আমার হূদয় আজ শূন্য। আমাদের হূদয় আজ শূন্য। আমাদের সকলই আজ শূন্য। আমাদের হূদয়পদ্ম শুকাইয়া গিয়াছে। আমাদের হূদয়পদ্মের পাপড়ি ঝরিয়া পড়িয়াছে। আমাদের হূদয়পদ্মের রেণুগুলি আজ পচিয়া দুর্গন্ধ ছড়াইতেছে। পদ্মার ঢেউ, তুমি আমাদের এই শূন্য, রিক্ত হূদয়খানি লইয়া যাও। আমরা হূদয়হীন হইয়া থাকি, তাই আমাদের সয়। কিন্তু এই অপমান কীরূপে সই?
আমরা কীরূপে মুখ দেখাইতেছি? জগৎ আমাদিগকে লইয়া হাসাহাসি করিতেছে। জগৎসভায় আমাদিগকে লইয়া বিচার বসিতেছে।
আমরা টাকা ধার লইতে গিয়াছিলাম। আমরা খাতক। আমরা অধমর্ণ। আমরা ঋণপ্রত্যাশী। তাই আমরা গিয়াছিলাম বিশ্বমহাজনের দ্বারে। তাহারা আমাদিগকে ঋণ দেয় নাই। মুখের ওপরে দরজা বন্ধ করিয়া দিয়াছে। শাসাইয়া দিয়াছে। বলিয়াছে, যা, যা! ঋণ চাইতে এসেছিস কোন মুখে? যা, আগে ঘর সামলা। টাকা নিয়ে তো উড়িয়ে দিবি। ওই টাকা ওড়ানো স্বভাবটা আগে শোধরা গে যা। তারপর টাকা চাইতে আসিস। এই, তোদের লজ্জা করে না ধার করে বাবুয়ানা করতে? ঋণ করে তোরা ঘি খাস, তা খা গে যা। কর্জের টাকায় তোরা কী করে দুর্নীতি করিস? ওই টাকাটা তো তোদের শোধ করতে হবে, নাকি? তোদের প্রত্যেকটা মানুষের ঘাড়ে সমান মাপে বসবে ঋণের বোঝা। সেই টাকাটা তোরা নয়-ছয় করিস কী করে? সকলের ওপরে চাপে যে ঋণের বোঝা, কয়েকজন মিলে সেই টাকাটা হাপিস করে ফেলে, তোরা কিছু বলিস না কেন? যা, আগে নিজের হাতটা সাফসুতরো কর। তারপরে আসিস।
হে পদ্মা, হে প্রতাপশালিনী, প্রমত্তা, অতিবিখ্যাত পদ্মা, তোমাকে উপলক্ষ করে এত নিন্দামন্দ আমাদের শুনতে হলো! এত গালমন্দও আমাদের কপালে ছিল!
পদ্মা, হে পর্বতদুহিতা, চিরপ্রমত্তা, তুমি জানো, এই দেশ নদীমাতৃক, নদীই মাতা এই দেশের। তুমি, তোমার মতো নদীসমূহ আমাদের এই বদ্বীপটিকে তিলে তিলে গড়িয়া তুলিয়াছে। পাহাড় হইতে নামিয়া আসা ঢল বহিয়া আনিয়াছে পলি, তাহাই জমিয়া জমিয়া গড়িয়া উঠিয়াছে এই বদ্বীপ। এই দেশ। জন্মই যদি দিলে হে পদ্মা, আমাদিগকে এত অপমান দিলে কেন?
