যুক্তরাষ্ট্রের সদ্যসমাপ্ত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল এখনও মেনে নেননি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার দাবি, তিনি এখনোও হারেননি। ভোট পুনঃগণনা হলে তিনি বিজয়ী হবেন। পাশাপাশি, বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ভোট গণনা নিয়ে একের পর এক মামলা দায়ের করে চলেছেন। অবশ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব মামলা নির্বাচনের ফল পাল্টাতে পারবে না।
তবে এমনটাও শোনা যাচ্ছে যে, প্রেসিডেন্ট ব্যক্তিগতভাবে পরাজয় মেনে নিয়েছেন—তার অনেক সহযোগী ও দলীয় মিত্ররাও পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া বিঘ্নিত করার চেষ্টা করে চলেছেন তিনি।
নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ডেমোক্রেট দলীয় প্রার্থী জো বাইডেন। এমতাবস্থায় নির্বাচিত প্রেসিডেন্টদের যে তহবিল ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কথা, বাইডেনকে সেসব দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে যাচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্রাম্প প্রশাসনের এমন আচরণ বাইডেন প্রশাসনের ভবিষ্যৎ ও যুক্তরাষ্ট্রকে বিপাকে ফেলতে পারে।
পর্যবেক্ষক, মানবাধিকার সংগঠন ও ইতিহাসবিদরা সতর্ক করেছেন যে, "জনসম্মুখে পরাজয় মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থার ক্ষতি করছেন ট্রাম্প। একইসঙ্গে বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের বাতিঘর হিসেবে দেশটির ভূমিকাও ক্ষুণ্ন করছেন তিনি"।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নির্বাহী পরিচালক কেনেথ রথ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের মানবাধিকার লঙ্ঘন বিদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলার এখতিয়ারকে খর্ব করছে। চলতি সপ্তাহে প্রকাশিত মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিবেদনে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের নির্যাতনের প্রতি নিন্দা জানানো হয়। রথ বলেন, এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে বিরোধীদের হটাতে ভোটারদের দমিয়ে রাখার চেষ্টার পর।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল নিয়ে তাদের প্রতিবেদনের সারাংশে লিখেছে, প্রেসিডেন্ট ‘ভিত্তিহীন কিছু দাবি’ করেছেন যেগুলো ‘বেপরোয়া’ ছিল। ইতিহাসবিদরা ট্রাম্পের আচরণকে আমেরিকান গণতন্ত্রের জন্য নজিরবিহীন হুমকি হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
ইয়েল ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিষয়ক অধ্যাপক টিমোথি স্নাইডার সম্প্রতি এক টুইটে ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে জোর করে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টার অভিযোগ এনেছেন।বুধবারের ওই টুইটে তিনি লিখেছেন, "গণতন্ত্র বাইরে থেকে নয়, ভেতর থেকেই নষ্ট হয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প যা করার চেষ্টা করছেন তার নাম হচ্ছে: অভ্যুত্থান। যদিও দেখে মনে হচ্ছে, এটা সুসংগঠিত নয়। কিন্তু এটি যে ব্যর্থ হবেই, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কিন্তু একে ব্যর্থ করতেই হবে"।স্নাইডার সতর্ক করেন, "আমেরিকান ব্যতিক্রমবাদ' আমাদেরকে ক্ষেত্রবিশেষে মৌলিক সত্য দেখা থেকে বিরত রাখে। "বিরোধীরা কারচুপি করেছে – নিজের ভোটারদের এভাবে বুঝিয়ে ট্রাম্প পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তুলছেন"।
প্রেসিডেন্সিয়াল ইতিহাসবিদ মাইক্যাল বেশলস সম্প্রতি দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেন, "এর আগে কোনো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হেরে, পরাজয় মেনে নিতে অস্বীকার জানিয়ে, নিজেকে ক্ষমতায় রাখতে ক্ষমতার অপব্যবহারের হুমকি দেননি। এর মাধ্যমে ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারো নিজের ঘরানার ইতিহাস তৈরি করছেন, আর এবার এটা গণতন্ত্রের জন্য অশুভ ইঙ্গিত বয়ে আনছে"।তিনি টিভি উপস্থাপক মেহেদি হাসানকে আরো বলেন, আমরা এই মুহূর্তে গণতন্ত্র নিয়ে সংকটে রয়েছি।
বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র পর্যবেক্ষণকারী অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউজের প্রেসিডেন্ট মাইকেল আব্রামোভিটজ্ দ্য টাইমসকে বলেন," ট্রাম্পের আচরণ কর্তৃত্ববাদী নেতাদের মতো। কখনোই ভাবিনি আমি আমেরিকায় এরকম কিছু দেখবো।তিনি বলেন, বিশাল একটি জনগোষ্ঠীকে ভোট কারচুপির কথা বিশ্বাস করিয়ে ট্রাম্প এমন এক বয়ান তৈরি করছেন যেটি বহু বছর থেকে যেতে পারে ও নির্বাচনি প্রক্রিয়ার ওপর মানুষের আস্থা নষ্ট করতে পারে"।
প্রেসিডেন্সিয়াল ইতিহাসবিদ এলান লিচম্যান জার্মানির ডয়েচে ভেলেকে বলেন, ট্রাম্পের নির্বাচনি ফলকে চ্যালেঞ্জ করার প্রয়োজন ছিল না। এর ফলে ক্ষতি হয়েছে। এই নির্বাচনের পর আমরা প্রেসিডেন্সিয়াল ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে মুহূর্তগুলো দেখেছি। এর আগে কখনোই ১৮ শতকেও কোনো প্রেসিডেন্ট হেরে যাওয়ার পর ভিত্তিহীন ও আমাদের গণতন্ত্রের মৌলিকত্বকে এভাবে ক্ষুণ্ণ করেনি।
ট্রাম্পের টিম দাবি করে চলেছে, তারাই আবার ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু বাইডেনের টিম ইতিমধ্যেই সরকার পরিচালনার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাইডেনের নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি ছিল, "একজন প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে ভোটাররা যেমন আচরণ প্রত্যাশা করে, তিনি তেমন আচরণই করবেন। এখন অবধি ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে তার আচরণের মাধ্যমে তিনি সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে চলেছেন।" মঙ্গলবার তিনি বলেন, "ট্রাম্পের পরাজয় মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানানো একটি ‘লজ্জার’ বিষয়"।বাইডেন আরো বলেন, আমার মনে হয় না, এটা প্রেসিডেন্টের ভবিষ্যৎ ভাবমূর্তির জন্য ভালো হবে।
ট্রাম্পের কর্তৃত্ববাদী আচরন তথা তার এসব পদক্ষেপের ফলাফল কি হবে তা সময়ই বলে দেবে। আমেরিকার সাংবিধানিক
প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্ত অবস্থানের কারনে শেষ পর্যন্ত হয়ত ট্রাম্প ফলাফল মেনে নিতে বাধ্য হবে তবে এটা ঠিক যে ,পশ্চিমা গণতন্ত্রের যে সৌন্দর্য তা ট্রাম্প সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিচছেন আর তার সাথে সাথে তৃতীয় বিশ্বের ন্যূনতম বা গণতান্ত্রিক স্বৈরশাসনের দেশগুলির শাসকেরা একটি মেসেজ পাবে যে , ক্ষমতাশীনরা যা চায় তাই করা সম্ভব।জনমত কোন বিবেচ্য বিষয় নয়।
পূর্বর্তী নির্বাচনী ফলোআপ পোস্ট ২ - Click This Link
(নিউজউইক থেকে অনূদিত)
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০২০ দুপুর ১:৫১