
আজও আমরা রোমান সভ্যতার কথা বলি; বলি যে, রোমান সভ্যতা ছিল অতীব উন্নত সভ্যতা-যে সভ্যতাটির আর্থ-সামাজিক বুনিয়াদ আমাদের আধুনিক মননেও বিস্ময়ের উদ্রেক করে ; আজও পশ্চিমা বিশ্ব প্রাচীন রোমানদের রীতিনীতি শ্রদ্ধার সঙ্গে সংরক্ষণ করে রেখেছে। ‘রিপাবলিক’, ‘সিনেট ’ এই রোমান শব্দগুলি আজ সাধারণ মানুষের কাছেও অতি পরিচিত। তবে এ কথাও সত্য যে- রোমান সভ্যতার এক মর্মান্তিক অন্ধকার ছিল- সভ্যতাটির ছিল অসম্ভব রক্তের তৃষ্ণা, বড় রক্ত লোলুপ ছিল রোমান সাম্রাজ্য। সে রক্তপাতের ক্ষরণ কেবল যুদ্ধবিগ্রহের জন্যেই হয়নি, হয়েছে খেলাচ্ছলে, আমোদ ফূর্তি করতে করতে, রোমের স্টেডিয়ামে (কলসিয়ামে) হাজার হাজার দর্শকের সামনে পশুতে পশুতে, মানুষে মানুষে, পশুতে মানুষে চলত লড়াই ঝরত রক্ত!। সমাগত দর্শকগন আনন্দে উল্লাসে ফেটে পড়ত। কারও মনে এই প্রশ্নের উদয় হয়নি যে-চোখের সামনে যা যা ঘটছে সেসব ঠিক নয় ... অবশেষে চারশ বছর পর প্রাণের বিনিময়ে সে রক্তপাত রোধ করলেন প্রাচ্যের এক মানবতাবাদী খ্রিষ্টান সাধু ...
৪০৩ খ্রিস্টাব্দ। অক্টোবর মাস। লাইসিয়া। (বর্তমান তুরস্ক)
বাতাসে শুকনো জলপাই ফলের গন্ধ; রসুনের গন্ধ। দূর থেকে সমুদ্রের ঢেউয়ের আওয়াজও শোনা যায়। না, গাঙচিলেদের ঘুম এখনও ভাঙ্গেনি। তবে এই ভোরেও নিকটস্থ বন্দরের কোলাহল বুঝি শ্র“ত হয়। ভোর। তবে আলো তেমন ফোটেনি। মোমের হলুদ আলোয় এই খ্রিস্টীয় মঠের কুঠুরীর সবটুকু অন্ধকার দূর হয়নি।
সাধু টেলিমেকাস দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
বৃদ্ধ সাধুটি মোমের ম্লান হলুদ আলোয় বাইবেল পাঠ করছেন। পবিত্র বাইবেলে লেখা রয়েছে: "Blessed are the peacemakers: for they shall be called the children of God." -Matthew 5:9 কদিন ধরে বারংবার এই কথাটিই পাঠ করছেন সাধু টেলিমেকাস। ক’দিন ধরে ভীষণই উত্তেজিত হয়ে আছেন তিনি । বারবার মনে মনে বলছেন: আমি ঈশ্বরের সন্তান হইব! আমি ঈশ্বরের সন্তান হইব! আমি ঈশ্বরের সন্তান হইব! এখন আবার ফিসফিস করে বললেন: ‘শান্তিবাদীগন আর্শীবাদপুষ্ঠ। তাহাদিগকে বলা হইবে ঈশ্বরের সন্তান।’ আহ্, আমি ঈশ্বরের সন্তান হইব! আমি ঈশ্বরের সন্তান হইব! আমি ঈশ্বরের সন্তান হইব!
লাইসিয়া নগরীতে ভোর গভীর হয়ে উঠছে।
জানালায় আলো। ফুঁ দিয়ে মোম নেভালেন সাধু; তারপর উঠে দাঁড়ালেন। তৈরি হয়ে নিতে হবে। পূর্বাহ্নে রোমের উদ্দেশ্যে একটি জাহাজ ছেড়ে যাবে আজ । সাধুটি জানেন রোমান অ্যাম্পিথিয়েটার গত চারশ বছর ধরে অপরিমেয় রক্তপাত হচ্ছে। সম্রাটকে চিঠি দিয়েছেন রক্তপাত বন্ধ করবার জন্য উদ্যেগ গ্রহন করার জন্য। লাভ হয়নি। সাধু এবার স্বয়ং রোমে যাবেন। ঈশ্বরের সন্তান হবেন; প্রাণ দিয়ে শান্তি স্থাপন করবেন।
এ ছাড়া অন্য কোনও পথ যে খোলা নেই!
