ছবি - ogrozatra.com
শিকাগো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় বৃহত্তম জনবহুল শহর আর সারা বিশ্বের মানুষের কাছে এই শহর পরিচিত পৃথিবীর কসাইখানা নামে। যদিও কসাইখানা বলতে পশু জবেহ করার স্থানকে বোঝায় এবং শিকাগোর ইউনিয়ন স্টকইয়ার্ডস এক শতাব্দীর ও বেশী সময় ধরে পুরো পৃথিবীতে বড় পশু জবেহখানা-কসাইখানা হিসেবে পরিচিত ছিল তবে এই শহরটির কসাইখানা উপাধি অর্জনের পিছনে রয়েছে এক করুণ ইতিহাস।
১৮৭১ সালের শিকাগো শহরের অগ্নিকান্ডের কাল্পনিক ছবি ।
ছবি - roar.media
শিকাগোর এই কসাইখানা উপাধির কারণ -
" গ্রেট শিকাগো ফায়ার " কথাটির সাথে আমরা অনেকেই পরিচিত। এখন থেকে প্রায় ১৫০ বছর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে ঘটেছিল এক ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা। এই আগুনের সূত্রপাত ঘটে ১৮৭১ সালের ৮ অক্টোবর, রবিবার রাতে এবং ১০ অক্টোবরের, মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত সেই আগুন নেভানো সম্ভব হয় নি। সেই বিধ্বংসী অগ্নিকান্ডে গোটা শিকাগো শহর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
১৮৭১ সালে জনপ্রিয় হারপার ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে শিকাগো শহরের অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হওয়া ও’ ল্যারি গোয়াল ঘরের কাল্পনিক ছবি
ছবি - wikimedia commons
আগুন লাগার কারন কি ছিল -
এই আগুন লাগার কারণ নিয়ে নানা কিংবদন্তী প্রচলিত রয়েছে। শহরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবার ক্যাথরিন ও’ ল্যারির গোয়াল ঘর থেকেই এই অগ্নিকান্ডের সূচনা বলে ধারণা করা হয়। বলা হয়ে থাকে, ৮ অক্টোবর রাতে ও’ ল্যারি তার গোয়াল ঘরে যান গরুর দুধ সংগ্রহের জন্য। এসময় গোয়ালের একটি গরু লাথি মেরে ও’ ল্যারির সাথে থাকা তেলের প্রদীপটি উল্টে দেয় এবং এ থেকেই অগ্নিকান্ডের প্রাথমিক সূত্রপাত বলে অনুমান করা হয়। আবার কেউ কেউ বলেন , প্রদীপে উল্টে যাওয়ার দুর্ঘটনাটা আসলে ঘটেছিল এক জুয়ার আড্ডায়।
আবার কারো কারো মতে, আকাশ থেকে উড়ে আসা জ্বলন্ত উল্কাপিন্ডের কারণে এই আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছিল যদিও পরবর্তীতে বিশেষজ্ঞরা বিষয়টিকে উড়িয়ে দেন। তাদের মতে, জ্বলন্ত উল্কাপিন্ড পৃথিবীতে পড়ার সাথে সাথে জলীয় বাষ্প আর মাটির সংস্পর্শে তার তাপমাত্রা কমতে থাকে। তাই উল্কাপিন্ডের কারণে শিকাগো শহরে এত বড় অগ্নিকান্ড ঘটা সম্ভব নয়। আজ পর্যন্ত আগুন আগুন লাগবার প্রকৃত কারণ অনেক অনুসন্ধান করেও জানা যায়নি। তবে কারণ যা-ই হোক না কেন, ভয়াবহ সেই অগ্নিকান্ডে শহরের কম-বেশি ৯ বর্গ কিলোমিটার এলাকা পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
অগ্নিকান্ডের পর ধ্বংসপ্রাপ্ত শিকাগো শহরের চিত্র
ছবি - architecture.org
অগ্নিকান্ড দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার কারণ
এদিকে তখন শিকাগোতে বেশ গরমও পড়েছিল। তাপমাত্রা বাড়ছিল হু হু করে। বৃষ্টিপাতের দেখা নেই বললেই চলে। জুলাইয়ের শুরু থেকে অক্টোবরে আগুন লাগার সময় পর্যন্ত এই অঞ্চলে খুব কম বৃষ্টিপাত হয়েছিল। স্থানীয় আবহাওয়া দপ্তরের পুরনো রেকর্ড থেকে জানা যায়, এই সময়টায় মাত্র ৩ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হয়েছিল। বৃষ্টিপাতের অভাবে চারপাশের পরিবেশ শুষ্ক ও রুক্ষ হয়ে উঠেছিল। ফলে শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল।
উনবিংশ শতকে শিকাগো শহরে ছিল সবুজের সমারোহ। শহর জুড়ে ছিল লাখ লাখ বৃক্ষ ও বন-বনানী। মনে হতো, সুবিশাল বনের মধ্যে মানুষজন তার স্বপ্নের বাড়ি বানিয়ে স্বপ্নপুরীতে বসবাস করছে। শুষ্ক আবহাওয়া আর বৃষ্টিপাতের অভাবে গাছগুলো শুষ্ক ও বিবর্ণ হতে থাকে। ফলে আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল নিমিষের মধ্যে। তার উপর সে সময় শহরের বেশিরভাগ বাড়িই ছিল কাঠের তৈরি।
