ছবি - m.somewhereinblog.net
বিয়ে হল একটি সামাজিক বন্ধন যাতে দুটি মানুষ পরস্পর পরস্পরের প্রতি দায়বদ্ধ থাকে।বিভিন্ন দেশে সংস্কৃতিভেদে বিবাহের সংজ্ঞার তারতম্য থাকলেও সাধারণ ভাবে বিবাহ এমন একটি রীতি বা প্রথা যার মাধ্যমে দু'জন মানুষের মধ্যে সম্পর্ক ও সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করে।
সৃষ্টির শুরুতে মানুষ ছিল প্রাণিজগতের আর দশটা প্রাণীর মত সাধারণ একটি প্রাণী যারা বনে-জংগলে ,গুহা মানব হিসাবে বিচরন করত। পরবর্তীতে সভ্যতার বিবর্তন এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান উন্নয়নের মাধ্যমে মানুষ হয়ে উঠেছে সমস্ত পৃথিবীর শাসক ।আজ মানুষ নিজেই অসীম ক্ষমতাশালী।আজ মানুষ শুধু কেবল নতুন নতুন অনেক কিছু সৃষ্টি করতেই চাইছে না বরং পৃথিবীর সকল ক্ষমতাগুলোকেও নিজের আয়ত্তে আনবার জন্য সে বদ্ধপরিকর এবং সমাজে প্রচলিত অনেক রীতি-নীতি-মূল্যবোধ ধ্বংসও করছে বা করার চেষ্টা করছে।আর এত সব কিছুর মাঝেও সেই আদিম যুগের গুহাবাসী পূর্বপুরুষ থেকে একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক সমাজেও পৃথিবীর সবচেয়ে আদিম ও বৈধ প্রথা যা মানবজাতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলছে "বিবাহ" তার ধংস হয়নি বা বিলোপ সাধন করতে পারেনি । যদিও আধুনিক সমাজে বিবাহ নিয়ে নানা বিরোধী মতবাদ বা নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা (লিভ ইন-লিভ টুগেদার) চলছে তারপরেও আপন মহিমায় বিবাহ প্রথা আজো টিকে আছে এবং যতদিন পৃথিবী আছে ততদিন তা টিকেও থাকবে।
ছবি - bn.al-shia.org
বিবাহ কি - বিবাহ হল একটি সামাজিক বন্ধন বা বৈধ চুক্তি, যার মাধ্যমে দু’জন (নর-নারী) মানুষের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়।বিভিন্ন দেশে জাতি-সংস্কৃতিভেদে বিবাহের সংজ্ঞার তারতম্য থাকলেও সাধারণ ভাবে বিবাহ এমন একটি প্রতিষ্ঠান যার মাধ্যমে দু’জন মানুষের মধ্যে ঘনিষ্ঠ ও যৌন সম্পর্ক সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করে।বিবাহ হল একটি বৈশ্বিক সার্বজনীন প্রথা বা সংস্কৃতি। কিছু সংস্কৃতিতে, যে কোনও প্রকারের যৌন কর্মকাণ্ডে প্রবৃত্ত হওয়ার পূর্বে বিবাহ সম্পন্ন করাকে বাধ্যতামূলক হিসেবে পরামর্শ দেওয়া হওয়া অথবা বিবেচনা করা হয়। বিবাহ সাধারণত কোনও রাষ্ট্র,সংস্থা,ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ,আদিবাসী গোষ্ঠী,কোনও স্থানীয় সম্প্রদায় অথবা দলগত ব্যক্তিবর্গের দ্বারা স্বীকৃত হতে পারে। একে প্রায়শই একটি চুক্তি হিসেবে দেখা হয়।
