্ন্যাসীদের প্রভাব।

আমরা বলি: নিনজা। জাপানে বলে: শিনোবি। সে যা হোক। আমরা নিনজাই বলব। নিনজা শব্দটির উদ্ভব দুটি চিনা শব্দ থেকে- ‘নিন’ এবং ‘শা’। তবে উচ্চারণে হয়: নিনজা। নিনজা শব্দটিকে জাপানী ভাষায় বলে ‘শিনোবি নো মোনো’। ‘শিনোবি’ এবং ‘নিন’ বলতে বোঝায় গোপন কিংবা শান্ত অ্যাকশন কিংবা যারা সহ্য করতে পারে। ‘শা’ এবং ‘মোনো’ বলতে বোঝায় ব্যাক্তি। এসব মিলিয়ে নিনজা বলতে বোঝায়: যে ব্যাক্তি গোপন শিল্পে দক্ষ কিং বা যে সহ্য করতে পারে।



নিনজা অস্ত্র কাটানা

কিন্তু নিনজার উদ্ভব হল কবে?
তা বলা কঠিন। আসলে নিনজা সম্বন্ধে বহু গল্পগাঁথা প্রচলিত থাকলেও এ নিয়ে বাস্তব ঐতিহাসিক বিবরণ কম। এর কারণ কি? কারণ হয়তো নিনজারা সমাজের নীচু শ্রেণির সদস্য; যে কারণে নিনজাদের নিয়ে জাপানের সাধারণ মানুষের আগ্রহ ছিল কম । বরঞ্চ অভিজাত সামুরাই-র প্রতি আগ্রহ ছিল বেশি। কেননা অভিজাত সামুরাই যোদ্ধাদের কর্মকান্ডের প্রতি লোকের তীব্র আকর্ষন ছিল।



সামুরাই যোদ্ধা।

এ কথা ঠিক যে-গুপ্তচরবৃত্তি ও গুপ্তহত্যা অন্যান্য দেশের মতোই জাপানেও আদি থেকেই ছিল। তবে পঞ্চদশ শতক থেকে জাপানে ভাড়াটে নিনজাদের সক্রিয় হতে দেখা যায়। এরা ছিল মূলত ভাড়াটে খুনি- গুপ্তহত্যা সম্বন্ধে যাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ ছিল।
আসলে সামন্ত জাপানে সামুরাই যোদ্ধাদের প্রতিপক্ষ হিসেবেই নিনজা যোদ্ধাদের উদ্ভব হয়েছিল।
বিষয়টি পরিস্কার করা যাক।
৬৪৬ খ্রিস্টাব্দে জাপানে টাইকা রিফর্ম সম্পন্ন হয়। এর পরেই নিনজাদের উদ্ভব। কেননা টাইকা রিফর্ম এর অর্ন্তভূক্ত ছিল ভূমির নতুন করে বন্টন ও নতুন করারোপ। এর উদ্দেশ্য ছিল চৈনিক সম্রাটের মতন একজন বৃহৎ ও কেন্দ্রিয় শাসক সৃষ্টি করা। টাইকা রিফর্ম-এর ফলে বহু ক্ষুদ্র চাষী জমি বিক্রি করে বর্গা চাষীতে রূপান্তরিত হয়। এবং সেই সঙ্গে জাপান জুড়ে অসংখ্য ভূস্বামীর উদ্ভব হয়। এভাবে মধ্যযুগের ইউরোপের মতো সামন্ত প্রথার উদ্ভব হয়।



সামন্ত জাপান।

ইউরোপের মতোই সামন্তপ্রভূদের সম্পদ রক্ষার জন্য প্রয়োজন হল দক্ষ ও সাহসী যোদ্ধার-এরাই জাপানের ইতিহাসে ‘সামুরাই’ যোদ্ধা হিসেবে খ্যাত। একজন সামন্ত প্রভূদের সঙ্গে অন্য একজন সামন্ত প্রভূর বিরোধ লেগেই ছিল। সামন্ত প্রভূররা প্রতিপক্ষকে হত্যা করতে ভাড়াটে নিনজা যোদ্ধা নিয়োগ করত। এসব নিনজা যোদ্ধারা সামন্ত প্রভূর নির্দেশে কাজ করত। যে কারণে বলা হয়েছে: A ninja or shinobi was a covert agent or mercenary of feudal Japan specializing in unorthodox arts of war. The functions of the ninja included espionage, sabotage, infiltration, and assassination, as well as open combat in certain situations. The ninja, using covert methods of waging war, were contrasted with the samurai, who had strict rules about honor and combat. (উইকিপিডিয়া)




