মস্তিস্ক নামক অঙ্গটি ১৫ সেন্টিমিটারের ব্যাসের একটা গোলকের চেয়েও ক্ষুদ্রাকার। সেই সীমাবদ্ধ যন্ত্রে অসীম জগত্ যে আঁটবেনা তা ধরে নেয়া সমীচিন । মহাবিশ্বের এক প্রান্তে অতিকায় গ্যালাক্সি, কৃষ্ণ গহ্বর আর অন্যদিকে অণুপরমাণু কোয়ার্কের ধারণায় আমাদের চিন্তা আটকে আছে।
Cosmic Voyage ফিল্মের ক্লিপ থেকে আমাদের জানার পরিধিটির ধারণা পাওয়া যায়।
যত সময় যায় জ্ঞান বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সত্ত্বেও সীমাবদ্ধতার কথাটি প্রকট ভাবে উঠে আসে, আমরা ভাবি কতদুর আমাদের বোধক্ষমতার আওতায়।বিজ্ঞানী নিউটন একবার সমুদ্রেতটে নুড়ি কুড়ানোর কথা বলেছিলেন। বাস্তব যেন তাকেও হার মানায়।
শুধু মস্তিস্ক কেন ৫/৬ ফুট লম্বা মানুষ নামক এই দ্বিপদী জন্তুটির সীমাবদ্ধতা সব কিছুতেই। চোখের কথাই ধরি। অনেক মেঠো সাপ স্বল্পতরঙ্গের আলো দেখতে পায়। মানুষ দেখা দুরের কথা এর অস্তিত্বই টেরই পায়না । অনেক পতঙ্গ নিজের দেহের চারপাশ দেখতে পায়, আমরা দেখি একদিক। আলোর ওঠানামা পর্যবেক্ষণে আমরা অতিশয় দুর্বল। সেকেন্ডে ১০ টি বল চোখের সামনে উড়ে গেলে তাদের আলাদা করে দেখার ক্ষমতা আমাদের নেই । তিন পাখার সিলিং ফ্যান ঘুরছে উপরে । কিন্তু মনে হচ্ছে যেন গোল চাকতি। অবশ্য চিত্রপরিচালকেরা চোখের এই মধুর অক্ষমতার সুযোগ নিচ্ছেন। ঐশ্বরিয়ার যে নাচ দেখে শীষ দিয়ে উঠতি যুবক বেরিয়ে গেল সিনেমা হল থেকে সে আসলে কয়েক লক্ষ নির্জীব ছবি দেখেছে ঐশ্বরিয়ার, শুধু দ্রুত টেনে নেয়া হয়েছে এই যা। সামান্য আলোতে দেখায় আমাদের বদনাম অনেক। মাছির চোখ আমাদের চেয়ে অনেক বেশী স্মার্ট, নচ্ছার তেলাপোকাও সামান্য অন্ধকারে চোখের জ্যোতি হারায় না আমাদের মত।
শুধু তাই না, কান নামক যে শব্দযন্ত্রটির উপর এত আস্হা। তার ক্ষমতা তো আরো হাস্যকর। আমাদের কানে সেকেন্ডে ২০ বারের কম বাতাসের দোলা মানে নিরবতা। ঝিঁঝিঁ পোকার চেয়ে একটু কড়া আওয়াজ হলেও কর্ণকূহরের বেল নাই। অথচ অবলা বাদুর এক্সপার্টের মত সেসব শব্দ শুনছে। রেডারীয় পদ্ধতিতে পথও খু্ঁজে নিচ্ছে তা দিয়ে। এমন কি পায়ের ধারে লেজ নাড়ছে যে বিড়াল তার কানটিও আমাদের লজ্জা দেবে।
অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে দেহকাঠামোতে, শক্তিতে খুব গর্ব করার মত কিছু নেই। চিতাবাঘের এমন কি বুনো কুকুরের ক্ষিপ্রতার ধারে কাছে নেই মানুষ। আকারে হস্তীর সঙ্গেও পাল্লা দেয়ার উপায় নেই। পরিবেশে বদলে গেলে তেলাপোকারা টিকে থাকবে আমরা মরে যাব। জীবন কাল বা আয়ুতে কচ্ছপ বা কুমিরের সঙ্গে তুলনা করলে অসহায় মনে হবে । এমন কি প্রজনন ক্ষমতায়ও খরগোশ আমাদের লজ্জা দেবে।
