সন্ধ্যার আকাশটা মেঘলা হয়েই ছিল।
সাতটার দিকে আজিজ সুপার মার্কেটে ঢোকার পর পরই ঝুপ ঝুপ বৃষ্টি শুরু ...
শেষ বৈশাখের বৃষ্টি।
চশমা পরা মেধাবী কিশোরীর মতন গম্ভীর
শেষ বৈশাখ-সন্ধ্যার বৃষ্টি।
আশ্চর্য! আজ লোড শেডিং নেই যে! বইয়ের দোকানগুলোয় স্নিগ্ধ আলো। পাঞ্জাবির দোকানগুলোতেও স্নিগ্ধ আলো। প্যাপিরাসের ভিতর বেশ ভিড়। বাইরের করিডরেও ভিড়। নিঝুম অরণ্যরা দাঁড়িয়ে ছিল। সেলিনা মলিকে দেখে হাই করল; নিঝুম অরণ্যের পাশে মাঝ বয়েসী নিধু গায়েন; লোকটা হাসল। ‘হাই’ বলে দ্রুত এগিয়ে যায় সেলিনা মলি। করিডরে হু হু করে ঢোকা ঠান্ডা বাতাস ও সিগারেটের গন্ধের সঙ্গে গাঁজার গন্ধ আর ঝুলিয়ে রাখা সার সার আনকোরা পাঞ্জাবির রঙের গন্ধ মিশেছিল। কেমন একটা নিঃসঙ্গতার অনুভূতি হয় সেলিনা মলির । শিউরে ওঠে । দ্রুত হাঁটে। ভীষন অস্থির লাগছে। অধ্যাপক আনাল হক কি এসে গেছেন?
সুব্রত সাঁইয়ের ঋদ্ধির সামনে এসে দাঁড়াল সেলিনা মলি।
ফাঁকা দোকান। ফাঁকাই থাকে ঋদ্ধি। সুন্দর সুন্দর পাঞ্জাবি আর জনপ্রিয় ইন্ডিয়ান বইয়ের বদলে ঋদ্ধিতে কেবল দু-বাংলার লিটিল ম্যাগাজিন রাখে সুব্রত সাঁই । বেচাকেনা কম। লসের পর লস। তবু দোকান তুলে দেবে না সুব্রত সাঁই-এমনই গোঁয়ার লোক সে। নাঃ, ভিতরে সুব্রত সাঁই নেই। সুব্রত সাঁইয়ের বদলে ঋদ্ধির কাউন্টারে শরৎ সূর্যকে একা বসে থাকতে দেখল সেলিনা মলি। এই দোকানটা অবশ্য সুব্রত সাঁইয়ের একার। শরৎ সূর্য ঋদ্ধির শরিকও নয়; মাঝে মাঝে বসে-এই যা। সেলিনা মলি জানে শরৎ সূর্য বেকার। পুরান ঢাকায় না কোথায় থাকে ।
টিউব লাইট জ্বলে ছিল- ঢুকতেই আগর বাতির মৃদু গন্ধ পেল সেলিনা মলি। টেবিলের ওপর পা তুলে বসেছিল শরৎ সূর্য। ওকে দেখে চট করে পা নামিয়ে নিল। নির্ঘাৎ পান করেছে। চোখ দুটো কেমন বসা-বসা; ঈষৎ বেসামাল। পাতা বিড়ি টানছিল বোধ হয়। পাতা বিড়ির গন্ধটা কড়া ; আগর বাতির গন্ধের সঙ্গে মিশে কেমন অদ্ভুত একটা গন্ধ তৈরি হয়েছে।
সুব্রত কই? ব্যাগটা টেবিলে রেখে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল সেলিনা মলি।
মীরপুর। শরৎ সূর্যর গলার স্বরটা কেমন খসখসে।
ও।
শরৎ সূর্য কে অনেক দিন পরে দেখল সেলিনা মলি। শ্যামলামতন; মাথায় উশকোখুশকো চুল, মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল। পয়ত্রিশের মতন বয়স; কেমন সাধু সাধু দেখতে। জটিল জটিল সব কবিতা লেখে। সেলিনা মলিও জটিল জটিল সব কবিতা লেখে। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে সূক্ষ্ম রেষারেষিও আছে। শরৎ সূর্য ইদানিং ‘রাত্রি নীল’ নিক নিয়ে জনপ্রিয় একটা বাংলা ব্ল¬গেও লিখছে। ( ‘জোছনাময়ী তারা’ -এই নিক নিয়ে রেজিষ্ট্রেশন অবশ্য সেলিনা মলিও করেছে; ফ্রন্ট পেজে একসেস অবশ্য এখনও পায়নি।)
চা খান। বলে ওপাশে মেঝের ওপর রাখা ফ্লাক্সটা তুলে নিল শরৎ সূর্য। খয়েরি রঙের ময়লা একটা পাঞ্জাবি পরে ছিল। ভয়ানক শুকিয়ে গিয়েছে। দু-তিন মাস আগেও এতটা শুকনো ছিল না। কী হয়েছে ওর?
