somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: শ্রীলেখার বুনোহাঁস।(২য় পর্ব)

৩০ শে জানুয়ারি, ২০০৯ বিকাল ৩:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শ্রীলেখার বাবা আচার্য রামদেব ছিলেন যেমন রক্ষণশীল-তেমনি চন্ড প্রকৃতির। রামদেব অবশ্য তার কন্যাটিকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। কন্যাটিও- ‘নবান্নের গলির ধোঁওয়ায় মাথা ধরে আছে। নদীর পাড়ে যাচ্ছি’ বলে রথে উঠে বসত। কন্যার কথা শুনে রামদেব মিটমিট হাসতেন। সঙ্গে নবীন তো রয়েছে-চিন্তা কী। বয়সে প্রবীন হলেও নবীন দেবপরিবারের বিশ্বাসী সারথী। তাছাড়া রামদেবের কন্যাকে উক্তত্য করে এমন স্পর্ধা কার আছে এ নগরে। তো, পুন্ড্রনগরের বাগদি পাড়ার কাছেই শালবন। শালবনের ওপাশে চন্দ্রদিঘি। সে দিঘির নিরালা পাড়ে অপেক্ষা করত জয়ন্ত। অপরাহ্নের আলো মুছে না যাওয়া অবধি দুজনের কত কথা, চুম্বন-প্রনয়। কিশোরী শ্রীলেখার শরীরে তখন রক্তের বদলে করতোয়ার জল ঢুকে যেত। যে জলে ঝড়জল-প্লাবন। জয়ন্তের গানের গলা ছিল দরদী। যখন সে এতদ্বঞ্চলের একটি লোকপ্রিয় গান ধরত-

তুমি আর আমি সখা, তুমি আর আমি।
ভালোবাসি ভালোবাসি জানে অর্ন্তযামী।

তখন ...তখন, শ্রীলেখার মনে হত চন্দ্রদিঘির কালো জলে সন্তরণশীল বুনোহাঁসেরা গানের টানে পাড়ের দিকেই এগিয়ে আসছে। চন্দ্রদিঘির পাড় ঘিরে দীঘল দীঘল শিলকড়–ই গাছ, কচু বন, আমরাঙা গাছ। সেসব গাছের গভীর ছায়া । পাড়ে উঠে এলেও বুনোহাঁসেদের আমাদের খুঁজে পেতে সমস্যা হবে-শ্রীলেখা তেমনই ভাবত। শেষ বেলার আলোয় অজস্র চুম্বনের পর বড় রাস্তার পাড়ে অপেক্ষমান রথের কাছে ফিরত শ্রীলেখা। রথের বুড়ো সারথী নবীন খুড়ো শ্রীলেখাকে ভারি ভালোবাসত। নবীন খুড়ো হেসে বলত, নদীর ধারে বেড়ানো হল।
খুব হল খুড়ো? লাজুক হেসে বলত শ্রীলেখা।
তাহলি এবার নখখি মেয়ের মতন রথের প’র উঠে পড়নি দেখি। সূর্যবাতি নিভবার আগেই ঘরে ফিরতি হবি যে- তানাহলে তোমার খ্যাস্টো পিতার কোপে পইড়তি হবি না?
শ্রীলেখা রথ দুলিয়ে রথে উঠে পড়ত। নবীন খুড়ো তুরন্ত গতিতে রথ চালিয়ে সন্ধ্যের আগে আগেই নবান্নর গলিতে ফিরে যেতে পারত। তো, নবীন খুড়ো একদিন সকালে পট করে মরে গেল। শ্রীলেখা কী যে কাঁদল। রাতভর কাঁদল, দিনভর কাঁদল। ওর খুব কষ্ট হল । তারপর যা হয়-গুরু জন মরে গেলে আরও আরও বিপদ ঘনিয়ে আসে। জয়ন্তর সঙ্গে প্রনয়ের ব্যাপারটা শ্রীলেখার বাবার কানে পৌঁছল। নতুন সারথী কানাই-সেই প্রভূর বদান্যতার আশায় রামদেবকে যা বলার বলল। বৈদিক রক্তের বিশুদ্ধতা অক্ষুন্ন রাখার মরণ পণ ছিল রামদেবের -সেইটে হয়তো দোষের নয়, তবে রামদেবের স্বভাবটি ছিল চন্ড প্রকৃতির । সুকন্ঠ গায় জয়ন্তর সবই ভালো-তবে সে যে জাতে হাড়ি-এই তার পাপ। কানাইয়ের মুখে অচ্ছুতের সঙ্গে কন্যার দৈহিক সম্পর্কের কথা শুনে ক্রোধে অন্ধ হয়ে উঠলেন রামদেব । পারিবারিক কলঙ্কের হাত থেকে বাঁচতে উপযুক্ত সিদ্ধান্তই নিলেন। পুন্ড্রনগরের ধনবান শ্রেষ্ঠী অনন্ত কে ভালো করেই চিনতেন আচার্য রামদেব; শ্রেষ্ঠী অনন্তর ভিটেয় যজ্ঞানুষ্ঠানের মূল পুরুত তো তিনিই। ত্বরিত শ্রেষ্ঠী অনন্তর কাছে পৌঁছে যা বলার বললেন রামদেব । পুন্ড্রনগরের যোগীর ধাপনিবাসী শ্রেষ্ঠী সঞ্জয়ের এক দৌহিত্রের অন্নপ্রাশনের অনুষ্ঠানে ষোড়শী শ্রীলেখাকে দেখেছিল শ্রেষ্ঠী অনন্ত । তন্বি শ্রীলেখার শ্যামবর্ণের উদ্ভিন্ন শরীরটি শ্রেষ্ঠী অনন্তর বিপুল কামপ্রদাহের উদ্রেক