যুক্তরাষ্ট্র প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে নাটকের শেষ অংকে কি আরো কিছু চমক বাকি আছে? ৩রা নভেম্বরের নির্বাচনে জো বাইডেনের বিজয় কি এখনো উল্টে দেয়া সম্ভব ? পাগলা ট্রাম্পের সাথে সাথে অন্তত কিছু রিপাবলিকান সিনেটর এখনো তেমনটাই আশা করছেন।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তার মিত্র কিছু রিপাবলিকান সিনেটরের একটি গোষ্ঠী পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন যে তারা সিনেট নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবেন, এবং জো বাইডেনের বিজয়র আনুষ্ঠানিক প্রত্যয়নকে আটকে দেবার চেষ্টা করবেন।তারা সেই চেষ্টা করবেন আগামীকাল বুধবার (০৬/০১/২০২১), যখন মার্কিন কংগ্রেসের দুই কক্ষ - প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেট - এক যৌথ অধিবেশনে বসবে এবং প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের ইতোমধ্যেই প্রত্যয়ন করা ইলেকটোরাল কলেজ ভোটগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে গণনা করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ীর নাম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করবে।
ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন ৩০৬টি ইলেকটোরাল ভোট পেয়েছেন আর ট্রাম্প পেয়েছেন ২৩২টি । আর তাই বেশ বড় ব্যবধানেই বাইডেনের পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়া নিশ্চিত হয়ে গেছে।
কিন্তু নভেম্বরের ৩ তারিখের সেই নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির অভিযোগ তুলে রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজের নেতৃত্বে ১২ জন সিনেটর কিছু অঙ্গরাজ্যের ফলাফল চ্যালেঞ্জ করছেন।যদিও ভোট জালিয়াতির এসব অভিযোগের পক্ষে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি। আদালতে তোলা প্রায় সব অভিযোগই বিচারকরা খারিজ করে দিয়েছেন। সর্বশেষ খবর - এই উদ্যোগকে ইতোমধ্যেই অভিনন্দন জানিয়েছেন ভাইস-প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স।তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনের ফল উল্টে দেবার এ চেষ্টা প্রায় সুনিশ্চিতভাবেই ব্যর্থ হবে। তাদের কথা, বুধবারের অধিবেশনে ভাইস প্রেসিডেন্টের ভুমিকা আনুষ্ঠানিকতা পালনের বেশি কিছু নয়।
কিন্তু মার্কিন দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট এক রিপোর্টে বলছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে তার কিছু মিত্র বুঝিয়েছেন যে ভাইস প্রেসিডেন্টের হাতে নির্বাচনের ফল উল্টে দেবার ক্ষমতা আছে এবং তিনি চাইলে জো বাইডেনের ইলেকটরদের প্রত্যাখ্যান করতে পারেন।ট্রাম্পের অনেক ভক্তই এখনো তার নির্বাচনী পরাজয়ের কথা বিশ্বাস করেন না।
এসব পদক্ষেপ এর মধ্যেই রিপাবলিকান পার্টিতে বিভক্তি সৃষ্টি করেছে। সিনেটে রিপাবলিকান নেতা মিচ ম্যাককনেল এর মধ্যেই মি বাইডেনকে জয়ের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং তার সহযোগীদের আহ্বান জানিয়েছেন যেন তারা নির্বাচনের ফল চ্যালেঞ্জ না করেন।
কিন্তু টেড ক্রুজের গোষ্ঠীর সিনেটররা বলছেন, চ্যালেঞ্জ তারা করবেনই। তারা বলেছেন, নির্বাচনে ভোট কারচুপির অভিযোগ তদন্তের জন্য একটি কমিশন গঠন না করা পর্যন্ত তারা নির্বাচিত জো বাইডেনকে সার্টিফাই করবেন না। সিনেটর নির্বাচিত টেড ক্রুজের নেতৃত্বে এমন দলবদ্ধ হয়েছেন মোট ১২ জন সিনেটর। বিবিসির খবরে বলা হয়, তারা ভোট কারচুরি অভিযোগ করলেও এর কোনো প্রমাণ দিতে পারেননি। তারা চাইছেন নির্বাচনী ফলের অডিট ১০ দিন বিলম্বিত করাতে। তবে তারা বাইডেনকে আটকে দিতে সফল হবেন না বলেই আশা করা হচ্ছে। কারণ, আগামী ৬ জানুয়ারি বেশির ভাগ সিনেটর বাইডেনকে সমর্থন করে অনুমোদন দেবেন বলে মনে করা হচ্ছে।২০ জানুয়ারি নতুন প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট শপথ নেবেন। কিন্তু টেক্সাসের সিনেটর টেড ক্রুজের নেতৃত্বে তাতে বাধা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। টেড ক্রুজ ও অন্যদের দাবি, নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অনাকাক্সিক্ষতভাবে ভোটে জালিয়াতি হয়েছে। নিয়ম লঙ্ঘন করা হয়েছে। নির্বাচনী আইনের প্রয়োগে ঘাটতি ছিল। এ ছাড়া অন্যান্য অনিয়ম ঘটেছে। এক্ষেত্রে তিনি ১৮৭৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ঘটনার উল্লেখ করেন। ওই সময় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে উভয় পক্ষই তিনটি রাজ্যে বিজয় দাবি করেছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে তখন ঘটনা তদন্তে দ্বিপক্ষীয় কমিটি গঠন হয়েছিল। তার ওপর ভিত্তি করে এবার টেড ক্রুজের নেতৃত্বে সিনেটররা কংগ্রেসের কাছে আহ্বান জানাবেন একটি কমিশন গঠন করতে।ভোট জালিয়াতির দাবিগুলো তদন্তের জন্য ১০ দিনের এক জরুরি অডিট করার দাবি করবেন তারা।