এখনও অধ্যাপক আনাল হক আসছেন না। সেলিনা মলি অস্থির বোধ করে। আনাল হক (এটি তাঁর ছদ্মনাম কি না জানা যায়নি) জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক । কবি। ষাটের মতন বয়স। ছোট কাগজ ‘জাতিস্মর’-এর সম্পাদক। দিন কয়েক আগে জ্যৈষ্ঠ সংখ্যার জন্য লেখা চেয়ে ফোন করেছিলেন । কাল রাত আড়াইটার দিকে কবিতাটার কম্পোজ শেষ করেছে সেলিনা মলি। সিডিটা দিতেই আজ আসা।
শরৎ সূর্য চায়ের কাপটা বাড়িয়ে দিল। গুড়ের চা। বাড়ি থেকেই বানিয়ে আনে। আগেও খেয়েছে। দারুন। সেলিনা মলির বিষন্নতা কাটতে শুরু করে। বৃষ্টির ঝরঝর শব্দটা অল্প হলেও কানে আসছিল। করিডরে লোক চলাচলের আওয়াজ। একটা মেয়ের চাপা কন্ঠে হাসি। কে যেন গাইছে-
মন মানুষ আছে ঢাকা/খোঁজ করলে পাবে দেখা
শক্ত কইরা তারে ধর রে/
মুর্শিদে দিলে ঠাঁই মিলবে আকাশের চাঁদ/
পাপযন্ত্রণা যাবে ঘুচে রে।
গলাটা চেনা চেনা মনে হল। জুলফিকার রাসেল? আগর বাতির গন্ধটা আরও ঘন হয়ে ওঠে। আরেকটা পাতাবিড়ি ধরিয়েছে শরৎ সূর্য । বলল, বেশ বৃষ্টি-কী কন?
হ। মজা করে বলল সেলিনা মলি। প্রায় দশ বছর ধরে ঢাকায় আছে সেলিনা মলি। এরপরও ঢাকার ডায়ালেক্ট পুরোটা আয়ত্ব করতে পারল না ও। শরৎ সূর্য অবশ্য অবিকল ঢাকার ডায়ালেক্ট বলে না। ওর স্পীচটা কেমন যেন-মিশ্র ধরনের। কাউন্টারের উল্টোদিকে চে গুয়েভারার পোস্টার। সেদিকে চোখ গেল। হঠাৎই কী এক অজানা কারণে ইংরেজ কবি অডেন সম্বন্ধে কয়েকদিন আগে পড়া কয়েকটি কথা মনে পড়ে গেল সেলিনা মলির:His own beliefs changed radically between his youthful career in England, when he was an ardent advocate of socialism and Freudian psychoanalysis, and his later phase in America, when his central preoccupation became Christianity and the theology of modern Protestant theologians...
বিড়ির প্যাকেটা বাড়িয়ে দিয়ে শরৎ সূর্য বলল, টানবেন?
না। থাক। অধ্যাপক আনাল হকের আসার কথা।
ও। বিড়ির প্যাকেটা সরিয়ে শরৎ সূর্য সেলিনা মলির কালো রঙের মুখটির দিকে তাকাল। তেমন শ্রী নেই। চশমা পরায় গম্ভীর লাগে। শরৎ সূর্য একমুখ ধোঁওয়া ছাড়ল। তারপর বলল, আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে মলি। কন্ঠস্বরটা গম্ভীর।
কী! সেলিনা মলির বুকটা ধক করে ওঠে। চশমার ভিতর থেকে ও শরৎ সূর্যর চোখে চোখ রাখে। শরৎ সূর্যর ভাঙ্গাচোরা মুখটা কেমন গম্ভীর। গম্ভীর আর বিষন্ন। আগর পোড়া তীব্র গন্ধটা কে যেন আরও উশকে দিল। ঠিক কী বলবে বুঝতে পারে না সেলিনা মলি। ঠিক তখনই ঋদ্ধিতে ঢুকলেন অধ্যাপক আনাল হক। মাথায় টাক, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, ধবধবে দাড়ি, মোটা, থলথলে, মাঝারি উচ্চতা- সাদা ফতুয়া আর কালো প্যান্ট পরেছেন। কাঁধে কাপড়ের একটা ঝুলি। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল সেলিনা মলি। শরৎ সূর্য বিড়িটা দ্রুত নিভিয়ে ফেলল।
অধ্যাপক আনাল হক বললেন, এই যে সেলিনা। কী- তোমার কবিতা কোথায়?
