তো স্যারের আসল নাম আমরা অল্প কদিনেই ভুলে গেলাম। আর প্রায় সব স্যারের মত ওয়ালিুজ্জামান স্যারের-ও কোডনেম দেয়া হল। সার্থক নামকরণের জন্য বন্ধুমহলে খ্যাত হাসান স্যারের নতুন নামকরণ করলো: "সি দাদু"। কারণ স্যার আমাদের "সি" নামের একটা প্রোগ্রামিং ভাষা শেখাতেন, আর তার বয়সের সাথে আমাদের বয়সের পার্থক্য দাদু-নাতির বয়সের পার্থক্যের চাইতে একটুও কম ছিল না।
স্যার ছিলেন এককালের নামকরা ডিপার্টমেন্ট কাঁপানো প্রফেসর। প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে তিনি কম্পু্যটার সায়েন্সে মাস্টার্স করেছিলেন। বিদ্যুৎ-সেক্টরে একটা কারিগরি সমস্যা সমাধান করে দেশের বেশ বড় একটা পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্্রা বাচিয়েছিলেন, পুরস্কার পেয়েছিলেন তার জন্য 10হাজার টাকা। তাঁর ভয়ে একসময় পুরো ডিপার্টমেন্ট কাঁপত বলে জানতাম। অথচ আমরা কি না করলাম তাঁর সাথে!
স্যারের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল, তিনি ছেলেদের সাথে ঠিকমত কমু্যনিকেট করতে পারতেন না। মূল কারণ, তিনি বয়সের কারণে এত আস্তে কথা বলতেন, পেছনের কেউ তার কথা শুনতে পারত না। আর নিজের প্রচন্ড ভাল প্রোগ্রামিং জ্ঞান থাকার কারণে তিনি আমাদেরকেও শুরু থেকে ভাল প্রোগ্রামার মনে করেই শেখাতে লাগলেন। কিন্তু আমরা তখন নাদান বাচ্চা। প্রোগ্রামিং-এর প-ও বুঝি না। ছেলেপেলে স্যারের কথা কিছুদিন বোঝার চেষ্টা করল, তারপর দিল হাল ছেড়ে। স্যারের ক্লাস থেকে মনযোগ হারাল অনেকেই।
আমাদের প্রোগ্রামিং অদক্ষতার জন্য আমরা সবসময় এই "সি দাদু"-কেই দায়ী করতাম। এরপরের বছর আরো দুটো প্রোগ্রামিং ভাষা শেখার কোর্স করার আগ পর্যন্ত বুঝি নি, এই "সি দাদু" কত বড় অ্যাসেট ছিলেন আমাদের জন্য।
স্যার প্রত্যকেদিন ক্লাসের শুরুতে খুব মনযোগ দিয়ে অ্যাটেনডেন্স শীটে কয়জন সাইন করলো, আর কয়জন আসলেই ক্লাসে উপস্থিত, তা মিলানোর চেষ্টা করতেন। ছেলেপেলে সেখানেও দুষ্টুমি। কে একজন চেয়ারের পেছনে লুকিয়ে থাকল, স্যার গুণে দেখলেন একটা সাইন বেশী পড়েছে। আবার গুনলেন। তো এবার সেই ব্যক্তি চেয়ারের সামনে এসে ঠিকমতো বসল। স্যার গুণে দেখেন, সব ঠিক আছে। কিন্তু আগের বার কি গণনা ভুল ছিল তাহলে? স্যার আবার গুনতে লাগলেন।
কেউ একজন একদিন অ্যাবসেন্ট থাকলে পরেরবার স্যার তাকে অনুপস্থিতির কারণ জিজ্ঞেস করতেন। একজন বললো, খালার বাসায় গিয়েছিলাম। স্যারের পালটা প্রশ্ন, খালার বাসায় রোজ কেন যাও? খালাত বোন আছে নাকি? পুরো ক্লাস হেসে উঠল সে কথা শুনে।
আরেকবার আমরা স্যারকে বল্লাম, সেমিস্টার শেষে আমাদের সবাইকে কিছু মিষ্টি খাওয়াতে হবে। স্যার কিছুতেই রাজি হলেন না। অনেক চাপাচাপের পর বললেন,ক্লাসের প্রথমজন দ্্বিতীয়জনকে, দ্্বিতীয়জন ত্রিতীয়জনকে, এভাবে ক্লাসের একেকজন তার পরের জনকে খওয়াও, আর শেষজন প্রথমজনকে খাওয়াও। তাতে সবারই খাওয়া হবে! আমরা শুনে তাজ্জব হয়ে রইলাম। না খাওয়ানোর জন্য স্যার অ্যলগরিদম বানিয়ে ফেল্লেন!
বয়স স্যারকে অনেক ক্ষেত্রে শিশুর মত করে ফেলেছিল। একদিন কি একটা ব্যাপারে ক্লাসের কেউ একটা (সম্ভবত বাজে) কমেন্ট করেছিল, স্যার খুব রাগ করে ক্লাস ফেলে চলে গেলেন। আমরা বুঝলাম, স্যার আর আসবেন না ক্লাস নিতে। সেদিন মনে হয়েছিল, সারা জীবনের জন্য স্যারের বদদোয়া লেগে গেল, প্রোগ্রামিং আর শেখা হবে না কোনদিন। কিন্তু পরদিন যখন স্যার সব ভুলে আবার ক্লাস নিতে আসলেন, তখন স্যারকে শিশু ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারলাম না।
স্যারের জন্য রইল অনেক শ্রদ্ধা। যেটুকু প্রোগ্রামিং শিখেছি, তার পেছনে স্যারের ভূমিকা অস্বীকার করতে পারবনা কোনদিন। দুঃখ, যেটুকু নেয়ার, তা নিতে পারিনি তার কাছ থেকে। আর যেটুকু সম্মান দেয়ের, তাও দিতে পারিনি তাকে। স্যার, দোয়া করবেন আপনার এই ছাত্রগুলির জন্য। ভাল থাকুন স্যার।
বি.দ্্র. সংযুক্ত ছবিটি আমাজন ডট কম থেকে নেয়া।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৭ বিকাল ৫:৩৮