পারস্যের এক প্রেরিত পুরুষের নাম মনি Mani. তাঁর সময়কাল ২১০ -২৭৬ খ্রিস্টাব্দ। তিনি ছিলেন মনিবাদ বা Manichaeism-এর প্রবক্তা। মনির জন্ম হয়েছিল বতর্মান বাগদাদের কাছাকাছি এক পার্থিয়- ইরানীয় পরিবারে। শোনা যায় বেশ বনেদী বংশ। মনির বাবার নাম ছিল পাটিগ (কিংবা ফাটিক) মায়ের নাম মারিয়াম। এরা ছিলেন মূলত হামাদানের লোক। (হামাদান বর্তমান ইরানের একটি জায়গা)
সেই সময়, অর্থাৎ সেই খ্রিস্টাব্দ তৃতীয় শতকে, আমরা এখন যেভাবে ওই অঞ্চলটিকে দেখি: ইরান, ইরাক-সে রকম কোনও রাজনৈতিক ভাগ ছিল না; ওই সমগ্র অঞ্চলটি ছিল পারস্যের সাসানিদ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত।
পাটিগ কিংবা ফাটিক এবং মারিয়াম - এই নাম দুটি, পন্ডিতদের মতে, সিরিয়। মনি যে ভাষায় কথা বলতেন তা ছিল মধ্য-পারসীয় বা সিরিয়।
মনির মায়ের নাম, লক্ষ করুন, মারিয়াম। নামটি আমাদের কাছে খ্রিস্টান অনুসঙ্গ বলেই মনে হয়।
সে যাহোক। ছোটবেলা থেকেই মনি ছিল অন্যদের চেয়ে আলাদা? অন্তমূর্খী?
এসব ব্যাপারে বিস্তারিত জানা যায় না। কাজেই এসবই অনুমানের বিষয়। তকে বালক মনি যে তুমুল স্পর্শকাতর ছিলেন তা অনুমান করি। যে কোনও বিষয়ের গভীরে প্রবেশের তীব্র ইচ্ছে ছিল। ভালো লাগত সংগীত রোদ ও রং। নারী?
মনি যে নগরে বেড়ে উঠছিল, মানে তৎকালীন বাগদাদ, এখন যেটা ইঙ্গমার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা তছনছ করছে-সে নগরে ছিল “এলকাসিটেস” নামে এক ইহুদি সম্প্রদায়। যুবা বয়েসে সেই সম্প্রদায়ের লোকদের
সঙ্গে মিশে মনি নাকি ধর্ম সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠেছিলেন। যে কোনও বিষয়ের গভীরে প্রবেশের তীব্র ইচ্ছে ছিল। তৎকালীন আরও কিছু ধর্মীয় মতবাদ মনিকে প্রভাবিত করেছিল। মনির প্রবল জ্ঞান তৃষ্ণা ছিল-যা স্বাভাবিক।
একাদশ শতকের পারস্যের প্রখ্যাত পন্ডিত আলবেরুনি। জ্যোর্তিবিদ্যা, গণিত বাদেও আত্মজীবনী লিখতেন বেরুনি। তাঁরই একটা লেখা থেকে জানা যায়: যুবা বয়েসেই নাকি মনির ঈশ্বরদর্শন হয়েছিল। উত্তরাধুনিক
মনোবিজ্ঞান বিষয়টিকে অবশ্য অন্যভাবে ব্যাখ্যা করে।
ঈশ্বরদর্শন সবার হয় না কেন? ঈশ্বর কি সবার নন?
সব মানুষের স্নায়ূতন্ত্র এক রকম নয়?
কেন?
