somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ডাডাবাদ থেকে সুররিয়ালিজম: অবিস্মরণীয় সেই শৈল্পিক উত্তোরণ

০৯ ই মে, ২০০৯ সকাল ৮:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ডাডাবাদ। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভের ইউরোপীয় একটি শিল্প আন্দোলন; একই সঙ্গে এটি একটি শিল্পতত্ত্বও বটে। ডাডাবাদী চিন্তাধারা সূত্রপাত হয়েছিল পূর্ব ইউরোপে-বিশেষ করে রুমানিয়ায়। রুমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্টে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বেই ডাডাবাদী কবিতা ও গদ্যের স্ফূরণ লক্ষ করা গিয়েছিল। অতিরিক্ত যৌক্তিক চিন্তা ও বুর্জোয়া মূল্যবোধ মানবসভ্যতার অমঙ্গল করে; কাজেই যৌক্তিকতাবিরোধী ও শিল্পবিরোধী অবস্থান নেওয়া অনিবার্য হয়ে উঠেছে-এই বিশ্বাসই ডাডাবাদী চিন্তাচেতনা । এমনটা ভাবার কারণ? তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮) ঘনিয়ে এসেছিল।
কয়েকজন রুমানিয় শিল্পী প্রথম মহাযুদ্ধের প্রারম্ভে সুইজারল্যান্ডের জুরিখে সেটেল করে। এদের মধ্যে হুগো বেল, এমি হেমিংস্, ট্রিসটান জারা, জ্যাঁ আর্প, মার্সেল জানকো, রিচার্ড হিউয়েলসেনবেক, সোফি টাওবের উল্লেখযোগ্য । এদের সবাই যে রুমানিয়-তাও না। ১৯১৬ সাল। প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। জুরিখের এক ক্যাফেতে বসে এরাই এক নতুন শিল্পবিরোধী শিল্পরীতির ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন।
সেই কাফের কাছেই একটি অ্যাপার্টম্যান্টে রাশিয়ার জন্য ভবিষ্যৎ কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করছিলেন ভ­াদিমির ইলিচ লেলিন ।
ডাডা শব্দের উদ্ভবও রুমানিয় ভাষার সঙ্গে জড়িত। দুজন রুমানিয় শিল্পী - ট্রিসটান জারা ও মার্সেল জানকো- এরা প্রায়ই ‘ডা’, ‘ডা’ করতেন। রুমানিয় ভাষায় ‘ডা’ হচ্ছে: ঠিক। ইংরেজি ইয়ে ইয়ে বা হ্যাঁ হ্যাঁ। কারও কারও মতে অবশ্য ডাডাবাদের উদক্তোরা জুরিখের সেই ক্যাফেতে বসে নতুন শিল্প আন্দোলনের জন্য যুৎসই একটি নাম খুঁজছিল। কার হাতে ছিল একটি ফরাসি-জার্মান অভিধান । সেখানেই ডাডা শব্দটি ছিল। ফরাসি ভাষায় ডাডা মানে: খেলনা ঘোড়া।
যা হোক। এভাবেই সুইজারল্যান্ডের জুরিখের একটি কাফেতে ডাডাবাদের সূচনা হল; যা ১৯১৬ থেকে ১৯২২ সাল অবধি তুঙ্গে ছিল। মূলত যুদ্ধ বিরোধী আর প্রচলিত শিল্পধারনার বিমূখ এই শিল্প আন্দোলনটি তৎকালীন শিল্পসাহিত্য কবিতা শিল্পতত্ত্ব মঞ্চ গ্রাফিক ডিজাইন-প্রভৃতি শিল্পমাধ্যমে ছাপিয়ে যায় ।



