শেখ সাদী। ইরানের প্রধানতম কবি। সময়কাল? ১১৮৪-১২৮৩ খ্রিস্টাব্দ কিংবা ১২৯১ খ্রিস্টাব্দ; শেখ সাদীর পুরো নাম আবু মুহাম্মাদ মুশলিহ আল-দিন বিন আবদেল্লা শিরাজী। দীর্ঘদিন ধরেই সাদী বাঙালি সমাজের এক অতি প্রিয় কবি। কেবল বাঙালিরই নন, বিশ্বজুড়েই সাদী অত্যন্ত জনপ্রিয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২০০৯ সালের মার্চ মাসে ইরানের জনগনকে ‘সাদীর লেখা থেকে উদ্ধৃত করে’ নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন:'The children of Adam are limbs to each other, having been created of one essence.' এই কারণে সাদী কেবলই কবি নন, মানবতাবাদী সমাজ চিন্তাবিদ হিসেবও বিশ্বজুড়ে পরিচিত। এসব কারণেই সাদী চর্চা জরুরি বলেই মনে হয় ...
ইরানের মানচিত্র; শেখ সাদীর সময়কালে, অর্থাৎ, ত্রয়োদশ শতকে ইরান পারস্য বা পারসিয়া নামে পরিচিত ছিল। এর কারণ আছে। প্রাচীন পারস্যে ছিল আর্য জাতির বাস। ‘পারস’ ছিল প্রাচীন আর্য জাতির এক গোষ্ঠীর নাম। পারস থেকেই পারস্য। আর আরইরান শব্দটি এসেছে আর্য শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘আরিয়ান’ থেকে।
ইরানের মানচিত্রে শিরাজ শহরের অবস্থান। শিরাজ শেখ সাদীর জন্ম দিয়ে আজও ধন্য হয়ে আছে ...শিরাজ শব্দটি বাংলাদেশেও অত্যন্ত পরিচিত। লালন শাহের গুরু ছিলেন সিরাজ শাঁই।
শিরাজ এর প্রাকৃতিক দৃশ্য। এরকম মনোরম জল ও সবুজের সমন্বয় কবির কিশোর মনকে রাঙিয়ে তুলেছিল নিশ্চয়ই।
সাদীর বাবার মৃত্যু সাদীর শিশু বয়েসে ঘটেছিল। আর কবির ছেলেবেলা কেটেছিল বাংলার কবি নজরুলের মতোই হা-হা অভাবে। কবি বলেই সাদীর জ্ঞান তৃষ্ণা ছিল প্রবল। দারিদ্র কে অগ্রাহ্য করে নজরুলের মতো বলেছেন,
হে দারিদ্র, তুমি মোরে করিয়াছ মহান
তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রিস্টের সম্মান ...
তরুণ বয়েসে কবিটি জ্ঞান অর্জনের জন্য গেলেন বাগদাদ। বাগদাদই তখনকার দিনের এম.আই. টি- ক্যালটেক। বাগদাদের সুবিখ্যাত ‘আল নিজামিয়া’ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লেন ১১৯৫ থেকে ১২২৬ খ্রিস্টাব্দ অবধি।
তা কি কি পড়লেন আমাদের মেধাবী কবিটি?
শারিয়া, আলকেমি, গভরমেন্ট, হিস্টোরি, এ্যারাবিক লিটরেচর অ্যান্ড থিওলজি।
শিল্পীর আঁকা মধ্যযুগের শিক্ষক ও ছাত্ররা
দ্বাদশ শতক মধ্য এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য ছারখার করেছিল নিমর্ম মঙ্গোলরা। সাদী দিশেহারা। কেন এই অহেতুক নিষ্ঠুরতা? মানুষ কি তবে আশরাফুল মাখলুকাত নয়? আল্লা কি নিষ্ক্রিয় শক্তি? না তিনি হস্তক্ষেপ করেন?
মঙ্গোল তরবারীর আঘাতে ফেটে যাচ্ছে মধ্য এশিয়ার শিশুদের কোমল খুলি।
মঙ্গোল তরবারীর আঘাতে ফেটে যাচ্ছে মধ্য এশিয়ার শিশুদের কোমল খুলি।
মঙ্গোল তরবারীর আঘাতে ফেটে যাচ্ছে মধ্য এশিয়ার শিশুদের কোমল খুলি।
এসব ভেবেই কবি দিশেহারা।
কি করবেন? দুধর্ষ মঙ্গোলরা মধ্য এশিয়ার খোওয়াইজম নগর ও পারস্য আক্রমন করেছে। জন্মভূমিতে ফেরাও যাচ্ছে না। কী আর করেন ... বাগদাদ ত্যাগ করে পথে নামলেন। তারপর ৩০ বছর ধরে এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ালেন। এতে কবির লাভই হয়েছিল। জন্মসূত্রে পাওয়া জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সঙ্গে এবার মিশল অভিজ্ঞতার তাপদাহ স্বর্ণশিখা...
মঙ্গোল আগ্রাসন। দ্বাদশ শতক ছারখার করেছিল নিমর্ম মঙ্গোলরা। এমন অর্থহীন হত্যাযজ্ঞ মানব ইতিহাসে তেমন নেই বললেই চলে ...
