আগেরদিনে এখনকার মতো গ্যাসের চুলা ছিল না যে টিপ দিলেই জ্বলে উঠবে, ছিল মাটির উনুন......... কাঠ আনো, খঁড়ি কাঠি আনো, ম্যাচ এনে ধরাও...... কঠিন পরিশ্রমের পরেই একমাত্র কাজটা সমাধান সম্ভব। আমার দাদুকে দেখতাম ভোর ৪ টায় উঠে চুলা জ্বালিয়ে, পানি গরম করে বদনায় ঢেলে, গামছা ভাজ করে চেয়ারের উপর রেখে দিত, খড়ম জোড়া বাড়ির বাইরের উঠানে একপাশে রেখে দিত.... এ সবই ছিল দাদাভাইয়ের জন্য ওজুর ব্যবস্থা। (খড়ম মানে এক ধরনের কাঠের সেন্ডাল যা পড়ে হাটা খুব কঠিন কি বলতে কি শুরু করলাম... সেটা আরেকদিন হবে)। কোথাও যাবার আগেই দাদু সব কিছু হাতের কাছে এনে দিত। দাদা শুধু হুকুম করতো এবং সব কিছুই রেডি হয়ে যেত। সেই সাথে তো রান্নাবান্না, ঘর-দোর দেখা, বাচ্চাদের টেককেয়ার করা.... এমন কি জমি-জমার ঝামেলা মাথায় রাখা ও সমাধানের পথ বের করা, সে সব মুজুররা কাজ করতো তাদের খাবার ব্যবস্থা থেকে তাদের বউ-বাচ্চাদের খাবার, কাপড়, পড়াশুনা সব কিছুর দায়িত্বে ছিলেন দাদু এবং সবকিছু নিখুঁতভাবে মেইন্টেন করে গেছেন সারা জীবন।
আমার মাকে আমি ডাকতাম দূর্গা বলে। বলতাম দূর্গার দশ হাতের মতোই মা সারা সংসারের সব কাজ করতো, কোথাও কোন ঘাটতি হতে দিত না। চাচা, মামা, ফুফু, খালাসহ বিশাল এ সংসারের প্রতিটা বিষয়ে নিখুঁতভাবে মা তদারকি করতেন। চাচা, মামা সহ আমাদের সকলের পড়াশুনা, রান্না, বাজার, সামাজিকতা, অতিথি, কাজের লোক সহ সব বিষয়ে মা অসাধারন দক্ষতার সাথে সব কিছু চালাতেন। তারপর ও বাবার অফিসে যাবার আগেই বাবার জন্য শার্ট-প্যান্ট, ওয়ালেট, চশমা, চাবি সুন্দর করে গুছিয়ে রেখে দিতেন। সব কিছুর পরেও প্রতি রোববারে লেডিস ক্লাব মিস করতেন না। খুব সুন্দর করে পরিপাটি হয়ে থাকতেন মা। কোথাও এতটুকু মিসিং ছিলনা। তারউপর ছিল আমার বাবার প্রায় বন্ধু-বান্ধব বা অফিস কলিগদের বাসায় দাওয়াত দেয়ার বাতিক কারন মা খুব ভালো রান্না করতো এবং মা সবকিছুই হাসি মুখে করতেন কোথাও কোন ত্রুটি রাখতে দেখিনি কখনো। বাবা অফিসের পর কিছুক্ষন টিভিতে খবর দেখার পর আমাদের পড়াতে বসতেন নতুবা বাকি সময় বই পড়ে কাটাতেন। কারন বাবার ছিল বই পড়ার নেশা। বই পড়ার নেশা মায়ের থাকলেও মা সময় করে উঠতে পারতেন না সংসারের এমন ঝামেলার মাঝে। প্রায় দেখা যেত বাবা নতুন কোন বই কিনে আনলে বাবা এক রাতেই শেষ করে দিত (বাবার আবার বই সংগ্রহের বাতিক ছিল)। আর মা প্রায় মাস লাগিয়ে বইটা শেষ করতো তাই বাবা প্রায় মাকে স্লো রিডার বলে ক্ষাপাতো কিন্তু কখনই মাকে বলতে শুনিনি স্লো রিডার হবার পিছনের আসল কারন। সংসারের ২৪ ঘন্টার পার্মামেন্ট বুয়ার কাজ করে বই পড়া অনেকটা বিলাসিতা। কিন্তু কখনই মাকে এ নিয়ে অভিযোগ করতে শুনিনি।
এবার আসি আমাদের যুগে... বিয়ের পর থেকেই দেখি অফিসে যাবার আগে আমার বর সারাঘর তছনছ করে একবার ওয়ালেট খুঁজে, আরেকবার শার্ট খুজেঁ তো পরেরবার চাবি। এবং অফিসে পৈাছানোর পর মনে পড়ে মোবাইলটা আনা হয়নি। অফিসে ঢুকেই ২৫টা কল দিবে আমাকে। এটা হয়নি, সেটা ঠিক হয়নি........... রাগে গজগজ করতে করতে একদিন বলে আচ্ছা তুমিতো একটু হেল্প করলেই পারো... সকালে এতো তাড়াহুড়ায় থাকি।
একটু মারমুখী আমি বলি
দাঁড়াও দাঁড়াও তুমিতো ও অফিসে যাচ্ছো এবং আমিও যাচ্ছি। তোমার যেমন ৯টা-৫টা ঘড়ি ধরে অফিস ঠিক সেরকমই আমারটা। তোমার যেমন অফিসে হাজারটা বিষয় মাথায় রাখতে হয় তেমনি মেয়ে হিসেবে আমাদের একটু বেশীই রাখতে হয়। ব্যাখ্যাটা একটু পরে দিচ্ছি। তার আগে কিছু উত্তর দাও...............