দাদাবাদকে এক ধরনের প্রতিশিল্পও বলা যায়।

বিরাজমান সংস্কতি যুদ্ধের জন্ম দেয়; কাজেই এর বিরোধীতা করা উচিত। শিল্পকে হতে হবে বিমূর্ত । কেননা, এটি পরিকল্পনা ও যৌক্তিক চিন্তাধারার বিপরীত। পরিকল্পনা ও যৌক্তিক চিন্তাধারা জন্ম দেয় যুদ্ধের আবহ। রিচার্ড হিউয়েলসেনবেক বলেছেন-""[A]bstract art signified absolute honesty for us." এ কারণেই ডাডাবাদকে বলা যায় উত্তরাধুনিক শিল্পের জনক। ডাডাবাদী ধ্যান ধারনা তারপর জুরিখ থেকে অপরাপর ইউরোপীয় শহরে ছড়িয়ে পড়ে। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায়।এর কর্মীসমর্থকরা মিছিল মিটিং বিক্ষোভ করে। নিয়মিত বইপত্র-জার্নাল প্রকাশ করে । ডাডাবাদ পরের শিল্পান্দোলনকেও প্রভাবিত করেছিল। আজ যে আমরা বিমূর্ত (যা মূর্ত নয়) কবিতা ও চিত্রকলার কথা বলি -ডাডাবাদ তারই পথ তৈরি করে দিয়েছিল। উত্তরাধুনিক শিল্পের সূচনা করেছিল। পরাবাস্তববাদের ভিত্তিপ্রস্তর রচনা করেছিল।



১৯২৪ এর দিকে ডাডাবাদী আন্দোলনটি কেমন থিতিয়ে আসে। যুদ্ধ শেষ সেই ১৯১৮ সালেই। প্যারিসে ডাডাবাদ পরাবাস্তববাদ শিল্প আন্দোলনে বিলীন হয়ে যাচ্ছিল। ডাডাবাদী শিল্পীরা ক্রমশ অন্যান্য আধুনিক শিল্পরীতির দিকে ঝুঁকে পড়ছিলেন। যেমন: সুররিয়ালিজম, সমাজবাস্তবতা। তিরিশ-চল্লিশের দশকের প্রাক্কালে অনেক ইউরোপীয় ডাডাবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। অনেকেই হিটলারের মৃত্যুশিবিরে প্রাণ দেন শিল্পকে বিকৃত করার অজুহাতে। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর ডাডাবাদ ঝিমিয়ে আসে। আরও কিছু নতুন শিল্প আন্দোলনের জন্ম হয়। যেমন, সিচুয়াশনিষ্ট এবং কাকোফনি সোসাইটি।
তবে সুররিয়ালিজম বা পরাবাস্তববাদই ডাডাবাদের সার্থক ও সফল উত্তরসূরী।



দিনক্ষণ গুণে কোনও নতুন শিল্পআন্দোলনের সূচনা হয় না। ফরাসী কবি গিয়োম অ্যাপোলিনিয়ার (১৮৮০ ১৯১৮) লেখায় বদলে যাচ্ছিল প্রকাশের বৈশিষ্ট্য। তাঁর লেখা কবিতা আদি-সুলিয়ালিস্ট কাব্যের নির্দশন হয়ে রয়েছে।

শ্বেত তুষার

আকাশে দেবদূতগন
একজন পরেছে অফিসারের পোশাক
একজন আজ পরেছে রাধুঁনির পোশাক
অন্যরা গান গাইছে

চমৎকার আকাশ-রঙা অফিসার
ক্রিসমাসের পরের বসন্ত
তোমাকে সুন্দর সূর্যে সাজাবে
চমৎকার সূর্য

রাঁধুনি হাঁস বাছছে
আহ! তুষার পতনের শব্দ
পতন এবং আমি আমার আলিঙ্গনে
তোমাকে পাচ্ছি না ...

ডাডাবাদী আন্দোলনের গোঁড়ায় একাধিক শিল্পী জড়িত ছিল;- পরাবাস্তববাদের শুরুতে অবশ্য একজন ব্যাক্তির উদ্যেগ ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ন। তিনি হলেন ফরাসি লেখক ও কবি আন্দ্রে ব্রেঁতো (১৮৯৬-১৯৬৬)। চিকিৎসাবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানও চর্চা করেছিলেন ব্রেঁতে। ১৯২৪ সালে 'দ্য সুরলিয়ালিস্ট মেনোফ্যাস্টো’ প্রকাশ করলেন। এভাবেই পরাবাস্তবাদের উত্থান ও বিকাশ ঘটল প্রথম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে। পরাবাস্তববাদের উত্থান হয়েছিল ডাডাবাদ থেকে। ডাডাবাদ ছিল যুক্তি ও শিল্পবিরোধী। পরাবাস্তববাদ জোর দিল সদর্থক প্রকাশের ওপর। তবে এর অবস্থানও যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে। পরাবাস্তবাদের সমর্থকরাও বললেন: যৌক্তিকতাবাদ ইউরোপীয় সংস্কৃতির কেন্দ্রে থাকায় মহাযুদ্ধের জন্ম দিয়েছে। আন্দ্রে ব্রেঁতো বললেন : অভিজ্ঞতার চেতনাচেতনে পরিভ্রম করে পরাবাস্তববাদ এক ধরনের স্বপ্নময় ফ্যান্টাসির জন্ম দেয়-যা পরিপূর্ন বাস্তবতা বা পরাবাস্তবাদ সৃষ্টি করে। ফ্রয়েড নির্জ্ঞান মনের তত্ত্ব জানতেন ব্রেঁতো। বললেন: অবচেতন মন হতে পারে কল্পনায় অশেষ উৎস। এই অধরা প্রদেশে অবগাহন করার জন্য তিনি শিল্পীসাহিত্যিকদের আহবান জানালেন।
এই ঘোষনার পর শুরু হল এক বিস্ময়কর যাত্রা।