সীমাবদ্ধতার মধ্যে অতিসীমিত পরিসরে আমাদের অবস্হান। গড়ে ৬০/৭০ বছরের এর ড্রাইসেল ব্যাটারীর মত ওয়ান টাইম চার্জের জীবনে, পুর্ণবয়স্ক হতেই লাগে ১৮/২০ বছর । তারপর ৩০ পেরোতে পেরোতে চোখ, কান, ত্বক, চিন্তাক্ষমতা, স্মরণ শক্তি লোপ পেতে থাকে। সুতরাং সীমায় পেরোনোর দৌড়ে খুব বেশী কিছু করার উপায় থাকে না।
কিন্তু তার পরও অন্য প্রাণীর চেয়ে নিজেদের সর্বশ্রেষ্ঠ ভেবে আত্মতুষ্টি লাভ করি। একমাত্র মস্তিস্কের কারণে।
২০ বিলিয়ন নিউরোকর্টিয়াল নিউরনের শক্তিশালী সিস্টেমের বদৌলতে সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমাদের সান্ত্বনা যে, এটি সর্বাধিক শক্তিশালী কম্পিউটারের চেয়ে জটিলতর বিশ্লেষণী ক্ষমতার অধিকারী। ১.৩ কেজির এই ছোট মগজে পেচিয়ে রয়েছে ২.৫ বর্গমিটারের কর্টেক্স যা বিছিয়ে দিলে একটি টেনিস মাঠের কাছাকাছি এলাকা দখল করবে। শরীরকে সামলাতে, বাঁচিয়ে রাখতে আমৃত্য ব্যস্ত সে । চিন্তাকোষগুলোতে চলে পটাশিয়াম, সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম আদান প্রদানের এক নিরবিচ্ছিন্ন খেলা। ২৫০ মাইল বেগে শরীরের এমাথা ওমাথা সঙ্কেত পৌছে দিতে প্রস্তুত থাকে এই অবিশ্বাস্য গতির স্নায়ুর নেটওয়ার্ক ।
বলাবাহুল্য মস্তিস্ক তথা স্নায়ুজালিকার জটিলতার প্রধান দুটো আদিম দায়িত্ব হলো আত্মরক্ষা এবং জীবন ধারণ। কিন্তু মানুষ এই মৌলিক চাহিদা অতিক্রম করে নিজেকে প্রশ্ন করে নানান প্রশ্ন। প্রশ্ন করা যেন মানুষের জন্মগত বৈশিষ্ট্য।
অবশ্য মগজের কম বেশী অস্তিত্ব পাওয়া যায় অন্যান্য অনেক প্রাণীতে। খাদ্যগ্রহণ এবং বংশবৃদ্ধিতে যখন অন্য সব প্রাণী তুষ্ট, তখন (সব না হলেও অন্তত: কিছু) হয়তো মানুষই প্রথম প্রাণী যারা জানতে চেয়েছে জগতের রহস্য? জানতে শেখার পর তার মৌলিক প্রশ্ন হলো, আমি কে? আমি কোথা থেকে এসেছি? আমি কোথায় যাব? ইত্যাদি? এ এক বড় বিরাট জিজ্ঞাসা কেন কোন কারণ ছাড়াই জ্ঞানার্জনের জন্য আগ্রহী হয় মানুষ? বৃষ্টি, বজ্রপাতের মধ্যে দাড়িয়ে প্রকৃতির বিদ্যুৎকে বন্দী করতে চায়? কেন রাতের পর রাত ঘষা লেন্সের দুরবীনে চেয়ে রয় আকাশের দিকে? কেন মৃত মানুষের দেহ কেটে দেখতো চায় দেহ রহস্য? কেন দিনের পর কেন সমাজ সংসার ধর্মের রীতিনীতি ভেঙে আবিষ্কারের নেশায় ছুটে চলে দেশ দেশান্তরে? সে যেন তার সীমাকে পেরিয়ে উঁকি দিতে চায় জটিলতম উত্তর জানতে।