২
স্থাপত্যবিদ্যায় অ্যাম্পিথিয়েটার হল: ডিম্বাকৃতির স্থানময় (স্পেসিয়াস) খোলা (ওপেন এয়ায়) ভবন। রোমান সাম্রাজ্যের সবচে জমকালো ভবন হল কলোসিয়াম এবং স্থাপত্য বিচারে
এটি অ্যাম্পিথিয়েটার। কলোসিয়ামকে প্রথম প্রথম বলা হত ফ্লাবিয়ান অ্যাম্পিথিয়েটার। এর কারণ আছে। ৭২ খ্রিস্টাব্দে ফ্লাবিয়ান বংশের প্রতিষ্ঠাতা রোমান সম্রাট ভেসপাসিয়ান কলোসিয়াম নির্মানের উদ্যেগ নেন। ৮০ খ্রিস্টাব্দে কলোসিয়াম-এর নির্মান কাজ শেষ হয়। ঐ বছরই রোমান সম্রাট ভেসপাসিয়ান মারা যান। কাজেই কলোসিয়ামের রক্তপাত তিনি স্বচক্ষে দেখে যেতে পারেননি। কলোসিয়ামটি নির্মান করা হয়েছিল রোম শহরের ভিতরে এক কৃত্রিম হ্রদের পাড়ে। হ্রদটি ছিল সম্রাট নিরোর উদ্যান এর অংশ। কলোসিয়ামের পাশে সম্রাট নিরোর এক Colossal মূর্তি ছিল। কলোসাল মানে বৃহৎ; অনেকে মনে করেন কলোসিয়াম নামটি এভাবেই হয়েছে।

কলোসিয়ামের এই অর্ধবৃত্তাকার কাঠামোটি ৬১৭ ফুট দীর্ঘ, ৫১২ ফুট চওড়া এবং ১৫৯ ফুট উঁচু। মাটি থেকে চার তলা সমান উঁচু। সবচে ওপরে বসত সমাজের নিচুতলার লোকজন; ওপরে বসত রোমক উচ্চবৃত্ত শ্রেণি। মাটির তলায় ছিল খাঁচা, সে খাঁচায় থাকত পশু। দড়ি দিয়ে টেনে পশুসমেত খাঁচা কলোসিয়ামের এরিনায় তোলা হত। একসঙ্গে ৫৫,০০০ দর্শক বসে ক্রীড়ানুষ্ঠান উপভোগ করতে পারত । ৮০টি প্রবেশপথ ছিল কলোসিয়ামে ।
কলোসিয়াম নির্মান করা হয়েছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। মানে রোমের জনগনকে খুশি-বশ করার জন্য, লোকের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্য কলোসিয়াম নির্মান করা হয়েছিল । এটা ছিল পলিটিকাল গিমিক-যাতে সম্রাটের বিরুদ্ধে আমজনতা রুষ্ট হয়ে বিদ্রোহ না-করে বসে! এর মানে কলোসিয়াম নির্মান করা হয়েছিল সম্রাটের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে । কলোসিয়ামে খেলাধূলা অনুষ্ঠিত হত, খেলাধধূলা মানে রক্তপাতের মচ্ছব! সারাদিন ধরে চলত সে রক্তাক্ত উন্মাদনা। কখনও কখনও দিনের পর দিন। রোমান সম্রাট ট্রাজান। তিনি ১০৭ খ্রিস্টাব্দে ডাচিয়া জয় করেন। কলোসিয়ামে বিজয় উৎসব চলেছিল ১২৩ দিন ধরে। ১১,০০০ পশু এবং ১০,০০০ গ্লাদিয়তর সে উৎসবে অংশ গ্রহন করেছিল।

এখানেই বলে রাখি যে তরবারির লাতিন শব্দ হল: গ্লাদিয়ুস । এ কারণে তরবারিপুরুষ সোডর্সম্যানকে বলা হয় গ্লাদিয়তর। গ্লাদিয়তর মানে সশস্ত্র যোদ্ধা যারা অন্য গ্লাদিয়তর কিংবা বন্য পশু কিংবা মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীর সঙ্গে কলোসিয়ামে লড়ে দর্শকের মনোরঞ্জন করে।