সাধারণত আনুষ্ঠানিকভাবে ধর্মীয় অথবা ধর্মনিরপেক্ষ আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিবাহ সম্পন্ন করা হয়। বৈবাহিক কার্যক্রম সাধারণত দম্পতির মাঝে সমাজ-স্বীকৃত বা আইনগত দায়িত্ববোধ তৈরি করে, এবং এর মাধ্যমে তারা বৈধভাবে স্বেচ্ছায় সন্তান-সন্তানাদির জন্ম দিতে পারে। বিশ্বের কিছু স্থানে, পরিবার-পরিকল্পিত বিবাহ, শিশু বিবাহ, বহুবিবাহ এবং জোরপূর্বক বিবাহ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে পালিত হয়। বলা বাহুল্য, আন্তর্জাতিক আইন ও নারী অধিকার বিষয়ক উদ্যোগের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখিত বিবাহ রীতি গুলো এখন শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আইনগত স্বীকৃতির ক্ষেত্রে, অধিকাংশ সার্বভৌম রাষ্ট্র ও অন্যান্য বিচারব্যবস্থায় বিবাহকে দু'জন বিপরীত লিঙ্গের মানুষের মধ্যে সীমিত করেছে এবং এদের মধ্যে হাতে গোনা কিছু রাষ্ট্র বহুবিবাহ, শিশুবিবাহ এবং জোরপূর্বক বিবাহকে স্বীকৃতি দেয়। আবার বিংশ শতাব্দীতে এসে, অনেক রাষ্ট্র সমলিঙ্গীয় বিবাহের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে এদেরকে আইনগত স্বীকৃতিও দিয়েছে।
ছবি - rodoshee.com
ইসলামের দৃষ্টিতে বিবাহ এবং এর প্রয়োজনীয়তা - মানবজীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো মানুষের যৌন জীবনকে সামাজিক প্রক্রিয়ার মধ্যে আবদ্ধ করা এবং বন্য পশুর সাদৃশ্য অবস্থা থেকে মানবসমাজকে রক্ষা করা। এই কঠিন সমস্যার লাগাম টেনে এবং জটিল চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে ইসলাম ধর্মে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে একটি সম্পর্ক তৈরি করেছে এবং এটিকে একটি নিয়ম-পদ্ধতির আওতায় এনেছে। ইসলাম যৌন জীবনকে মেনে নিয়ে এর জন্য যুক্তিসংগত যাবতীয় আইন ও পদ্ধতি তৈরি করেছে এবং বিয়ের মতো একটি কল্যাণকর ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে। সামাজিক ব্যবস্থার উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য পরিবার গঠনের উদ্দেশ্যে বিবাহবন্ধন হলো অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রথা।
ইসলামে বিবাহ ছাড়া যৌন জীবনযাপনের কোনো সুযোগ নেই এবং তা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। বিবাহ হচ্ছে একমাত্র উপায়, যার মাধ্যমে একজন নারী ও পুরুষ স্বামী-স্ত্রী হিসেবে স্থায়ী বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে। বিবাহ অনেক লোকের উপস্থিতি ও সাক্ষ্য-প্রমাণভিত্তিক একটি উন্মুক্ত ঘোষণা, যার মাধ্যমে নারী-পুরুষ নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক ও দায়িত্ব বরণ ও গ্রহন করে নেয়। মানব সৃষ্টির শুরু থেকে ইসলামের এই বিধান চালু ছিল এবং এখনো একই বিধান কার্যকর আছে। বিবাহ পদ্ধতির বিধান দিয়েই ইসলাম ছেড়ে দেয়নি, বরং কাকে বিয়ে করা বৈধ বা হালাল, কাকে বিয়ে করা অবৈধ বা নিষিদ্ধ তারও একটা তালিকা ঘোষণা করেছে।
ছবি - muslimmarrige.com
ইসলামী বিবাহ রীতি -