ঘটিয়েছিল। উপরোন্ত, শ্রেষ্ঠী অনন্তর প্রথমা স্ত্রী দেবী সুদেষ্ণা সদ্য গত হয়েছেন। শ্রীলেখাকে দেখার পর থেকেই শ্রেষ্ঠী অনন্ত শ্রীলেখাকে সম্ভোগের সুযোগ খুঁজছিল। সে সুযোগ এল। সে বিপুল উত্তেজনা চেপে রেখে রামদেবকে বলল, আপনি ভাববেন না আচার্য। যা করবার আমিই করছি। এই ঘটনার পর-শ্রীলেখা পরে শুনেছিল- অনন্ত শ্রেষ্ঠীর নির্দেশে তারই কতিপয় বশ্য পেশল পুরুষেরা কাল বিলম্ব না করে হাড়িপাড়ার উদ্দেশে যাত্রা করে দ্রুত হাড়িপাড়া ঘিরে ফেলে। তারপর জয়ন্তকে তারা ঘর থেকে বের করে টেনে হিঁচড়ে অপেক্ষমান রথে তুলে কালীদহ বিলের কাছে নিয়ে যায়। ঘাতকদের সবার হাতে ছিল কাঠের মুষল। তারা কাঠের মুষল দিয়ে জয়ন্তকে এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করে।
সময়টা ছিল এরকমই মধ্য-আষাঢ়ের এক পূর্ণিমাসন্ধ্যা।
অপহরণকারী ঘাতকরা নাকি মেরেই ফেলত জয়ন্তকে-একজন পেশলপুরুষ নাকি জয়ন্তর গানের ভক্ত ছিল-তাই প্রাণে মারেনি। যা, ভাগ, পুন্ড্রনগর থেকে। আর কখনও যেন এ নগরে না দেখি।
এই ঘটনার পর আর কখনও জয়ন্তকে পুন্ড্রনগরে দেখা যায়নি।
নিুবর্ণের হওয়ায় মূল্য দিল জয়ন্ত । আগে অবশ্য বর্ণের এহেন বিভেদ ছিল না পুন্ড্রে-যখন বৈদিকেরা এতদ্বঞ্চলের আসেনি। বৈদিকেরা অতিশয় যজ্ঞপ্রবণ- এবং তারা আনখশির বর্ণবাদীও বটে। তবে কী কারণে যেন শ্রীলেখার হৃদয়টি ঠিক তেমন সংকীর্ণ ছিল না। ও তো ঠিক করেই রেখেছিল যে- কোনও এক আশ্বিন শেষের দিনে শুধুমাত্র কামরাঙার ফুল বিনিময় করেই তবে তার আর জয়ন্তর বিয়ে হবে নির্জন শালবনের সেই চন্দ্রদিঘির পাড়ে। যে বিবাহ অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবে কেবল বুনোহাঁসেরা। শ্রীলেখার নিভৃত স্বপ্নটি যে বর্ণবৈষম্যের তোড়ে এমনভাবে মিলিয়ে যাবে-কে জানত। যে দিন শ্রেষ্ঠী অনন্তর পোষ্য ঘাতকেরা জয়ন্তকে ধরে নিয়ে গেল-ঠিক সে দিন রাতেই পুন্ড্রনগরের আকাশে একঝাঁক বুনোহাঁস উড়তে দেখা গিয়েছিল। শ্রীলেখা তো বন্দি হয়েই ছিল। ওর ঘরটি ছিল নি®প্রদীপ। নি®প্রাণ মূর্তির মতো জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল শ্রীলেখা । আকাশে ছিল মধ্যআষাঢ়ী একটি পরিপূর্ন গোল চাঁদ ও ধবল পূর্ণিমা। হঠাৎ চোখ চলে গিয়েছিল আকাশে। এক ঝাঁক বুনোহাঁস হারের মতন অর্ধবৃত্তাকারে উড়ছিল দক্ষিণ অভিমূখে। চন্দ্রদিঘির বুনোহাঁস নয় তো? শ্রীলেখার প্রস্তর হৃদয়ে অসহ্য কষ্টেরা ভিজে ভিজে ছড়িয়ে পড়ছিল। পুন্ড্রনগরে এর আগে এ রকম কত অচ্ছুত যুবক খুন হয়েছে বর্ণবাদী গোষ্ঠীপিতাদের হাতে! ওকেও কি এখন ওরা খুন করে ফেলবে? এই ভাবনায় শ্রীলেখা হিম হয়ে যেতে থাকে। তা হলে আমিও কি খুনি নই বুনোহাঁস। এক ঝাঁক বুনোহাঁস হারের মতন অর্ধবৃত্তাকারে উড়ছিল দক্ষিণ অভিমূখে। হায়, আমি জয়ন্তকে খুন করেছি। হঠাৎ হাড়িপাড়ার দিক থেকে চীৎকার ভেসে আসল। শ্রীলেখা চমকে ওঠে। ওদিকটায় আগুনের লাল আভা। গনগনে। লাল। হাড়িপাড়ায় আগুন লেগেছে। শ্রীলেখার মাথা কেমন টলে ওঠে। পরদিনই শ্রেষ্ঠীর অনন্ত বরবেশে ক’জন অতিথি নিয়ে রাজর্ষী প্রাঙ্গনের পুবের নবান্নের গলিতে শ্রীলেখার বাড়িতে উপস্থিত হল। রামদেব প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। অপেক্ষা করছিলেন। নামমাত্র বিয়ের পর প্রায় অচেতন শ্রীলেখাকে টেনে হিঁচড়ে রথে তুলে বন্দি করে নিয়ে গেল শ্রেষ্টী অনন্ত। শ্রীলেখাকে যখন শ্রেষ্ঠী অনন্ত ধর্ষন করছিল শ্রীলেখা তখনও প্রায় অর্ধচেতন।
তারপর?