মনে করা হয় যে তিনি-মনি, ভারতে এসেছিলেন। স্পর্শকাতর মানুষেরা ভ্রমনে আগ্রহী হয়ে থাকেন। কিন্তু, মনি কেন ভারতে গিয়েছিলেন? কার মুখে বুদ্ধের কথা ওই আলোর কথা শুনেছিলেন? পন্ডিতদের মতে-২৪০ কিংবা ২৪১ খ্রিস্টাব্দের দিকে নৌপথে সিন্ধু উপত্যকায় এসেছিলেন। আরও বলা হয় যে তিনি ভারতের বৌদ্ধ রাজা তুরাণ শাহ কে ধর্মান্তরিত করেছিলেন।কে এই তুরাণ শাহ? কোন ধর্মে? বর্তমান আফগানিস্থানের বামিয়ান-এর অনেকগুলি ধর্মীয় চিত্র মনিকে নিয়েই বলে মনে করা হয়।
এক সময় মধ্য এশিয়ায় মনির ধর্মের গভীর প্রভাব ছিল।
মনি ভারত থেকে পারস্যে ফিরে এলেন।
তারপর ধর্ম প্রচার করতে থাকেন।
তো, তখনকার পারস্যের রাজনৈতিক অবস্থা কেমন ছিল?
মনির সময়কাল পারস্যে ছিল সাসানিদ রাজবংশ। রাজবংশটির সময়কাল ২২৬-৬৫১ খ্রিস্টাব্দ. সপ্তম শতকের মুসলিম অভিযান রাজবংশটির পতনের কারণ হয়ে ওঠে। সে যা হোক।
সাসানিদ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতার নাম ছিল প্রথম আর্দাশির। একে নিয়ে আমাদের কোনও আগ্রহ নেই; অবশ্য এঁর ছেলেকে নিয়ে আছে। এঁর ছেলের নাম ছিল শাহপুর-মহান সম্রাট শাহপুর। সম্রাট শাহপুর ছিলেন বিশাল মনের মানুষ । কথাটা বলার কারণ আছে। ওই সময়ে পারস্যে রাষ্ট্রীয় ধর্ম ছিল জরথুশত্রবাদ। তা সত্ত্বেও মনিকে পৃষ্ঠপোষক করেছিলেন শাহপুর।
সম্রাট শাহপুরের ভাই পেরোজ (ফিরোজ?) কে ধর্মান্তরিত করেছিলেন মনি।
ধর্মপ্রচারের জন্য তুর্কিস্থান মেসোপটেমিয়া পারস্য ফিলিস্তিন সিরিয়া মিশর এবং ভারতের কুষান সাম্রাজ্যে মিশনারী পাঠিয়েছিলেন মনি ।
অবশ্য পরবর্তী পারশিক সম্রাটদের আনুকূল্য পাননি মনি।
ততদিনে মহান শাহপুর মৃত।
পারস্যের সিংহাসনে তখন প্রথম বাহরাম ।
লোকটা দারাশিকোর মতন উদার পরমতসহিষ্ণু ছিলেন না বরং ছিলেন আরঙ্গজেবের মত। আরঙ্গজেব এক পবিত্র শিখগুরুকে হত্য করেছিল। বাহরাম মনিকে। অবশ্য তাকে প্রভাবিত করেছিল এক জরথুশত্রবাদী পুরোহিত। তার নাম কার্তির। রাজদরবারে প্রভাবশালী ছিল কার্তির । কার্তিরের প্ররোচনায় মনিকে বন্দি করা হয়। অমানুষিক নির্যাতন করা হয়।
নিজস্ব মত প্রচারের জন্য মৃত্যুকেও মেনে নিতে পারে কিছু কিছু মানুষ? কেন কিছু কিছু মানুষের জীবনবোধ তার নিজের জীবনেরও চেয়েও মূল্যবান? কবিদের যেমন কবিতা। প্রেরিতপুরুষেরা কি তাহলে কবি? না ব্যাখ্যাতীত সত্ত্বা।
কারাগারেই মৃত্যু হয় মনির।
এবং মনি নিরেশ্বরবাদী ছিলেন না। জরথুশত্রর মতোই ঈশ্বরের দ্বৈতসত্তায় বিশ্বাসী ছিলেন।মনির ঈশ্বর মনিকে রক্ষা করেনি। ঈশ্বর কি তা হলে নির্বিকার? তা হলে নির্বিকার সত্ত্বায় মানুষের কি প্রয়োজন? কত কত মানুষ ঘুমিয়ে থাকল-আর মনি পারস্যের পথে পথে ঘুরে দান করলেন উপদেশ যা মানুষের জন্য পরম হিতকর আর তাকেই সইতে হলো যন্ত্রনা ...