এই যে- বলে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ব্যাগ খুলে একটা সিডি বার করল সেলিনা মলি।
গুড। তা কী নাম কবিতার?
সেলিনা মলি বলল, চশমা পরা মেধাবী কিশোরীর মতন শেষ বৈশাখ-সন্ধ্যার গম্ভীর বৃষ্টি।
বাহ্ । নামেই তো হিট। সিডিটা নিতে নিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন অধ্যাপক আনাল হক । বসলেন।
শরৎ সূর্য ততক্ষনে উবু হয়ে ফ্লাক্স থেকে কাপে চা ঢেলে নিয়েছে। বছর খানেক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে। অবশ্য ইসলামের ইতিহাসে। তখন থেকেই অধ্যাপক আনাল হককে চেনে। স্যার, স্যার করে। এখন সিধে হয়ে বসে বলল, চা নেন স্যার।
চা? আচ্ছা দাও।
অধ্যাপক আনাল হক ভিজে যাননি; তার মানে তিনি আজিজেই ছিলেন। অধ্যাপক আনাল হককে নিয়ে আজিজে ইদানিং ফিসফিস কানাঘুঁষো চলছে। দিনদিন কেমন রক্ষণশীল হয়ে যাচ্ছেন অধ্যাপক আনাল হক । আগে সমাজতন্ত্র ও আধুনিকতার কঠোর সমর্থক ছিলেন; কথায় কথায় পোস্ট কলোনিয়ালিজমের তত্ত্ব ঝাড়তেন-আজকাল নাকি প্রবল আধাত্মবাদী হয়ে উঠছেন অধ্যাপক আনাল হক । ইরানের ইসলামী বিপ্লব ও সেই বিপ্লব নিয়ে মিশেল ফুকোর ধ্যানধারনা নিয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখছেন। দাড়ি রেখেছেন (সেটা অবশ্য ব্যাপার না; দাড়ি কার্ল মার্কসেরও ছিল।) অধ্যাপক আনাল হকের জীবনদর্শন বদলে গেলেও এখনও লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেন; নিয়মিত আজিজেও আসেন। বহুদিনের অভ্যেসটা-রক্ষণশীল হওয়া সত্ত্বেও ত্যাগ করতে পারছেন না?
অধ্যাপক আনাল হক চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, খবরটা শুনেছ তো মলি?
কোন্ খবর? সেলিনা মলি খানিকটা বিস্মিত।
ইরানের প্রেসিডেন্ট আহমেদনিজাদ ...
হ্যাঁ, তো?
ইরানের প্রেসিডেন্ট হয়েও খলিফাদের মতন সরল জীবন যাপন করেন আহমেদনিজাদ ; শতরঞ্জি পেতে মেঝেতেই ঘুমান।
তাতে কী লাভ? সেলিনা মলির কন্ঠে শ্লেষ।
কেন? কেন?
সেলিনা মলি শ্লেষের সুরে বলল, আহমেদনিজাদ হলোকাস্ট অস্বীকার করেছেন।
অধ্যাপক আনাল হক খানিকটা রুঢ়কন্ঠেই বললেন, হলোকাস্ট হইল বানোয়াট।
তাই?
হ্যাঁ।
আপনি কিন্তু আগে হলোকাস্ট স্বীকার করতেন আনাল ভাই। সে নিয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধও লিখেছেন। সেলিনা মলির কন্ঠে জেদ। ধীরে ধীরে ক্ষুব্দ হয়ে উঠছে ও। হলোকাস্ট নিয়ে একটা ছবির দৃশ্য মনে পড়ে গেল ওর। নাজীরা পোল্যান্ডের এক শহরে ঢুকেছে। লোকজনকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নেওয়ার জন্য ট্রাকে তুলছে অস্ত্রের মুখে। রাস্তার মোড়ে একটা ফাঁসিকাষ্ঠ ... দুজন কিশোর-কিশোরী দাঁড়িয়ে। কিশোরী গলায় দড়ি ...