ইসলাম ধর্মে বিবাহের মাধ্যমে নারী ও পুরুষের মধ্যকার যৌন সম্পর্কের অনুমতি রয়েছে। ইসলামী বিবাহরীতিতে পাত্র পাত্রী উভয়ের সম্মতি এবং বিবাহের সময় উভয়পক্ষের বৈধ অভিভাবক বা বাড়িওয়ালীর উপস্থিতি ও সম্মতির প্রয়োজন। ইসলামী বিবাহে যৌতুকের কোন স্থান নেই। বিয়ের পূর্বেই পাত্রের পক্ষ হতে পাত্রীকে পাত্রীর দাবি অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা বা অর্থসম্পদ বাধ্যতামূলক ও আবশ্যকভাবে দিতে হয়, একে দেনমোহর বলা হয়। এছাড়া বিয়ের পর তা পরিবার পরিজন ও পরিচিত ব্যক্তিবর্গকে জানিয়ে দেয়াও ইসলামী করনীয় সমূহের অন্তর্ভুক্ত।ইসলামী বিধান অনুযায়ী, একজন পুরুষ সকল স্ত্রীকে সমান অধিকার প্রদানের শর্তে তার প্রয়োজন ও চাহিদা অনুসারে সর্বোচ্চ চারটি বিয়ে করতে পারে। আর সমান অধিকার দিতে অপারগ হলে শুধু একটি বিয়ে করার অনুমতি পাবে। মেয়েদের ক্ষেত্রে একাধিক বিয়ের অনুমতি নেই। তবে, স্বামী মারা গেলে কিংবা তালাক দেয়ার পরে নির্দিষ্ঠ সময় (ইদদত পালন)পর চাইলে একজন নারী পুনরায় বিয়ে করতে পারবে তবে এক স্বামী থাকা অবস্থায় একাধিক স্বামী বা বিয়ের অনুমতি নেই। ইসলামে একজন মুসলিম একজন অমুসলিমকে বিয়ে করতে পারবে যদি উক্ত অমুসলিম ঈমান আনে (ইসলাম গ্রহণ করে)।
ছবি - muslimmarrige.com
কাকে বা কাদেরকে বিয়ে করা যাবে -পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহপাক বলেন, "তোমাদের ওপর হারাম করা হয়েছে তোমাদের মাতাদের, তোমাদের মেয়েদের, তোমাদের বোনদের, তোমাদের ফুফুদের, তোমাদের খালাদের, ভাতিজিদের, ভাগ্নিদের, তোমাদের সেসব মাতাকে যারা তোমাদের দুধ পান করিয়েছে, তোমাদের দুধবোনদের, তোমাদের শাশুড়িদের, তোমরা যেসব স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয়েছ সেসব স্ত্রীর অন্য স্বামী থেকে যেসব কন্যা তোমাদের কোলে রয়েছে তাদের, আর যদি তোমরা তাদের সঙ্গে মিলিত না হয়ে থাকো, তাহলে তোমাদের ওপর কোনো পাপ নেই এবং তোমাদের ঔরসজাত পুত্রদের স্ত্রীদের এবং দুই বোনকে একত্রে বিবাহ করা (তোমাদের ওপর হারাম করা হয়েছে)"। (সুরা নিসা, আয়াত - ২৩)
বিবাহের শর্ত - ইসলাম বিবাহের বিধান দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, বিবাহের শর্তও বাতলে দিয়েছে ইসলাম। বিবাহের শর্ত দুটি—ইজাব ও কবুল। বিবাহের পক্ষদ্বয়, নারী ও পুরুষের বা তাদের অভিভাবক অথবা প্রতিনিধিদের ইজাব-কবুলের মাধ্যমে বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। ইজাব অথবা কবুল যেকোনো পক্ষ থেকে হতে পারে। ইজাব-কবুল মৌখিক অথবা লিখিত আকারে হতে পারে। ইজাব-কবুলের শর্তাবলি সুস্পষ্ট অর্থজ্ঞাপক হতে হবে।
বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্য পাত্র ও পাত্রীকে -
১। মুসলমান, বালিগ ও বুদ্ধিজ্ঞানসম্পন্ন হতে হবে।