প্রাচীন দার্শণিকরা এই নেশাটির এক সরল সংজ্ঞা দিয়েছিল, অন্ধকার ঘরে একটি অন্ধ মানুষ একটি কালো বেড়ালের সন্ধান পাওয়ার জন্য হাতড়িয়ে মরছে। কিন্তু কেন ধরে নিচ্ছে একটি বেড়াল আছে সেখানে? যদি অন্ধ হয় তবে এটি যে একটি ঘর তারই বা নিশ্চয়তা কী? বিড়ালই অন্ধ লোকের হাতের নাগালে থাকবে কেন? যদি হয় দেয়ালহীন অসীম মাঠ, তবে কী কোনদিন বেড়াল থাকলেও জানা যাবে?
সীমাবদ্ধ জ্ঞান সত্ত্বেও সমষ্টিগত জ্ঞান বংশ পরম্পরায় প্রবাহিত করার জন্য মানুষ জ্ঞানকে লিপিবদ্ধ করেছে। এই জ্ঞানের সমাহার কে সে নাম দিয়েছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞান যেন একটি সাময়িক বিশ্বাস। চিরন্তন কিছুর জন্য অপেক্ষা না করে, যে সব তত্ত্ব দিয়ে চলমান ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা যায় তাকেই স্হান দেওয়া হয় বিজ্ঞানে। ধরেই নেয়া হয় সব তত্ত্ব পরিবর্তনশীল। ভুল না ধরা পড়লে ভুলেই চলতে থাকতে হবে এই যেন জ্ঞানের একমাত্র উপায়। যখন ভুল ধরা পড়বে ছুড়ে ফেলে দেয়া হবে পুরনো তত্ত্ব এবং সাদরে গ্রহণ করা হবে নতুন তত্ত্ব।
জ্ঞানের অন্যতম সীমাবদ্ধতা হলো মানুষের ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতার বাইরে আমাদের চিন্তা করার উপায় নেই। এ বিষয়ে একটি মজার কাহিনী আছে। প্রথম যখন টেলিফোনের আবিস্কার হয় তখন অনেকে এর বিষয়ে নানান কথা তুলছিল। লোকজনকে বিশ্বাসই করানো যাচ্ছিল না যে যাদু টোনা ছাড়া অনেক মাইল দুরে শব্দ পৌছানো যাবে। তখন বলা হয়েছিল ধরুন, একট কুকুর পাওয়া গেছে যার লেজ বোষ্টনে আর মাথা নিউজার্সিতে । বোষ্টনে লেজে টান দিলে কুকুরটি নিউজার্সিতে ডেকে ওঠবে না? তখন সঙ্গে সঙ্গে সবাই সেটা সহজে বুঝতে পারলো। কিন্তু সমস্য বাধলো যখন ওয়্যারল্যাস ফোন এল। তখন আবারো বলা হল অবশেষে এমন একটি কুকুর পাওয়া গেছে যেটি অদৃশ্য।
অভিজ্ঞতালব্ধ সংস্কারের একটি উদাহরণ হলো শুরু এবং শেষ জানতে চাওয়া। আমরা জানি ১, ২, ৩, ৪, ৫.. এভাবে এক করে যোগ করতে থাকলে তা শেষ হয় না। আবার ০.১, ০.০১, ০.০১ এভাবে ছোট করতে থাকলে তারও শেষ নেই। তবুও প্রশ্ন জাগে সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে ছোট সংখ্যা কত। গণিত বলছে সংখ্যার কোন সীমা নেই। শেষ শুরু ভাবতে চাওয়ার মানে নেই। কিন্তু মন সায় দেয়না । তাই ইঞ্চি দিয়ে, মাইল দিয়ে, আলোক বর্ষ দিয়ে মেপে হলেও জগতের সীমা খুঁজতে থাকি, হয়তো অযথাই। (অবশ্য আফ্রিকার বুশম্যানরাই আরামে, তারা তিনটি সংখ্যা নিয়ে সন্তুষ্ট: ১,২ এবং অনেক। চিন্তা না করলে আসলেই আরাম।)।