অধ্যাপক আনাল চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন: আগে আমি হলোকাস্ট স্বীকার করতাম। এখন করিনা। আমি তোমাকে তোমার মেইলে কয়েকটা লিঙ্ক পাঠাব। পড়ে দেখ। তা হলেই বুঝবে ওসব হল ফেইক-ফিলিস্তিনে ওই হারামির বাচ্ছাদের ঢোকানোর জন্য পশ্চিমাদের সুকৌশল প্রচার । ইরানের প্রেসিডেন্ট আহমেদনিজাদ বলেছেন ... যাক, এইসব তোমাদের বলে কোনও লাভ নেই। আর তুমি বলল না আপনি আগে কিন্তু হলোকাস্ট স্বীকার করতেন আনাল ভাই। বেশ। তা হলে বলি- বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের জ্ঞান বাড়ে না কমে? এই জুলাইয়ের আমার কত হবে বল তো?
আপনার ডেট অভ বার্থ কত স্যার? শরৎ সূর্য জিজ্ঞেস করল।
জুলাই; ১২।
শরৎ সূর্য বলল, কবি আল মাহমুদের জন্মও তো বারোই জুলাই।
সহসা সেলিনা মলির মনে পড়ল ইরানের প্রেসিডেন্ট আহমেদনিজাদের পুরো নাম মাহমুদ আহমেদনিজাদ। আর ইরান দ্রুত পারমাণবিক ক্ষমতা অর্জন করতে যাচ্ছে। আরেক হলোকাস্ট কি আসন্ন? হঠাৎই ওর শীত করতে থাকে। হাতের তালু ঘেমে ওঠে। তখন শরৎ সূর্য বলল: আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে। কী! সেলিনা মলি কেঁপে উঠেছিল। কী বলবে শরৎ... রশীদের মুখটা মনে পড়ে ওর।
আল মাহমুদের কথায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল অধ্যাপক আনাল হকের মুখ। কলকল করে বললেন, কাল অনেকদিন পর গেসলাম মাহমুদ ভাইয়ের বাসায়। পীর ... পীর -সাক্ষাৎ পীর; বুঝলা...তিনি ছাড়া কোরান আর কেউ বুঝছে বলে আমার মনে হয় না। আহা। কবির ব্যাখ্যায় কোরানের সত্য ধরা পড়ে।
ভীষন বিস্মিত হয়ে শরৎ সূর্যর দিকে তাকাল সেলিনা মলি । বলে কি লোকটা!
ঠিক তখনই কী এক বিচিত্র কারণে তিনজনের মোবাইল ফোন একসঙ্গে বাজল।
শরৎ সূর্য : হ্যালো। কও। পেষ্ট? আচ্ছা, আনুম নে। ...হ হ । আইতাছি। আইতাছি। রাস্তায় আছি। বৃষ্টি পড়ে দেখ না ...
সেলিনা মলি: হ্যাঁ, রিনা’পা ... বলো ...আচ্ছা। হু। আচ্ছা। ঠিকাছে ...হু ...
অধ্যাপক আনাল হক: জ্বি, মুসলিম ভাই। কন। আচ্ছা। নয়টার ভিতরেই পৌঁছায়া যাব ইনশাল্লা। নো টেনশন। আমি না আইলে শুরু কইরেন না। ওকে ...ফাইন।
কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়িয়ে হন্তদন্ত হয়ে অধ্যাপক আনাল হক ঋদ্ধি থেকে বেরিয়ে যান। যেন আর কেউই ছিল না দোকানে। শরৎ সূর্যর দিকে তাকিয়ে সেলিনা মলি বলল, অধ্যাপক আনাল হকের অসুখের কি নাম জানেন?
কী? শরৎ সূর্য অবাক।
অডেন ডিজিজ।
অডেন ডিজিজ?
হ্যাঁ, অডেন ডিজিজ।
শরৎ সূর্য বলল, বুঝছি। অধ্যাপক আনাল হকের বাড়ি ছিল কেরানিগঞ্জ। বাপমায়ে নাম রাখছিল জয়নাল আবেদিন। মাতব্বরি কইরা রাখছে আনাল হক।
তাই?