শুরুতে পরিবেশিত হত কৌতূক, মানে ভাঁড়ের আগমন হত । এর পরে শুরু হত বিচিত্র প্যারেড বা বিচিত্র প্রাণিদের প্রদর্শনী ; গন্ডার জলহস্তি হাতি জিরাফ সিংহ প্যানথার চিতা ভালুক কাস্পিয়ান বাঘ কুমির সে প্রদর্শনীতে অংশ নিত। পশুগুলি আনা হত আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে-ওসব অঞ্চল রোমান শাসনাধীন । বিস্মিত দর্শকেরা পশুগুলি দেখে উল্লাসে ফেটে পড়ত, সম্রাটের যারপরনাই প্রশংসা করত। এরপর আরম্ভ হত গ্লাডিয়েটর মধ্যে মরণপণ লড়াই। কখনও পশুর বিরুদ্ধে কখনও পশুতে পশুতে।
বড় রক্তাক্ত সে খেলা।
প্রায় চারশ বছর ধরে চলেছিল সে খেলা।
৩
এরপর এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটল। যে মর্মান্তিক ঘটনাটি পঞ্চম শতকের বিশপ থিওডোরেট (৩৯৩/৪৩৭) বর্ননা করে গেছেন। বিশপ থিওডোরেট ছিলেন সিরিয়ার ধর্মযাজক। তিনি লিখেছেন, ‘রোমান কলোসিয়ামে ক্রিড়াকৌতূক শেষবার অনুষ্ঠিত হইয়াছিল ৪০৪ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি । সেই ধূসর দিবসে কলোসিয়ামের রক্তাক্ত প্রাঙ্গনে একজন ন্যায়পরায়ন সাধু ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছিল । টেলেমেকাস-এই হইল সাধুটির নাম। সাধুটি ছিলেন পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের ( বর্তমান তুরস্ক) অধিবাসী । রোমের অ্যাম্পিথিয়েটার-প্রাঙ্গনে ঈশ্বরের সৃষ্ট জীব হত্যার রোমহর্ষন অনুষ্ঠান হইয়া আসিতেছিল। রক্তপাত বন্ধের ঐশ্বরিক উৎসাহ অনুভব করিয়াছিলেন সাধু টেলেমেকাস । রোমে পৌঁছাইয়া জনতার ভিড়ে মিশিয়া থাকিয়া সাধু টেলিমেকাস কলোসিয়ামের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। কলসিয়ামের সুবৃৎ প্রাঙ্গনে দুইজন ভয়াল দর্শন গ্লাডিয়েটর (খুনে অস্ত্রবাজ) একে অন্যকে ক্ষুরধার তরবারি দিয়া হত্যা করিতে সচেষ্ট হইয়া যুদ্ধরত অবস্থায় ছিল। কি করিয়া সাধুটি সংগ্রামরত গ্লাডিয়েটরদের মাঝখানে আসিয়া দুপক্ষকে থামাইবার চেষ্টা করেন তাহা আমি বলিতে পারি না। সাধু তিনবার চিৎকার করিয়া উঠিলেন : “দোহাই, খ্রিস্টের নামে বিরত থাক।” একদল দর্শক আমোদে বাধা পাইয়া সাধুকে লক্ষ করিয়া প্রস্তর নিঃক্ষেপ করিতে থাকিল। হায়, ততক্ষণে বৃদ্ধ সাধুর পবিত্র বক্ষে একজন গ্লাডিয়েটর দ্বারা তরবারি প্রবিষ্ট হইয়া যায়। দর্শক দেখিল সাধু ব্যাক্তিটি মৃত হইয়া রক্তের ভিতরে পড়িয়া আছে । দর্শক করুন দৃশ্যটি দেখিয়া প্রস্তর নিক্ষেপ হইতে বিরত থাকিল; এবং সকল দর্শক মৌন হইয়া কলোসিয়াম ত্যাগ করিতে থাকিল। তৎকালে রোমান সম্রাট ছিলেন অনারিয়াস। তাহার কর্ণে যথাসময়ে বিয়োগান্ত ঘটনাটি পৌঁছিল। তিনিও অত্যন্ত শোকাভিভূত হইয়া পড়িলেন। বিমর্ষ হইয়া থাকিয়া সম্রাট পূর্বাপর ঘটনাবলী বিশ্লেষন করিলেন। ফ্লাবিয়ান বংশের প্রতিষ্ঠাতা রোমান সম্রাট ভেসপাসিয়ান ৭২ অব্দে কলোসিয়াম নির্মানের উদ্যেগ গ্রহন করিয়াছিলেন। ইহার পর ৮০ খ্রিস্টাব্দে কলোসিয়াম-এর নির্মান কাজ শেষ হয়। ঐ বছরই রোমান সম্রাট ভেসপাসিয়ান মারা যান। সুতরাং কলোসিয়ামের রক্তপাত তিনি সৌভাগ্যবশত