তারপর শ্রেষ্ঠী অনন্তর ধানমোহনীর বাড়িতে শ্রীলেখার দীর্ঘ বন্দি জীবনের শুরু।
কী লাভ হল? আচার্য রামদেবের মৃতদেহটি গত চৈত্রের এক মধ্যরাত্রে করতোয়ার দক্ষিণ পাড়ের বানেশ্বর শশ্মানের চিতায় পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। শ্রীলেখা ক্রর হাসে।
কী লাভ হল?
শ্রেষ্ঠী অনন্তর সেই নিরুঙ্কুশ প্রতাপ আর নেই। সে হঠকারী সিদ্ধান্তের ফলে অলাভজনক বানিজ্যে জড়িয়ে শ্রীহীন হয়ে পড়েছে আজ। শ্রীলেখা ক্রর হাসে।
কী লাভ হল?
জয়ন্ত এখন কোথায়?
মধ্য আষাঢ়ের রাত্রিকালীন বাতাসে হরীতকীর পাতাগুলি সরসর করে ওঠে। পাতাগুলি যেন শ্রীলেখার মুক্তির আনন্দে উদবেলিত-একইসঙ্গে জয়ন্তর নিরুদ্দেশে দুঃখকাতর। অদূরে পুস্করিণীর জলে চাঁদের প্রতিফলিত বিভা। পুস্করিণীময় রুপো গলা জল। সেই রুপো গলা জল থেকে শ্বেতপাথরের সিঁড়ি উঠে গেছে ঝলমলে ঘাটে । ঘাটের ওপাশে ঘুমন্ত জৈন মন্দির। জলসিঁড়িমন্দির-সবই যেন আর্শীবাদ করছে শ্রীলেখাকে।
বাতাসে বকুল ফুলের কড়া গন্ধ। শ্বাস টানে শ্রীলেখা। হরীতকী তলার গাঢ় ছায়ায় ছায়ার মতো মিশে রয়েছে। চোখ- চাঁদের আলোয় ঝলমলে পথের ওপর। কে যেন আসছে। এদিকেই। ভিক্ষু নয় তো। বুকের ভিতরে ক্ষীণ উত্তেজনা টের পায় শ্রীলেখা।



হরীতকী গাছটির একটু দূরে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল সুমন্ত ।
গাছতলায় অন্ধকার। ওখানে কেউ রয়েছে বলে বোঝা যায় না। তা হলে? তার বুক ধক করে ওঠে। শ্রীলেখা আমায় ঠকালো? তখন তো দেখে ওকে সেরকম মনে হল না।
এই যে আমি এখানে। শ্রীলেখা চাপা স্বরে বলল। তখনই করতোয়ার দিক থেকে বাতাস এল। বাতাসে বকুল ফুলের গন্ধটা গাঢ় হয়ে উঠল। কেন এমন হয়? দ্রুত পায়ে শ্রীলেখার কাছে এসে চীবরটা বাড়িয়ে সুমন্ত বলল, ধরুন। এটা পড়ে নিন।
কী পরব? শ্রীলেখা থতমত খেল।
চীবর।
চীবর কেন? আমি তো ভিক্ষুণী হব না। ইষৎ তীক্ষ্ম হয়ে উঠল শ্রীলেখার কন্ঠস্বর।
সুমন্ত ইষৎ হেসে বলল,ভিক্ষুণী হবেন না ঠিকাছে। ছদ্মবেশ ধারন করবেন না তাই বলে? একা একজন ভিক্ষুর সঙ্গে যাবেন-লোকে কী ভাববে ভেবেছেন।
ওহ্। নিমিষে শ্রীলেখা নরম হয়ে এল। হরীতকী তলার অন্ধকারে পরনের কাপড়টি দ্রুত খুলে ফেলল শ্রীলেখা। তার নগ্ন দেহ ছুঁল মধ্য আষাঢ়ের মাঝরাত্রির শীতল বাতাস। গাছের অন্ধকারে নগ্নতা বিশেষ কিছু না। তবু সুমন্ত খুব কাছে দাঁড়িয়ে কেঁপে উঠল। তার বুদ্ধের সৌম মুখটি মনে পড়ে গেল। শ্রীলেখা নির্বিকার। ধীরেসুস্থে চীবর পরে নিল। সুমন্তর ঝুলিতে ক্ষুর ছিল। আরও কাছে এগিয়ে এল। বলল, আসুন।
কেন? শ্রীলেখার গলার স্বর কেঁপে উঠল।
চুল কাটব।
কেন-ওহ্।
শ্রীলেখা আরও এগিয়ে আসে। কুড়ি বছরের ভিক্ষুজীবনে কত সদ্য দীক্ষাপ্রাপ্তর নারীর চুল কেটে দিয়েছে সুমন্ত। ক্ষৌরকর্মে তার বিশেষ দক্ষতা জন্মেছে। শ্রীলেখা চোখ বন্ধ করে আছে। সুমন্ত অভ্যস্ত হাতে ক্ষুর চালালো। খসে পড়া গুচ্ছ গুচ্ছ চুলের জন্য মায়া লাগছিল শ্রীলেখার। জয়ন্তর রক্তাক্ত মুখটি মনে পড়তেই শক্ত হল।
চুল কাটা শেষ হলে ক্ষুরটা ঝুলিতে ভরল সুমন্ত। তারপর গম্ভীর কন্ঠে বলল, তখন বলছিলেন যে শ্রাবস্তী যাবেন। সত্যিই কি আপনি শ্রাবস্তীই কি যেতে চান শ্রীলেখা?
আগে এই নগর ছেড়ে চলে যাই চলুন।
বেশ। চলুন তা হলে। বলে ঘুরে দাঁড়াল। করতোয়া পাড়ের শীলা দেবীর ঘাটটি এখান থেকে বেশি দূরে নয়। ঘাটে অনেক নৌকা থাকার কথা। কাল ভোর ভোর সময়ে ছাড়বে। সুমন্ত শীলা দেবীর ঘাটের দিকে হাঁটতে থাকে। শ্রীলেখা তার পিছন পিছন হাঁটছে । আমাকে এখন ঠিক কেমন দেখাচ্ছে? হাঁটতে হাঁটতে শ্রীলেখা ভাবল। এখন যদি আমায় আমার বৈদিক পিতা স্বর্গ থেকে আমায় দেখতে পেতেন! শ্রীরামদেব! কী লাভ হল আপনার? আমি তো আজ বেদবিরোধীদের ঘরেই চলে গেলাম। আপনি আর আপনার সংকীর্ণ সংস্কার আজ পরাজিত হল। মিছিমিছি রক্ত ঝরালেন। ঘৃনার তীব্র উদগার ছড়িয়ে শান্ত হল শ্রীলেখা। আজ আমি চীবর পড়লাম। জয়ন্ত আমায় চিনতে পারবে তো? চীবর পরার পর থেকে শরীরে কেমন যেন অবশ অবশ লাগছে। আমার মন বলছে: জয়ন্তকে আমি কখনও খুঁজে পাব না। এ জগৎ কত বড়? কেউ হারিয়ে গেলে তাকে খুঁজে পাওয়া সাধ্যি কি। আমি যে পথে বেরিয়েছি-এ আমার বৌদ্ধ হওয়ার ছল। অনেক অনেক দিন আগে নবীন কাকার মুখে শ্রীলেখা শুনেছিল: তথাগত বুদ্ধ যখনই কোনও নগরে পৌঁছোন-তখন কোনও না কোনও নারীর সংসার ত্যাগের উপলক্ষ তৈরি হয়ে যায়। নারীটি তারাপর সংসার ত্যাগ করে অহিংসধর্ম গ্রহন করে ধ্যানের নির্বানের শুদ্ধ নির্মল পথ বেছে নেয়।
আমারও কি তাইই হল?
শ্রীলেখা শিউরে উঠল।
মধ্যরাত্রি বলেই পথ নির্জন। নির্জন এবং জ্যোøাময় । দু’পাশে শালের গাছ। ঝিঁঝির ডাক বেশ প্রগাঢ়। শালপাতার ওপর শিশির পতনের শব্দও শোনা যায় । এই সেই শালবন। শ্রীলেখার বুক ধক করে ওঠে। শালাবনের ওধারে চন্দ্রদিঘি। গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে মাঝে মাঝে চোখে পড়ছে দিঘির রুপালি জল। বুনোহাঁসেরা সেই জলে ভাসত একদা। ভাসত কি? দিঘির ওপাশ থেকে দলবদ্ধ শিয়ালের ডাকও শোনা যায়।
হঠাৎই ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ শোনা গেল।
কী ব্যাপার?
শীলাদেবীর ঘাট থেকে অশ্বারোহী সৈন্যের একটি দল এদিকেই আসছে।
নিমিষেই সুমন্ত শ্রীলেখার হাত ধরে। তারপর চট করে সরে যায় শালগাছের আড়ালে। সৈন্যরা প্রায় কাছে এসে পড়েছে। কী মনে করে সুমন্ত শ্রীলেখাকে জড়িয়ে ধরে। এবং এই প্রথম সে শ্রীলেখার শরীরের কোমলতা ও ওম একই সঙ্গে টের পায়; সে জেগে উঠতে থাকে। শ্রীলেখা মুচকি হাসে।
প্রথম দর্শনেই গতকাল ভিক্ষু ওকে ভালোবেসে ফেলেছিল । তখনই সামান্য স্পর্শ দেবার কথা নিজে থেকেই ভাবছিল। এই মুহূর্তে সুযোগ এল। শালের বনে ঝিঁঝির প্রগাঢ় ডাক, শ্রীলেখার পায়ের নীচে ভিজে ঘাসপাতা, তার ওপরে চুঁইয়ে পরা জ্যোøার রোদ, অশ্বক্ষরধ্বনি, শালপাতার ওপর শিশির পতনের শব্দ আরও স্পস্ট হয়ে উঠেছে । শ্রীলেখাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে সুমন্ত। মুখ নামিয়ে ঠোঁট রাখল জ্যোøা ঝরা শ্রীলেখার ঠোঁটের ওপর। নাঃ, শ্রীলেখা চোখ বন্ধ করল না। বরং, শালাবনের গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে চোখ রাখল চন্দ্রদিঘির রুপালি জলে। জয়ন্ত ওখানে প্রথম আমার উরুসন্ধিতে জিভ রেখেছিল ... আমি আসছি জয়ন্ত। আমি জানি তুমি কোথায় আছ। আমি তোমার কাছে ঠিকই পৌঁছে যাব দেখো। চন্দ্রদিঘির বুনোহাঁসেরা আমায় পথ দেখাবে।
অশ্বারোহী সৈন্যদলের ক্ষুরের শব্দ দূরে মিলিয়ে যায়।
শ্রীলেখা। সামান্য জোর খাটিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। তারপর শালবন থেকে বেরিয়ে এল।
সুমন্তর বুকটা ভীষন ধকধক করছিল। অনেকদিন পর চুম্বন করে খানিকটা বিহবল বোধ করছিল সুমন্ত। মাঝবয়েসি সে। আর, শ্রীলেখার কতই বা বয়েস। তাতে কি? শরীর ও শরীরের ভিতরে রয়েছে যে এক অলীক মনতন্ত্রবীণা-সেটি যে কোনও বয়েসেই ঈশ্বরের কারসাজিতে বেজে উঠতে পারে। আজ সত্যি সত্যি বেজে উঠল। তাতে প্রশ্নও তৈরি হল কিছু। কেননা, তখন বুদ্ধ বলছিলেন, যাহারা, অসার বস্তুকে সার বিবেচনা করে এবং সারকে অসার বিচেনা করে, মিথ্যাদৃষ্টির প্রশ্রয়দাতা-সেই ব্যাক্তি কখনও সার প্রাপ্ত হয় না। প্রেম কি আসলেই অসার? আর, ধর্মই কেবল সার?
সুমন্ত এখন জানে, নারীপুরুষের প্রেমই জগতে একমাত্র সত্য বস্তু। সাবিত্রীর মৃত্যুর পর মিছিমিছি অত উদাস হওয়া ঠিক হয়নি। আরেকটি বিবাহ করা উচিত ছিল। তারপর উচিত ছিল দেহের ভোগে গা ভাসিয়ে দেওয়া। গৃহত্যাগ করে কী লাভ হল। কিন্তু, ধর্মের ধ্বজাধারী পুরুষেরা এত প্রেমবিমূহ কেন? বুদ্ধ? প্রেমে সুবিধে হয়নি বলে। সুমন্তর মাঝবয়েসী শরীরটি ছমছম করে ওঠে। তার পরনে এখনও চীবরবেশ। সুযোগ মতন এটি খুলে ফেলতে হবে। বড্ড ভার ভার ঠেকছে।
শ্রীলেখার অনুভূতি অবশ্য ততখানি অবশ নয়। যদিও ভিক্ষু সুমন্ত ওর স্তনদুটি স্পর্শ করেছিল। দীর্ঘদিন বন্দিজীবন যাপন করে ভোঁতা হয়ে উঠেছে শ্রীলেখা। পুরুষস্পর্শ আর উপভোগ্য নয় জেনে শ্রীলেখা বিস্মিত হয়নি।
শালবনের শেষে বাগদি পাড়া শুরু। পথের দুপাশে মাটিলেপা বেড়ার ঘরদোর। দরিদ্র মানুষের ঘরদোর। পাড়াটি ঘুমন্ত। এত রাতে কে আর জেগে। কেবল শিশুর কান্না শোনা যায়। শুকনো মাছের গন্ধ পেল শ্রীলেখা। বেড়ার ফাঁকে কূপীর মিটিমিটি আলো। এক বৃদ্ধ বাগদি কাশছে। তার কী অসুখ কে জানে।
দ্রুত পায়ে হেঁটে বাগদি পাড়াটি পেরিয়ে যায় ওরা।
পথের দুপাশে এখন সুপারি গাছের ঘন সারি । পথের ওপর ঘন হয়ে দুজনের ছায়া পড়েছে। বাতাসে শিশির ভেজা পাতা ও বাকলের কড়া গন্ধ । অনেকক্ষণ ধরে হাঁটছিল বলে পায়ের গোড়ালি হাঁটু উরু ব্যাথা করছিল শ্রীলেখার। জন্মাবধি এতটা হাঁটেনি শ্রীলেখা। এখন তো অনেকটাই পথ হাঁটতে হবে। মানুষরচিত সংকীর্ণ সংসার থেকে বহূদূরে সরে যেতে হবে। যন্ত্রণা হবে ওর। এই যন্ত্রণা টের পাওয়ার জন্যই ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেছেন? হাড়ি-বাগদিদের কষ্টে রেখেছেন। জয়ন্ত তো হাড়ি বলেই ওকে কালীদহের বিলের ধারে পিটিয়ে মেরে ফেলা হল। লাশটা বিলের জলে ফেলে দিয়েছিল ওরা। তারপর হাড়িপাড়ায় আগুন দিয়েছিল। জানালা দিয়ে আগুনের লাল আভা শ্রীলেখার চোখে পড়ছিল সে রাতে-যে রাতের পর কেউই আর জয়ন্তকে পুন্ড্রনগরে দেখেনি। হাড়িপাড়া থেকে চীৎকার ভেসে আসছিল। শ্রীলেখা আজও শুনতে পায়। ও শিউরে ওঠে। আমি জয়ন্ত কে হত্যা করেছি। আমি জয়ন্ত কে হত্যা করেছি। আমি জয়ন্ত কে হত্যা করেছি। আমি জয়ন্ত কে হত্যা করেছি ...



মধ্য আষাঢ়ের গাঢ় জ্যোøায় পথের দুপাশের সুপারি পাতাগুলি উতল বাতাসে কেমন সরসর করে ওঠে। ক্ষাণিকবাদে বাতাসের গন্ধ বদলে গেল। হাঁটতে হাঁটতে ওরা প্রায় শীলাদেবীর ঘাটের কাছে পৌঁছে গেল। এখন মধ্য রাতও পেরিয়ে গেছে। পূর্ণিমার চাঁদটাও আর আকাশের মাঝখানে নেই। তবে এখনও সমানে তরল রুপা ঢেলে চলেছে।
ওরা ঘাটের চাতালের ওপর এসে দাঁড়াল।
এমন নির্জন ঘাট- এমকী প্রহরী সৈন্যরাও জেগে নেই বলে মনে হয়। উথালপাথাল হাওয়া। নোনা গন্ধ। করতোয়ার জলে তরল রুপা। ঢেউ। ঘাটে অনেকগুলি ছোটবড় নৌকা। অবশ্য নিথর নয়। ঢেউয়ের দোলায় অল্প অল্প করে দুলছে। এখন মধ্যরাত বলে আগুনের ফুটকি চোখে পড়ল না। ছইওলা বড়নৌকাগুলির পাল গোটানো। নদীর ওপারে ক্ষীণ আভাস। চর। ওই পেরিয়ে আবার করোতোয়া নদী । তারপর ডাঙা। বহুকাল আগে শ্রীলেখাকে জয়ন্ত বলেছিল- করতোয়া পেরিয়ে ডাঙার ওপর ক্রোশ ক্রোশ পথ হাঁটলে যমুনা নামে একটি নদীর কাছে যাওয়া যায়।
সেই কথা মনে করে শ্রীলেখা এখন কেঁপে উঠল।
সমস্ত দৃশ্যটা পূর্ণিমার আলোয় কেমন এক ধূসর স্বপ্নের মতো মনে হয় সুমন্তর। সে ফিসফিস করে বলল, কাল ভোরে নৌকায় উঠব। চল, এখন বসি কোথাও।
চুমু খেয়েছে তো। এখন তো ‘তুমি’, ‘তুমি’ করেই বলবে। শ্রীলেখা মনে মনে ভাবল। চলুন। শ্রীলেখা বলল। লোকটার জন্যও কী রকম খারাপ লাগছে । কোথ্ থেকে এসে একটা গল্পে ঢুকে পড়েছে। ইস্, লোকটা যদি বুনোহাঁসদের কথা জানত!
বাঁ দিকে কয়েক পা হেঁটে ঘাটের ওপর বসল সুমন্ত। ইটের ওপর তার স্পস্ট ছায়া-শ্রীলেখারও। সুমন্তর পাশে, অল্প দূরত্ব রেখে বসল শ্রীলেখা। তখন শালবনের অন্ধকারের ভিতর সৈন্যদের সামনে পড়ে যাওয়ার আতঙ্কে আলিঙ্গন-চুম্বন হল বটে; কিন্তু, এখন প্রকাশ্য জ্যোøালোক; এখন এই মাঝবয়েসী ভিক্ষুটি ওর হাত ধরলে সঙ্কোচ বোধ করবেই শ্রীলেখা।
ওরা যেখানে বসেছে-তার ঠিক দুধাপ নীচে একটি কুকুর শুয়ে ছিল। রাত শেষের চাঁদের আলোয় ওটার গায়ের রংটা ঠিক বোঝা গেল না। ওরা বসামাত্র কান খাড়া করল কুকুরটি। শ্রীলেখাকে দেখে নিশ্চিত হয়েই আবার থাবায় মুখ লুকালো। কুকুরটির পাশে কে যেন কাথা মুড়ে শুয়ে। বৃদ্ধা বলে মনে হল। শ্রীলেখা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এ জগতে নির্বাচিত কয়েকজন মানুষকে প্রেমের উপলব্দি দিতে কত কত প্রাণকে যে দুঃখকষ্টে রেখেছে ঈশ্বর। মলিন হাসে শ্রীলেখা। ওর হাতে একটা ছোট পোটলা । ওটা খুলে বলল, নেন, খান।
কী।
তেমন কিছু না-গুড়ের সন্দেশ।
ওহ্। দাও।
জয়ন্তর পাশে কত কত রাত যে শীলাদেবীর নির্জন ঘাটে বসে থেকেছে শ্রীলেখা। জয়ন্ত খুব গুড়ের সন্দেশ পছন্দ করত। ওর জন্য গুড়ের সন্দেশ তৈরি করতে শিখেছিল মনো মাসির কাছে। সেসব কথা মনে করে শ্রীলেখা বলল, কাল খানিক দইও পেতছিলাম। কিন্তু, আনি কী করে।
কেন? বাড়িতে কি করঙ্গ ছিল না? সন্দেশে কামড় দিয়ে সুমন্ত বলল। বাহ্, বেশ স্বাদ তো।
করঙ্গ? করঙ্গ কি? শ্রীলেখা তো অবাক।
করঙ্গ চেনেন না মেয়ে?
না তো।
সুমন্তর পুরোন খোলশটি আজ একেবারেই খসে গিয়েছিল। এককালে সে যে গান গাইত সেকথা মনে পড়ে গেল তার। সে সন্দেশটা খেয়ে শেষ করে দীর্ঘদিন আগে শোনা পদ্মাপাড়েরর একটি লোকায়ত গান ধরল।

একটি নারকেলের মালা,
তাতে জল তোলা ফেলা- করঙ্গ সে।
পাগলের সঙ্গে যাবি পাগল হবি বুঝবি শেষে।

ওমাঃ, আপনি গানও জানেন? শ্রীলেখা কেমন উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে।
সুমন্তর কন্ঠস্বরে কে যেন ভর করে বলল: পুন্ড্রবঙ্গে যে জন্মেছে -সে অল্পবিস্তর গান জানে না-তা কি করে হয় গো মেয়ে? এ ভারি গানের দেশ। গানে ঝরে দুঃখ, প্রশ্ন ও সন্দেহ।
তা ঠিক। শ্রীলেখা বলল। মনে মনে ভাবল-কী সুন্দর গান করত জয়ন্ত। এমন মানুষকে কেউ পিটিয়ে মারে।
সুমন্তর মধুমেহ। তারপরও সে পরপর দুটি সন্দেশ খেয়ে শেষ করল। আহ্, চমৎকার স্বাদ। মনে মনে বলল, এই জীবন। কী লক্ষ তার?
কে যেন করতোয়ার বাতাসে ভেসে এসে উত্তর দিল, পথে যেতে যেতে একটা আলোর মুখে দাঁড়িয়ে যাওয়ার জন্য।
আর?
আর কী।
ঐ কুকুরেরও?
হ্যাঁ। তুমি কি নিশ্চিত যে সে কেবলই কুকুর-ওটি আকাশ পথ থেকে নেমে আসেনি?
সুমন্ত বিভ্রান্ত বোধ করে। একা হলেই কে যেন কথা কয়ে ওঠে তার ভিতরে। কে সে? কে?
শ্রীলেখা মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকালো। এক ঝাঁক বুনোহাঁস উড়ে যাচ্ছে পূর্ণিমার আকাশে। সেই চন্দ্রদিঘির বুনোহাঁসগুলো নয় তো ? চন্দ্রদিঘির কালো জলে সন্তরণশীল বুনোহাঁসেরা জয়ন্তর গান গুরে পাড়ে উঠে এসে ওদের খুঁজত।
শ্রীলেখা জিজ্ঞেস করল, নৌকাগুলি কোথায় যায় জানেন?
সুমন্ত বলল, কত জায়গায় যে যায়।
শ্রীলেখা কী মনে করে বলল, আমি আমার স্বামীর মুখে গঙ্গাহৃদয় রাজ্যের কথা শুনেছি। বিদ্যাধরী নদীর ধারে।
হ্যাঁ। চন্দ্রকেতু গড়। সুমন্ত বলল।
আপনি গেছেন?
হু।
আমরা কি সেখানে যেতে পারি?
পারি।
শ্রীলেখা বলল, আচ্ছা, আপনি কি কখনও লঙ্কা দ্বীপে গিয়েছেন?
হু।
আমরা যদি লঙ্কা দ্বীপে চলে যাই তো?
যাওয়া যায়। লঙ্কাদ্বীপের রাজধানী অনুরাধপুর। বেশ চমৎকার নগর। আরাভি আরু নদীর পাড়ে।
কী? কী নদী বললেন?
আরাভি আরু।
আরাভি আরু?
হ্যাঁ।
শ্রীলেখার কী খিলখিল হাসি। শীলাদেবীর ঘাটের নির্জনতা খান খান করে দিল। সুমন্ত অবাক হয়ে যায়। যেন স্বপ্ন দেখছে সে। তখন বুদ্ধ বলছিলেন, যাহারা, অসার বস্তুকে সার বিবেচনা করে এবং সারকে অসার বিচেনা করে, মিথ্যাদৃষ্টির প্রশ্রয়দাতা-সেই ব্যাক্তি কখনও সার প্রাপ্ত হয় না। আমি কি মিথ্যাদৃষ্টির প্রশ্রয়দাতা? কে জানে। শ্রীলেখার হাত ধরল সুমন্ত। শ্রীলেখা কেঁপে উঠল কি? সুমন্ত নরম স্বরে জিগ্যেস করল, তুমি লঙ্কাদ্বীপ যেতে চাও শ্রীলেখা?