ঈশ্বর নির্বিকার কেন?
যা হোক। কিন্তু, কি ছিল মনির শিক্ষা?
আত্মসংযম। নিরামিষ আহার। যৌনসংগম থেকে বিরত থাকা। উপবাস। দান।
এসবই দেখছি মঠবাসী খ্রিস্টধর্ম আর বৌদ্ধধর্মের প্রভাব?
নিশ্চয়ই। খ্রিস্টধর্মের আবহে বেড়ে উঠেছিলেন মনি। তাঁর মায়ের নাম মারিয়াম। তদুপরি, ভারতে এসেছিলেন মনি। কাজেই তাঁর জীবনবোধে খ্রিস্ট ও বুদ্ধের প্রভাব থাকাই স্বাভাবিক।
মনি নিজেকে সর্বশেষ প্রেরিতপুরুষ দাবি করেছিলেন। তাঁর মতে অন্যান্য প্রেরিত পুরুষগন হলেন-সেথ, নূহ নবী, ইব্রাহীম, শেম, নিকোথেওস (কে ইনি?) এনচ (কে ইনি?) জরথুশত্র, বুদ্ধ ও জেসাস।
বুদ্ধ? এখানেই আমাদের আগ্রহ।
মনি নিজেকে খ্রিস্টের প্রতিভূ মনে করতেন। এটি অবশ্য তাঁর নিজস্ব মত।
নিকট প্রাচ্যে মুসলিম অভিযানের পূর্বে ভাষা ছিল সিরিয় বা সিরিয়াক। সেই ভাষাতে সাতটি ( ৭সংখ্যাটি কারও কারও কাছে রহস্যময়) ধর্মীয় গ্রন্থ লিখেছিলেন মনি।
ওঁর সবচে গুরুর্ত্বপূর্ন গ্রন্থের নাম "আরজাঙ্গ"।(কেউ এই গ্রস্থটি সম্বন্ধে কোনও তথ্য পেলে জানাবেন।)
ছবিও আঁকতেন মনি। আরজাঙ্গ-এর রঙীন ছবিগুলো নাকি মনিরই আঁকা।
আবার কোনও কোনও পন্ডিতের মতে মনির আদি গ্রন্থগুলি সংরক্ষণ করা যায়নি। অল্পবিস্তর যা পাওয়া গেছে তা মিশরীয় কোপটিক* লেখমালা এবং চৈনিক মনিবাদী রচনার সূত্রেই। বিষয়টি অবশ্য পন্ডিতদের। আমাদের নয়।
মনির মৃত্যুর পরে ইউরোপ থেকে চিন অবধি তাঁর অনুসারীরা ছড়িয়ে যায়।কয়েক শতাব্দী জুড়ে ওই অঞ্চলের মানুষের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল Manichaeism বা মনিবাদ।প্রথম জীবনে রাজদরবারের পৃষ্টপোষকতা পেলেও - যে মতবাদটি প্রচারের জন্য অশেষ নির্যাতন সহ্য করে অনিবার্য মৃত্যুকে মেনে নিতে হয়েছিল মনিকে।
আজকের পৃথিবীতে যদিও মনিবাদের একজনও অনুসারী খুঁজে পাওয়া যাবে না, অথচ আরও আরও প্রাচীন মত আজও টিকে রয়েছে- এখানেই আমাদের আগ্রহ।
নিজস্ব মত প্রচারের জন্য অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিলেন পারস্যের এক বিস্মৃত প্রেরিত পুরুষ, যিনি বুদ্ধকেও প্রেরিত পুরুষ মনে করতেন-এখানেই আমাদের আগ্রহ।
*মিশরীয় কোপটিক লেখমালা নিয়ে পরে লিখব।
(মনির ওপর আমি একটা গল্প লিখছি। যা যথাসময়ে এই ব্লগে প্রকাশিত হবে। তারই ভূমিকা হিসেবে এই লেখাটা ...।)
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ১০:৩০