তোমার বুকে আমরা গড়িয়া তুলিতে চাহিয়াছি একখানা সেতু। এই কি আমাদের অপরাধ? আমরা সেতু গড়িব না? আমাদের কপাল এই যে, আমাদের কতগুলি মন্ত্রণালয় আছে, সেতু বানানোর দায়িত্ব তাই কোনো না কোনো মন্ত্রণালয় লাভ করিবেই। এখন সেই মন্ত্রণালয়ের ব্যাপারে, সেতু নির্মাণের প্রক্রিয়ার ব্যাপারে যদি দাতাদের আপত্তি থাকে, তাহার দায়িত্ব এই দেশের নদীতীরস্থ ১৬ কোটি মানুষকেই বহন করিতে হয়! অথচ এই দেশের ১৫ কোটি ৯৯ লাখ মানুষেরই রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির সহিত কোনো সম্বন্ধ নাই। একটা সেতু কে নির্মাণ করে, কত টাকায় করে, কত টাকা অপচয় হয়, কত টাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়, কত টাকা কাহার উদরে যায়, সে সম্পর্কে দেশের ৯৯.৯ ভাগ মানুষেরই কোনো জ্ঞান নাই, সম্পৃক্ততা নাই। কিন্তু নিন্দার কালি তাহাদের সকলের মুখেই লাগে।
আমাদের বুকে এই নিন্দা খুব গভীর আঘাত হানিয়াছে। আমাদের হূদয়ে এই অপমান বড় তীব্র হইয়া বাজিয়াছে। আমাদের এক প্রতিনিধি থলি হস্তে গিয়াছিলেন ঋণ আনিতে। ঋণ পান নাই, অপমান পাইয়াছেন, উপদেশ পাইয়াছেন। তাঁহার না-জানি কীরূপ লাগিয়াছে। আমাদের গ্রামদেশে প্রবাদ আছে, ভিক্ষা চাই না মা, কুত্তা তাড়া। তাঁহার অবস্থা হইয়াছে তাহার অপেক্ষা খারাপ। তিনি বলিতেও পারিতেছেন না, ‘লাগবে না তোমার কর্জের টাকা। ভারি তো ধার দিচ্ছ। সুদে-আসলে শোধ দিতে হবে! নেব না! নিজের আয়েই সেতু বানিয়ে ফেলব।’ আবার বলিতেও পারিতেছেন না, ‘আচ্ছা, দেশে গিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করব। সব দুর্নীতিবাজকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করব।’ তিনি এটা বলিতেও পারিবেন না, কারণ, তাঁহার দলে, তাঁহার সরকারে, তাঁহার দেশে কোনো দুর্নীতিবাজ নাই! কখনো ছিল না! শুধু অভিযোগ করিলে চলিবে না, প্রমাণ আনিতে হইবে।
ইহাকেই বুঝি বলে ত্রিশঙ্কু অবস্থা। একেবারে শূন্যে ঝুলিয়া থাকা।
আজ এই নদীমাতৃক দেশটির বড় অপমান হইয়াছে। তাহার মুখে চুনকালি পড়িয়াছে।
কিন্তু যাহাদের কারণে আমাদের এই অবমাননা, এই দুঃখদুর্দশা, তাহাদের কোনো বিকার নাই, ভ্রুক্ষেপ নাই। তাহারা কেমন সুখে নিদ্রা যাইতেছে। তাহারা কত কথা কহিতেছে। তাহারা কেমন সদুপদেশ দিতেছে!
হে পদ্মা! তুমি এই মাটি গড়িয়াছ। তুমি এই দেশ গড়িয়াছ। তোমার সন্তানদের এই দুঃখদুর্দশা-অপমান-লাঞ্ছনা দেখিয়া তোমার হূদয় বিদীর্ণ হয় না? তোমার কান্না পায় না? তুমি কীরূপে অশ্রু সংবরণ করিবে?
তোমার সন্তানদের মাথা হেঁট হইয়া গিয়াছে। কিন্তু যাহাদের কারণে আজ সন্তানদের এই সম্মিলিত অবমাননা, তাহাদের মুখে দেখো আকর্ণবিস্তৃত হাসি। টাকা তাহাদের হইয়া কথা কহিতেছে। তাহারা সকল কিছুর ঊর্ধ্বে। দেশের অপমান তাহাদের বুকে বাজে না। তাহাদের নিজেদের অপমান তো তাহারা কিছুতেই বোধ করিতে পারে না। তাহারা যে বোধবুদ্ধির ঊর্ধ্বে! তা না হইলে তাহারা তাহারা কেন?
আর কত অপমান আমাদের কপালে লেখা আছে, হে পদ্মা! সর্বনাশা পদ্মা নদী, তোর কাছেই শুধাই, বল, আমাদের লজ্জা-অপমানের কি কোনোই কূলকিনারা নাই? নদীর এ-কূল ভাঙে ও-কূল গড়ে, কিন্তু আমাদের কেন দুই কূলই ভাঙে? আমাদের সবকিছু কেন ভাঙিয়া পড়িতেছে? আমরা কী পাপ করিয়াছি?
পদ্মা রে! আমরা আর সহিতে পারিতেছি না। নিজের অবমাননা, নিজের অপমান সহ্য হয়। দেশের অপমান যে সইতে পারি না। মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমাদের যে নয়নজলে ভাসিতে হয়। আজ আমাদের নয়নজলে ভাসিতেই হইবে। অনেক কান্না কাঁদিয়াও যে আমরা এই অপমানের জ্বালা ভুলিতে পারিতেছি না। আমাদের ধনসম্পদ কখনোই ছিল না। ছিল কিছুটা মানসম্মানবোধ। আজ তাহাও গেল। সব হারাইয়া আমরা নিঃস্ব, রিক্ত, আমরা আজ শূন্যহূদয়।
পদ্মার ঢেউ রে, তুই আছড়াইয়া পড়। আমাদের শূন্যহূদয় তুই লইয়া যা। আমাদিগকে মারিয়াই বাঁচাইয়া তোল।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
View this link