শহরের এক বিশাল অংশে বাস করতো বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা দরিদ্র অধিবাসীরা। তাদের অধিকাংশই একসাথে কম টাকায় জরাজীর্ণভাবে কাঠের বাড়ি তৈরি করে তাতে বসবাস করতো। এসব বাড়ির সুরক্ষা ব্যবস্থা ছিল না বললেই চলে। অগ্নিকাণ্ডের পরের মাসে সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত সে সময়ের শিকাগোর জনপ্রিয় পত্রিকা শিকাগো ট্রিবিউনে বিষয়টি বিস্তারিতভাবে উঠে আসে।
শিকাগো শহরের ধ্বংসাবশেষের চিত্র
ছবি - architecture.org
কি পরিমাণ ক্ষয়-ক্ষতি হয় এই এই শিকাগো ফায়ারে ?
ভয়াবহ এ অগ্নিকান্ডে ভেঙ্গে পড়ে সকল ধরনের অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা, ক্ষতিগ্রস্ত হয় পুরো শহর। শিকাগো শহর ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। কালো ধোঁয়া আর ছাইয়ে চারদিক ছেয়ে যায়। কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছিল তা নিরূপণ করাও বেশ দুরুহ হয়ে পড়ে। এই ঘটনার কয়েক মাস পর শিকাগোর স্থানীয় প্রশাসন থেকে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় যেখানে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দেখানো হয় আনুমানিক ১৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
তখনকার শিকাগো শহর
ছবি - ogrozatra.com
শহরের প্রায় ৯ বর্গ কিলোমিটার এলাকা পুড়ে ছাই হয়ে যায় এই বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডে। এ ঘটনায় প্রায় ৩০০ এর বেশি মানুষ জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায়। যদিও ১২০ টির বেশি লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ১,০০০ এর বেশি বসতবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, হোটেল, সরকারি-বেসরকারি অফিস সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। গৃহহীন হয় শহরের প্রায় ১ লাখ মানুষ। সেই সাথে পুড়ে ছাই হয় যায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র। সেসব গুরুত্বপূর্ণ নথির মধ্যে ছিল তৎকালীন মার্কিন প্রেসেডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ চিঠি এবং শিকাগোর জনপ্রিয় আলোকচিত্রী আলেকজান্ডার হেসলারের তোলা লিঙ্কনের বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য ছবির নেগেটিভ, যা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়।
ভয়াবহ এ অগ্নিকান্ডে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ২২২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ( মুদ্রাস্ফিতি হিসেবে যা এখন ৪.৫ বিলিয়ন ডলারের বেশী )। পরবর্তীতে, ১৯১০ সালের ২২-২৩ ডিসেম্বর আবার এই শহরের ইউনিয়ন স্টকইয়ার্ডস এ ঘটে যায় আরেকটি অগ্নিকান্ড। এ অগ্নিকান্ডে ২১ জন অগ্নি নির্বাপক কর্মী প্রাণ হারায়।
১৯৩৪ সালের ১৯ মে, শিকাগোর ইউনিয়ন স্টকইয়ার্ডস এ আরো একটি অগ্নিকান্ডে ১ জন অগ্নি নির্বাপক কর্মীর প্রাণহানি, ৫০ জন আহত, ৪০০-১০০০ গবাদি পশুর মৃত্যু সহ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার যা রীতিমত এই শহরকে
" কসাইখানা" তে রূপান্তরিত করেছিল।
বর্তমানের শিকাগো শহর
ছবি - nationalgeographic.org
শিকাগো শহরের পুনঃনির্মাণ
