“ভাই দুইটা টাকা হইবো, সারাদিন গাঞ্জা টানিনাই”
আমি হাসিমুখে লোকটার দিকে তাকিয়ে দশটি টাকা বাড়িয়ে দিলাম।কিন্তু লোকটা অনেকক্ষন নিশ্চুপ থেকে টাকার দিকে তাকিয়ে থেকে আমার দিকে বিমর্ষ চাহনী দিলো।আমি তাই টাকাটা আবার পকেটে ঢুকিয়ে তাকে মিষ্টি হাসি উপহার দিলাম।
“বিয়া করছেন?”
“না, আজকে বাসায় যেয়ে মেয়ে দেখতে যাবো।”
সেদিন ছিলো ১৪১৬ সনের ৯ই বৈশাখ, একটি বৃষ্টির দিন।সারাদিন আকাশ কালো করে ঝমঝম বারিধারা।আমি অফিসের সামনের বাস স্ট্যান্ডের ছাউনীতে বসে আছি শেষ বিকেলে।রাস্তা ছিমছাম ফাকা হয়ে আছে।কেমন যেন মোহ ধরিয়ে দেয়া এক নীরবতা চারদিকে।সিদ্দিক নামে ১০ বছরের টোকাই ছেলেটি তার সব দন্ত বাহির করে রাস্তার এপার ওপার হো হো করে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। আমি আজকে আমার মার সাথে মেয়ে দেখতে যাবো।আমি অনেকদিন ধরে বাসায় বিয়ে করবো বলে মা বাবার কান ঝালাপালা করে ফেলেছি।এমন নয় যে আমার পছন্দের কোন পাত্রী আছে।কিন্তু জীবনের ২৬টি বসন্ত আমাকে প্রেম থেকে বঞ্চিত করেছে,আর বঞ্চনার জীবন কাটাতে চাইনা।মূলত বিয়ের ভাবনাটা এসেছে আমার বন্ধু মাজেদের বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে।৩ বছর প্রেম করে বিয়ে করা বন্ধু আর তার বউয়ের আনন্দ দেখে আমার মনে হয়েছিলো, কি পাইলাম এ জীবনে!
সেই থেকেই আমি দিনরাত বিয়ের স্বপ্ন দেখি।
আজকে এই পড়ন্ত বিকেলে যখন বাসস্ট্যান্ডে নিশ্চুপ বসে আছি তখন বারবার মনে হচ্ছে, আহা! পাশে যদি একজন প্রেয়সী থাকতো।গুন গুন করে হাবিবের দ্বিধা গানটা গেয়ে যাচ্ছি।কিছুক্ষণ পর আমার পাশের গাঁজাখোরের নাম জানতে পারলাম।হালিম মিয়া তার জীবন কাহিনী যা বর্ণনা করলো তার সারমর্ম হলো, সে একজন কবিরাজ ছিলো।তার গ্রাম শিলাইকন্দতে।সে বহু নাম কামাই করলেও একবার ভুল ওষুধ দিয়ে ধরা খায়।পরে তাকে বিবস্ত্র অবস্থায় ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে গ্রামছাড়া করে এলাকার লোকজন।সেই দুঃখে হালিম মিয়া এখন গাঁজা খায় আর গান বানায়।
“একটা গান শুনবেন?” হালিম মিয়া জানতে চাইলো আমার কাছে।আমি উদাসীন হয়ে উত্তর দিলাম, "শুনি"।
হালিম মিয়া উকিল মুন্সীর বিখ্যাত গানটা “আমার গায়ে যত দুঃখ সয়” গাইতে থাকে আর আমি তন্ময় হয়ে তার কর্কশ কন্ঠে একটি গানের অপমৃত্যু প্রত্যক্ষ করি।কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমার একটুও খারাপ লাগছিলোনা।আমি, টোকাই সিদ্দিক এবং হালিম মিয়া তখন ছমছমে প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।আমাদের কাছে তখন সব কিছুই আনন্দের।বৃষ্টির ঝাপটা আমাদের ভালো লাগে, মাটির সোঁদা গন্ধে আমরা পাচ্ছি জান্নাতের সুবাস।
“শুনুন”, হঠাৎ করে এমন রমনী কন্ঠের ডাক শুনে আমি থমকিয়ে গেলাম।কি যেন হলো জানিনা, আমি ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়েটিকে দেখতে পারছিলাম না।বুকটা কেমন ধক ধক করছিলো।কি অদ্ভুত কান্ড দেখুন তো!
“জ্বী বলেন”, সিদ্দিক আমার হয়ে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলো।মেয়েটির মুখ না দেখেও আমি বলে দিতে পারি যে আমার এই আচরণে সে আহত হয়েছে।
“আমি মতিঝিল যেতে চাচ্ছি এখান থেকে,কোন সিএনজি স্টেশন কি আশেপাশে পাওয়া যাবে অথবা কোন বাস ওদিকটায় যায় বলতে পারেন?”।
আমি মেয়েটির কথা শুনেই বুঝেছিলাম যে তার গন্তব্যে যাওয়াটা জরুরী।আমার নিজগন্তব্য হলো উত্তরা,কিন্তু জানিনা কি মনে করে আমি মেয়েটিকে বললাম, “আমিও মতিঝিলে যাবার জন্য দাঁড়িয়ে আছি"”।
অবশেষে আমি তার দিকে তাকালাম এবং পাগল হলাম।সাদা এপ্রোন পরা একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট, মায়াময় চাহনী আর কত সাদাসিদে কথাবার্তা।আমি প্রেমে পড়লাম বা প্রেম আমার উপর পড়লো।
কিন্তু আমি এখন আর ওই বয়সে তো নেই যখন একটি মেয়ের দিকে লুলহাসি দিয়ে তাকানো যায়, তাকে বলা যায় “জানেন বাংলালিঙ্কের নতুন অফারে আপনি আমাকে অথবা আমি আপনাকে ফোন করলে যা বিল হবে তার দ্বিগুন আমাদের একাউন্টে জমা হবে।ভালো না?”