ঘুম থেকে উঠেই তুমি নাস্তা রেডি পেয়েছো, ঠিক?......
হাঁ পেয়েছি। বাট ওটাতো বুয়ার কাজ!
ছেলের টিফিন রেডি করে, ওকে রেডি করে নীচে যেয়ে গাড়িতে পৈাছায়ে দিলাম, ঠিক?
অারে মা হিসেবে ওটা তুমিইতো দেখবা।
তোমার লান্চ বক্স রেডি পেয়েছো, ঠিক?
এটা আর এমন কি, বুয়া রান্না করেছে আর তুমি প্যাক করেছো।
অফিস থেকে ফিরেই আগে রান্না ঘরে ঢুকি তোমাদের সন্ধ্যার নাস্তা রেডি করতে, সেটা সময় মতো পাচ্ছো, ঠিক?
এটা আর তেমন কি, এক কাপ চা সাথে সামান্য ভাজি ভুজি নতুবা বিস্কিট!!!!
তারপর বসি ছেলেকে নিয়ে প্রথমে নাস্তা খাওয়াই ,তারপর ওর স্কুলে হোমওয়ার্ক দেখি, তারপর ওকে রাতের খাবার খাওয়ানো শুরু করি, ঠিক?
ছেলে তোমার কাছে পড়তেই বেশী কমফোর্ট ফিল করে। আর বাচ্চাদের খাওয়ানোর মতো ধৈর্য্য নেই।
এর মাঝে রান্না তদারকি করি ও সময় মতো তোমাদের টেবিলে খাবার দেই, ঠিক?
বুয়াইতো সব রেডি করে বলতে গেলে!!!!
যেদিন অফিসের কাজ থাকে তারপর তা নিয়ে বসি, ঠিক?
তোমার অফিসের কাজতো তুমিই করবা, সেটা আবার বলার কি আছে!!!
এর মাঝে ছেলেকে ঘুম পাড়াই ও তাকে জড়িয়ে ধরে বেড টাইম স্টোরি না বললে তার ঘুম আসে না, ঠিক?
ছেলে তোমার কাছেই ঘুমাতে বেশী কমফোর্ট ফিল করে। অামি গেলে পছন্দ করে না।
তারপর পরের দিনের ছেলের স্কুলের ড্রেস যেটা নোংরা হয়েছে সেটা হয় ধুতে যাই ও নতুন সেট গুছিয়ে রাখি, ঠিক?
তোমার আবার পরিস্কারের বাতিক!! একটা কাপড় এক সপ্তাহ পড়লে সমস্যা কোথায়। প্রতিদিন পরিস্কার কাপড়ের দরকার কি!!
আরো আছে, অফিস থেকে ফেরার সময় প্রায় বাজারে নামতে হয় কারন তুমি যা বাজার করো তার ৭০% ই অপ্রয়োজনীয়। আর সপ্তাহের মাঝে বাজারের কথা বললে তোমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। ঠিক?
আমি যাই আনি তুমি খুঁত ধরো। আমার বাজার তোমার কিছুতেই পছন্দ হয় না, সেটা আমার কি দোষ!!!
আমার শশুড়-শাশুড়ির খাওয়া, ওষুধ ডাক্তার দেখানো সবই আমি করি, ঠিক?
মা-বাবা তোমার উপরই বেশী ভরসা করে, সেটার আমি কি করতে পারি।
নিজের মা-বাবারও সব খোজঁ রাখতে হয় ঠিক?
সেটাতো তোমার দায়িত্ব!!