উনিশ শতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় বিপর্যয়গুলোর একটি ছিল দ্য শিকাগো ফায়ার। ভয়াবহ এই অগ্নিকান্ডের পর শিকাগো শহরের প্রশাসনিক এবং আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। মার্কিন সরকার তখন পুরো শহরের দায়িত্ব সামরিক বাহিনীর ওপর ন্যস্ত করে। শহরের আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সামরিক আইন জারি করা হয়।তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ইউলিসিস প্রাথমিকভাবে তার ব্যক্তিগত তহবিল থেকে ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য সাহায্য প্রদানের ব্যবস্থা করেন। শিকাগোর আশেপাশের অঙ্গরাজ্যগুলো থেকে সাহায্য পাঠানোর কাজও শুরু হয়। এরপর শহর পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়। বাড়ি নির্মাণে অগ্নি নির্বাপনের শর্তগুলো আরো কঠোর করা হয় এবং শহরের জনগণ তা যথাযথভাবে মেনে চলছে কি না তার কঠোর তদারকির ব্যবস্থা করা হয়।
শিকাগোর ভয়াবহ অগ্নিকান্ড সত্ত্বেও শহরের মূল অবকাঠামো, পরিবহন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় অক্ষত রয়ে যায় বলে নগর পুনর্গঠনের কাজ দ্রুত শুরু করা সহজ হয়। শুরু হয়ে যায় ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ। স্থাপত্যবিদদের সহায়তায় আধুনিক নগরায়ণের সব ধরনের সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়। তৈরি হতে থাকে বড় বড় চোখ ধাঁধানো ইমারত। কয়েক বছরের অক্লান্ত চেষ্টায় বর্তমানে শিকাগো হয়ে ওঠে এক আধুনিক শহর।
বর্তমানের শিকাগো শহর
ছবি - dreamstime.com
অবাক করা বিষয় হচ্ছে, এই গ্রেট ফায়ারের কারণ হিসেবে বলা হয় ও’লেরি নামক এক গরিব কৃষক মহিলার গরুর দুধ দোয়ানোর সময় গরুর লাথিতে হারিকেন ভেঙ্গে খড়ের গাদায় আগুন ধরে যাওয়াকে। তবে, সেই সময়ের আমেরিকার জনতার আইরিশ বিরোধী মনভাবের কারনেও এই ঘটনা রটতে পারে বলে অনেক মনে করেন। ও’লেরি পরিবারের সদস্যদের মতে তারা আগুন লাগার সময় সবাই ঘুমন্ত ছিলেন ।
১৮৯০ সালে শিকাগো শহর হয়ে ওঠে লক্ষ লক্ষ মানুষের অর্থনৈতিক কেন্দ্রস্থল। আর শহরটি পরিবহন সেক্টরের মূল হাব হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকে। তার সাথে শহরটি পর্যটক আকর্ষণের মূল কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। পরবর্তীকালে এখানে একটি ফায়ার ডিপার্টমেন্ট ট্রেনিং একাডেমি গড়ে তোলা হয়। কাকতালীয়ভাবে তা ও’ ল্যারির বসতবাড়ির পাশেই নির্মাণ করা হয়, যে স্থান থেকে গ্রেট শিকাগো ফায়ার শুরু হয়েছিল বলে অনেক শিকাগোবাসী আজও মনে করে থাকেন।
মূলত এই শহরে এত মানুষ ও গবাদি পশুর প্রাণহানি ঘটে যাওয়ার কারণেই শিকাগোকে " পৃথিবীর কসাইখানা " বলা হয়।
তথ্যসূত্র - বিবিসি বাংলা (২০শে জানুয়ারী ২০১৫), প্রথম আলো ( ২৮ নভেম্বর ২০১৯)
*Encyclopædia Britannica,উইকিপিডিয়া,"Chicago Fire of 1871." Gale Encyclopedia of U.S. Economic History, edited by Thomas Carson and Mary Bonk, vol. 1, Gale, 1999, pp. 158-160. Gale Virtual Reference Library.
==============================================================
পূর্ববর্তী পোস্ট -
" কৌতুহল - ৪ " - Click This Link
মিনিকেট নামে কোন ধান নেই ॥ খাদ্যমন্ত্রী ॥ তবে মিনিকেটের নামে আমরা কি খাচছি এবং বাজারে মিনিকেট চাল নামে আসলে কি বিক্রয় হচছে ?
"কৌতুহল - ২ / ২ " - " ডারউইনের বিবর্তনবাদ " - মানুষ কি এপ-প্রাইমেট (বানর) থেকে এসেছে বা পৃথিবীতে মানুষের শুরু কিভাবে হয়েছে? এ ব্যাপারে ধর্ম ও বিজ্ঞানেরই বা কি অভিমত ?
Click This Link
"কৌতুহল - ২ / ১ " - " ডারউইনের বিবর্তনবাদ " - মানুষ কি এপ-প্রাইমেট (বানর) থেকে এসেছে বা পৃথিবীতে মানুষের শুরু কিভাবে হয়েছে? এ ব্যাপারে ধর্ম ও বিজ্ঞানেরই বা কি অভিমত ?
Click This Link
"কৌতুহল -১"- আমেরিকার প্রেসিডেন্টরা ২০ জানুয়ারি কেন শপথ নেন? Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মার্চ, ২০২২ দুপুর ২:২৭