মুদ্রায় অঙ্কিত ব্যাকট্রিয় গ্রিক রাজা মিলান্ডার। ইনি একজন বৌদ্ধ পন্ডিতকে কয়েকটি প্রশ্ন করে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। প্রাচীন ভারতে মৌর্যবংশের পতনের যুগে ব্যাকট্রিয় গ্রিক রাজারা পশ্চিম ভারতের গুজরাটের ভৃগকচ্ছ অবধি তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করে। এদের সর্বশেষ নৃপতি মিলান্ডার (বা মিলিন্দ) বৌদ্ধধর্মে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং ঐ ধর্মে দীক্ষা নেওয়ার পূর্বে বৌদ্ধ পন্ডিত নাগসেনের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেন। পালি সাহিত্যে এই আলোচনা ‘মিলিন্দ পহনো’ বা মিলিন্দ প্রশ্ন আখ্যায় লিপিবদ্ধ আছে।
ব্যাকট্রিয়ার মানচিত্র
ব্যাকট্রিয়া বা বাখট্রিস রাজ্যটির অবস্থান ছিল বর্তমান আফগানিস্তানের উত্তরে। অতি প্রাচীনকালেই দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ও জরথুশত্র প্রচারিত ধর্মের কারণে অঞ্চলটি বিখ্যাত ছিল। ব্যাকট্রিয়ার উত্তরে অক্সাস নদী (আমু দরিয়া) এবং দক্ষিণে হিন্দুকুশ পর্বতমালা। এর মাঝখানে উর্বর পলল সমতল, উষ্ণ মরুভূমি ও ঠান্ডা পবর্তমালা সমন্বিত ভৌগোলিক বৈচিত্র্য অতি বিচিত্র । রোমান লেখক কুইনটাস কার্টিয়াস রুফুস এই বৈপরীত্যের কথা উল্লেখ করেছেন।
মানচিত্রে ব্যাকট্রিয়া
গ্রিক সম্রাট আলেকজান্দারের পারস্য আক্রমনের সময় গ্রিকরা ব্যাকট্রিয়ায় নতুন নগর গড়ে বসবাস করতে শুরু করে । ব্যাকট্রিয়ার স্থানীয় লোকজনও বাস করত সে নগরে। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৫ সালে একটি ভারতীয় নগর অবরোধ সময় আলেকজান্দার আহত হলেন । ঠিক ঐ সময়ই ব্যাকট্রিয়ায় বসবাসকারী গ্রিকরা গ্রিসে ফিরে যেতে চাইল । উপরোন্ত ব্যাকট্রিয়ার স্থানীয়রাও চাইছিল না যে ব্যাকট্রিয়ায় গ্রিকরা থাকুক। তারা আন্দোলন শুরু করে।
প্রাচীন ব্যাকট্রিয়ার চিহ্ন
যা হোক। গ্রিক সৈন্যরা কঠোর হাতে অরাজকতা দূর করে। এরপর ৩২৩ খ্রিস্টপূর্বে আলেকজান্দার মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর একজন উত্তাধিকারীর নাম পারডিকাস। তিনি সেনাপতি পেইথনকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের জন্য ব্যাকট্রিয়ায় পাঠালেন। পেইথন চাইলেন গ্রিকরা ব্যাকট্রিয়ায় থাকুক। কিন্তু তারা বিদ্রোহ করে। পেইথন এর অনুগত গ্রিক সৈন্যরা তাদের হত্যা করে। এভাবে ব্যাকট্রিয়ায় বসবাসকারী গ্রিকদের সংখ্যা কমে এল। অর্থাৎ
গ্রিকদের আর ব্যাকট্রিয়ায় ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য থাকল না।
ব্যাকট্রিয়ায় গ্রিক নগরের মডেল
এর মধ্যে একচ্ছত্র ক্ষমতার লক্ষ্যে আলেকজান্দার এর সেনাপতিদের মধ্যে ব্যাবিলনে সংঘাত বাধল। ৩০৮ খ্রিস্টপূর্বে ১ম সেলুকাস নিকেতর ব্যবিলনীয় যুদ্ধে জয়লাভ করেন। এরপর ব্যাকট্রিয়ায় নতুন সৈন্য অনুপ্রবেশ করল। ব্যাকট্রিয়া সেলুসিদ বংশের অধীন হয়ে পড়ে। সম্রাট ১ম সেলুকাস নিকেতর এর ছেলে অ্যান্টিওকাস ১ম সোটার ব্যাকট্রিয়া শাসন করতে থাকে। তাঁর শাসনের ধরন ছিল পারশিক।
পার্থিয়ার মানচিত্র
ব্যাকট্রিয়ার পশ্চিমে পার্থিয়া। ২৪৫ খ্রিস্টপূর্বে পার্থিয়ার প্রাদেশিক শাসনকর্তা (সাটরাপ) অ্যান্ড্রাগোরাস সেলুসিদ কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে; এই গোলযোগের সুযোগে মধ্য এশিয়ার তৃণভূমির পার্ণি গোত্র পার্থিয়া আক্রমন করে। সেলুসিদ সৈন্যরা পার্নিদের প্রতিরোধ ব্যর্থ হয়। পার্নিরা পার্থিয়া ধ্বংস করে।