২। তাদের স্বেচ্ছাসম্মতিতে বিবাহ অনুষ্ঠিত হতে হবে এবং ইজাব-কবুল নিজ কানে শুনতে হবে। (তবে অভিভাবক বা প্রতিনিধির মাধ্যমে বিবাহ অনুষ্ঠিত হলে তা নিজ কানে শোনা আবশ্যক নয়)।
৩। বিবাহের জন্য অন্তত দুজন প্রাপ্তবয়স্ক ও বুদ্ধিমান মুসলিম পুরুষ অথবা একজন প্রাপ্তবয়স্ক ও বুদ্ধিসম্পন্ন মুসলিম পুরুষ এবং দুজন প্রাপ্তবয়স্কা ও বুদ্ধিসম্পন্ন মুসলিম নারীকে সাক্ষী থাকতে হবে। বিবাহের এই শর্তগুলো মানার পরও অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দেনমোহর।
৪। পুরুষ ও শরী‘আতের বিধান প্রযোজ্য (প্রাপ্তবয়স্ক) এমন দুজন সাক্ষ্যের সাক্ষী ছাড়া বিয়ে শুদ্ধ হবে না।
৫- স্বামী-স্ত্রী উভয়ে বিবাহ বন্ধনে শরী‘আতের নিষেধাজ্ঞামুক্ত থাকা (অর্থাৎ যাদের সাথে বিয়ে হারাম তাদের অন্তর্ভুক্ত না হওয়া)।
বিবাহবন্ধন উপলক্ষে স্বামী বাধ্যতামূলকভাবে স্ত্রীকে নগদ অর্থ, সোনা-রুপা বা স্থাবর সম্পত্তির আকারে যে মাল প্রদান করে তাকে মোহর বলে। দেনমোহর প্রদান স্বামীর ওপর বাধ্যতামূলক কর্তব্য। এটি স্ত্রীর অধিকার। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহপাক বলেন, "তোমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নারীদের তাদের মোহর প্রদান করো"। (সুরা - নিসা, আয়াত -৪)
এভাবে ইসলামী শরিয়ত নানা শর্ত ও আইনের আওতায় বিবাহকে সামাজিক সুরক্ষার একটি বিধান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে এবং সব ধরনের অবৈধ যৌন অনাচারকে বিবাহের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করেছে। বিবাহই হচ্ছে একজন মানুষের সুশৃঙ্খল যৌন জীবনযাপনের একমাত্র হাতিয়ার। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন চান, বৈবাহিক জীবনযাপনের মাধ্যমে মানুষ তার দৈহিক ও মানসিক প্রশান্তি লাভ করবে। প্রশান্ত চিত্তে সে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগিতে নিয়োজিত থেকে একটি সুন্দর সমাজ গঠনে যথাযথ দায়িত্ব পালন করবে। এভাবে সমাজ হয়ে উঠবে সুন্দর ও কল্যাণের মহিমায় ভাস্বর।
বিবাহের উপকারীতা - বিয়ের বহুমুখী উপকারিতা রয়েছে। যেমন—
১. গুনাহ ও পাপাচার থেকে নিজেকে সংবরণ করার মাধ্যমে নারী-পুরুষ উভয়ে ঈমান, ইসলাম ও সতীত্ব রক্ষা করতে পারে।
২. নারী জাতির তত্ত্বাবধান ও রক্ষণাবেক্ষণ হয়।
৩. নারীর সম্মানজনক জীবন-জীবিকা সহজ হয়।
৪. পুরুষ একজন আমানতদার নির্ভরযোগ্য সঙ্গিনী লাভ করে।
৫. বৈধ পন্থায় মানব বংশের বিস্তার হয়।
৬. সৃষ্টিগত ও স্বভাবজাত যৌন চাহিদা পূরণের বৈধ ও নিরাপদ ব্যবস্থা হয় বিয়ের মাধ্যমে।
৭. নারী-পুরুষ উভয়ের মানসিক স্বস্তি, তৃপ্তি ও প্রফুল্ল অর্জন হয়, যা বিয়ে ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে সম্ভব নয়।
৮. নবীজি (সা.)সহ সব নবীর একটি মহৎ সুন্নত বাস্তবায়ন করা হয়। (মুসলিম শরীফ, হাদিস নং ১৪০০)
৯. মানবশিশু তাদের প্রকৃত পরিচয় লাভ করে সঠিক লালন-পালন ও পৃষ্ঠপোষকতার উপর।
১০. বিয়ের দ্বারা রিজিকে বরকত ও জীবনে প্রাচুর্য আসে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, "তোমরা বিয়ে করো, স্ত্রীরা স্বীয় ভাগ্যে তোমাদের কাছে সম্পদ টেনে আনবে" (মুসনাদে বাজ্জার, হাদিস - ১৪০২)
১১. অবিবাহিত থাকলে মানসিক বা শারীরিক রোগ ও জটিলতা তৈরির আশঙ্কা থাকে।
১২. অবাধ ও অবৈধ যৌনতা এইডসের মতো মারণব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার পথ খুলে দেয়।আর বিয়ে তা থেকে মানুষকে পরিত্রাণ দেয়।
১৩. অবৈধ যৌন সম্পর্ক সামাজিক শৃঙ্খলা নষ্ট করে।
১৪. বিয়ে মানুষকে সংসারী করে। ফলে পুরুষরা দায়িত্বসচেতন ও কর্মমুখী হয়। ভোগের মানসিকতা দূর হয়। তদ্রূপ নারীরাও দায়িত্বসচেতন ও বাস্তবমুখী হয়।
১৫. স্বামী-স্ত্রী একে অন্যকে উৎসাহ দিয়ে সুন্দর পৃথিবী বিনির্মাণের পথ সুগম করে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নবুয়ত লাভের সময় আকস্মিক ওহিপ্রাপ্তিতে ভয় পেলে খাদিজা (রা.) তাঁকে অভয় দেন এবং তাঁর পাশে থাকার ঘোষণা দেন।
বিবাহে যেসব কাজ সুন্নাত ও যেসব কাজ হারাম:
১।সকল মুসলমানের জন্য একটি বিয়ে করা সুন্নাত।
২।বিয়ের খিতবা তথা প্রস্তাব দেওয়া কন্যাকে সতর ব্যতীত অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ভালোভাবে দেখা মুস্তাহাব, যাতে তাকে বিয়ের প্রতি আগ্রহী করে তুলে, তবে নির্জনে দেখতে পারবে না। এমনিভাবে কনেও হবু বরকে ভালোভাবে দেখা মুস্তাহাব।
৩।বিয়ের প্রস্তাবকারী বরের পক্ষে মেয়েকে দেখা সম্ভব না হলে সে একজন বিশ্বস্ত নারী পাঠাবে, তিনি ভালোভাবে দেখে তাকে মেয়ের গুণাবলী বর্ণনা করবে।
৪।কেউ কোনো মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব দিলে উক্ত প্রস্তাবকারী তার প্রস্তাব ফিরিয়ে নেওয়া বা তাকে দেখার অনুমতি না দেওয়া পর্যন্ত অন্য কেউ উক্ত মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া হারাম।
৫।যেসব নারী তিন ত্বালাক ব্যতীত বায়েন ত্বালাকের ইদ্দত পালনরত তাদেরকে স্পষ্ট বা ইশারায় বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া বৈধ।তবে রাজ‘ঈ তালাকের ইদ্দত পালনকারী নারীকে স্পষ্ট বা ইশারায় বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া হারাম।
৬।জুম‘আর দিন (শুক্রবার) বিকেলে বিয়ে পড়ানো সুন্নাত। কেননা আসরের সালাতের পরের সময় দো‘আ কবুল হয় এবং সম্ভব হলে মসজিদে বিয়ে পড়ানো সুন্নাত।
** বিভিন্ন ধর্মের বিবাহরীতি
ছবি - bn.wikipedia.org
হিন্দু বিবাহরীতি -
