ছবি - istockphoto.com
আত্মসম্মান-নীতি-নৈতিকতার সংজ্ঞা ও বিস্তৃতি-পরিধি শাশ্বত এবং চিরন্তন - বহুকাল আগে যা ছিল, এখনও তা-ই আছে তবে বদলে গেছে আমাদের জীবনে এদের প্রভাব । মানুষের আত্মসম্মান হলো নিজের বিবেচনাবোধ বা প্রশংসা যা তার নিজের। এদিকে সমাজে সবার জন্য প্রচলিত, গ্রহণযোগ্য এবং অবশ্যই পালনীয় বিষয়গুলো বা নির্দেশনাগুলোই হলো নীতি। আর নৈতিকতা মানুষের আচরণ বা চরিত্রকে নির্ধারণ করে। মানুষের চারিত্রিক আদর্শ বা নৈতিক গুণাবলির সমষ্ঠি হলো নৈতিকতা। নীতি হলো আপনি-আমি নিজের জন্য যা অর্জন করছি তা সঠিক ও ভাল এবং এর সাথে জড়িত সমস্ত লোকের পক্ষে তা উপকৃত হয় । আবার নৈতিকতা যা আমাকে-আপনাকে শেখানো হয়েছে এবং তা (নৈতিকতা) এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে চলে আসছে। একই সমাজে একজনের নৈতিকতা অন্যের থেকে পৃথক হতে পারে তবে নীতি সবার ক্ষেত্রে একই থাকে । মানুষের জীবনের আত্মসম্মান-নীতি-নৈতিকতা - নৈতিক মূল্যবোধ ও সুশৃঙ্খল জীবন গড়ার ক্ষেত্রে পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ দু জায়গায়ই মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার ভিত্তি রচিত হয়। যা পরবর্তীতে একজন মানুষকে আত্মসম্মানের সাথে নীতি-নৈতিকতা অনুসরন করে ভাল মানুষ হিসাবে জীবন-যাপন করতে সাহায্য করে।
ছবি - nojoto.com
আত্মসম্মান কি -
আত্মসম্মান হলো নিজের বিবেচনাবোধ বা প্রশংসা যা তার নিজের। বিশদভাবে বলতে গেলে, একজন মানুষের নিজের প্রতি নিজের মর্যাদাবোধ থাকা, নিজেকে ভালবাসা, নিজের যতটুকু ক্ষমতা তার প্রতি আস্থা রাখা এবং একই সাথে নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে ধারনা থাকা ও নিজের সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়ে নিজেকে সম্মান করার অর্থ হল আত্মসম্মান। আত্মসম্মানযুক্ত ব্যক্তি হওয়া সহজ নয়, কারণ মানুষের জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি দ্বারা পরিপূর্ণ যা কিছুটা হলেও আমাদের আত্মবিশ্বাসকে হ্রাস করে দেয়। আত্ম-সম্মান কোনও সহজাত ক্ষমতা নয়,এ এমন একটি জিনিস যা শৈশব থেকেই নানা অক্ষমতার মাঝ থেকেই ধৈর্য্যের সাধনার মাধ্যমে অর্জন করতে হয়।
আত্মসম্মান ও বিবেক একটি অপরটির পরিপূরক। আত্মসম্মান বলতে সাধারণ অর্থে আমরা বুঝি নিজের মর্যাদা বা সম্মান বিষয়ে সচেতনতা। একজন আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষে কখনো এমন কোনো কাজ করা সম্ভব নয় যেটি তার সম্মান বা মর্যাদার জন্য হানিকর। আত্মসম্মানবোধ ব্যক্তিরাই বিবেকবান হয়ে থাকেন এবং তার পক্ষে কখনো অন্যায় ও অসত্যের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ সম্ভব হয়না। তিনি বিবেকে তাড়িত হয়ে সর্বদা ন্যায় ও সত্যের পক্ষে থাকেন।
আপনার-আমার নিজের আত্মসম্মানবোধ আছে কি না তা আপনি উপলব্ধি করা গুরুত্বপূর্ণ। যদি আপনার-আমার কাছে এটি না থাকে তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিবেক এর সাহায্য নেওয়া উচিত। কারন,কম আত্ম-সম্মান হল হতাশা যা জীবনে যে কোন গুরুতর পরিণতি ঘটতে পারে। নিজেকে একটি পরিপূর্ণ সফল জীবন হিসাবে বাঁচতে সক্ষম হওয়ার জন্য ভাল আত্ম-সম্মান বোধ থাকা জরুরী। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আমার নিজের জীবনের সর্বাধিক মূল্যবান ব্যক্তি আমি এবং আমি-আপনি যতটা কল্পনা করতে পারি তার চেয়ে বেশি মূল্যবান। আমাদের জীবনে আমরা কতটা মূল্যবান তা অনুধাবন করতে সংকোচ বোধ করা উচিত নয় এবং আমাদের জীবনকে আমাদের পজেটিভলি গ্রহণ করা উচিত। আমি-আপনি কীভাবে বা আমার-আপনার কী কী গুণাবলীর বিষয়টি বিবেচনা করব, নিজের সফলতার জন্য এগুলিই আমাকে-আপনাকে এই সমাজে-দেশে-বিশ্বে অনন্য করে তুলবে।