হ্যাঁ।
তাই যাই চল।
ঠিক আছে চলেন। সেখানে কি জয়ন্ত আছে? কে জানে।
সুমন্ত শ্রীলেখার হাতটা ধরেই আছে। কন্ঠে আবেগ এনে বলল, আমার বউয়ের নাম ছিল সাবিত্রী। বেশিদিন বাঁচেনি সাবিত্রী। শ্রীলেখা, তোমার সঙ্গে সাবিত্রীর মুখোশ্রীর এত মিল! এসবই করুণাময় ঈশ্বরের খেলা নয় নি? নইলে আমিই বা কে পুন্ড্রনগরে আসব। তোমার সঙ্গে আমারই বা দেখা হয়ে যাবে কেন।
এসব শুনছিল না শ্রীলেখা। ও বরং আলত করে সুমন্তর হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে জ্যোøাবিধৌত করতোয়া নদিটির দিকে তাকালো। নদীটির ওপারেই রুপহাটি। তার উত্তরে বিস্তির্ণ আখের ক্ষেত। চৌদ্দ বছর তিন মাস বয়েসে শ্রীলেখা প্রথম জয়ন্তকে দেখেছিল বৈশাখ মাসের প্রথম দিনের রৌদ্রমূখর অপরাহ্নে রুপহাটির মেলায় । রসিক ময়রার মিস্টান্নর আপণের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল জয়ন্ত। শ্রীলেখা তো ওকে দেখে থ। বুকে ঝড়। সে ঝড় বাহিরের প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল কি? নইলে আচমকা ঝড় উঠবেই বা কেন। ঘূর্ণি বাতাসে কে কোথায় যে ছিটকে গেল। মুহূর্তেই সমস্ত মেলা লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল। রুপহাটির উত্তরে যে বিস্তীর্ণ আখক্ষেত আছে-সেখানেই জয়ন্তর বুকে শ্রীলেখা নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিল। সন্ধ্যে অবধি।
তারপর নিত্য দেখা হত জয়ন্তর সঙ্গে।
তারপর?



তারপর কথায় কথায় কখন যে ভোর হয়ে গিয়েছিল। পুন্ড্রনগরে একটি নতুন ভোরের জন্ম হয়েছিল। পূর্বাকাশের সূর্যদেবের রক্তিম রঙে ক্রমশ রাঙিয়ে উঠেছিল করতোয়ার জল। বাতাস হয়ে উঠেছিল সত্যিকারের ভোরের বাতাস। শীলা দেবীর ঘাটের ওপর শুয়ে থাকা সেই ককুরটির ঘুমও ভেঙে গিয়েছিল। যাত্রীর পদশব্দে ওটি সম্ভবত ঘুম থেকে জেগেই চুলকাতে লাফিয়ে কয়েকটা ধাপ ডিঙিয়ে শ্রীলেখাদের চোখের আড়ালে চলে গিয়েছিল।
দক্ষিণ অভিমুখী নৌকা ছাড়বে।
শ্রীলেখা ও সুমন্ত উঠে দাঁড়িয়েছিল। তারপর সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নেমে গিয়েছিল? কে জানে। কবেকার কথা। শ্রীলেখা সম্ভবত করতোয়ার জলের অনেকটা কাছে পৌঁছে জলের আষঁটে গন্ধ পেয়েছিল। জলের মৃদু ছলাত শব্দও শুনেছিল বোধ হয়। ঘাটে তো পাশাপাশি অনেক নৌকা থাকার কথা। দু-একজন ব্যস্ত যাত্রী। কিছু পণ্য উঠছিল। এই ধরা যাক আখ, সুপারি, গুড়ের হাঁড়ি। ওরা একটি নৌকায় উঠেছিল। বেশ বড়সরো নৌকা। ছইয়ের ওপর অনেকখানি জায়গা। সিঁড়ি বেয়ে ছইয়ের ওপর উঠেছিল ওরা? তখন দূরন্ত বাতাস ওদের ঠেলে ফেলে দিচ্ছিল প্রায়? পাল তুলছিল মাঝিমাল্লারা? ভালো করে রোদ ওঠার আগেই গলুই ঘুরে গিয়েছিল?
শ্রীলেখারা ছইয়ের ওপরই বসল। শ্রীলেখা সম্ভবত শীলাদেবীর ঘাটের দিকে তাকিয়ে থাকে। কেননা, মধ্য-আষাঢ়ি বাতাসের তোড়ে পালের বুকে টান খাওয়ায় ওর চোখের সামনে থেকে শীলাদেবীর ঘাট ক্রমেই মিলিয়ে যাচ্ছিল। এই ঘাটে আর ফেরা হবে না। কবে যেন জয়ন্তর পাশে নির্জন মাঝরাতে ঘাটের পৈঠায় বসে থাকতাম। সে কবেকার কথা বলে মনে হয। লঙ্কা দ্বীপ কেমন? আমি জয়ন্তকে খুঁজব। কেন যেন মনে হয় অভিমানী জয়ন্ত লঙ্কা দ্বীপে লুকিয়ে আছে। জয়ন্ত কি সত্যিই লঙ্কাদ্বীপে রয়েছে? ও আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকায়। ভোরের শুভ্র আকাশে এক ঝাঁক বুনো হাঁসের সারি। দক্ষিণমুখি উড়ে চলেছে। শ্রীলেখা হাসল। ওরাই যে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। জয়ন্ত যেখানে আছে সেখানে। আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে নেয় শ্রীলেখা। ভিক্ষু সুমন্তর দিকে তাকালো। লোকটাকে কেমন ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ছইয়ের এককোণে বড় একটি মাটির ধামা। ধামার ভিতরে কি আছে কে জানে। তারই আড়ালে ঘুমোবার আয়োজন করছে লোকটা। করুক। বয়েস হয়েছে তো। তা ছাড়া কাল সারারাত জেগেছে। এই বয়েসে এত সয়- তা ছাড়া এই গল্পের পরের অধ্যায়ে তার তো তেমন কোনও ভূমিকাই নেই। ঘুমাক, লোকটা ঘুমাক।
শ্রীলেখা শুধু জেগে থাকুক বুনোহাঁসেদের উড়াল পথ চেয়ে।

(সমাপ্ত)

সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুলাই, ২০১২ দুপুর ১:৩২
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×