হিন্দু ধর্ম অনুযায়ী, বিবাহে ছেলে মেয়েটির সমস্ত পালন-পোষণের দ্বায়িত্ব নেয় এবং মেয়েটি তাদের সংসারের খেয়াল রাখার দ্বায়িত্ব গ্রহণ করে। এইভাবে তারা দুই আলাদা আলাদা মানুষ এক হয়ে নিজেদের বংশ এগিয়ে নিয়ে যায়। বিবাহের লক্ষ হল সংসার ও সন্তানের লালনপালন করে বংশ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আর এর জন্য একই সময়ে বাইরে থেকে দরকারী জিনিস উপার্জন করে আনা আর ঘরের ভেতরে সংসারের কাজ সামলাতে হয়। যেহেতু একজন মানুষ একই সময়ে এই দুটো কাজ করতে পারে না তাই দুটো কাজ দুজনের মধ্যে বন্টিত হয়ে যায়।যেহেতু পুরুষ বেশি বলবান হয় প্রাকৃতিকভাবেই আর মেয়েরা কোমল প্রকৃতির হয় এবং তাদের গর্ভে সন্তান জন্ম নেয় তাই বাইরে থেকে সংসারের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস উপার্জনের দ্বায়িত্ব পুরুষ নেয় আর ঘরে সংসারের দেখাশোনার দ্বায়িত্ব স্ত্রী নেয়। এইরকমভাবে হলেই সংসার সুস্হভাবে বেড়ে ওঠে ও সন্তানের সুন্দর দেখাশোনার মাধ্যমে বিবাহে বংশবিস্তারের উদ্দেশ্য সফল হয়। দুইজনের মধ্যে ভালবাসা থাকলেই এই কাজগুলো বাধাহীনভাবে সম্পন্ন হয় কিন্তু দুইজনের মাঝে তৃতীয় কেউ আসলে সেই দুইজনের ভালবাসায় ফাটল তৈরী হয়।আর তাতে আগের কাজগুলো করার দ্বায়িত্ববোধ মন থেকে মিটতে শুরু করে। কষ্ট-হিংসার সৃষ্টি হয়।তাতে সংসারের ক্ষতি হয় যার ফলে সন্তানেরও পালন ঠিকভাবে হতে পারে না। আর এখানেই বিবাহের উদ্দেশ্য বিফল হয়ে যায়।এতে পরকীয়ার মতো অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে তাই বিয়ের উদ্দেশ্যকে রক্ষা করতেই বিয়ে শুধু দুইজনের মাঝেই হয়।
হিন্দু বিয়ে
** আবহমান কাল থেকে সনাতন ধর্মীয় বিয়ের রীতিনীতি চলে আসছে । হিন্দু বিয়ে বেশ কয়েকটি আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। সনাতন ধর্মীয় বিয়ে রীতি -
প্রথমত পাত্র-পাত্রীর সম্মতিতে একে অপরকে পছন্দের ভিত্তিতে অভিভাবকরা পঞ্জিকা থেকে শুভ দিনক্ষণ নির্ধারণ করেন। বিয়ের ক্ষেত্রে শুভ দিনক্ষণ বলতে পঞ্জিকায় বিয়ের যে দিন উল্লেখ থাকে তাকেই বোঝায়।বিয়ের দিন ঠিক করার অর্থ হল পাত্রের পক্ষ থেকে পাত্রীকে বাগদান করা। আর বাগদান করা মানে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করা।
বাগদান অনুষ্ঠানে পাটিপত্র করা হয়। এই পাটিপত্র উভয় পক্ষের উপস্থিতিতে পুরোহিত লেখেন। পাটিপত্রে বর-কনের স্বাক্ষর থাকে। এরপর কোনো পক্ষের অসম্মতি প্রকাশ করার সুযোগ থাকে না।সাধারণত আশির্বাদ আসরে পাটিপত্র করা হয়। তবে অনেকে পাটিপত্র করে না। এরপর আসে আশির্বাদ আসর। এর প্রধান উপকরণ ধান, দূর্বা, প্রদীপ, চন্দন, পান, সুপারি ও বড় মাছ। পঞ্জিকা অনুসারে শুভদিন দেখে আশির্বাদ করা হয়।