হ্যাঁ। শরৎ সূর্য মাথা ঝাঁকায়।
সেলিনা মলি বলল, বাদ দেন। শুনেন শরৎ, আমি একটা বিপদে পড়ছি। আমাকে উদ্ধার করেন।
শরৎ সূর্য অবাক হয়ে বলল, কী বিপদ? বইলা ফেলান।
আজ সাদা ওরনা আর নীল রঙের সালোয়ার-কামিজ পরেছিল সেলিনা মলি। বৃষ্টির জন্যই ভ্যাপসা গরম। অল্প অল্প ঘামছিল ও। ওরনা দিয়ে কপাল মুছে নিল। নিয়ে বলল-আমার একটা থাকার জায়গা দরকার। আজ তো তেরো তারিখ। সামনের মাস থেকে হলেই চলবে।
আচ্ছা। সমস্যা নাই। আরেকটা বিড়ি ধরাতে ধরাতে শরৎ সূর্য বলল।
আশ্চর্য! সমস্যা নাই মানে?
মানে আর কী। যতদিন না ভালো ব্যবস্থা হয় ততদিন আমাগো লগেই থাইকেন।
আপনারা পুরান ঢাকায় থাকেন না?
হ। সূত্রাপুর। ঋষি পাড়ায়।
মানে ... আমাকে পুরান ঢাকায় থাকতে হবে?
সমস্যা আছে?
আমার অফিস মহাখালি। দূর হয়ে যায় না?
কী এমন দূর? রোজ লোকে ট্রেনে-বাসে চিড়াচ্যাপ্টা হইয়া নারানগঞ্জ-জয়দেবপুর থেকে ঢাকায় আসতেছে। আর আপনি এইসব কি কন?
সেলিনা মলি অস্বস্তি বোধ করতে থাকে। ও জিজ্ঞেস না-করে পারল না, আপনার বাসায় কে কে আছে?
মা, আর বউ আর আমাগো পাঁচ বছরের মাইয়া আর কাজের একটা মেয়ে।
আপনাদের সঙ্গে আমি থাকলে ...মানে আপনার বউ ...মানে ...
দূরও ...বীথিরে না দেখলে বুঝবেনা। নেত্রকোনার মেয়ে।
তা হলে আপনার বউয়ের সঙ্গে মানে- বীথি ভাবীর সঙ্গে কথা বলে নিয়েন। তারপর আমারে ফোন দিয়েন। নাম্বার তো আছেই।
আজই চলেন যাই।
কোথায়?
সূত্রাপুর। আমাগো বাড়ি। ঋষি পাড়ায় থাকি।
আজই।
অসুবিধা কি? আমার মায়েরে দেখলে আপনার টেনশন কমব। না দেখলে কমব না।
দ্রুত ভাবতে থাকে সেলিনা মলি। একটু আগে রিনা’পা ফোন করেছিল। ফ্ল্যাটটা ছাড়তে হবে। সে কথা মনে করে ঘড়ি দেখে বলল, চলেন তাহলে।
যাব। অস্থির হইয়েন না। আগে সুব্রত আসুক।
আটটার আগেই সুব্রত সাঁই ফিরল। নিখুঁত কামানো মাথা। নীল জিন্স আর লাল টি-শার্ট পরেছিল। পুরোপুরিই ভিজে গেছে। হাতে রুমাল ও ফাইল। সেলিনা মলিকে দেখে হাসল। বলল, দিদি, পরশু আমরা-মানে ফুলদল শিল্পীগোষ্ঠী চাঁদপুর যাচ্ছি। স্টিমারে। দিনে গিয়ে দিনে ফিরব। আপনি যাবেন আমাদের সঙ্গে?
