রবীন্দ্রনাথই বুঝি প্রথম বাংলার ইতিহাসে বাংলারই অজ পাড়াগাঁয়ের এক কালো মেয়ে কে তার প্রাপ্য মূল্য দিলেন, অভূতপূর্ব মান-মর্যাদা দিলেন; যে রকম ইতিপূর্বে আর কখনও দেখা যায়নি। ক্ষণিকা কাব্যগ্রন্থে ‘ কৃষ্ণকলি’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি ,
কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক ।
মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে
কালো মেয়ের কালো হরিণ - চোখ ।
কবিটি কিন্তু যেন তেন লোক নয়, খোদ গ্রামের জমিদার, বাংলার অন্যতম ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। তা সত্ত্বেও তিনি অজ পাড়াগাঁয়ের এক সামান্য কালো মেয়ে কে অপরিসীম মূল্য দিলেন, অঢেল মান-মর্যাদা দিলেন ...
এখানেই আমাদের আগ্রহ।
এই যে বাংলার পাড়াগাঁর কালো মেয়ে, কি তার সামাজিক ইতিহাস?
সামাজিক ইতিহাস আর কি - কেবল বহিরাগত জাতিগোষ্ঠী দ্বারা দীর্ঘকালীন বঞ্চনা আর শোষনের দীর্ঘ ইতিহাস ছাড়া। একই সঙ্গে কালো মেয়েটির ব্যক্তিইতিহাসও অতি সঙ্কটাপন্ন। কেননা,‘ কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক ।’ অথচ কবি বললেন,
‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি ’।
অনাগত ফুলের সঙ্গে কালো মেয়েটির তুলনা করলেন কবি। বললেন, মেয়েটি কেবল কালো নয়, সে কালো রঙের ফুলের কুঁড়ি।
প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্রমথ নাথ বিশী একবার বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ববাংলা) না এলে তিনি নাগরিক কবিই রয়ে যেতেন। এই মন্তব্য হয়ত খানিক অতিরঞ্জিত -তবে এতে একেবারেই যে সত্যি নেই তাও নয়। আমরা জানি উনিশ শতকের শেষের দিকে রবীন্দ্রনাথ পারিবারিক জমিদারি দেখভালের জন্য তৎকালীন পূর্ববাংলায় এসেছিলেন। এসে শুধু জমিদারি নয় পূর্ববাংলার নদীমাটিপ্রকৃতি, প্রাকৃতজন ও এর লোকজ দর্শনের সঙ্গে নিজের প্রাণের ছন্দটি খুঁজে পেলেন । পূর্ব বাংলার বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতি তাঁকে সম্পূর্নরূপে গ্রাস করেছিল।
‘বর্ষাকাল আসিল। ক্ষুধিত পদ্মা উদ্যান গ্রাম শস্যক্ষেত্র এক-এক গ্রাসে মুখে পুরিতে লাগিল। বালুকাচরের কাশবন এবং বনঝাউ জলে ডুবিয়া গেল। পাড় ভাঙার অবিরাম ঝুপঝাপ শব্দ এবং জলের গর্জনে দশদিক মুখরিত হইয়া উঠিল এবং দ্রুতবেগে ধাবমান ফেনরাশি নদীর তীব্র গতিকে প্রত্যক্ষগোচর করিয়া তুলিল।... একবার ঝপ করিয়া একটি শব্দ হইল।... পদ্মা পূর্ববত্ ছল্ছল্ করিয়া ছুটিয়া চলিতে লাগিল, যেন সে কিছুই জানে না...।’
এই সমাজের মানুষ তাকে মুগ্ধ করেছিল।
পুবে বাতাস এল হঠাৎ ধেয়ে ,
ধানের খেতে খেলিয়ে গেল ঢেউ ।
আলের ধারে দাঁড়িয়েছিলেম একা ,
মাঠের মাঝে আর ছিল না কেউ ।
আমার পানে দেখলে কিনা চেয়ে
আমিই জানি আর জানে সে মেয়ে ।
কালো ? তা সে যতই কালো হোক
দেখেছি তার কালো হরিণ - চোখ ।
এই গ্রামীন সমাজের হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা লোকজ দর্শন কবিকে বদলে দিল আমূল । কবি পরবর্তীকালে হয়ে উঠেছিলেন রবীন্দ্র-বাউল ...