বরপক্ষ কনেকে এবং কনেপক্ষ বরকে আশির্বাদ করে। আশির্বাদে অনেকে উপঢৌকনও দিয়ে থাকেন। বর-কনের দাম্পত্য জীবন যেন সুখের হয়, সেই প্রার্থনাই করা হয় আশির্বাদ অনুষ্ঠানে।আশির্বাদের পর আসে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের জন্যও দিনক্ষণ আছে। এখানেও শুভ দিনক্ষণ দেখে গায়ে হলুদের জন্য হলুদ কোটা হয়। ৫ বা ৭ জন সধবা স্ত্রীলোক মিলে হলুদ কোটে। এই হলুদই পরে গায়ে হলুদের দিন গায়ে মাখানো হয়।
গায়ে হলুদের পর এবার বিয়ের অনুষ্ঠান। দুই পর্বের অনুষ্ঠানে একটি ‘সাজ বিয়ে’ অন্যটি ‘বাসি বিয়ে’। দুটি আসরই কনের বাড়িতে বসে। তবে কোনো কোনো সময় বাসি বিয়ে বরের বাড়িতেও হয়ে থাকে।‘সাজ বিয়ে’ বিয়ের মূল পর্ব। এই পর্বেই কনে আর বরকে ৭ বার প্রদক্ষিণ করে বরণ করে নেয়। বরণ শেষে বর-কনে দুজনের দিকে শুভ দৃষ্টি দেয়, একই সময় মালা বদল করা হয়। পরে পুরোহিত মন্ত্র উচ্চারণ করে বর-কনের ডান হাত একত্রে করে কুশ দিয়ে বেধে দেন।
এরপর ‘বাসি বিয়ে’র পর্ব । বাসি বিয়েতে বিভিন্ন দেবদেবীর অর্চনা শেষে বর, কনের কপালে সিঁদুর দিয়ে দেয়। তারপর উভয় মিলে ৭ বার অগ্নি দেবতা প্রদক্ষিণ করেন।এভাবেই বিয়ের আসরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়।
ছবি - journaleye24.com
খ্রিস্টীয় বিবাহরীতি
পাত্রী নির্বাচন - খ্রিস্টান সমাজে সাধারণত প্রথমে পাত্রী দেখা হয়। প্রথমত বরপক্ষই কনে নির্বাচন করে। বরপক্ষ কনে নির্বাচন করে কনের চরিত্র, দোষ-গুণ, বংশ পরিচয় জেনে নেয়।
পাত্রীকে প্রস্তাব - শুভদিন দেখে বরপক্ষ কনের বাড়ি যায়। সাধারণত পাশের কোনো আত্নীয়ের বাড়ি গিয়ে তার সঙ্গে কনের বাড়ি যায় এবং তাদের উদ্দেশ্যের কথা জানায়।
বাগদান - বরপক্ষের প্রস্তাবে কনেপক্ষ রাজি হলে বাগদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। কোথাও এ অনুষ্ঠানকে ‘পাকা দেখা’ও বলে। ভাওয়ালে এ অনুষ্ঠানকে ‘পানগাছ’ অনুষ্ঠান বলে। বাগদান উপলক্ষে পান, সুপারি, বিজোড় সংখ্যক মাছ নিয়ে যাওয়া হয়।
বাইয়র - এই অনুষ্ঠানে বরপক্ষের লোকজন কনের বাড়িতে যায়। যা আগেই কথা বলে ঠিক করে রাখা হয়। এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত বর-কনে সবার আশির্বাদ গ্রহণ করে।
নাম লেখা - বিয়ের ৩ সপ্তাহ আগে কনের বাড়িতে পুরোহিতের কাছে বর-কনে নাম লেখান। অনেকে এ অনুষ্ঠানে আতসবাজি ও বাজনার আয়োজন করে।
বান প্রকাশ - এই অনুষ্ঠানে বর-কনে বিয়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। মন্ডলীর বিধি অনুযায়ী এ সময় বিয়ের ক্লাস করতে হয়। এটি বিয়ে পূর্ব ব্যাধতামূলক ক্লাস ব্যবস্থা।
অপদেবতার নজর - নাম লেখা থেকে শুরু করে বিয়ের আগ পর্যন্ত বর-কনেকে অতি সংযমী জীবন করতে হয়। অনেকে এ সময় ভূত-প্রেত ও অপশক্তির নজর থেকে রক্ষার জন্য ‘রোজারি মালা’ বা ‘জপমালা’ গলায় পরেন।
কামানি বা গা-ধোয়ানী - বিয়ের আগের রাতের অনুষ্ঠানকে গা-ধোয়ানী বলে। অনেক খ্রিস্টান সমাজে এই দিন গায়ে হলুদ মাখিয়ে জাকজমকের সঙ্গে অনুষ্ঠান করা হয়।