"সৃষ্টি" শব্দটি আরেক অদ্ভুত টার্ম। জন্ম থেকেই দেখে আসছি আমরা বিদ্যমান এক বস্তুময় বিশ্বে। যদিও আমরা কাজের প্রয়োজনে গাছ কেটে আসবাব সৃষ্টি করেছি, খনির লোহা তুলে ইস্পাতের অস্ত্র সৃষ্টি করেছি। কিন্তু সবই এক বস্তু থেকে অন্য বস্তুতে রূপান্তর ছাড়া কিছু না। আমরা নতুন কাঠামোয় রুপান্তরের কৃতিত্ব দিয়েছি নিজেদের। প্রকৃতির মধ্যে যখনই কিছু দেখি আমরা যেন নিজের অজান্তেই খুঁজে ফিরি কেউ না কেউ সেই সৃষ্টির জন্য দায়ী ।
সৃজনশীলতা আমাদের নিত্যসঙ্গী, হয়তো সৃষ্টির পিছনে কাউকে না পেলে মন ধাক্কা খায়। তবে কি এই কর্তা খোঁজার চেষ্টাটিও নিছক সংস্কার? নাকি সত্যিই সৃষ্টিকর্তা ছাড়া জগতের রহস্যের ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব নয়? যদি সৃষ্টিকর্তা শ্বাশ্বত একটি প্রশ্ন হয় তা কি স্পিনোজার মডেলের মত নিরীহ হবে যে সমগ্র বিশ্বকে নিজের অংশ বলে মনে করে কিন্তু শাস্তি বা পুরষ্কারের জন্য নিয়োজিত করে না। নাকি সেই সৃষ্টিকর্তাই সঠিক যার অস্বীকারে কঠোর শাস্তির বিধান, যার দাসত্বে অসীম চিরস্হায়ী দেহসুখের নিশ্চয়তা? নানান ভাবে মানুষ স্হান-কাল-পাত্র ভেদে নিজেদের কে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিচ্ছি নানান কায়দায়।
আইনস্টাইন বলতেন, I am deeply religious non-believer
কেউ বলবে এখনও উত্তর খু্ঁজছি, কোনদিন অবশ্যই পাবো । কেউ গভীরে না গিয়ে গোজামিল কোন তত্ত্বে বিশ্বাস করতে থাকবে। কেউ বলবে উত্তর কোনদিনই জানা সম্ভব হবে না - কেননা সীমিত মগজ, সীমিত জ্ঞান, সীমিত জীবনকাল।
পুনশ্চ: শৈশব থেকে একটি সরল প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খেত, ধরা যাক সীমিত জ্ঞানের কারণে সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজতে ব্যর্থ হই, যদি মনে বিশ্বাস আনতে চেয়েও বিশ্বাস খুঁজে না পাই তবে এর জন্য কি ভয়াবহ দন্ড প্রাপ্য হওয়া উচিত? যদি হয় তবে এ যেন কুকুরের মগজে ক্যালকুলাস ঢুকবেনা জেনেও কুকুরকে গণিত অকৃতকার্য বলে উত্তম মধ্যমের সিদ্ধান্ত!
--------------------------------------------------------------------
কৃতজ্ঞতা: Click This Link
--------------------------------------------------------------------
গতপরশু নিরাপদ ঘোষিত হওয়ার পর এটি আমার প্রথম পোষ্ট। সামহোয়ারের নিকট বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ!