
শীতের শৈশব, শৈশবের শীত
এখন এই যান্ত্রিকযুগেও খুব মনে পড়ে হারিয়ে যাওয়া শৈশবকে। এই কনকনে শীতে যখন স্যুটেট বুটেট হয়ে গরম কফির উষ্ণ আমেজে শীতকে দূরে রাখার কৃত্রিম চেষ্টা করি তখন খুব মনে পড়ে বাড়ীর দাওয়ায় বসে খেজুর রস দিয়ে গরম গরম ভাপা পিঠা খাওয়ার সেই দিনগুলো। মনে পড়ে পুকুর পাড়ে দলবেধে সূর্যের জন্য প্রতীক্ষার কথা, মনে পড়ে খুব ভোরে খড়ের গাদায় আগুন পোহানোর কথা। আহা! কি চমৎকারই না ছিল সেই দিনগুলো।
আমার গুলতিগুলো হারিয়ে গেছে
খুব মনে পড়ে শীতের কনকনে সকালে কোনমতে দুটো মুখে দিয়েই বেরিয়ে পড়তাম নিজের বানানো কাঠের গুলতি নিয়ে। আগেরদিনই মাটি দিয়ে গোল করে ঢেলা বানিয়ে রাখতাম গুলতিতে ব্যবহারের জন্য। ওগুলোর নাম ছিল গুলি। গুলি আর গুলতি নিয়ে বিল থেকে বিলে বনে বাদাঁরে ঘুরে বেড়াতাম নানা রঙের পাখির পেছনে। মনে পড়ে না জীবনে কখনো পাখি মারতে পেরেছি কিনা। কিন্তু গুলতি নিয়ে পাখির পিছনে ঘুরতে যে কি আনন্দ তা যে ঘুরেনি সে কি বুঝবে? প্রায় দুপুরে দেরী করে বাড়ী ফেরার জন্য মায়ের বকুনী খেতাম কখনো কখনো মারও কিন্তু পরদিন কি ওসব মনে থাকতো। এখন আর গুলতি চোখে পড়ে না, চোখে পড়ে না নানা রঙের পাখির সমারোহ। এই এয়ারগানের যুগে আমার প্রিয গুলতিরে কে মনে রাখে।
সেই ডাংগুলি আমাকে এখনো আবেশে জড়ায়
শীতের দিনে যখন ফসলের ক্ষেত হতো বিরান বিশাল মাঠে সদলবলে নেমে পড়তাম ডাংগুলি খেলায়। আহা, কি আনন্দ। খেলাটা একটু বিপদজনক হলে ছিল চরম উত্তেজনাকর, হালের টি২০ ক্রিকেটের মতো। এখন ফুটবল, ক্রিকেট আর ভিডিও গেম এর যুগে ডাংগুলি খেলতে দেখি না তেমন কাউকে। ডাংগুলির পরিবর্তে গ্রামের ছেলেপুলেদের হাতে শোভা পায় ক্রিকেট ব্যাট আর বল। হারিয়ে গেছে আমার প্রিয় ডাংগুলি শুধু আমার কপালে রয়ে গেছে ডাংগুলির গুলির আঘাতে পাওয়া দাগটি। দাগের উপর হাত বুলালে ডাংগুলির আবেশে এখনো চোখ বুজেঁ আসে।
গরুর লড়াই, বলি খেলা কেটে যেতো সারাবেলা
শীতের সময় ধান কাটা শেষ হলে যখন ফসলের ক্ষেতগুলোতে চড়ে বেড়াতো রাখালের গরু তখন আয়োজন করা হতো এক বাড়ীর গরুর সাথে অন্য বাড়ীর গরুর লড়াই। কোন আনুষ্ঠানিকতা ছিল না এতে শুধুই আনন্দের জন্যই করা হতো এসব। এখন ডিশ, ইন্টারনেটের যুগে মানুষের এত সময় কোথায় গরুর লড়াই দেখে সময় নষ্ট করার।
আর একটা খেলা ছিল, বলি খেলা। আধুনিক কুস্তির পূর্বূরুপ বলি খেলা। মূলত গ্রামের মাঠে গরু চড়াতে যাওয়া রাখালেরা পরস্পরের সাথে শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতো বলি খেলার মাধ্যমে। শারিরীক ক্ষীণকায় বলে এই একটি খেলায় জীবনে কখনো জেতা হয়নি। বরাবরই হেরে যেতাম শক্তি পরীক্ষার এই খেলায়। এখন যখন জীবনের অনেক কিছুতেই জিতে যাই তখনও কেবলই ফিরে যেতে ইচ্ছে করে সেই হেরে যাওয়া খেলাগুলোতে। আহা! সেই হারাতে কত আনন্দই না ছিল।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ডিসেম্বর, ২০০৯ রাত ১১:৩৮