ছবি - nayadiganta.com
নীতি - নৈতিকতা কি -
সমাজে সবার জন্য প্রচলিত, সবার নিকট গ্রহণযোগ্য এবং অবশ্যই পালনীয় বিষয়গুলো বা নির্দেশনাগুলোই হলো নীতি।
আর নৈতিকতা ? নৈতিকতা মানুষের আচরণ বা চরিত্রকে নির্ধারণ করে। মানুষের চারিত্রিক আদর্শ বা নৈতিক গুণাবলিই হলো নৈতিকতা। অথবা আমরা বলতে পারি জীবনে কিছু নীতি রয়েছে যা পালন করার মাধ্যমে তার নৈতিকতা বা চরিত্র বিকশিত হয়। এক কথায়, মানুষের সুন্দর ও সুষ্ঠু প্রকাশ বা বিকাশটাকেই তার নৈতিকতার বিকাশ বলা যেতে পারে। আমরা প্রায়ই শুনে থাকি মানুষ তাদের নৈতিকতা হারিয়ে ফেলছে। আত্মসম্মানকে নিচে নামিয়ে বা আত্মমর্যাদার কথা বিবেচনা না করে এবং অন্যকে ছোট বা অসম্মান করে ভুল বা যে কোন অসামাজিক কাজকেই অনৈতিক বলা যায়। সততার সঙ্গে যেকোনো কর্ম সম্পাদনই নৈতিক কাজ। আর নীতি হলো যে কাজগুলো গ্রহণযোগ্য, সাবলীল এবং প্রবিধানযোগ্য।
আমাদের সমাজের প্রতিটি মানুষের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা রয়েছে। অর্থাৎ একের প্রতি অন্যের সম্মান প্রদর্শনের দায়বদ্ধতা, সহানুভূতির, সহযোগিতা, সহমর্মিতা এসব কিছুই নৈতিক আচরণের বা নৈতিকতার। একজন মানুষের চুরি বা অসামাজিক কাজ করাটা যেমন অনৈতিক তেমনি কাউকে অসম্মান করাটাও অনৈতিক কাজ। যাকে আমরা মূল্যবোধ বলে থাকি। বর্তমানে পৃথিবীজুড়ে আজ যে অস্থিরতা, অশান্তি, সংঘর্ষ, অরাজকতা সবকিছুই নৈতিক এবং আত্মিক প্রশিক্ষণহীনতার কারণেই ঘটছে। তাই সবার আগে প্রয়োজন নিজের মানষিক বিকাশ। যাকে আমরা বলতে পারি "আত্মশুদ্ধি" বা মূল্যবোধ। আর এই নীতি, নৈতিকতা বা মূল্যবোধ এসব কিছুই একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের মূল চালিকা শক্তি। এসব কিছুর অভাব রাষ্ট্রের সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক মানদণ্ডকে দূর্বল করে দেয়।
সমাজে চলার পথে তিনিই আদর্শিকভাবে নীতিবান হয়ে থাকেন যার আত্মসম্মানবোধ প্রবল । নীতির বিপরীত শব্দ দুর্নীতি। দুর্নীতি শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয় এবং নীতি ও নৈতিকতা বিরোধী যেকোনো কাজই দুর্নীতি। সাধারণ্যে একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, অবৈধ পন্থায় অর্থ উপার্জন দুর্নীতি এবং এ ধারণাটি যারা পোষণ করেন তাদের অভিমত- নগদ অর্থ ব্যতীত কোনো দ্রব্যসামগ্রীর মাধ্যমে যদি কোনো কার্যসিদ্ধির উদ্দেশ্যে কোনো ব্যক্তিকে কিছু প্রদান করা হয় সেটি দুর্নীতি নয়। কিন্তু এটি একেবারেই ভ্রান্ত ধারণা। একজন ব্যক্তির পক্ষে বৈধ আয়বহির্ভূত নগদ বা দ্রব্যসামগ্রীর মাধ্যমে যেকোনো ধরনের সম্পদের আহরণ দুর্নীতির অন্তর্ভুক্ত এবং এরূপ দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি দেশের প্রচলিত আইনের বিধিবিধান অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধের দায়ে বিচারের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত হয়ে থাকেন।
দুর্নীতি শব্দটি ঘুষের সমরূপ। ঘুষের মাধ্যমে যে নগদ অর্থ বা দ্রব্যসামগ্রীর আদান-প্রদান ঘটে তাতে ঘুষ গ্রহীতা ও দাতা উভয়ে লাভবান হয়। ঘুষ গ্রহীতার ক্ষেত্রে এটি অন্যায় বা অবৈধ প্রাপ্তি অপর দিকে ঘুষদাতা অবৈধ পন্থায় স্বীয় স্বার্থ হাসিলের জন্য কার্য সম্পাদনকারী ব্যক্তিকে নগদ অর্থ বা সামগ্রী দ্বারা অপরের বঞ্চনায় বশীভূত করে থাকে। এখানে অপর বলতে একজন ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টি বা দেশের সামগ্রিক জনগোষ্ঠীকে বোঝায়।