আমার ননদ-দেবরদের কি লাগবে তার সব কিছু আমি খেয়াল রাখি, ঠিক?
ওরা সবাই তোমার সাথে বেশী কমফোর্ট ফিল করে, সেটা আমি কি করবো।
আমার এবং তোমার পরিবারের সব সামাজিকতা, গিফট্ কেনা সহ সব কিছু আমি দেখি, ঠিক?
একই কথা, আমার কেনা কাটা তোমার কিছুতেই পছন্দ হয়না। যত দাম দিয়েই কিনি না কেন তুমি খুঁত ধরবাই!
আমি ভোর ৬টায় ঘুম থেকে উঠে কাজের মেয়ের সাথে কাজ করছি। আবার রাত বারোটা পর্যন্ত ওর সাথে কাজ করি, ঠিক?
তুমি একটু বাড়াবাড়ি করো, ওর উপর ছেড়ে দিলে এমন কি হয়!!!
এবার আসি তোমার রুটিনে.... তোমার ডেইলি রুটিন হলো, আফিস থেকে আসো, রেডি নাস্তা খেয়ে খবর দেখতে বসো, মাঝে অফিসের কাজ কখনো করো, এরপর ডিনার খেয়ে টকশো দেখতে বসো রাত ১টা পর্যন্ত। এরপরও শুধু নিজেরটুকু গোছাতেই তুমি হিমসিম খাও।
সারাদিনের পরিশ্রমের পর একটু টকশো দেখি, সেটার উপর তোমার এতো রাগ কেন বলতে পারো!!!
পতিবর এবার একটু থমকে চিন্তা করলো, তারপর বললো, তুমি যা কাজের ফিরিস্তি দিলা এগুলোতো তোমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, এ নিয়ে কথা বলার কি অাছে!!
গুড গুড কাজের ও জেন্ডার বিশ্লেষন ... তো স্বামীর সকল কাজের দেখবাল স্ত্রীর দায়িত্ব, বাচ্চাদের খাওয়ানো পড়ানো, স্কুল-পড়াশোনা, বুয়া সামলানো, অতিথি সামলানো, সকল সামাজিকতা আমাদের দায়িত্ব। তো সাংসারিক দায়িত্বের মধ্যে কোনটা তোমাদের পড়ে? তোমাদের দায়িত্ব শুধুমাত্র ৮ই মার্চ বিশ্ব নারী দিবসে স্ত্রীর ছবি সহকারে ব্লগ ফেইসবুকে কঠিন নারীবাদী পোস্ট দিয়ে ভার্চুয়াল
জগৎ গরম রাখা। আর সবাইকে জানানো চেস্টা করা তুমি কতটা নারীবাদী পুরুষ, সমতা তুমি পছন্দ করো, নারীর অধিকার রক্ষায় সদা সচেষ্ট!!
পতিবর একটু দু:খিত হলো, বললো নাহ্ ৪০ বছর আগেই জন্মানো দরকার ছিল। মা-খালা, দাদু, নানু সবাইকেই দেখেছি এভাবে সংসার করতে। অথচ আমাদের সময় থেকেই সব ঝামেলা শুরু হয়েছে...... কাজের জেন্ডার, অফিসে জেন্ডার। আমার মা-খালা সবাই জব করেও কি সুন্দর করে সংসার দেখাশুনা করেছেন, সব কিছুই সুন্দরভাবে ম্যানেজ করেছেন।
হাঁ, ঠিক, যেভাবে তাদের মা-খালারা করে গেছেন পুরুষ প্রজাতী সে ধারনা থেকে বের হতে পারছে না পুরোপুরি। এখন দিন পাল্টেছে.... নদীর পানি বহু দূর চলে গেছে। নারীরা এখন ঘরে বাইরে সর্বত্র বিচরন করছে, চার দেয়ালে আর বন্দী নেই তারা। জয় করে চলছে একর পর এক বাধাঁ। দেশের প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেত্রী নারী... অফিস-আদালত সব কিছুতেই নারীদের আধিপত্ব। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা চেইন্জ হয়ে নারীতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা হয়নি তবে একটি সহমর্মিতার সমাজ গড়ে উঠছে দিনে দিনে। তাই এ নতুন সমাজে পুরুষ জাতির এমন আধিপত্ব ক্ষমতার দাপোট বা আরাম-আয়েশের কিছুটা ঘাটতিতো হবেই। আর সে কারনেই নতুনভাবে অনেক কিছু ভাবতে হচ্ছে এবং আরো ভাবতে হবে ভবিষ্যতে এবং কাজের জেন্ডারের বিশ্লেষন নতুনভাবে করতে হচ্ছে ঘরে বা বাইরে।