আনাতোলিয়া (বর্তমান) তুরস্ক নিরাপদ ছিল। গেলেন সেখানে কবি। সেখান থেকে সিরিয়া (দামেস্ক শহরের খরার বর্ননা করেছেন); সিরিয়া থেকে গেলেন মিশর (মিশরের সংগীত, বাজার, মোল্লা ও অভিজাতকূলের বর্ননা উঠে এসেছে তাঁর লেখায় ) ... পুবে ভারতের সিন্ধু প্রদেশ অবধি এসেছিলেন সাদী। সেখানেই ব্রাহ্মণদের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন। সাদীর দর্শনের মূলকথা: মানবজাতি অভিন্ন মূল থেকে উদ্ভূত। এই বিশ্বাসের সঙ্গে ভারতীয় অদ্বৈতবাদী দর্শনের সাদৃশ্য লক্ষ করে বিস্মিত হয়ে যাই। হয়তো একমেবাদ্বীতিয়াম (এক ব্যতীত দুই নাই) কথাটি আকৃষ্ট করেছিল কবিকে। যা হোক। মধ্য এশিয়ায় গিয়েছিলেন সাদী। দেখেছেন দুর্ধষ মোঙ্গল হাত থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষের মুখেচোখে নীল আতঙ্কের ঢেউ ...
মহাতীর্থ মক্কা ও মদীনায় গিয়েছেন। পালন করেছেন হজব্রত। গিয়েছেন সুপ্রাচীন পয়গম্বরগনের পদধূলিতে পবিত্র জেরুজালেম।
১২৫৮ সালে মোঙ্গলরা বাগদাদ ধ্বংস করে। সে ধ্বংস লীলা প্রত্যক্ষ করেছেন সাদী।
সাদীর জীবন নানা বিচিত্র অভিজ্ঞতায় ভরপুর। খ্রিস্টান ক্রসেডারদের হাতে বন্দি হয়েছিলেন। ৭ বছর দাস হিসেবে পরিখা খনন করেছেন। পরে অবশ্য মুক্তিপনের বিনিময়ে মুক্তি পান। এত কষ্ট সত্ত্বেও সাদী তাঁর লেখায় বারবার বলেছেন .. মানবজাতি অভিন্ন মূল থেকে উদ্ভূত। এর কারণ তিনি ছিলেন কবি।
আমরা যেন শেখ সাদীর মহৎ হৃদয়কে চিনতে পারলাম।
৭ বছরের গ্লানিময় দাস জীবনের পর এমন মহৎ বাক্য উচ্চারণ একমাত্র মহৎ চেতনার পক্ষেই সম্ভব।
পারস্যের কবি শেখ সাদী মহৎ চেতনার অধিকারী ছিলেন।
এসব কারণেই সাদী চর্চা জরুরি বলেই মনে হয় ...
নানা জাতের মানুষের সঙ্গে মিশেছেন সাদী। যাত্রাপথের সরাইখানায়। সাধারন মানুষ থেকে অভিজাত।কত যে অভিজ্ঞতা হল। সে অভিজ্ঞতার কথা লিখেও রাখলেন। লিখলেন:
এক জনের জুতো নেই।
এই নিয়ে তার আক্ষেপ।
তার আক্ষেপ ঘুচল।
কেননা সে দেখল এক জনের পা-ই নেই।
দ্বিতীয় আরেকটি ঘটনার কথা লিখেন।
একবার শেখ সাদী গিয়েছেন অভিজাত এক ব্যক্তির বাড়ি। সাদী পরনে সাদাসিদে পোশাক। এ কারণে তেমন পাত্তা পেলেন না। সে ভাবে আপ্যায়ন করা হল না তাঁকে। পরে সাদী ওই বাড়িতে আবার গেলেন। এবার কবির পরনে ঝা চকচকে পোশাক। গৃহকর্তা এবার নিজেই খাবার এগিয়ে দিলেন। সাদী সব খাবার না খেয়ে আলখাল্লার জেবে ঢোকাতে লাগলেন।
কী ব্যাপার?
গৃহকর্তা সহ সকলে বিস্মিত।
সাদী তখন ব্যাখ্যা করে বললেন, আমি তো কিছু নই, আমার সব সম্মান তো আমার পোশাকের জন্য। সেই বরং খাক এসব।
সাদী এ জন্যই বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়।
অনেক ঘুরলেন বটে। কিন্তু তাঁর লেখালেখি বাদ যায়নি।
শিরাজে ফিরেছেন বৃদ্ধ বয়েসে। সুন্দর মহৎ বৃদ্ধ ...
শিরাজ তখন শান্তি বিরাজ করছে। শিরাজে সাদীকে বিপুল সম্বর্ধনা জানানো হয়।
কবির বাকি জীবন শিরাজেই কেটেছে।
‘বুস্তাঁ’ আর ‘গুলিস্তা’ সাদীর দুটি রচনা। গদ্য ও পদ্যের মিশেল। গুলিস্তার অন্য উচ্চারণ ও বানান হল গুলিস্তান। এর মানে গোলাপ বাগান। ঢাকার গুলিস্তান কল্পনা না করাই ভালো। বরং নিচের ছবিটি দেখুন।
১৬৪৫ সালের মুগল মিনিয়েচার । গোলাপ বাগানে শেখ সাদী।
জাতিসংঘের ‘হল অভ নেশন’ এর প্রবেশপথে গুলিস্তাঁর চরণ খোদিত ...
Human beings are members of a whole,
In creation of one essence and soul.
If one member is afflicted with pain,
Other members uneasy will remain.
If you have no sympathy for human pain,
The name of human you cannot retain.
পারস্য থেকে ইংরেজি অনুবাদ উনিশ শতকের পারস্য পন্ডিত ফ্রান্সিস গ্লাডউইন।
শিরাজে সাদীর সমাধির সামনে তরুণ-তরুণীরা দাঁড়িয়ে।
গুলিস্তান এর ডাউনলোড লিঙ্ক
http://www.mediafire.com/?eoogyjzmyyn
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুন, ২০১০ বিকাল ৫:৩২