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় - একজন ব্যক্তি নির্ধারিত হারের চেয়ে কম শুল্ক দিয়ে কোনো দ্রব্য ছাড় করালে তাতে রাষ্ট্র বৈধ রাজস্বপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়। আর এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের যে ক্ষতি হয় তা দেশের সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর ক্ষতি হিসেবে বিবেচিত। যে কোন চাকরির ক্ষেত্রে লিখিত ও মৌখিক উভয় পরীক্ষার মাধ্যমে প্রার্থীদের যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়, কিন্তু এ ধরনের চাকরিতে যদি অবৈধ অর্থের লেনদেনের মাধ্যমে চাকরি দেয়া হয় সে ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নিয়োগ প্রক্রিয়াটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। অনুরূপ যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে যদি স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হয় সে ক্ষেত্রে মেধাবী ও যোগ্যদের জন্য উচ্চতর শিক্ষার দ্বার উন্মোচিত হয়। আর ভর্তি পরীক্ষায় যেকোনো ধরনের অসাধুতা মেধাবী ও যোগ্যদের জন্য গভীর মর্মবেদনা ও পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
কেন আত্মসম্মান-নীতি-নৈতিকতা হারিয়ে যাচছে সমাজ থেকে ?
যেকোনো জাতির মেরুদণ্ড হলো শিক্ষা। একজন ব্যক্তি সুশিক্ষায় শিক্ষিত হলে তার পক্ষে আত্মসম্মান নষ্ঠ করে এমন কাজ কিংবা নীতিবিরোধী বা অনৈতিক কাজ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায় তবে পৃথিবীর সব দেশ ও সমাজে কমবেশি এর ব্যতিক্রম রয়েছে। একজন ছাত্রছাত্রীকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে দেশের আদর্শ নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে মূল দায়িত্বটি প্রাথমিক-মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যারা শিক্ষকতার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন তারা পালন করে থাকেন। বর্তমানে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় অবধি যে প্রক্রিয়ায় শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়া হয় তাতে মেধা ও যোগ্যতার চেয়ে প্রার্থীর রাজনৈতিকসংশ্লিষ্টতা অধিক বিবেচ্য হওয়ায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকৃত মেধাবী ও যোগ্যরা শিক্ষকতার চাকরি লাভে বঞ্চিত হচ্ছেন। আর এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে যাদের প্রবেশ ঘটছে তারা কতটুকু আত্মসম্মান ও বিবেকবোধসম্পন্ন তা অতি সহজেই অনুমেয়।
অর্থের টানা পোড়ন তথা দারিদ্রতা আমাদের দেশে যুগ যুগ ধরেই ছিল, তবুও সে সময়ও মানুষ আত্মসম্মান-নীতি-নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ হারায়নি। অভাবের মধ্যেও তাদের নীতি-নৈতিকতা অটুট ছিল। সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে আমরা এখন এমন এক সমাজে বসবাস করছি, যেখানে মান-সম্মান, মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতাকে কেউ আর তোয়াক্কা করছে না। অনেকের মধ্যে এমন একটা প্রবণতা বিরাজমান, অর্থ-বিত্তের মালিক হতে পারলে মান-সম্মান কেনা যাবে। নিজে বাঁচলে বাপের নাম - এমন প্রবণতা এখন সবার মাঝে। মানবিক গুণাবলীর ধার ধারছে না এমন লোকের সংখ্যা বাড়ছে সমাজে- রাষ্ট্রে। অন্যদিকে, সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্থ ও চিহ্নিত দুষ্টু শ্রেণীর লোক সমাজের সব কিছুর নিয়ন্তা হয়ে বসে আছে। তাদের হাতে অর্থ আছে, আছে পেশীশক্তিও । তারা মনে করে, এই দুই শক্তি থাকলে মান-সম্মান এমনিতেই তাদের পায়ে লুটিয়ে