১৯৭১'র পরাজিত শক্তি পাকিস্তান সে সময় তাদের সহায়তাকারী ও বাংলাদেশের বিরোধীতাকারীদের বাঁচাতে তৎপরতা শুরু করেছে। এ জন্য গত সপ্তাহে পাকিস্তানী হাইকমিশনার বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে 'যুদ্ধাপরাধ ইস্যূ ১৯৭৪ সালে ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যে স্বাক্ষরিত ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে বিষয়টি মিটে গেছে' বলে জানিয়ে গেছেন। তবে বাংলাদেশ পাকিস্তানের এ তৎপরতাকে কোনভাবেই গুরুত্ব না দেয়ার এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার থেকে পিছু না হটার কথা জানিয়েছে।
অর্থাৎ জারজগুলোর বাবারা তাদের নিজ সন্তানদের বাঁচাতে চাচ্ছে, কিন্তু আমার মনে হয় এ যাত্রা পার পাওয়া সহজ হবে না।
পাক হাইকমিশনারের সাম্প্রতিক বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সরকার আগামী মাস থেকে যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে যাচ্ছে তাতে পাকিস্তানের আপত্তি আছে -এমনটি বোঝানোর চেষ্টা করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে সরকার তার নিজস্ব রীতিতে কাজ করে যাবে। পাক হাইকমিশনারের এ বক্তব্য দেশের চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ায় কোন বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।
আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদও সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, আমরা পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের চেষ্টা করছি না। আমরা তাদেরকে বিচারের আওতায় আনতে চাই যারা বাংলাদেশী নাগরিক হয়েও মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ ও মানবতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলো। তারা এ দেশের মানুষকে হত্যা করেছে, মেয়েদের ধর্ষণ করেছে, বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং পাক হানাদারদের সাহায্য করেছে। তাদের ক্ষেত্রে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি খাটে না। এজন্য ১৯৭৩ সালে প্রণীত আনত্দর্জাতিক যুদ্ধাপরাধী আইনকে যুগোপযোগী করে সেটির আওতায় তাদের বিচারের ব্যবস্থা করা হবে।
পাক হাইকমিশনারের বক্তব্য আসলে সমর্থন করছে না কেউই। সেক্টরস কমান্ডার ফোরামের সাধারণ সম্পাদক লে. জেনারেল এম হারুন-অর- রশিদ, বীর প্রতীক (অব বলেছেন, আমরা যাদেরকে বিচারের কাঁঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাচ্ছি তাদের ব্যপারে কোন দ্বিপক্ষীয়-ত্রিপক্ষীয় চুক্তি চলবে না। তারা আমাদের দেশের নাগরিক এবং আমাদের দেশের বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে। তাদের ব্যপারে অন্য দেশের হস্তক্ষেপ কোনমতেই কাম্য নয়। তিনি আরো বলেছেন, তাদের পক্ষে পাকিস্তান তৎপরতা চালাতে পারে কিন্তু আমরা সেটা শুনবো কেন?
৭১'র ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির আরো এক কাঠি বেশি সরেস। তিনি বলেছেন, পাকিস্তানী হাইকমিশনারের বক্তব্য একেবারে অবান্তর ও অগ্রহণযোগ্য। ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলা হয়নি। বাংলাদেশে আটক ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীকে পাকিস্তানে হস্তান্তরের কথা বলা হয়েছিলো। এবং এটি করা হয়েছিলো সে সময় উপমহাদেশে শান্তির পরিবেশ সৃষ্টির জন্য। পাকিস্তান তাদের বিচার করবে এ রকম প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলো। কিন্তু তারা সেটি করেনি। আমরা চাইলে তাদের বিচারের ব্যবস্থাও করতে পারি। তিনি আরো বলেছেন, পাকিস্তান সরকার যদি বাংলাদেশের বন্ধুত্ব চায় তাহলে তাদেরকে এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্যে বাংলাদেশকে সাহায্য করতে হবে। পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্সের কাছে বাংলাদেশী যুদ্ধাপরাধীদের ব্যপারে অনেক তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। সেগুলো তারা বাংলাদেশের সাথে আদান-প্রদান করতে পারে। তা না করে পাকিস্তানী হাইকমিশনার যে বক্তব্যটি দিলেন তা এখতিয়ার বহির্ভূত এবং দুই দেশের সম্পর্ক নষ্ট করার অণুঘটক। যা একজন হাইকমিশনার দিতে পারেন না। তিনি আরো বলেন, হাইকমিশনারের এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ সংগঠনটি এখনো পাকিসত্দানের দোসর।
এখানে একটা বিষয় হচ্ছে ক্ষমতাসীন সরকারের নির্বচানী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্রুতি ছিলো। সেই অনুযায়ী সরকার কাজ করছে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারী আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্যে অবকাঠামো উদ্ধোধনকালে আগামী মার্চে বিচার শুরুর কথা ঘোষণা করেন।
গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতা ও রাষ্ট্রদ্রোহী কার্যকলাপের সঙ্গে তৎকালীন পূর্ব পাকিসত্দান জামায়াতে ইসলামীর আমীর গোলাম আজম, ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী ও পূর্ব পাকিসত্দান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ যে সরাসরি যুক্ত ছিলেন তার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রসংঘ ও আলবদর বাহিনীর কর্মকাণ্ড ও বক্তব্য থেকে। এছাড়াও চিহ্নিত অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীদের রাষ্ট্রদ্রোহী কার্যকলাপে জড়িত থাকার ব্যপারেও পাওয়া গেছে অসংখ্য প্রমাণ।
১৯৭১ সালে ২৬ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান সরকারের মূখপত্র দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় প্রকাশিত "জামাত বাঙালি জাতীয়তাবাদ মেনে নিতে রাজি নয়, মন্ত্রী সম্বর্ধনায় গোলাম আজম" শীর্ষক এক সংবাদে বলা হয়, "পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী'র আমীর অধ্যাপক গোলাম আজম বলেছেন, জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরা মুসলিম জাতীয়তাবাদের আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদকে মেনে নিতে রাজি নয়। তিনি বলেন, জামায়াতের কর্মীরা শাহাদাৎ বরণ করে পাকিস্তানের দুশমনদের বুঝিয়ে দিয়েছে যে তারা মরতে রাজী তবুও পাকিস্তানকে ভেঙে টুকরো টুকরো করতে রাজী নয়।"
ওই সংবাদে আরো বলা হয়, আগের দিন অর্থাৎ ২৫ সেপ্টেম্বর শনিবার ঢাকা শহর জামাত তৎকালীন প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী আব্বাস আলী খান ও রাজস্বমন্ত্রী মাওলানা একেএম ইউসুফকে দেয়া সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে এসব বক্তব্য দেন গোলাম আজম। এ দু'জন ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে গঠিত ১৮ সদস্য বিশিষ্ট মালেক মন্ত্রী পরিষদের সদস্য ছিলেন।
১৯৭১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর জায়ায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম-এ প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়, "ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী পাকিস্তান দিবসে কার্জন হলে দেয়া ভাষণে উল্লেখ করেন, ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রতিটি কর্মী দেশের প্রতি ইঞ্চি ভূমি রক্ষা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এমনকি তারা পাকিস্তানের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য হিন্দুস্তানের মূল ভূখণ্ডে আঘাত হানতেও প্রস্তুত।"
এছাড়া তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ৭ নভেম্বর বদর দিবস উপলক্ষে বায়তুল মোকাররম মসজিদ প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত এক গণজমায়েতে ঘোষণা দেন যে, "পাকিস্তানের অস্তিত্বে বিশ্বাসী স্বেচ্ছাসেবকদের সম্পর্কে বিরূপ প্রচার করা হচ্ছে। যারা এই প্রচার করছে তাদের সম্পর্কে হুঁশিয়ার থাকুন।" এটি ছিলো বদর দিবসে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের দেয়া ৪ দফা ঘোষণার তৃতীয় দফা।
গোলাম আজমের পাকিস্তানপ্রীতি সম্পর্কে আরো ধারণা পাওয়া যায় তার উল্লিখিত বক্তব্যের আরো কয়েকটি লাইন পড়লেই। তিনি বলেছেন, "বর্তমানে প্রদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) যে ২০ ভাগ লোক সক্রিয় রয়েছে তারা দু'ভাগে বিভক্ত। এক দল পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে চায়, আর একদল পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত। জামায়াতে ইসলামী শেষোক্ত দলভুক্ত।" তিনি বলেন, 'জামাতের যে দু'জন সদস্য মন্ত্রীসভায় যোগ দিয়েছেন তাদেরকে দলের পক্ষ থেকে এই দায়িত্ব গ্রহণে বাধ্য করা হয়েছে।'
মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যে রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটির সরাসরি যোগাযোগ ছিলো এ কথারও সত্যতা মিলেছে গোলাম আজমের ওই ভাষণে। তিনি বলেছেন, "যে উদ্দেশ্য নিয়ে জামায়াত রাজাকার বাহিনীতে লোক পাঠিয়েছে, শান্তি কমিটিতে যোগ দিয়েছে সেই উদ্দেশ্যেই মন্ত্রীসভায় লোক পাঠিয়েছে। দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা যে কাজ করেছি সেই কাজে সাহায্য করার জন্যই দু'জনকে মন্ত্রিসভায় প্রেরণ করা হয়েছে।" তিনি বলেন, এ মন্ত্রী পদ ভোগের বা সম্মানের বস্তু নয়। আমরা তাদের বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছি।
এসব ছাড়াও প্রমাণ আছে হাজারে-বিজারে। শাহরিয়ার কবির বলেছেন পাক ইন্টেলিজেন্সের কাছে যুদ্ধাপরাধীদের দেশদ্রোহী কাজের প্রমাণ আছে। তারা সেগুলো আমাদের সাথে শেয়ার করতে পারে যদি বাংলাদেশের বন্ধুত্ব চায়। আমার মনে হয় না ওরা বাংলাদেশের বন্ধুত্ব পাওয়ার জন্য এসব ইনফরমেশন শেয়ারে রাজি হবে। তবে আইনমন্ত্রী-পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য আর কার্যকলাপ, সেই সরকারের ভাবভঙ্গিতে মনে হচ্ছে রাজাকারগুলোর এইবার আর রক্ষা নাই।
সূত্র: দৈনিক ডেসটিনি (২৮-০২-১০), ব্লগ ও ঢাবি সেন্ট্রাল লাইব্রেরীর পুরোনো পত্রিকা
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই অক্টোবর, ২০১৩ রাত ১১:৫৭