কেবল অবচেতন মনের আবিস্কারই নয়-পরাবাস্তববাদে আরও বহু উপাদান সংযুক্ত হল। যেমন, সারপ্রাইজ, অভাবিত উদ্ভট পরিবেশনা, যুক্তির শিথিলতা। পরাবাস্তববাদের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল প্যারিস। পরে, গোলার্ধের সর্বত্রই অভিনব ধারনাটি ছড়িয়ে যায়। জনপ্রিয় হয়ে ওঠে অটোমেটিক রাইটিং। স্বপ্নের আর বিবরণ। ফ্রয়েড ছাড়াও মার্কস ও হেগেলও প্রভাব রেখেছিলেন পরাবাস্তব ধ্যানধারণায়।
এভাবে শুরু হল উত্তরাধুনিক এক শিল্প ঘরানার। উত্তরাধুনিক শিল্পের অনেক কলাকৌশলই পরাবাস্তববাদে প্রয়োগ করা হয়েছিল।
ডাডাবাদ ও পরাবাস্তব বাদ উভয়ই যুদ্ধ বিরোধী। ডাডাবাদে অবচেতন মনের গুরুত্ব না থাকলেও এই আন্দোলনটির অবস্থান ছিল প্রথম মহাযুদ্ধের বিরুদ্ধে- যে কারণে মানবিক। একই সঙ্গে জাতীয় বুর্জোয়া ভাবধারা ও ঔপনেবেশিক শাসনশোষনের বিরোধী ছিল ডাডাবাদী চিন্তাচেতনা। কেননা, তারা বিশ্বাস করতেন যুদ্ধের মূল কারণ জাতীয় বুর্জোয়া মূল্যবোধ। যে শিল্পকলা যুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট -ডাডাবাদীরা সেই শিল্পকলার বিরোধী ছিল। পরাবাস্তববাদও তাই মনে করে: পুঁজিবাদী সমাজের যুক্তিবাদ মানুষকে আলটিমেটলি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। সে কারণে সুরিয়ালিস্ট শিল্পীরা সচেতন ভাবে যৌক্তিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাস্তবতা বা রিয়ালিটির বিকৃতি সাধন করেন মানবজাতির কল্যানে। মনে থাকার কথা ডাডাবাদী শিল্পী রিচার্ড হিউয়েলসেনবেক বলেছিলেন-"[A]bstract art signified absolute honesty for us."

সব কটি ছবিই ডাডাবাদী ও সুরিয়ালিষ্ট শিল্পী মার্সেল ডুকাম্পের

তথ্যসূত্র: ড. বিমলকুমার মুখোপাধ্যায়। সাহিত্য-বিবেক।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০০৯ সকাল ১০:৫৭
২২টি মন্তব্য ২১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বেফাঁস মন্তব্য করায় সমালোচনার মুখে সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৩ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৩২



"মেট্রোরেলে আগুন না দিলে, পুলিশ না মারলে বিপ্লব সফল হতো না "- সাম্প্রতিক সময়ে ডিবিসি নিউজে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করে সমালোচনার শিকার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিবুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমিত্ব বিসর্জন

লিখেছেন আজব লিংকন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১:৪৮



আমি- আমি- আমি
আমিত্ব বিসর্জন দিতে চাই।
আমি বলতে তুমি; তুমি বলতে আমি।
তবুও, "আমরা" অথবা "আমাদের"
সমঅধিকার- ভালোবাসার জন্ম দেয়।

"সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট"
যেখানে লাখ লাখ শুক্রাণুকে পরাজিত করে
আমরা জীবনের দৌড়ে জন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×