মানচিত্র। গান্ধার। বর্তমান পকিস্তান। ব্যাকট্রিয় গ্রিক রাজারা যখন গান্ধার ও পাঞ্জাব দখল করে সে সময় মৌর্য শাসন ক্ষয়ে যাচ্ছিল।
গ্রিক ও মেসিডোনিয়রা এরপর ইউরোপ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ডিওডোটাস ব্যাকট্রিয়ায় স্বাধীন রাজ্য গড়ে তোলেন। ইনি পার্নিদের সমর্থন দিয়েছিলেন। যদিও সেলুসিদ সম্রাট ৩য় অ্যান্টিওকাস ২০৬ খ্রিস্টপূর্বে পার্থিয়া ও ব্যাকট্রিয়া আক্রমন করে তা সত্ত্বেও এতদ্বঞ্চলের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখেন। ব্যাকট্রিয়ার রাজা ইউদিদেমাস ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। ১৮৪ খ্রিস্টপূর্বে ব্যাকট্রিয় গ্রিক রাজারা গান্ধার ও পাঞ্জাব দখল করেন।
দেমেট্রিয়াস
ইউদিদেমাস এর পুত্র দেমেট্রিয়াস তক্ষশিলায় তাঁর শাসনের কেন্দ্র করে তোলেন। তক্ষশিলাকে গ্রিক নগরীর আদলে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। তক্ষশিলা হয়ে ওঠে শিক্ষাদীক্ষার কেন্দ্র । বিশেষ করে বৌদ্ধসংস্কৃতির বিকাশ লাভ করে। ভারতীয় শিল্পের সঙ্গে গ্রিক শিল্প মিলে গান্ধার শিল্প গড়ে উঠে।
বৌদ্ধ মূর্তি। মুখায়ব ভারতীয়; কাজের ছাঁচটি গ্রিক। এইই গান্ধার শিল্পে মূল বৈশিষ্ট্য।
নাগসেন রচিত মিলিন্দ পহনো গ্রন্থের প্রচ্ছদ।
আমাদের এই লেখার বিষয় মিলিন্দ পহনো। ব্যাকট্রিয় গ্রিক রাজা মিলিন্দ এর পরিপ্রেক্ষিত বোঝার জন্যই সংক্ষেপে ব্যাকট্রিয় গ্রিক রাজাদের ইতিবৃত্তটি বলতে হল। এবার নাগসেন সম্বন্ধে কিছু কথা বলা দরকার। নাগসেন প্রথম জীবনে ব্রাহ্মণ ছিলেন, সম্ভবত গান্ধারে বাস করতেন। পরে তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহন করেন। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০ তাঁর সময়কাল বলে চিহ্নিত করা গেছে। সর্বশেষ ব্যাকট্রিয় গ্রিক রাজা মিলান্ডার (বা মিলিন্দ) বৌদ্ধধর্মে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং ঐ ধর্মে দীক্ষা নেওয়ার পূর্বে বৌদ্ধ পন্ডিত নাগসেনের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেন। আগেই বলেছি -পালি সাহিত্যে এই আলোচনা মিলিন্দ পহনো বা মিলিন্দ প্রশ্ন আখ্যায় লিপিবদ্ধ আছে।
বিশ্বের পড়ুয়া মহলে বইটি আদৃত।
মিলান্ডার শাসন করেন ১৫৫ থেকে ১৩০ খ্রিস্টপূর্ব। ইনি ছিলেন ২য় অ্যান্টিমাকাস এর উত্তরাধিকারী। মিলান্ডার ১ম দেমেট্রিয়াস এর কন্যা আগাথোক্লেইয়াকে বিবাহ করেছিলেন। এর রাজত্বকালেই ব্যাকট্রিয় গ্রিক সাম্রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধি পেয়েছিল। তক্ষশিলা ছিল কেন্দ্র এবং পশ্চিম পাঞ্জাব ও গান্ধারের রাজধানী।
মিলান্ডার আমলের রুপার দ্রাকমা (গ্রিক মুদ্রা)
রাজা মিলান্ডার এর ২৫০ টি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন নাগসেন। তারপর মিলান্ডার ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। মিলিন্দ পহনো সাতটি অধ্যায়ে বিভক্ত।
১ পটভূমি ইতিহাস
২ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের ওপর প্রশ্ন
৩ দুবোধ্যতা দূর করবার জন্য প্রশ্ন
৪ দ্বন্দ বিষয়ক প্রশ্ন
৫ উদাহরণ দিয়ে প্রশ্নের উত্তর
৬ সংযমের বিশেষ গুণ
৭ তুলনামূলক প্রশ্ন
ব্যাকট্রিয় গ্রিক রাজা মিলান্ডার এর প্রশ্নের ধরনে গ্রিক বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন প্রজ্ঞান বৈশিষ্ট সম্পর্কে মিলান্ডার বলছেন: মাননীয় নাগসেন, প্রজ্ঞার স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য কি?
