কুয়াশায় আচ্ছন্ন শীতের বিকেল। বারান্দায় দাড়িয়ে প্রায়ই নির্বাক চোখে তাকিয়ে থাকি বিশ গজ দুরের একটি উইমেন হোস্টেলের দিকে।হোস্টেলের সামনের গলিটাকে আজকাল খুব নিষ্প্রাণ আর নি:স্ব মনে হয়। গলির ভেতর দিয়ে হেটে গেলেও হৃদয় মাঝে হাহাকার জেগে ওঠে। এতদিনের চেনা গলিটাকে খুব অচেনা মনে হয়। এই গলিতে আমার বসবাস। একসময় ময়নাপাখিটার গলিও ছিল এটি।আমার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে কয়েকদিন আগে সে হোস্টেল ছেড়ে চলে গেছে। অথচ কয়েকমাস আগে তার হাত ধরে এই গলিতে পা রেখেছিলাম। আজ এ গলিতে ময়নাপাখি নেই। আমিও চলে যাচ্ছি। কিন্তু সরু গলিটা হয়ত থেকে যাবে যুগ যুগ ধরে। আজ দুজনের পথ বদলে গেছে। চিন্তা ভাবনার জগতও পাল্টে গেছে। তারপরও কোথাও যেন একসঙ্গেই রয়ে গেছি আমরা। কোথাও যেন দুজন একসঙ্গে মিশে যাই।
আমাদের একসঙ্গে বেশিদিন থাকা হয়ে উঠেনি। কেন হয়নি সেটা নিয়ে এখন আর ভাবতে ভাল লাগে না।বয়সের ব্যবধান খুব বেশি না হলেও মনের দিক থেকে দুজন ছিলাম খুব কাছের। বিধ্বস্ত জীবনের বিষণ্ণতায় তার একটু সঙ্গই ছিল আমার সুখ-আনন্দের একমাত্র অবলম্বন। খুব আদর করে নাম দিয়েছিলাম ‘ময়নাপাখি’। অনেকদিন হয়ে গেল তাকে সে নামে ডাকা হয়ে ওঠেনা।
মাত্র কয়েক মাসে মেয়েটি আমার মনের গহীনে বড়সড় বাগান করে ফেলেছিল। কাজের ফাঁকে ফোনালাপ, পিসি থেকে চ্যাট, কত ভাবনা-চিন্তার আদান-প্রদান করেছি দুজন। তারপর খুব কাছাকাছি, এমনকি সংরক্ষিত জায়গায় প্রবেশেরও অনুমতি।ব্যস্ত জীবনের কয়েকটি মাস কেটেছিল দুজনার আড্ডা,গল্প আর মান,অভিমান দিয়ে।যান্ত্রিক শহরে রিক্সার হুড খুলে ঘুরে বেড়ানো।পার্ক কিংবা রেস্তোরায় বসে একটু গল্প করা।আরো কত কি... !!!
মাসখানেক আগে এক পড়ন্ত বিকেলে গলির পাশে দাড়িয়ে আমি। দেখি, ময়নাপাখি তার স্মার্ট বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে রিকশার হুড লাগিয়ে গলির পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে।আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। যে চোখের মায়াজালে বর্ষা আমাকে আকড়ে রেখেছিল।তার সে চোখ দুটো আজ বড় ক্লান্ত, বিধ্বস্ত ।অসংখ্য নির্ঘুম রাত তার চোখের লাবণ্যতাকে অনেকটা ম্লান করে দিয়েছে।আমার পাশ দিয়ে রিকশাটি দ্রুতগতিতে সামনে এগিয়ে গেল।আমি পিছনে ফিরে তাকিয়ে রইলাম রিকশার দিকে।ভাবলাম, মানুষের জীবন হয়ত এমনই গতিশীল।বহমান নদীর মত।যে গতিশীল জীবনে মানুষ কখনো পেছনে ফিরে তাকাতে চায় না। পেছনের স্মৃতি যে বড় যন্ত্রণার, বড়ই করুণ। একটা সময় দুজন খুব কাছের ছিলাম।কত রাত কত বিকেল একসঙ্গে কাটিয়েছি।অথচ সামান্য কিছু কারণে সময়ের স্রোতে আজ আবার দুজন আলাদা হয়ে গেলাম।
পৌষের রাত। ঝির ঝির করে প্রতিদিন তুষার ঝড়তে থাকে জানালার কাঁচ বেয়ে । অথচ আমি তাকিয়ে থাকি গলির শেষ সীমানার দিকে, যতদুর চোখ যায়..।গলির শেষ প্রান্তের উইজডম উইমেন হোস্টেলটি আনওয়াইজের মত কেমন যেন অভিমানী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে প্রতিরাতে। রাতের ল্যাম্পপোস্টের আলোয় সরু গলিটাকে বড় নিষ্প্রাণ আর বিষণ্ণ লাগে।রাত গভীর থেকে গভীরতর হয়।কুয়াশায় ঢাকা পড়তে থাকে বাইরের সবকিছু।ব্যস্ত শহরটাও ক্রমশ শান্ত হয়ে ওঠে।আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ে প্রকৃতি ।আশপাশের ভবনগুলোর ভেতরে জলতে থাকা বাতিগুলোও একটা সময়ে নিভে যায়। কিন্তু আমার চোখে ঘুম আসে না। আমি আর ল্যাম্পপোস্টের নিয়ন বাতিগুলো সারারাত জেগে থাকি…..!!!/#