সেলিনা মলি দ্রুত ভাবল। পরশু রশীদের ওখানে যেতে হবে। সংক্ষেপে বলল, যদি যাই তো কাল ফোন করে আপনাকে জানাব।
ঠিক আছে। বলে সুব্রত সাঁই হাসল।
দুজনে ঋদ্ধি থেকে বেরিয়ে পড়ল। তার আগে নীল রঙের ফ্লাক্সটা সাদা একটা পলিপ্যাকে ভরে নিল শরৎ সূর্য। তখনও আজিজের করিডরে ঠান্ডা বাতাস ও সিগারেটের গন্ধের সঙ্গে পাঞ্জাবির রঙের গন্ধ মিশে ছিল। তখনও প্যাপিরাসের ভিতর বেশ ভিড়। বাইরে নিঝুম অরণ্যের পাশে গিয়াসউদ্দীন সেলিম দাঁড়িয়ে। গিয়াসউদ্দীন সেলিমের মুখচোখে সাফল্যের আনন্দ। নিঝুম অরণ্য সেলিনা মলিকে দেখে হাসল -ওর পাশে সেই নিধু গায়েন, লোকটাও হাসল। দ্রুত এগিয়ে যায় সেলিনা মলি। পাঠক সমাবেশের সামনে জটলায় জুলফিকার রাসেল দাঁড়িয়ে ছিল- শরৎ সূর্যকে দেখেই এগিয়ে এল। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, আব্বে, আমার জিনিস কই।
দিমুনি। বলে কাটিয়ে চলে আসে শরৎ সূর্য। শরৎ সূর্যর মুখে সামান্য অস্বস্তির ধুলো জমেছে লক্ষ করল সেলিনা মলি।
ঝুম বৃষ্টিটা ততক্ষনে থেমে গেছে। অবশ্য ঝিরঝির করে ঝরছিল। বাতাস অবশ্য অশান্ত। ভেজা ফুটপাতের ওপর নেমে এল ওরা। একটা সি এন জি দাঁড়িয়ে। সাদা একটা টয়োটা। ঝাঁ ঝাঁ পেট্রলের গন্ধ। একটা বাস। তার হেড লাইটের আলো। সেই সঙ্গে ভিজে দমকা বাতাস। শাহবাগের দিকে মুখ করে পাশাপাশি হাঁটতে লাগল ওরা। জাদুঘরের সামনে থেকে রিক্সা নেবে। একটা পাতা বিড়ি ধরালো শরৎ সূর্য। সেলিনা মলি শীত টের পায়। ঋদ্ধির বাইরে তখন আজিজের করিডরে অদৃশ্য শীতেরা এলোমেল হয়ে জুজু বুড়ির মতন ছড়িয়ে যাচ্ছিল। ক্ষণিকের জন্য কালো মতন নিধু গায়েনের মাঝবয়েসী কঠোর মুখটা ভেসে ওঠে। গতকাল রাত্রেই লোকটাকে স্বপ্নে দেখেছিল ও। আদিবাসী মুখোশ পরে ছিল লোকটা। আর খুব কাছেই যেন অসম্ভব জোরে বীণ বাজছিল। হরপ্পা হরপ্পা আধাঁর ঘনিয়ে ছিল চারপাশে । ঘন হরপ্পা হরপ্পা আধাঁর ...আর বোধ হয় সাপের খোলশ ...অজস্র ...আর একটা লোক ধানগাছের মাঝখান দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছিল সূর্যাস্তের দিকে ... সুলতানের ছবি কি? নিঝুম অরণ্য কি যেন বলছিল... মলি, আপনার এনজিওর চাকরিটা থাকবে না। কেন? নিঝুম অরণ্য মিলিয়ে যায়। সেলিনা মলি বলল, তখন কী বলবেন বলছিলেন?
শরৎ সূর্য বলল, আমার ক্যান্সার ধরা পড়ছে। আমি মইরা গেলে বীথিরে বইলেন বিয়া করতে। শরৎ সূর্যর কন্ঠস্বরটা নির্বিকার।
কী! সেলিনা মলি দাঁড়িয়ে যায়।
হ। শরৎ সূর্য বলল। বীথিরে জানাই নাই এখনও।
বলেন কী! ইস! কোন্ ডাক্তার দেখিয়েছেন? সেলিনা মলির বুকটা ভীষন কাঁপছে।
মাহজাবীন হক । এফসিপিএস। গ্রিন রোডে বসেন ।
ওহ্। সেলিনা মলির দম বন্ধ হয়ে আসে। সেলিনা মলি জানে একটা অদৃশ্য ঘূর্ণি ঘুরছে। এই শহরে। কখন যে কাকে টান দেবে। সেই অদৃশ্য ঘূর্নির টানেই আজ রিয়াজ ভাইয়ের সঙ্গে রিনা’পা ডিভোর্স হয়ে গেল। ওদের ফ্ল্যাটেই সাবলেট থাকে সেলিনা মলি-কলাবাগানে। এখন অন্য কোথাও চলে যেতে হবে। রিনা’পা এ মাসের পঁচিশ তারিখ জার্মানি চলে যাচ্ছে। রিয়াজ ভাইয়ের এনজিওতে চাকরি করে সেলিনা মলি। চাকরিটাও থাকবে কি না কে জানে। নিঝুম অরণ্য কাল রাতের স্বপ্নে কি যেন বলছিল ... মলি, আপনার এনজিওর চাকরিটা থাকবে না। কেন? সেলিনা মলি জানে একটা অদৃশ্য ঘূর্ণি ঘুরছে। সভ্যতায়। যে অদৃশ্য ঘূর্নির বলে ১৯৪২ সালে পোল্যান্ডের একটা শহরে ঢুকে পড়েছিল সশস্ত্র নাজীরা । লোকজনকে তারপর কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নেওয়ার জন্য অস্ত্রের মুখে ট্রাকে তুলেছিল। রাস্তার ধারে এক ফাঁসিকাষ্ঠ ... তার সামনে দু’জন কিশোর-কিশোরী। কিশোরীর গলায় দড়ি ...ক্যাপ পরা কিশোরটি কিছুটা বিমূঢ় ...