নাগসেন বললেন, আমি আগেই আপনাকে বলেছি মহারাজ কঠোরতা প্রজ্ঞার স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য। এখন আবার বলছি আলোকময়তা প্রজ্ঞার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য।
রাজা জিজ্ঞেস করলেন, মাননীয় নাগসেন, কী ভাবে আলোকময়তা প্রজ্ঞার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য?
নাগসেন বললেন, মহারাজ উদীয়মান প্রজ্ঞা অজ্ঞতার অন্ধকার দূর করে। অর্ন্তদৃষ্টির উজ্জ্বলতা উৎপন্ন করে। জ্ঞানের আলোক আনে। আর্যসত্যকে প্রকাশ করে। উপরোন্ত আধ্যাত্মিক সাধক পূর্নজ্ঞানে দেখতে পায় অনিত্য, অতৃপ্তি ও অন্তসারশূন্যতা।
উদাহরণ দিন। রাজা বললেন।
নাগসেন বললেন, ধরুন এক ব্যক্তি অন্ধকার ঘরে প্রদীপ নিয়ে এল। প্রদীপ জ্বালাতেই আলো হল, আর আঁধার দূর হল। এভাবে উৎপন্ন হল উদ্ভাসন। আলোক প্রকাশিত হল, সেই সঙ্গে রুপও গোচরীভূত হল। এভাবে প্রজ্ঞার উত্থানে বিদূরিত হল অজ্ঞতার অন্ধকার। জ্ঞানের আলো এল। আর্যসত্য প্রকাশিত হল। উপরোন্ত আধ্যাত্মিক সাধক পূর্নজ্ঞানে দেখতে পেল অনিত্য, অতৃপ্তি ও অন্তসারশূন্যতা।
রাজা বললেন, মাননীয় আপনি সত্যিই জ্ঞানী। তারপর রাজা বললেন, এবার বলুন চেতনার স্বাতন্ত্র বৈশিষ্ট্য কি?
নাগসেন বললেন, চেতনার স্বাতন্ত্র বৈশিষ্ট্য অবধারণ করা।
উদাহরণ দিন। রাজা বললেন।
নাগসেন বললেন, ধরুন একজন নগরপরিদর্শক নগরের মধ্যিখানে চৌরাস্তায় বসে আছে। সে পূর্বদিক থেকে আসা একজন ব্যাক্তিকে দেখতে পাবে, দক্ষিণ দিক থেকে আসা একজন ব্যাক্তিকে দেখতে পাবে, পশ্চিম দিক থেকে আসা একজন ব্যাক্তিকে দেখতে পাবে এবং উত্তর দিক থেকে আসা একজন ব্যাক্তিকে দেখতে পাবে । এভাবে সচেতন ব্যাক্তি চোখ দিয়ে রুপ দেখতে পারে, কান দিয়ে শব্দ শুনতে পারে, নাক দিয়ে গন্ধ নিতে পারে, জিভ দিয়ে স্বাদ নিতে পারে, স্পর্শ দ্বারা সচেতন হতে পারে, মন দ্বারা উপলব্দি করতে পারে। এ হল চেতনার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য।
আপনি জ্ঞানী মাননীয় নাগসেন। রাজা বললেন।
ব্যাকট্রিয় গ্রিক রাজা মিলান্ডার এর এরকম ২৫০টি প্রশ্নই বৌদ্ধধর্মে মিলিন্দ পহনো বা The Milindapañha নামে পরিচিত।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মার্চ, ২০১০ রাত ৮:৫৯