নিনজা অস্ত্র । ডার্ট

অবশ্য নিনজা যোদ্ধাদের আরও একটি দিক রয়েছে। সেটি হল এদের সামাজিক প্রেক্ষাপট ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। ঐতিহাসিক ষ্টিভেন হায়েস লিখেছেন: জাপানের সামুরাই যোদ্ধা ভিত্তিক সামাজিক রাজনৈতিক ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াসরূপ নিনজা যোদ্ধাদের উদ্ভব। এবং যারা এই নতুন গতিশীল শিল্পের সমর্থক তারা ছিল যোদ্ধা, অভিবাসী ও কৃষক। অত্যাধিক করারোপ করা হলে সামন্ত প্রভূর লোভী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিনজা-কৌশলে আক্রমন করা হত। কেননা, নিনজাদের শিকড় প্রোথিত ছিল গ্রামীন দরিদ্র কৃষি স¤প্রদায়ে। কাজেই নিনজারা লক্ষ অর্জনে ছিল মরিয়া। তবে সম্ভব হলে এরা বিরোধ এড়িয়ে চলত। যদি লক্ষ অর্জনে রক্তপাত প্রয়োজন না হয় তো রক্ষপাত করত না।
এখন প্রশ্ন এই-জাপানে নিনজা সমরকৌশলের উদ্ভব হল কী ভাবে?
এখন এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক।
৮৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে চিনের তাঙ শাসনামলে চিন জুড়ে দেখা দেয় চরম বিশৃঙ্খলা। ৯০৭ খ্রিস্টাব্দে পতন হয় তাঙ বংশের । এরপর চিন ৫০ বছরের জন্য চিন জুড়ে ব্যাপক অরাজকতা চলতে থাকে। সে সময় বেশ ক’জন তাঙ সেনাপতি সমুদ্রপথে জাপানে চলে আসে। এবং এরা জাপানের ইগা ও ওকা পাহাড়ে বসতি স্থাপন করে। এদের সঙ্গে ছিল নতুন রণকৌশল ও যুদ্ধদর্শন। ষষ্ট শতকে সুন জু নামে একজন চৈনিক সমরবিদ ‘আর্ট অভ ওয়ার’ নামে একটি গ্রন্থ লিখেছিলেন। এই বইটি নিনজা সমরকৌশলকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।




ইগা ও ওকা পাহাড়াড়ের উপত্যকাই নিনজার জন্মভূমি।

নবম ও দশম শতকের দিকে চৈনিত সন্ন্যাসীরাও জাপানে আসতে থাকে । তাদের সঙ্গে ছিল ভেষজ ও যুদ্ধ দর্শন। জাপানের যোদ্ধা সাধুরা সেসব শিখে। এরাই প্রথম নিনজা গোত্র। এদের যুদ্ধ কৌশলকে বলা হত নিনজুৎসু। এর অন্তর্গত হল কারাতে বা মার্শাল আর্ট, রণকৌশল, অপ্রথাগত যুদ্ধের কৌশল এবং গেরিলা যুদ্ধ। এই নিনজুৎসু থেকেই নিনজাদের যুদ্ধবিদ্যা উদ্ভব হয়েছিল। মনে রাখতে হবে জাপানে সামন্ত প্রভূদের অর্ন্তবিরোধ অব্যাহত ছিল অষ্টাদশ শতক অবধি।



নিনজা অস্ত্র । কুসারিগামা

নিনজাদের দক্ষতা নিখুঁত ও নানা ধরনের হত। মার্শাল আর্ট বাদেও নিনজাদের বেঁচে থাকার কৌশল রপ্ত করতে হত। এছাড়া নিনজাদের দর্শন, আবহাওয়াবিদ্যা, মনোবিজ্ঞান, ভূগোল, অভিনয়, গুপ্তচরবিদ্যা এবং সমরবিদ্যাও রপ্ত করতে হত। পরিস্থিতি বুঝে তারা হালকা ও উপযুক্ত অস্ত্র ব্যবহার করত। যেমন উপরে ওঠার যন্ত্র। এছাড়া ব্লেড, চেইন, দড়ি, বিষ ও পাউডার ইত্যাদি সঙ্গে রাখত। সিনেমায় নিনজাদের কালো পোশাক দেখালেও রাত্রির অভিযানের জন্য নিনজারা নেভি ব্লু রঙের পোশাক পরত। আসলে নিনজাদের পোশাক নির্ভর করত অপারেশনের ধরনের ওপর।



নিনজা অস্ত্র । শুরিকেন

জাপানে ইডো যুগে (১৬০৩-১৮৬৮) জাপানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসে এবং সামন্তবাদ অবক্ষয়ের পর জাপানে আধুনিকতা সূচিত হতে থাকে। ফলে নিনজা অধ্যায়েরও সমাপ্তি ঘটে। যদিও আজও কমিক বইয়ে কি চলচ্চিত্রে নিনজারা বহাল তবিয়তেই টিকে রয়েছে।



টিন এজ মিউটান্ট নিনজা টারটেল। অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি নিনজা কার্টুন।


তথ্য ও ছবি: ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০১০ বিকাল ৩:৩৩
৩৫টি মন্তব্য ৩৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×