পড়বে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, এখন সাধারন মানুষ সম্মিলিতভাবেই এদের অবস্থানকে শক্ত করার সুযোগ করে দিচ্ছে। সমাজে যাদের মধ্যে এখনও একটু-আধটু ভালো গুণ রয়েছে, তারা কোনোভাবেই এক হতে পারছেনা। একেক জন যেন আলাদা হয়ে বিচ্ছিন্ন দ্বীপবাসী হয়ে বসবাস করছে। কে মরল, কে মারল, এ নিয়ে এখন আর কেউ টুঁ শব্দ করেনা। অন্যায়ের কিভাবে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করতে হয়, তা জেনেও কেউ আর উদ্যোগী হচছেনা। সমাজের সাধারন মানুষের দুর্বলতার এ সুযোগটাই নিচ্ছে সমাজের মাথা হয়ে থাকা দুষ্টচক্র।
ছবি - jugantor.com
সমাজে আত্মসম্মানবোধ-নীতি- নৈতিকতার অভাবের প্রভাব -
আমাদের আত্মসম্মানবোধ-নীতি- নৈতিকতার অবক্ষয়ের প্রভাব এখন সুদূরপ্রসারি হয়ে উঠেছে সমাজের প্রতিটা ক্ষেত্রে। এর প্রতিক্রিয়া পড়ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর। এই যে শহর ও গ্রামে, পাড়া-মহল্লায় কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে, এর মূল কারণই হচ্ছে, অভিভাবক শ্রেণীর উদাসীনতা ও সমাজে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়ার মানষিকতা। তা নাহলে, একটি বাড়ন্ত কিশোর যার পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা, তার মধ্যে কেন খুন, ধর্ষণ, চুরি, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ প্রবণতা দেখা দেবে? এর জন্য ঐ কিশোর যতটা না দায়ী তার চেয়ে বেশি দায়ী আমাদের পরিবার ও সমাজের অভিভাবক শ্রেণী।
পরিবার ও সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রাতারাতি ঘটে না,দশকের পর দশক ধরে এর পরিবর্তন হয়। মানুষের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে,আধুনিক সভ্যতার দিকে ধাবিত হওয়া। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেকের মধ্যেই এখন ন্যায়-অন্যায় ভূলে ভাল থাকার,স্বাবলম্বী ও স্বনির্ভর হওয়ার প্রবল ইচ্ছা শক্তি জেগেছে। তাদের ইচ্ছা শক্তির গতি এতটাই বেড়েছে যে, পারিবারিক ও সামাজিক রীতি-নীতি, মূল্যবোধ এমনকি ধর্মীয় অনুশাসন তাদের এই গতির কাছে হার মানছে, পেছনে পড়ে যাচ্ছে। এসব দিকে কেউ তাকানোরও প্রয়োজন বোধ করছে না। এর ফলে আমাদের দেশে আবহমান কাল ধরে চলে আসা রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থা এবং সামাজিক যে বন্ধন, তা ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে পড়ছে। শিক্ষিত ও সচেতন মানুষের এই উদাসীনতার সুযোগ নিচ্ছে সমাজের সবচেয়ে সংখ্যালঘু অথচ ভয়ংকর দুর্বৃত্ত শ্রেণী। তারা প্রাধান্য বিস্তার করছে সামজের সর্বত্র এবং একের পর এক অমানবিক ঘটনা ও দুর্নীতির মহোৎসবে জড়িয়ে পড়ছে অবলীলায়।
আমাদের দেশ ও সমাজ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার সমন্বয়ে গঠিত। আমাদের দেশ ও সমাজের নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে তাদের অনেকে অন্যায়ের দিকে ধাবিত হলেও এখন আত্মসম্মান ও বিবেক বাধা হিসেবে দাঁড়ায় না। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা অনুসৃত হয় এমন সব দেশে সরকার পরিবর্তনের একমাত্র পথ হলো অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। পাকিস্তানের শাসনাধীন থাকাবস্থায় অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরে বিঘ্ন ঘটার কারণেই আমরা-দেশের অপামর জনসাধারন আন্দোলনে নামে যার অনিবার্য পরিণতি আজকের বাংলাদেশ । যেকোনো দেশে রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে আত্মসম্মান ও বিবেকবোধ যত বেশি প্রবল হবে সে দেশে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশায় তত