- দোস্ত খবর শুনেছিস?
- না তো। কি খবর?
- বিল্ডিং ভেঙ্গে অনেক মানুষ মারা গেছে, শুনিস নি এখনও?
- কোথায়?
- সাভারে, একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে।
- সেটা বলবি তো, গার্মেন্টস শ্রমিক মারা গেছে, আমি ভাবলাম গুরুত্বপূর্ণ কোন বিল্ডিং বুঝি ভাঙল। গার্মেন্টস ভাঙবে আর লোক মারা যাবে এটা আর এমন কি খবর?
উপরের কথোপকথনটি পুরোটাই কল্পনাপ্রসুত। কিন্তু কল্পনা কি বাস্তব থেকে খুব বেশী দূরে? এইসব নিম্ম আয়ের মানুষদের জীবন হানি কি আমাদের খুব বেশী আন্দোলিত করে? এই যে বিগত এক দশকে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির বিভিন্ন বড় ধরনের দূর্ঘটনায় ৭৩০ টি তাজা প্রাণ হারিয়ে গেল সেই দূর্ঘটনা গুলোর কয়টির সুষ্ঠু তদন্ত হয়েছে? কয়জনকে শাস্তি প্রদান করা হয়েছে? দূর্ঘটনার সঠিক কারণ চিহ্নিত করে ভবিষ্যতের জন্য শিল্প মালিকদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে কি? সেইসব নির্দেশনা মানা হচ্ছে কিনা তা কে দেখছে? রাজউক এর যেসব দূর্ণীতিবাজ মানুষের জন্য এই সকল ঝুকিপূর্ণ স্থাপনা গড়ে উঠছে, শত শত লোক মারা যাছে তাদের কয়জনের শাস্তি হয়েছে, কয়জন জেলে আছে, ফাসীতে ঝুলেছে কয়জন? কয়জন শিল্প মালিককে শাস্তি তো দূরের কথা; অন্তত গ্রেফতার করা হয়েছে?
কয়েকটি বড় ঘটনার কথা বলিঃ-
১। ২০০৪ সালে নরসিংদী গার্মেন্টস এ আগুন লাগল, মারা গেল ৪৮ জন---কেউ কি কোন শাস্তি পেয়েছে? মিডিয়াতে কিছু আহা আহা উহু উহু মার্কা রিপোর্ট আর নাম মাত্র ক্ষতিপূরণ। তারপর যেই কি সেই। আমরা যে যার মহামুল্যবান জীবন নিয়ে আবার ব্যস্ত।
২। ১১ এপ্রিল, ২০০৫ এবার বাইপাইল, সাভারে ভেঙে পড়ল নয়তলা স্পেকট্রাম সোয়েটার কারখানা। মারা গেল ৬৪ জন, খোঁজ মেলেনি আরও অনেকের। কারণ?কারণ বিল্ডিং এর দুর্বল ভিত্তি। কারা কারা দায়ী ছিল সেই দুর্বল ভিত্তির জন্য? মালিকপক্ষ, ইঞ্জিনিয়ার, ঠিকাদার নাকি রাজউক? কি হয়েছিল তাদের? জানি না। জানতে গেলে জানব কারও কিছুই হয়নি। আর হবেই বা কেন? যাদের কোন মুল্য নেই আমাদের কাছে, তারা মরলেই কি আর বাঁচলেই কি?
৩। কোন ভূমিকম্প বা জলোচ্ছ্বাস না হটাৎ করেই তেজগাঁও শিল্প এলাকায় ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০০৬ এ বসে পড়ল ফিনিক্স গার্মেন্টস এর ৫টি তলা। মৃতের সংখ্যা ২৫, মালিক পক্ষের কাউকে গ্রেফতার করা হল না। কেনই বা হবে একজন গার্মেন্টস মালিক দেশের হর্তা-কর্তা- বিধাতা। যে কিনা নিয়মিত চাঁদা দেন বড় রাজনৈতিক দলের তহবিলে, দেশের সূর্যসন্তান তো এরাই!!!