খাঁচার ভিতর অচিনপাখি কেমনে আসে যায়?
তারে ধরতে পারলে মনবেড়ি দিতাম পাখির পায়।
এ গান শুনে, এই গানের ইতিহাস শুনে, এই গানের কর্তার কথা শুনে কবি বদলে গেলেন, বদলে গেল তাঁর চিন্তাধারা, এমন কী পোশাক-আশাক। তাঁকে আর আমরা ঘনঘন ইউরোপ যেতে দেখি না। অবশ্য পরিনত বয়সে যখন ইউরোপ আর অন্যত্র গেলেন, বললেন, বাংলা দেশে বাউল বলে এক দল আছে যারা নিজের অন্তরের ভিতর সদূরের অলীক অশ্র“ত ধ্বনি টের পায় ...
আর, হরিণ চোখের কালো মেয়েটি তো বাংলার বাউলসমাজ থেকেই উঠে এসেছে।
যে কারণে কালো মেয়েটির এত সম্মান জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিটির কাছে।
রবীন্দ্রনাথ পূর্ববাংলায় এসে পূর্ববাংলাকে আপন করে নিয়েছিলেন। এর সবকিছু । এমন কী পূর্ব বাংলার বিশিষ্ট বাগবিধিও। পাঠ করুন-
ঘন মেঘে আঁধার হল দেখে
ডাকতেছিল শ্যামল দুটি গাই,
ডাকতেছিল ক্রিয়াপদটি হয়তো ছন্দের কারণেই এসেছে, তারপরও বলব যে কবিতার আপন আবহে কবি একাকার না হলে সার্থক কাব্যের সৃষ্টি কি করে সম্ভব। জীবনানন্দের কবিতায় যেমন অনিবার্যভাবেই কখনও কখনও বরিশালের বাগবিধি উঠে এসেছে...
কে মোরে ব্যথা দেছে
কে বা ভালোবাসে
শুধু মোর দেহের তালাশে ...
বরিশালের মানুষ মাত্রেই জানেন ‘ব্যথা দেছে’ বলতে কি বোঝায় ...
আমরা বলছিলাম তৎকালীন পূর্ববাংলার গ্রামের এক শ্যামল কিশোরীর কথা, যাকে দেখে রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন,
কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি ,
কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক ।
মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে
কালো মেয়ের কালো হরিণ - চোখ ।
ঘোমটা মাথায় ছিল না তার মোটে ,
মুক্তবেণী পিঠের ‘পরে লোটে ।
কালো ? তা সে যতই কালো হোক
দেখেছি তার কালো হরিণ - চোখ ।
ঘন মেঘে আঁধার হল দেখে
ডাকতেছিল শ্যামল দুটি গাই ,
শ্যামা মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে
কুটির হতে ত্রস্ত এল তাই ।
আকাশ - পানে হানি যুগল ভুরু
শুনলে বারেক মেঘের গুরুগুরু ।
কালো ? তা সে যতই কালো হোক
দেখেছি তার কালো হরিণ - চোখ ।
পুবে বাতাস এল হঠাৎ ধেয়ে ,
ধানের খেতে খেলিয়ে গেল ঢেউ ।
আলের ধারে দাঁড়িয়েছিলেম একা ,
মাঠের মাঝে আর ছিল না কেউ ।
আমার পানে দেখলে কিনা চেয়ে
আমিই জানি আর জানে সে মেয়ে ।
কালো ? তা সে যতই কালো হোক
দেখেছি তার কালো হরিণ - চোখ ।
এমনি করে কালো কাজল মেঘ
জ্যৈষ্ঠ মাসে আসে ঈশান কোণে ।
এমনি করে কালো কোমল ছায়া
আষাঢ় মাসে নামে তমাল - বনে ।
এমনি করে শ্রাবণ - রজনীতে
হঠাৎ খুশি ঘনিয়ে আসে চিতে ।
কালো ? তা সে যতই কালো হোক
দেখেছি তার কালো হরিণ - চোখ ।
কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি ,
আর যা বলে বলুক অন্য লোক ।
দেখেছিলেম ময়নাপাড়ার মাঠে
