মনিবাদী নীতিমালা এবং এর পান্ডাপুরুতগন
আগের একটা লেখায় পারস্যের এক প্রেরিতপুরুষ সম্বন্ধে লিখেছি। মনি। ওই লেখাটায় মনির জীবনবোধ নিয়ে সামান্য আলোচনা করেছি। যেহেতু জ্ঞানপিপাসুদের মধ্যে মনিবাদ নিয়ে নানান প্রশ্ন উঠেছে সে কারণেই আরও একটা লেখার প্রস্তুতি নিতে হলো। আসলে আমি যে কোনও তত্ত্বের চেয়ে সেই তত্ত্বের পিছনের মানুষটার জীবন নিয়েই বেশি কৌতূহল বোধ করি বলেই মনিবাদ নিয়ে না-লিখে মনিকে নিয়ে লিখেছি।
সে যাই হোক। মনিবাদ বা Manichaeism সম্পর্কে সবচে গুরুত্বপূর্ন দিক হলো- এটি বৌদ্ধধর্ম, জরথুশত্রবাদ ও খ্রিস্টধর্মের জগাখিচুরি এবং বাঙালিমাত্রেই জানেন জিনিসটি কী প্রকার উপাদেয়। ওই ত্রয়ী দর্শন মিলিয়ে দিয়ে সম্পূর্ন একটি নতুন ভাষ্য তৈরি করার সমস্ত কৃতিত্ব অবশ্যই মনির। উপরোন্ত,বুদ্ধ,জরথুশত্র ও খ্রিস্টকে প্রেরিতপুরুষ মানলেও মনির দাবী অনুযায়ী নাকি সহি ওহী কেবলমাত্র তাঁর কাছেই এসেছিল।
এসব বিষয়ে কান না-দিয়ে বরং আরও গভীরে প্রবেশ করি। মনিবাদ-এর মূলকথা দ্বৈতবাদ।
দ্বৈতবাদ কি?
দ্বৈতবাদ মানে বিশ্বের প্রতিপালক একজন নন দু’জন। এবং এই ধারণাটি মনি প্রাচীন পারস্যের জরথুশত্র থেকে সম্ভবত গ্রহন করেছেন। মানুষ তার কালের চিন্তাচেতনায় আচ্ছন্ন থাকে। হেগেলিয় এই ধারণাটি অসত্য নয়। আমরা কেন মনির কথা এতদিন পরে জানলাম?
সে যাই হোক। মনি বিশ্বাস করতেন যে বিশ্বজগতে দুটি পরস্পর বিরোধী শক্তির মধ্যে প্রতিনিয়তই সংঘর্ষ হচ্ছে। এর একটি অশুভ (অন্ধকার ও বস্তু); অন্যটি শুভ ( আলো ও আত্মা)।
বোঝা যায় বিষয়টি খ্রিস্টানদের ‘গড’ ও ‘ডেভিল’-এর ধারণার অনুরুপ।
তা হলে ব্যাতিক্রম কোথায়?
মনিবাদ অনুযায়ী দুটি পরস্পর বিরোধী শক্তির ক্ষমতা সমান!
কী ভয়ানক ধারণা!
তা হলে শুভ ও অশুভ শক্তির ক্ষমতা সমান?
মনিবাদ অনুযায়ী তাইই। এবং এখানেই মনিবাদ জগতের অন্যান্য ধর্মীয় দর্শন থেকে স্বতন্ত্র।
যেখানে করুনাময় ঈশ্বরের জগতে অশুভের উপস্থিতি নিয়ে ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মতাত্ত্বিকগন ইষৎ লজ্জ্বিত-সেখানে মনিবাদীরা দেখুন কত নির্ভার। নির্ভার ও স্বচ্ছ। বজ্রপাতে খোলামাঠে নিরীহ কৃষকের মৃত্যু হলো। নচ্ছার ঈশ্বরের কাজ। পাঁচ বছরের মেয়েশিশু ধর্ষিত হলো। সেই একই অশুভ ঈশ্বরের কাজ। তাই ...
মনিবাদের আরেকটি বদখত সিদ্ধান্ত হলো-
শরীর=অশুভ
আত্মা =শুভ।
[মনির কেন মনে হয়েছিল শরীর অশুভ আর আত্মা শুভ। আত্মাকে তিনি কোথায় দেখলেন? যা দেখা যায় না তা শুভ হয় কি করে? মনকে অনুভব করা যায়। আত্মাকে করা যায় কি? আত্মা কি ধারণামাত্র নয়? শরীরে মনই তো যথেস্ট, আত্মার কি প্রয়োজন? রাস্তা পেরিয়ে কোথাও যেতে হলে মনের দিকনির্দেশনা ই যথেস্ট-আত্মার তাতে কি কাজ? অনেকে বলেন, আত্মা পরলোকের। তো তার এখানে কাজ কি!
আর শরীরই-বা অশুভ হয় কি করে? ছেঁউড়িয়ার সাঁইজী তো অন্যকথা বলেন।
খাঁচার আড়া প’ল ধসে
পাখি আর দাঁড়াবে কি সে?
আমি এই ভাবনা ভাবছি মিছে?
আমার চমকজ্বরা বইছে গায়।
এই খাঁচাই শরীর। বাংলার ভাব অনুযায়ী শরীর শুভ-অশুভ কিছুই নয়। একটা বাস্তবতা মাত্র। যেখানে মানুষ রতন বাস করেন। দেহ হল গৃহ। দেহগৃহ। গৃহ অপরিস্কার হয় কি করে?]
শরীর অশুভ ভেবেই কি সব ধরনের যৌন সঙ্গম নিষিদ্ধ করেছেন মনি? এমন কী জন্মদানের উদ্দেশে হলেও। নির্দেশটি সাধুসংঘে মানায় কিন্তু মানুষের সমাজে? তা হলে মনিবাদ লোকসমাজে গ্রহনযোগ্যতা পেল কি করে ? মনির জীবদ্দশাতেই তো মতবাদটি ইউরোপ থেকে ভারত বর্ষ অবধি ছড়িয়ে পড়েছিল; আর মৃত্যুর পরে স্পেন থেকে চিন অবধি।
কিন্তু, যে ধর্মে যৌনতার মতন এক অনিবর্যি তাগিদ নিষিদ তা লোক সমাজে গ্রহন যোগ্যতা পায় কী করে?
মনিবাদে কেবল যৌনতাই নিষিদ্ধ নয়, মাংস ও মদ্যপানও নিষিদ্ধ। তা হলে? তা হলে লোকসমাজে কি করে মনিবাদ অত গ্রহনযোগ্যতা পেয়েছিল?
আসলে মনির অনুসারীরা ছিল দু’ভাগে বিভক্ত। Elect এবং Hearers.বিষয়টা আসলে বৌদ্ধদের মঠবাসী ও গৃহস্থ উপাসকের মত। মনিবাদী ধর্মের কঠোর অনুশাসনগুলি কেবলমাত্র Elect-দের জন্যই। অন্যদিকে, Hearers-রা বিয়েথা করে সংসারী হতে পারত। এমন কী তারা মদ ও মাংশও খেতে পারত। তবে দুটো শর্ত আছে।
কি শর্ত?
(১)Hearersদের সব মনিবাদী ধর্মীয় উৎসব পালন করতে হবে আর
(২) Elect-দের পুষতে হবে।
বোঝা গেল, Elect রা আসলে মনিধর্মের কাঠমোল্লা। তাইই। বলা হয়ে থাকে যে Elect
দের আত্মা মৃত্যুর পর সরাসরি স্বর্গে যাবে। আর Hearersদের সৎগতি অত সহজে নয়।
এ বিষয়ে অবশ্য দ্বিমত রয়েছে। সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বিশ্বের ধর্মগুলির ভাঙ্গনের প্রসঙ্গে দু-একটি কথা বলতে হয়। বিশ্বের সব ধর্মই ভেঙ্গেচুরে খন্ডবিখন্ড হয়ে আছে।জৈনধর্মে- শ্বেতাম্বর, দিগম্বর। বৌদ্ধধর্মে- মহাযান, হীনযান। খ্রিস্টান ধর্মে- রোমান ক্যাথলিক প্রোটেস্টান্ট। ইসলাম- বাহাই, আহমদীয়া, বুহরা।
মনি যে নগরে বেড়ে উঠছিল, মানে তৎকালীন বাগদাদ, সে নগরে “এলকাসিটেস” নামে এক ইহুদি সম্প্রদায় ছিল। সেই গোত্রের সঙ্গে মিশে ধর্ম সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠেছিলেন মনি।
তেমনি একটি মনিবাদী সম্প্রদায়ের নাম Cathari. এরা বিশ্বাস করত যে Hearers
-রা Elect দের মতোই সরাসরি স্বর্গে যেতে পারবে। এবং সেই লাইসেন্স নাকি বেঁচে থাকতেই যোগার করা সম্ভব!
এ ব্যাপারে আপনার কি মত?