শরৎ সূর্য বলল, আমি মইরা গেলে বীথিরে বইলেন বিয়া করতে। বাচ্চাটার কথা তো ভাবতে হবে। পেনিলোপির মতন সতী হইয়া বাঁইচা থাইকা কী লাভ?
সেলিনা মলির মনে হল এ শহরের আজ রাতে তুষার যুগ নেমেছে। এত শীত। ওর শ্যামলা শরীরটি ভিজে যায়। ঝড়ো বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ পায়। ও শরৎ সূর্যের পাশে হেঁটে হেঁটে রাস্তা পার হয়। আবারও ভেজা ফুটপাত। শক্ত অনঢ় রেলিং। রেলিংয়ের ওপাশে জাদুঘরের আবছা অবয়ব। জাদুঘরের কাছে রিক্সা নেওয়ার কথা। ওরা রিক্সা নেয় না। বরং, হাঁটতে থাকে । ডানপাশে চারুকলা রেখে এগিয়ে যায়। ঝির ঝির বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছিল।
শরৎ সূর্য বলল, কী সুন্দর একটা জীবন কাটল এই ঢাকাই শহরে। আপনি তো শুনছি সিরাজগঞ্জের মেয়ে?
হ্যাঁ। তাড়াস উপজেলা। মাধাইনগর।
শরৎ সূর্য বলল, আমার জন্ম পুরান ঢাকায়। পড়ছিলাম পোগোজ স্কুলে । পুরান ঢাকার পুলাপাইনে এখন খালি মোবাইল মোবাইল করে। দশ-পনেরো বছর আগে পুরান ঢাকার পুলাপাইনে ঘুড়ি উড়াইত, কবুতর পালত। আমার অনেকগুলি কবুতর ছিল। কবুতরের ঘর ছিল ছাদে। কবুতরের ঘেরান ভালা পাইতাম। আমার আবার সাইকেলের শখ হইল। তখন ক্লাস এইটে উঠছি। আব্বারে বললাম সে কথা। আব্বা আমারে একখান লাল রঙের চপার সাইকেল কিন্যা দিল। আপনি চপার সাইকেল দেখছেন?
না।
না দেখলে অসুবিধা নাই। আমি তাড়াস উপজেলার মাধাইনগর যাইনি। আব্বা লাল রঙের চপার সাইকেল কিন্যা দিয়া কইলেন: রমজান মিঞা। সাবধানে সাইকেল চালাইবা। আচ্ছা, আব্বা। আমি কইলাম। এই রাস্তা দিয়া ... ফুলার রোড দিয়া কত সাইকেল চালাইছি। আগে কত ফাঁকা ছিল ঢাকা শহর। আর এখন? বলে হঠাৎ সেই গানটা ধরল শরৎ সূর্য-মন-মানুষ আছে ঢাকা/খোঁজ করলে পাবে দেখা/ শক্ত কইরা তারে ধর রে/ মুর্শিদে দিলে ঠাঁই মিলবে আকাশের চাঁদ/ পাপযন্ত্রণা যাবে ঘুচে রে।।
ঝিরঝির করে বৃষ্টি ঝরেই চলেছে।
ঝাঁ ঝাঁ পেট্রলের গন্ধ।
হেড লাইটের আলো।
বাঁয়ে সোরওয়ার্দী পার্ক থেকে আসা ভিজে দমকা বাতাস।
সেলিনা মলি বলল, আমার জন্ম সিরাজগঞ্জের একটা গ্রামে। জন্মের পর আব্বা নাম রাখছিল সেলিনা আক্তার। সেই মানুষ ভোর রাতে জলায় মাছ ধরতে গিয়ে আর ফিরল না। আব্বা মারা যাওয়ার পর আমরা চাচার কাছে মানুষ। লোকে আমার সম্বন্ধে বলে না- সেলিনা মলি জটিল জটিল সব কবিতা লেখে। হ্যাঁ, কবিতা লিখতাম বলেই বেঁচে গেছি। ষোল বছর বয়েসেই লিখেছিলাম: আদিবাসী মুখোশ পরা লোকটা/ আমাকে হরপ্পা হরপ্পা আধাঁরে টেনে নিয়ে যায়/ আর খুব কাছেই অসম্ভব জোরে যেন বীণ বাজছিল / ...আর বোধ হয় সাপের খোলশ ...