কংগ্রেসের উভয় কক্ষের আইনপ্রণেতারা আপত্তি ওঠালে প্রতিটি আপত্তির জন্য আলাদা বিতর্ক ও ভোট হতে পারে। এমনটি হলে মার্কিন নির্বাচনের ফলাফল ও পরবর্তী প্রেসিডেন্টের ভাগ্য নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে।
এখনো নির্বাচনের ফল না মেনে সে সম্পর্কে ট্রাম্প বলছেন," সামনে আরো অনেক কিছু আসছে"। ট্রাম্প শনিবার (০২/০১/২০২১) টুইট করেছেন, "একটি ভূমিধ্বস জয় চুরি করার প্রচেষ্টা, যা হতে দেয়া যায় না "। তবে ডেমোক্র্যাট নিয়ন্ত্রিত হাউসে বুধবার আনুষ্ঠানিক প্রত্যয়নের জন্য অনেক রিপাবলিকানই ভোট দেবেন। তাই ট্রাম্পের নির্বাচনী পরাজয়কে ফিরিয়ে আনার অন্যান্য ব্যর্থ প্রয়াসের মতো সর্বশেষ রাজনৈতিক কূটচালটিও নস্যাৎ হতে যাচ্ছে বলে আশা করা হচ্ছে।তিনি তার হাজার হাজার সমর্থককে আহ্বান জানিয়েছেন যেন তারা বুধবার ওয়াশিংটনে(০৬/০১/২০২১) সমবেত হন এবং তার নির্বাচনী পরাজয়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেন।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ার রবিবারের (০৩/০১/২০২১) নির্বাচনেও জিতেছেন বাইডেন। কিন্তু জর্জিয়ায় ভোটের ফল উল্টে দিতে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ফোন করেছেন ট্রাম্প।
যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ফোন কলের রেকর্ডিং প্রকাশ করেছে ওয়াশিংটন পোস্ট। ফোনে জর্জিয়ার রিপাবলিকান সচিব ব্র্যাড রাফেনসপার্জারের সাথে কথা বলেছেন ট্রাম্প। ব্র্যাডকে তিনি বলেছেন, "জর্জিয়ায় জেতার মতো ভোট খুঁজে বের করতে। কারণ তিনি বিশ্বাস করেন না, জর্জিয়ায় জো বাইডেনের কাছে তিনি হেরেছেন"।
এই প্রথম জর্জিয়ায় কোনো ডেমোক্র্যাট প্রার্থী রিপাবলিকানের চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন। জর্জিয়ার ইতিহাস এ ঘটনা অভূতপূর্ব। নির্বাচনের আগে জর্জিয়া জেতার ব্যাপারে ট্রাম্প যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি। ১১ হাজার ৭৭৯ ভোট বেশি পেয়েছেন বাইডেন। আর তাতেই চটেছেন ট্রাম্প। প্রাথমিকভাবে তিনি দাবি করেছিলেন, ডেমোক্র্যাটরা ভোটে কারচুপি করেছেন। কিন্তু ওই দাবি ধোপে না টেকায়, জর্জিয়ার রাজ্য সরকারের উপর চোটপাট করতে শুরু করেন তিনি। ওই ফোন কল তারই প্রমাণ।
ফোন কলে শোনা যাচ্ছে, ব্র্যাড এবং তার আইনজীবীকে হুমকি দিচ্ছেন ট্রাম্প। বলছেন, তিনি বিশ্বাস করেন না, জর্জিয়ায় তিনি হেরেছেন। যেভাবেই হোক তার জন্য ভোট জোগাড় করে দিতে হবে। প্রয়োজনে আবার গণনা করতে হবে। জর্জিয়া স্টেট তার চাই।
ব্র্যাড ও তার আইনজীবী একাধিকবার ট্রাম্পকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, ওই ভাবে ভোট জোগাড় করা সম্ভব নয়। ট্রাম্প যে কারচুপির কথা বলছেন, তার কোনো প্রমাণ নেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প কোনো কথাই মানতে রাজি হননি।
ট্রাম্পের এই ফোন কল সাড়া ফেলে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। বিশেষজ্ঞদের একাংশ বিষয়টিকে ছেলেমানুষি বলে উড়িয়ে দিলেও, অন্যপক্ষের বক্তব্য, ট্রাম্প নিজেই আসলে কারচুপির চেষ্টা করেছেন। যেভাবে ব্র্যাডকে তিনি হুমকি দিয়েছেন, তা অভূতপূর্ব।
অবশ্য জর্জিয়া জিতলেও ট্রাম্প জিততে পারবেন না। জর্জিয়ায় ১৬টি ইলেকটোরাল ভোট। ওই ভোট ট্রাম্পের পক্ষে গেলেও বাইডেন এগিয়ে থাকবেন। আগামী ২০ তারিখ প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাইডেনের শপথ নেয়ার কথা। তার আগে ট্রাম্পের এই ফোন কল শেষ মুহূর্তের মরিয়া চেষ্টা বলেই ব্যাখ্যা করছেন সাংবাদিকরা।
পূর্ববর্তী পোস্ট - Click This Link
(আমেরিকার নির্বাচন পরবর্তী ফলোআপ পোস্ট -১০ )।
তথ্যসূত্র - বিবিসি,আলজাজিরা, ডয়েচে ভেলে, সংবাদপত্র এবং ছবি - গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৩:৫১