কনে তোলা - বিয়ের দিন ভোরে বাদকদলসহ বরের আত্মীয়-স্বজন কনের বাড়ি গিয়ে কনেকে নিয়ে আসে। কনেকে ঘর থেকে আনার সময় তার হাতে পয়সা দেওয়া হয়। কনে বাড়ি থেকে আসার সময় সেই পয়সা ঘরের মধ্যে ছুড়ে ফেলে। এর অর্থ হল যদিও সে বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছে, তারপরও বাড়ির লক্ষী ঘর থেকে চলে যাচ্ছে না।
গির্জার অনুষ্ঠান - শুরুতে গির্জার প্রবেশ পথে যাজক বর-কনেকে বরণ করে নেয়। তারপর বর-কনে দুজনের মধ্যে মালা বদল করা হয়। এরপর কনের সিঁথিতে সিদুর পরিয়ে দেওয়া হয়।
ঘরে তোলা - এই অনুষ্ঠানে উঠানের দিকে মুখ করে বড় পিঁড়ির উপরে বর-কনেকে দাঁড় করানো হয়। এরপর বর-কনে সাদা-লাল পেড়ে শাড়ির উপর দিয়ে হেঁটে ঘরে ওঠে। এ সময় বর ও কনে একে অপরের কনিষ্ঠ আঙুল ধরে থাকে।
সকল ধর্মেই নারী-পুরুষের মাঝেই বিবাহ সংঘটিত হ্য় আর তাই সার্বজনীন। আর যা সার্বজনীন তাই সত্য ও সুন্দর । আর বিয়ের মাঝে রয়েছে মানব জাতীর জন্য কল্যাণ এবং এর মাধ্যমেই মানব জাতীর বংশরক্ষা এবং পবিত্রতা রক্ষা হয়।তাই মানব জাতির কল্যাণে বিয়ের ভুমিকা ও গুরুত্ব অপরিসীম।
বিবাহের মাধ্যমে একটি পরিবারের সূত্রপাত হয়। এছাড়া বিবাহের মাধ্যমে বংশবিস্তার ও উত্তরাধিকারের সুযোগ সৃষ্টি হয়। বিবাহের মাধ্যমে পরস্পর সম্পর্কিত পুরুষকে স্বামী (পতি) এবং নারীকে স্ত্রী (পত্নী) হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। স্বামী ও স্ত্রীর যুক্ত জীবনকে "দাম্পত্য জীবন" হিসাবে অভিহিত করা হয়। বিভিন্ন ধর্মে বিবাহের বিভিন্ন রীতি প্রচলিত। একইভাবে বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন প্রথায় বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বিবাহ মূলত একটি ধর্মীয় রীতি হলেও আধুনিক সভ্যতায় এটি একটি আইনি প্রথাও বটে। দুনিয়ায় প্রচলিত সকল ধর্ম মতেই বিবাহবহির্ভুত যৌনসঙ্গম অবৈধ বলে স্বীকৃত এবং ব্যাভিচার হিসাবে অভিহিত একটি পাপ ও অপরাধ।যদিও বর্তমানে কিছু কিছু রাস্ট্রে সমকামিতাকে আইনি কাঠামো দিয়েছে এবং সমলিংগের মাঝে বিয়ে বিয়েকে বৈধতা দেয়ার চেস্টা করা হয়েছে, তারপর ও কোন সমাজে,পরিবারে এ বিকৃত রুচির মানুষকে বা এ বিকৃত প্রথাকে মুলধারা হিসাবে বিবেচনা করা হয়না।কাজেই একজন নারী এবং একজন পুরুষের মাঝেই বিয়ে সংঘটিত হয় এবং এটাই প্রতিষ্ঠিত। আর এতেই মানব জাতির কল্যাণ নিহিত।
চলবে -
====================================================================
পূর্ববর্তী পোস্ট -
মানব জীবন - ৪ " মাতৃত্ব " - Click This Link
মানব জীবন - ৩ Click This Link
"নারী স্বাধীনতা বনাম নারী(জরায়ু)'র পবিত্রতা "
মানব জীবন - ২ " মাতৃগর্ভ (জরায়ু)"- Click This Link
মানব জীবন - ১ "মানুষের জন্ম প্রক্রিয়ার ইতিকথা"- Click This Link
তথ্যসূত্র -**উইকিপিডিয়া।