স্বচক্ষে দেখিয়া যাইতে পারেন নাই। কলোসিয়াম নির্মান করা হইয়াছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, যাহাতে সম্রাটের বিরুদ্ধে আমজনতা রুষ্ট হইয়া বিদ্রোহ না-করিয়া বসে! সম্রাট অনারিয়াস নিগূঢ় হইয়া ভাবিলেন রোমকবাসীদের বশে রাখিবার জন্য হীন উদ্দেশ্যে গ্রহন করিবার আর কি প্রয়োজন, শতবর্ষ হইল রোমান সাম্রাজ্য দরদী খ্রিষ্টধর্ম গ্রহন করিয়াছে। তিনদিন পর সম্রাট কলোসিয়ামে সমূদয় রক্তাক্ত খেলাধূলা নিষিদ্ধ ঘোষনা করেন। এখন প্রশ্ন হইল সাধু টেলিমেকাস কেন প্রাণ দিতে গেলন? পাঠক, লক্ষ করুন, বাইবেলের নতুন নিয়মে লিখিত আছে: ‘শান্তিবাদীগন আর্শীবাদপুষ্ঠ। তাহাদিগকে বলা হইবে ঈশ্বরের সন্তান।’ (ম্যাথিউ ৫/৯) সাধুর তো বাইবেল পাঠ করিবার কথা। বিশদ ব্যাখ্যার আর কি প্রয়োজন। সাধুর অভিপ্রায়টি উপলব্দি করা যায়।”
এই কথাগুলি লিখে গেছেন ৫ম শতকের বিশপ থিওডোরেট ছিলেন সিরিয়ার ধর্মযাজক।
৪
লালনের একটি গান হয়ে যাক-
কবে সাধুর চরণধূলি
মোর লাগবে গায়?
আমি বসে আছি আশাসিন্ধুর
পাড়েতে সদাই।
আহ্, এই গান!
এবং স্মরণ করি জৈনদের একটি প্রার্থনা এরকম: Namo Loe Savva Sahunam: - এর অর্থ: I bow to all saints and sages everywhere in the world!
এই হল কথা।
৫
আধুনিক ইউরোপীয় ঐতিহাসিকগন অবশ্য রোমান কলোসিয়ামে রক্তপাত বন্ধে সাধু টেলিমেকাসের প্রতক্ষ্য ভূমিকায় বিশ্বাস করে না। তাদের যুক্তি হল: এ হল ক্যাথলিক প্রচার, রোমান নথিপত্রে এ ধরণের বিষয়ের উল্লেখ নেই। ‘শান্তিবাদীগন আর্শীবাদপুষ্ঠ:’ আধুনিক ঐতিহাসিকগন বাইবেলের এই কথায়ও বিশ্বাস করে না। আমিও অবশ্যি বাইবেলকে কখনোই ঐশ্বরিক অনুষঙ্গে দেখি না। বাইবেলের প্রেমমূলক নীতিবাক্যগুলি আমার খারাপ লাগে না, এর কারণ সম্ভবত আমি প্রাচ্যবাসী। পাশ্চাত্যের চিন্তাবিদেরা সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় হাজার হাজার পৃষ্ঠার যুক্তিজাল বিস্তার করেন; পক্ষান্তরে রবীন্দ্রনাথ একই বিষয় বোঝান মাত্র ১২ লাইনের গানে ...
আমরা সবাই রাজা
আমাদের এই রাজার রাজত্বে।
বাইবেলে লেখা রয়েছে: “শান্তিবাদীগন আর্শীবাদপুষ্ঠ, তাহাদিগকে বলা হইবে ঈশ্বরের সন্তান।” আমরা এ যুগে ঈশ্বরের সন্তান হতে না চাইলেও আমাদের লক্ষ যে শান্তিবাদী হওয়া এখন একথা অস্বীকার কে করবে?
৬
দীর্ঘদিন হল ইঙ্গ-মার্কিন পরাশক্তি ইরাক আফগানিস্তান তছনছ করছে। তারা খ্রিস্টান হলে সাধু টেলিমেকাসের মত করে বলা যেত: “ দোহাই, খ্রিস্টের নামে বিরত থাক।” আধুনিক ইউরোপীয় ঐতিহাসিকগন তো ইরাক ও আফগান আগ্রাসনের বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছে!
৭
শ্রদ্ধাঞ্জলি: সাধু টেলিমেকাস।
আপনি একুশ শতকের স্পর্শকাতর মানুষের শ্রদ্ধা গ্রহন করুন!

আধুনিক ঐতিহাসিকগন বিশ্বাস না করলেও শিল্পীর চোখে সত্য ধরা পড়েছে ঠিকই ...