মনিবাদের বিকাশ
আগেই বলেছি, মনির জীবদ্দশাতেই মনির মতবাদটি ইউরোপ থেকে ভারতবর্ষ অবধি ছড়িয়ে পড়েছিল।
এর আরেক কারণ হলো- মনির ধর্মটি ছিল Proselytizing ধর্ম। Proselytizing কি? অভিধান দেখুন।
ইউরোপে চতুর্থ শতকে মনিবাদীদের রমরমা ছিল। এমন কী খ্রিস্টধর্মের জন্য হয়ে উঠেছিল প্রবল হুমকি। একটা উদাহরণ দিই। সাধু অগাস্টিন নাকি প্রথম জীবনে প্রায় ৯ বছর মনিবাদী ছিলেন। এবার ভাবুন।
চতুর্থ শতকে রোমানরা খ্রিস্টধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে গ্রহন করে। এর পরপরই মনিবাদীদের ওপর নেমে আসে লাঞ্ছনা। নির্যাতন ও মৃত্যু। মনি তার বিশ্বাসের জন্য প্রাণ দিয়েছেন। এবার তাঁর অনুসারীরা মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াল।
আগের লেখাটায় বলেছি-মনির জন্ম হয়েছিল মেসোপটেমিয়ায়। আরও নির্দিস্ট করে বললে বর্তমান বাগদাদে। তো সেখানে মনিবাদের কি হলো? পারস্য ও মেসোপটেমিয়ায় মনিবাদ প্রথম থেকেই টিকে ছিল। ওখান থেকেই মধ্য এশিয়া, তুর্কিস্থান ও চিনে (বেশ সচেতনভাবেই আমি এই বানান লিখছি) মনিবাদ ছড়িয়ে যায়। এমন কী চিন ছাড়িয়ে তাইওয়ান অবধি পৌঁছেছিল।
পশ্চিম চিন ও মঙ্গোলিয়া নিয়ন্ত্রন করত Uighursরা। অস্টম শতকের শেষের দিকে Uighursরা মনিবাদ কে তাদের রাস্ট্রীয় ধর্ম করে।
সপ্তম শতকে ইসলামের অভ্যদয় মনিবাদের অন্তিম ঘন্টা বাজিয়ে দেয়।
অস্টম শতকে বাগদাদকেন্দ্রীক আব্বাসীয়রা মনিবাদীদের ওপর চাপিয়ে দেয় লাঞ্ছনা। নির্যাতন ও মৃত্যু।
হায়! বাগদাদেই জন্ম হয়েছিল মনির।
এর পরপরই মতবাদটি ইরান ও মেসোপটেমিয়া থেকে ক্রমশ অবসৃত হয়ে যেতে থাকে।
নবম শতক থেকে মধ্য এশিয়ায় মনিবাদের প্রভাব কমে যেতে থাকে। ইসলামের প্রসার এর অন্যতম কারণ। ১৩ শতকে মঙ্গোল অভিযানের পর পর মধ্য এশিয়া থেকে মনিবাদীরা সম্পূর্নত উচ্ছেদ হয়ে যায়। মার্কো পোলো অবশ্য পূর্ব চিনে মনিবাদীদের দেখা পেয়েছিলেন। সময়টা ছির ১৩০০ সাল।
তখন বলছিলাম যে- চতুর্থ শতকে রোমানরা খ্রিস্টধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে গ্রহন করে। আর এর পরপরই মনিবাদীদের ওপর নেমে আসে লাঞ্ছনা। নির্যাতন ও মৃত্যু। [যিশু কি জানতেন যে তাঁর দয়াময় মতবাদটি প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে অন্যান্য অবিশ্বাসীদের প্রাণ বলি হয়ে যাবে?]
রোমানদের নির্যাতন সত্ত্বেও নানা সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে ইউরোপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল মনিবাদীরা।
যেমন সপ্তম শতকে বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যে Paulicians-রা এবং বলকানে
Bogomilsরা।
Cathariদের কথা তো আগেই বলেছি। এই সম্প্রদায়টি ছিল গুরুত্বপূর্ন। এদেরই অন্য নাম Albigensians । দক্ষিণ ফ্রান্সে ছিল এদের মূল ঘাঁটি। মজার কথা হলো- এরা নিজেদের খ্রিস্টান মনে করত। যদিও এদের মতবাদ মনিপন্থিদের মিল বেশি। মজা এখানেই। ওদিকে গোঁড়া গির্জে পিতারা এদের মনে করত খ্রিস্টবিরোধী। কী সর্বনাশ! সময়টা ত্রয়োদশ শতকের প্রারম্ভ। ইউরোপে তখন পোপ ইনোসেন্টের দোদর্ন্ড প্রতাপ। পরম প্রতাপশালী ছিলেন পোপ ইনোসেন্ট । অতি কট্টরপন্থি ও দারুন অসহিষ্ণু। তিনি Cathari দের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধের ডাক দিলেন।
১২০৯। ক্রসেড আরম্ভ হলো।
১২৪৪। Cathari সম্প্রদায় সম্পূর্নত ধ্বংসপ্রাপ্ত হলো।
অবশ্য চতুর্দশ শতক অবধি Cathari সম্প্রদায়টি ইতালিতে টিকে ছিল।
তথ্যসূত্র:
Michael H. Hart;The 100: A Ranking Of The Most Influential Persons In History. pp.429-434.
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১২:৪৫