অজস্র ...আজও কবিতারতি হয় বলেই আমি আজও বেঁচে আছি। তারপর নানা ঘটনা। সিরাজগঞ্জ শহরের মেজ চাচার বাড়ি থেকে ইন্টার পাস করলাম। যথাসময়ে ঢাকায় এলাম। দূর সম্পর্কের এক ফুপুর বাড়ি উঠলাম মালিবাগে। তখন একটা প্রেম করে ছ্যাঁকা খাইছিলাম বলে ঢাকা ইনভারসিটিতে চান্স পাই নাই। ইডেনে পড়লাম। ইডেনেই রাজশাহীর রিনা আপা সঙ্গে পরিচয়। রিয়াজ ভাইয়ের সঙ্গে প্রেম করত রিনা আপা; রিয়াজ ভাই তখন প্রশিকায় চাকরি করতেন। আমি পাস করে রিয়াজ ভাইয়ের এনজিও তে জয়েন করলাম-রিয়াজ ভাই ততদিনে প্রশিকা ছেড়ে অন্য একটা এনজিওতে জয়েন করেছে। তার আগে রিনাপার সঙ্গে রিয়াজ ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেছে; মগবাজারে ফ্ল্যাট ভাড়া নিল ওরা। আমিও সাবলেট হলাম। বিয়ের পর কেন জানি বনিবনা হয়নি দুজনের। খালি ঝগড়া করত রিয়াজ ভাই আর রিনাপা। আজ ওদের ডির্ভোস হয়ে গেল ...
ঝিরঝির করে বৃষ্টি ঝরেই চলেছে।
পাতাবিড়ি শেষ; রমজান মিঞার পকেটে গোল্ড লিফের একটা প্যাকেট ছিল। দুটো সিগারেট ছিল। তারি একটা সিগারেট ধরায়।
সেলিনা আক্তার বলতে থাকে-তার আগেই অবশ্য আমার সঙ্গে রশীদ ভাইয়ের পরিচয়।
কে?
রশীদ ভাই, মানে রশীদ আশরাফ। রশীদ রিনাপার খালাতো ভাই।
ও।
রশীদ ভাই, যশোরের ছেলে; দারুন হ্যান্ডসাম, ফ্রি স্কুল ষ্ট্রিটে থাকত। আমাকে দেখে ভীষন পছন্দ হল তার। আমার সেলিনা আক্তার নামটা রশীদ ভাইয়ের পছন্দ হয়নি ... আমাকে ‘মলি’ নামে ডাকত রশীদ ভাই। আমার হাতের রান্না খুব পছন্দ করত-বিশেষ করে গুরের পায়েস। রোজ বুধবার চাইনিজ খাওয়াতে নিয়ে যেত সন্ধ্যার পর। মৌসুমী ভৌমিক আর কবির সুমনের ভক্ত ছিল। তাড়াতাড়ি বড়লোক হওয়ার ইচ্ছা ছিল রশিদ ভাইয়ের-যশোরের জমি বেচে সি এন জি স্টেশন দিল কালিহাতিতে। স্থানীয় মাস্তানদের জন্য চালাতে পারল না। মার খেল। তারপর কী ভাবে যেন এক বন্ধুর সঙ্গে আদম ব্যবসার জড়িয়ে পড়ে ... রুমানিয়ায় লোক পাঠাত ...এখন ধরা পড়ে জেলে আছে-সপ্তাহে একবার দেখতে যাই ... এই আর কী-
ঝিরঝির করে বৃষ্টি ঝরতেই ছিল। ওরা হাঁটতেই থাকে। বাংলা একাডেমির সামনে ফুটপাতটা ভিজে । ভিজে আর ফাঁকা।
ওপাশে ভিজে ভিজে গাছ। তার ভিজে ভিজে পাতা। থেকে থেকে সরসর বাতাস। ক্ষীন পেট্রোলের গন্ধ। হেড লাইটের আলো। ওরা হাঁটতেই থাকে। বাড়ির দিকে যেতে ওদের কারওই মনে থাকে না।
সময়টা এখন প্রায় মাঝরাতের কাছাকাছি।
ঝিরঝির করে বৃষ্টি ঝরেই চলেছে।
ওরা হাঁটতেই থাকে
বৃষ্টিভেজা একটা রাতের আলো-অন্ধকার শহরে ...
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০০৯ সকাল ৮:২৮