জিওদার্নো ব্রুনো।
বিজ্ঞানের পথটি কখনোই মসৃন ছিল না। এখনও কি মসৃন? এখনও পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ বিজ্ঞানের নানাবিধ সুবিধাদি ভোগ করলেও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহন করতে অনিচ্ছুক! যা হোক। দীর্ঘকাল ধরেই মানুষ জগৎ সম্বন্ধে অবৈজ্ঞানিক পৌরাণিক ধারণায় আচ্ছন্ন ছিল; সে আচ্ছনতা যারা যারা জীবনের বিনিময়ে হলেও দূর করতে চেয়েছেন ইতালিও দার্শনিক জিওদার্নো ব্রুনো তাদের মধ্যে অন্যতম। তবে একটা কথা। আমরা যেন ব্রুনোকে পেশাদার জ্যোর্তিবিদ না ভাবি-আসলে ব্রুনো ছিলেন সৌখিন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর লেখক। তিনি তৎকালীন প্রচলিত জ্যোর্তিজ্ঞানের আলোয় মহাবিশ্ব সম্বন্ধে অনুমান করেছেন মাত্র, কোনওকিছু প্রমাণ করেননি, অবশ্য পরে তাঁর অনেক অনুমানই প্রমাণিত হয়ে। তাঁর উদ্দাম কল্পনাপ্রবনতার পিছনে ছিলেন কোপানিকাসের বৈজ্ঞানিক আবিস্কার ...

মানচিত্র ইটালির ক্যম্পেনিয়া প্রদেশে (লালচিহ্নিত অংশ)। এই প্রদেশেরই একটি শহরের নাম নোলা।
জিওদার্নো ব্রুনোর জন্ম ১৫৪৮ খ্রিস্টাব্দে ইটালির নোলা শহরে। অবশ্য ব্রুনোর
পরিবার প্রদত্ত নাম ছিল ফিলিপ্পো ব্রুনো। ব্রুনোর বাবার নাম গিওভান্নি ব্রুনো
-ছিলেন সৈনিক। মায়ের নাম ফ্রাওলিসা সাভোলিনো।
নোলা।
নোলা। এই পথে একদিন হেঁটে গিয়েছিলেন একজন স্বাধীনচিন্তাসম্পন্ন মানুষ
তৎকালীন রীতি অনুযায়ী ধর্মীয় পাঠ গ্রহনের উদ্দেশ্যে ১৫৬১ সালে সেন্ট ডোমেনিকো মঠে ভর্তি হন ব্রুনো।

সেন্ট ডোমেনিকো মঠ। এই মঠেই খ্রিস্টীয়সমাজের বিখ্যাত সাধু সেন্ট থমাস অ্যাকুইনাস অধ্যয়ন করেছিলেন।
সেন্ট ডোমেনিকো মঠে থাকাকালীন নিজের নাম পরিবর্তন করে রাখেন গিওদার্নো ব্রুনো । যা হোক। পাঠ সমাপ্ত করে তিনি ডমিনিকান অর্ডারের যাজক হলেন। ১৩ শতকে ফ্রান্সের সেন্ট ডোমেনিক এই ক্যাথলিক সম্প্রদায়টি প্রতিষ্ঠা করেন।
আসলে ব্রুনো ছিলেন দার্শনিক। তাই তাঁর মঠের একঘেঁয়ে জীবন ভালো লাগেনি। তাছাড়া খ্রিস্টীয়শিক্ষা অনেক বিষয়ই পরখ না করে তাঁর পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। কথাবার্তায় খোলামেলা ছিলেন ব্রুনো, কোনওরকম ভনিতা পছন্দ করতেন না। তাঁর সংশয়ের কথা বলতেনও সহকর্র্মীদের।