আর হাঁ, এ পারিবারিক ক্যাচাল প্রতিটি ঘরে ঘরে যেখানে নারীরা কাজ করছে ঘরে ও বাইরে। যে মেয়েটি অফিস করছে তার জীবন শুধু ৯টা ৫টা অফিসের মধ্যেই সীমিত না, তার অফিস ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত। তাই বলে ভাববেন না যে নারীরা অফিস করে না তাদের হাতে অঢেল সময় আছে? হয়তো কিছুটা সময় জি বাংলা দেখে কাটায় কিন্তু সে ৯টা ৫টা অফিসের পরিবর্তে দেখা যায় কোন কাজের সাহায্যকারী মানুষই নেই আর পতিবর নিজের পানিটুকু ঢেলে দেবার জন্য ও কইগো এক গ্লাস পানি দিয়ে যাও বলে হাক দেয়। আরো আছে...অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বলে কিছুই নেই, প্রতিটি বিষয়ে স্বামীজির উপর ডিপেন্ড করা ছাড়া দ্বিতীয় কোন রাস্তা নেই তাদের। ২ টাকার চকলেট কেনার জন্য ফুল টেন্ডার প্রসেসের মধ্যে যেতে হয়... ডিমান্ড নোট, আস্কিং প্রাইস ম্যাচ, ইভালুয়েশান.... সব স্টেজের পরই কিনতে পারে। আর স্বামীজিও প্রতিটি মূহুর্তে বুঝিয়ে দেন কি কঠিন পরিশ্রম করে তারা টাকা আয় করছে........ কিন্তু একবার ও ভেবে দেখে না সারাটা দিন এ নারী তার সংসারের চাকা কিভাবে সচল রেখেছে।
তবে আশার কথা অনেক পরিবর্তন হয়েছে এবং হচ্ছে। সংসারে অনেক স্বামীই এগিয়ে আসছে সাংসারিক কাজ। রান্না, বাচ্চা পালা শুধু একার মেয়েদের কাজ না...... এ বিশ্বাস এখন অনেকেই করে। এবং এ সহমর্মিতা, সহযোগীতা যে আরো ছড়িয়ে দিতে হবে.... আমরাতো বলিনি তোমরা সব কিছু করো শুধু চাই একটু হাত বাড়িয়ে দেও.... দেখো সে সংসারটা আরো অনেক সুন্দর হয়ে উঠেছে। প্লিজ.....তোমরা শুধু পুরুষ থেকো না মানুষ হোও। তোমাদের মতো আমাদের ও ইচ্ছে করে আকাশে ঘুড়ির মতো উড়তে, আমাদের ও ইচ্ছে করে একটু সময় নিজের ভালোলাগার জন্য দিতে, আমাদের ও ভালো লাগে একটু সময় বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আড্ডা দিতে, আমাদের ভালোলাগে ভালো কোন নাটক দেখতে, ভালো কোন ছবি দেখতে, প্রিয় কোন গান শুনতে, প্রিয় কোন বই পড়তে। "সাংসারিক কাজ শুধু নারীদের" এ চিন্তা থেকে একটু কি বেড়িয়ে এসে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারো না তোমরা?
বি:দ্র: লিখাটা আগে দিলেও কেন জানি খুজেঁ পাচ্ছি না। ভাগ্যিস ইউনির একটি সংখ্যায় দিয়েছিলাম এটি। তাই আবার ঘষে মেঝে রিপোস্ট দিলাম নারী দিবস উপলক্ষে।
২য় বি:দ্র:: পাঠককূল, আকুল আবেদন এই যে লিখাটার সাথে আমার ব্যাক্তি জীবনকে কিছুতেই গুলায়ে ফেলবেন না। ইহা একটি সাধারন কর্মজীবি পরিবারের নিত্যদিনের কথোপকথন। কখনো এ কথোপকথন বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৈাছে কখনো কখনো নয় ............. এই যা পার্থক্য।
বিশ্ব নারী দিবস পালিত হলেও বিশ্ব নর দিবস পালিত হয় না তাই প্রত্যাশা............. বিশ্ব নারী দিবসের মত বিশ্ব নর বা পুরুষ দিবসও পালিত হবে.........।
ছবি সূত্র: গুগুল মামা।
বি:দ্র: প্রিয় ব্লগার আহমেদ জী এস ভাই আমার এ লিখার প্রতিউত্তরে চমৎকার একটি লিখা পোস্ট করেছেন। তাই সেট্রি এর সাথে দেবার লোভ সামলাতে পারলাম না।
নারী হওয়ার হ্যাপা বুঝতে ছোটনের একটি দিন.............
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মার্চ, ২০২১ রাত ২:০২