বেশি সৎ, যোগ্য ও ন্যায়নিষ্ঠ মানুষের প্রবেশ ঘটবে। একটি দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে আত্মসম্মান ও বিবেকবোধসম্পন্ন হতে হবে এবং দেশের জনগণের মধ্যেও সে উপলব্ধি জাগ্রত করতে হবে। এর সাথে সাথে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের ওপর রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে - এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে দেশের জনগণকেই। বর্তমানে আমরা আমাদের নিকট অতীতের দিকে তাকালে সমাজে-দেশে আত্মসম্মান ও বিবেকবোধের ক্রম হ্রাসের যে চিত্রটি দেখতে পাই তাতে সুদূর অতীতের আত্মসম্মান ও বিবেকবোধের পুনরার্বিভাব ঘটবে এমন আশাবাদী হওয়া এখন সুদূর পরাহত বিষয়।
ছবি - istockphoto.com
সর্বজনীনভাবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কিছু নৈতিক আচরণ রয়েছে। সেটি হলো তার বিবেক-আচরণ-ভুল ও সঠিক নির্ধারণ করার মেধা। প্রকৃতপক্ষে যে যাই বলুক, আমরা যেন মানবিক মূল্যবোধ থেকে সরে না যাই। অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন নৈতিকতার একটি মূলনীতি। আমরা যদি একের প্রতি অপরের সম্মানটুকু রেখে চলি, তাহলে আমার ধারণা এতে নীতি ও নৈতিকতা দুটিই পারস্পরিকভাবে পাশাপাশি বজায় রেখে চলা সম্ভব। জীবনকে সুশৃঙ্খল ও সঠিকপথে পরিচালিত করার লক্ষ্যেই মানুষ মানবিক গুণাবলী ধারণ করেছে। তা নাহলে, মানুষ সেই আদিম যুগেই পড়ে থাকত। আজকের সভ্যযুগে বসবাস করত না।এখনও মানুষের মধ্যে মানবিকতা রয়েছে, প্রয়োজন শুধু তা জাগিয়ে তোলা। পরিবারের অভিভাবক শ্রেণীকে সন্তানদের নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ সৃষ্টিতে কাজ করতে হবে। সন্তানরা কিভাবে সময় কাটাচ্ছে, কি করছে, সেদিকে গভীর নজর রাখতে হবে। আর রাষ্ট্রের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশায় বেশী বেশি সৎ, যোগ্য ও ন্যায়নিষ্ঠ মানুষের প্রবেশ ঘটাতে হবে এবং তাদের উৎসাহিত করতে হবে , যার দায়িত্ব সরকারের ও দায়িত্বশীলদের। সবশেষে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কোনোভাবেই বিপথে যেতে দেয়া যাবে না এবং তাদের রক্ষায় আমাদের সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে চেষ্টা করতে হবে। আর না হলে এতে শুধু ব্যক্তি-পরিবারই ধ্বংস হবে না, সমাজ ও রাষ্ট্রও ক্ষতিগ্রস্ত হবে দীর্ঘমেয়াদে।
=========================================================
পূর্ববর্তী পোস্ট -
মানব জীবন - ১৮ - " ধর্মহীনতা " Click This Link
মানব জীবন - ১৭ - " ধৈর্য " Click This Link
মানব জীবন - ১৬ -" সততা " Click This Link
মানব জীবন - ১৫ - " লজ্জা " Click This Link
মানব জীবন - ১৪ - "পর্দা " Click This Link
মানব জীবন - ১৩ - "ধর্ম " Click This Link
মানব জীবন - ১২ " সহ শিক্ষা " Click This Link
মানব জীবন - ১১ " শিক্ষা " - Click This Link
মানব জীবন - ১০ "পরিবার " - Click This Link
মানব জীবন - ৯ "বিবাহের পরে" - Click This Link
মানব জীবন - ৮ " মানব জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য " - Click This Link
মানব জীবন - ৭ " তালাক " - Click This Link
মানব জীবন - ৬ "দেনমোহর - স্ত্রীর হক" - Click This Link
মানব জীবন - ৫ "বিবাহ" - Click This Link
মানব জীবন - ৪ " মাতৃত্ব " - Click This Link
মানব জীবন - ৩ Click This Link
"নারী স্বাধীনতা বনাম নারী(জরায়ু)'র পবিত্রতা "
মানব জীবন - ২ " মাতৃগর্ভ (জরায়ু)"- Click This Link
মানব জীবন - ১ "মানুষের জন্ম প্রক্রিয়ার ইতিকথা"- Click This Link