কালো মেয়ের কালো হরিণ - চোখ ।
মাথার ' পরে দেয় নি তুলে বাস ,
লজ্জা পাবার পায় নি অবকাশ ।
কালো ? তা সে যতই কালো হোক
দেখেছি তার কালো হরিণ - চোখ ।
হয়তো মেয়েটি ছিল কবির প্রজা। মুসলিম প্রজা কি? যাই হোক। প্রজা তো কি? (আসলে সেই কালো মেয়েটি তো বাংলার বাউল সমাজ থেকেই উঠে এসেছিল) ... সেই শ্যাম বর্ণের প্রজা মেয়ের নির্মল রূপে মুগ্ধ হয়েছেন তরুণ কবি। শ্রাবণ রজনীতে মেয়েটির কথা ভেবেছেনও।
এমনি করে কালো কাজল মেঘ
জ্যৈষ্ঠ মাসে আসে ঈশান কোণে ।
এমনি করে কালো কোমল ছায়া
আষাঢ় মাসে নামে তমাল - বনে ।
এমনি করে শ্রাবণ - রজনীতে
হঠাৎ খুশি ঘনিয়ে আসে চিতে ।
কালো ? তা সে যতই কালো হোক
দেখেছি তার কালো হরিণ - চোখ ।
কবি এভাবেই শ্রেণির উর্দ্ধে উঠতে পেরেছিলেন, যা অত্যন্ত জরুরি। যে শ্রেণি অনঢ় পাথর-দেওয়াল নির্মান করে মানুষে- মানুষে সৃষ্টি করে বিভেদ, দূরত্ব। রবীন্দ্রনাথ সেসব অনভিপ্রেত বাধা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন। লালনের মতোই যেন বলতে চেয়েছেন ...
বেদ বিধির পর শাস্ত্র কানা ...
যা হোক। এখন এই সময়টা একুশ শতক। রবীন্দ্রনাথের সেই কালো মেয়েরা আজ ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে যায়, পাচার হয়ে যায় সীমান্তের ওপারে (স্বাধীনতার পরে সংখ্যাটি ভীতিকর) বড় শহরে এসে স্বল্প মূল্যে শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য হয় গৃহ পরিচারিকা হিসেবে কিংবা যৌনকর্মী হিসেবে কিংবা ভাগ্য ভালো হলে পোশাক শিল্পে। এই তিনটি ক্ষেত্রেই কৃষ্ণকলিরা, আমরা জানি, পদে পদে শিকার হয় নানা অপমান নির্যাতন আর বঞ্চনার .... এই নির্যাতন আর বঞ্চনা চলে ... কেননা আমরা পাড়াগাঁর মেয়েদের প্রতি সচেতন নই, আমরা কবির চোখে ওদের দেখতে শিখিনি ... কেননা আমরা কবিতা থেকে দূরে সরে গেছি ...আমরা জানিনা যে পোশাক শিল্পে শ্রম বেচা ঐ বিপর্যস্ত মেয়েটিই কবিতা কিংবা কালো রঙের ফুলের কুঁড়ি ... যাকে উদ্দেশ্য করে কবি বলেছিলেন:
আকাশ - পানে হানি যুগল ভুরু
শুনলে বারেক মেঘের গুরুগুরু ।
কালো ? তা সে যতই কালো হোক
দেখেছি তার কালো হরিণ - চোখ ।
রবীন্দ্রাথের কালো মেয়েরা এখন পোশাক শিল্পের উচ্চ মুনাফার বলি । আমরা এদের দেখে রবীন্দ্রনাথের মতো বলতে পারি না। কালো ? তা সে যতই কালো হোক/ দেখেছি তার কালো হরিণ - চোখ ।
তখন বলেছি যে রবীন্দ্রনাথের সেই কালো মেয়েরা আজ ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে যায় ... গ্রাম ও শহরের ভূমিকা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ সচেতন ছিলেন। লিখেছেন,
‘অন্যান্য সকল রিপুর মতোই লোভটা সমাজবিরোধী প্রবৃত্তি। এইজন্যেই মানুষ তাকে রিপু বলেছে। বাইরে থেকে ডাকাত যেমন লোকালয়ের রিপু, ভিতর থেকে লোভটা তেমনি। যতক্ষণ এই রিপু পরিমিত থাকে ততক্ষণ এতে করে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের কর্মোদ্যম বাড়িয়ে তোলে, অথচ সমাজনীতিকে সেটা ছাপিয়ে যায় না। কিন্তু লোভের কারণটা যদি অত্যন্ত প্রবল ও তার চরিতার্থতার উপায় অত্যন্ত বিপুল শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তবে সমাজনীতি আর তাকে সহজে ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। আধুনিক কালে যন্ত্রের সহযোগে কর্মের শক্তি যেমন বহুগুণিত, তেমনি তার লাভ বহু অঙ্কের, আর সেই সঙ্গে সঙ্গে তার লোভ। এতে করেই ব্যক্তিস্বার্থের সঙ্গে সমাজস্বার্থের সামঞ্জস্য টলমল করে উঠছে। দেখতে দেখতে চারি দিকে কেবল লড়াই ব্যাপ্ত হয়ে চলেছে। এইরকম অবস্থায় গ্রামের সঙ্গে শহরের একান্নবর্তিতা চলে যায়, শহর গ্রামকে কেবল শোষণ করে, কিছু ফিরিয়ে দেয় না।(পল্লীপ্রকৃতি)
কি গ্রাম, কি শহর- আজ সমগ্র বাংলাদেশজুড়েই রবীন্দ্রনাথের কালো রঙের ফুলের কুঁড়িরা বিপর্যস্ত। তাদের কেউ কেউ ইভ টিজিংয়েরও শিকার। এরা কি পুঁজির দাপটে আর পুরুষের লালসার শিকার হয়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে? গত কয়েক মাসে পয়ত্রিশ কিশোরীর আত্মহনন সভ্য মানুষ হিসেবে আমাদের বেঁচে থাকাকে নিরর্থক করে দেয় না কি? আমরা উদ্ধারের পথ খুঁজি...মনে হয় দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন ছাড়া উদ্ধারের উপায় নেই ... যে কারণে আমাদের অতি অবশ্যই ফিরে যেতে হবে কবিতার কাছে । পর্নগ্রাফি নয়, কবিতা ... যে কবিতা গ্রামের এক কিশোরী মেয়েকে দেখে কামতাড়িত না হয়ে বরং অত্যন্ত মানবিক ভাবেই বলে:
মাথার ' পরে দেয় নি তুলে বাস ,
লজ্জা পাবার পায় নি অবকাশ ।
কালো ? তা সে যতই কালো হোক
দেখেছি তার কালো হরিণ - চোখ ।
এই ‘ কালো হরিণ - চোখ’-এর দিকে তাকানোর নিষ্কাম শিক্ষাই কবিগুরুর শিক্ষা ...
আর একটা কথা। ময়নাপাড়ার মাঠে কবি আর কৃষ্ণকলি একাই ছিল। ‘কৃষ্ণকলি’ কবিতায় সে প্রমাণ রয়েছে।
পুবে বাতাস এল হঠাৎ ধেয়ে ,
ধানের খেতে খেলিয়ে গেল ঢেউ ।
আলের ধারে দাঁড়িয়েছিলেম একা ,
মাঠের মাঝে আর ছিল না কেউ ।
আমার পানে দেখলে কিনা চেয়ে
আমিই জানি আর জানে সে মেয়ে ।
কালো ? তা সে যতই কালো হোক
দেখেছি তার কালো হরিণ - চোখ ।
আর ...
আমার পানে দেখলে কিনা চেয়ে
আমিই জানি আর জানে সে মেয়ে ।
এ হল নির্মল মানবিক প্রেম, যা কোনওমতেই জবরদস্তি নয়, বরং এতে প্রত্যেকেরই অধিকার রয়েছে ... এবং এর অবস্থান ইভ টিজিংয়ের একেবারেই বিপরীতে ...বাঙালি শিল্পপতির হৃদয়ে এই মানবিক বোধের সঞ্চার পোশাক শিল্পে কর্মরত শ্যামলা রঙের গ্রামীণ মেয়েদের কখনোই উচ্চ মুনাফার বলি করে তুলবে না আশা করা যায়...
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মে, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:২৩