৪। ৮ জন মারা গেল স্মার্ট গার্মেন্টসে আগুন লেগে, তাকে টেক্কা দিল তাজরীন ফ্যাশন্স-আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে ছাই হয়ে গেল ১১১ জন। পুড়ল গারিব এন্ড গারিব, ম্যাট্রিক্স সোয়েটার আর হামিম গ্রুপ, খুব অল্প কয়েকজন, মাত্র ৫১ জন অগুরুত্বপূর্ণ আদম সন্তান দুনিয়া থেকে গায়েব হয়ে আমাদের মত গুরুত্বপূর্ণ মানুষের জন্য দুনিয়াটাকে আরও বাসযোগ্য করে তুলল।
বলুন তো এত গুলো কমদামী মানুষ যে মারা গেল, তাদের মৃত্যুর জন্য একটি দামী, গুরুত্বপুর্ণ, সমাজের মাথা, সুশিক্ষিত লোকের কোন শাস্তি হয়েছে কিনা? হয়নি, এবারো হবে না।
কারণ যারা মারা গেছে তাদের সম্বন্ধে আমরা বলি, “ও তো গারমেন্টেসে চাকরি করে”। কি তাচ্ছিল্যটাই না করি। জানি এদের বেতন ৩০০০ টাকা, আরে আমার মোবাইল বিল ই তো আসে এর বেশী। জানি এরা থাকে বস্তিতে বা গলি ঘুপচির মেসে, যেখানে আমরা কখনও পা ফেলি না, যদিও ফেলি নাক ঢেকে দ্রুত সরে যাই। সকাল বেলাতে যাতে এদের সাথে একি বাস টেম্পুতে না উঠতে হয় তার জন্য আমাদের আলাদা শিডিউল। “উফ আজ দেরী হয়ে গেল বা আজ আগে যেতে হবে, কিন্তু ঐ সময় তো গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য হাঁটাই যায় না, আর এদের সাথে এক বাসে যাওয়া যে কি ঝক্কি”। যেন ওরা এক অচ্ছুৎ জাতি, ওদের গায়ের স্পর্শে আমাদের জাত চলে যাবে।
তাই ওদের মৃত্যুতে আমাদের কিছু আসে যায় না, ওরা মরল মানে জনসংখ্যা কমল, আমাদের থাকার এই পৃথিবীটা আরও বাসযোগ্য হল।
কিন্তু সত্যি কথা হল ওরা এই গরমে ঘেমে সারাদিন পরিশ্রম করে তিন হাজারের বেতনে কাজ করছে বলেই আমি আপনি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে লক্ষ টাকা রোজগার করি, আপনার আমার উপার্জিত লক্ষ টাকা দেশের বাজেটে কোন (যৎসামান্য) ভুমিকাই রাখে না, কিন্তু সে তিন হাজারে যা করছে তা দিয়ে ই চলছে আমার আপনার এই স্বদেশ। ওরা কাজ করছে বলেই আমরা বেচে আছি, পিজা হাট আর কে এফ সি তে মাস্তি করছি। যার জন্যে আপনি আমি বেচে আছি তার জীবন কেন বারংবার এত সহজে শেষ হয়ে যাবে? যারা দেশকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তারা মারা গেলে কেন স্থবির হয়ে যাবেনা দেশের প্রশাসন?
যে সকল রাঘব বোয়ালরা এদের ঘাম আর রক্ত শুষে আজ এত বড় তারা কেন থেকে যাবে সবসময় ধরা ছোয়ার বাইরে? আর চাই না সহজে, অকাতরে আমাদের দেশের প্রধান চালিকাশক্তিশ্রেনীর প্রাণ। তাদের জীবন এত মূল্যহীন না যে কেউ সহজে কেড়ে নেবে, কিন্তু তার কোন বিচার হবে না। এবার তথাকথিত দামী মানুষের বিচার হতেই হবে। এ দাবী সময়ের, এ দাবী কৃতজ্ঞতার, এ দাবী ঋণ পরিশোধের।