ব্রুনো
১৫৭৬ সালে তিনি মঠ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। তারপর ইউরোপ ভ্রমন করেন; মেধাবী পন্ডিত ছিলেন-ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা বিষয়ে ভাষণ দেন। কীভাবে স্মৃতিশক্তি বাড়ানো যায়-সে ব্যাপারেও বক্তব্য রাখতেন। এ ব্যাপারে ফ্রান্সের ৩য় হেনরি ও ইংল্যান্ডের প্রথম এলিজাবেথ-এর দৃষ্টি আকর্ষন করেছিলেন । “মনে রাখার কৌশল” বা “দ্য আর্ট অভ মেমরি” নামে একটি বইও লিখেছিলেন -যে বইটি বিস্মরণপ্রবণদের আজও কাজে লাগে।

ব্রুনোকে মানুষ যুগ যুগ ধরে স্মরণ করবে ...
আমি আগেই বলেছি, কথাবার্তায় খোলামেলা ছিলেন ব্রুনো, কোনওরকম ভনিতা পছন্দ করতেন না। লেখালেখিতেও তাই। ১৫৮৪ সাল। ‘অভ ইনফিনিটি, দ্য ইউনির্ভাস অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড’ নামে একটি বই লেখার পর তাঁর বিপদ ঘনিয়ে আসে।
কিন্তু, কি লিখেছেন সে বইতে?

মহাবিশ্ব। মানুষের বিস্ময়; তবে মানুষের প্রজ্ঞায় এর রহস্যজট খুলছে।
আমাদের এই সৌরজগৎটি সূর্যকেন্দ্রিক। মহাবিশ্ব অসীম। নক্ষত্রগুলি আসলে সূর্যর মতোই স্বাধীন ও স্বতন্ত্র মহাজাগতিক বস্তু-যাদের সংখ্যা কোটি কোটি। মহাবিশ্ব কেবল অসীম নয়-এর প্রবাহও অনন্ত। আর পৃথিবী বিশ্বজগতের কেন্দ্রে অবস্থিত না-হলে আর দূরবর্তী নক্ষত্রগুলি সূর্যর মতো বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হলে মহাবিশ্বে আরও পৃথিবী (গ্রহ) আছে ...সেখানে আমাদের মতো প্রাণিও থাকতে পারে!
যা হোক। ব্রুনোর ধারণার সঙ্গে ক্যাথলিক বিশ্বাসের সঙ্গে খাপ খায়নি। তারা কাজ দেবে বলে রোমে ডেকে নিয়ে যায়। ব্রুনো রোমে পৌঁছলে তাঁকে ইনকুইজিশন (ধর্মীয় বিচার সংস্থা) এর কাছে ধর্মদ্রোহী হিসেবে হস্তান্তর করা হয়।

রোমের ক্যাসটেল সেন্ট অ্যাঞ্জেলো। এখানেই ৮ বছর শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল স্বাধীন চিন্তার দার্শনিকটি । বিচার অনুষ্ঠিত না-হওয়া পর্যন্ত নিয়মিত টর্চার ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হত। তারপরও তিনি মাথা নত করেনি গন্ডমূর্খ মূঢ়দের কাছে। বলেছিলেন: “আমার মৃত্যুদন্ডের রায় ঘোষনা শোনার সময় আমার চেয়ে তোমরাই ভয় পেয়েছ বেশি!”
মৃত্যুদন্ডের রায় ঘোষনার পরপরই ব্রুনোর চোয়ালে লোহার কপাট পরিয়ে দেওয়া হয়। লোহার শলাকা দিয়ে জিভ ফুটো করে দেওয়া হয়। ১৬০০। ফেব্রুয়ারি ১৯। স্বাধীন চিন্তার দার্শনিকটি রোমের রাস্তায় টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় ... অগ্নিমঞ্চের দিকে। তারপর ...নগ্ন করে আগুন ধরিয়ে দেয় ...

শিল্পীর তুলিতে ...ইতিহাসের সেই নৃশংসতম দৃশ্য

ভাস্কর্যশিল্পীর কল্পনা ও পরিশ্রমে ব্রুনোর প্রতি শ্রদ্ধা