আমি বুঝতে পারছিনা আমার এভাবে আকস্মিক প্রেমে পরার কারণটা কি!প্রকৃতির কোন খেলা নাকি সত্যি আমার মেয়েটিকে ভালো লেগে গেলো।যেটাই হোক, যেভাবেই হোক আমি এই মেয়েটির সাথে সারা বাংলাদেশ ঘুরে বেড়াতে যাই, তার হাতের ভালোবাসা মাখা সকালের নাস্তা আর শীতের পিঠা খেতে চাই।
“আমি এখন কি করে যাবো বলতে পারেন?”
“আপনি একটু অপেক্ষা করুন, হয়তো একটা বাস পেয়ে যাবেন।আমি নিজেও অপেক্ষা করছি”
“ও আচ্ছা”
আমি আবার নিশ্চুপ,মেয়েটিও নিশ্চুপ।সিদ্দিক কৌতুহলী হয়ে আশেপাশে ঘুরঘুর করছে।হালিম মিয়া আবারো গান গাওয়া শুরু করলো।আমি মনে প্রাণে চাচ্ছি মেয়েটিও যেন প্রকৃতির একটি অংশ হয়ে যায়।আমার বুকে তখন তোলপাড় চলছে।আমার তাকে কিছু একটা বলতে হবে।কিন্তু আমি কি বলব!!
“ভাই আমার বয়স ২৬ বছর।আমার বাসা থেকে আমাকে বিয়ের জন্য খুব চাপ দিচ্ছে।কিন্তু আমার না আপনাকে দেখে খুব ভালো লেগে গেছে।আমি আর কাউকে বিয়ে করতে চাইনা।আমি বলছিনা আপনার আমাকে পছন্দ করতে হবে।কিন্তু আমি আপনাকে পছন্দ করে ফেলেছি।চাইলে আপনি আমাকে এখন থাপ্পর মারতে পারেন অথবা ইগনোর করতে পারেন,কিন্তু তবুও আমি আপনার পিছ পিছ ঘুরবো বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি"”। এই কথাগুলো আমি একটুও বিরতি না দিয়ে টানা মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়ে বললাম এবং চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম।
“আমাকে পছন্দ করলে ভাই বলছেন কেন?”
এই কথা শুনে আমি আবার মত্যে নেমে আসলাম।চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি মেয়েটি বিরক্ত চেহারা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আমি এবার সেই আগের মত লুলহাসি দেয়ার চেষ্টা করলাম,কিন্তু ভয়ে সম্ভব হলোনা।আমি অপেক্ষা করছি সে আবার কি বলে।কিন্তু সে আর কিছুই বললোনা।এভাবে অনেকক্ষন চুপ করে থাকতে থাকতে আমি হতাশ হয়ে নিজেকে মনে মনে ধিক্কার দিতে লাগলাম এই ছাগলের মত কাজ করার জন্য।সিদ্দিক আর হালিম মিয়া অন্য দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে আর আমি বোকার মত মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছি।
“আমি দুঃখিত”,এটুকু বলে আমি আবার ভাল ভাবে তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছু শোনার অপেক্ষায়।
“আপনি মদন এবং একটা ছাগল।ইচ্ছা করলে আপনি আমাকে ফলো করে বাসার ঠিকানা নিয়ে পরে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে পারতেন,তাই না? এই যে আমাকে এইসব বললেন এখন আমি তো আপনাকে খারাপ ছেলেও ভাবতে পারতাম"”।
আমি জ্ঞানী মানুষের মত মাথা দুলিয়ে আস্তে আস্তে বললাম “তা ঠিক, তা ঠিক”।
“আপনাকে দেখেই অবশ্য মদন মদন লাগে,আমি মদন টাইপ কারো সাথে প্রেম বিয়ে করতে চাইনা, সরি।আর তাছাড়া এখন আমার প্রফ চলছে, ৩ দিন পর কম্যুনিটি মেডিসিনের ভাইভা।এইসব প্রেম প্রীতি পরীক্ষার পর”।
“আফা এখন আপাতত উনাকে চিন্তা করবেন বইল্যা ঝুলায়া রাখেন।লোকটা ছাঘলের মত দেখতে হইলেও মনটা কিন্তু মাশাল্লাহ মাম ওয়াটারের মত পরিষ্কার”
হালিমের কথা শুনে মেয়েটি উফ! বলে একটা বিরক্তির শব্দ করলো।আমি চরম আশাহত হয়ে আশেপাশে তাকাতে থাকলাম।একবার মনে হল একটা দৌড় দেই যেদিকে দুচোখ যায়।আরেকবার মনে হলো, দেখিনা যদি ভালো কিছু হয়।
আচমকা লক্ষ্য করলাম মেয়েটি মিটি মিটি হাসছে।একটু পরই আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কি করেন?”
আমি বললাম “আমি চাকরী করি একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে।পাশ করেছি তড়িৎ প্রকৌশলে বছর দুই আগে।জীবনে কখনো প্রেম করিনি”
মেয়েটি “আচ্ছা” বলে একবার মাথা ঝাকালো শুধু।আমার মনে হচ্ছিলো আমি ভাইভা দিচ্ছি মঈন স্যারের সামনে।উনি আমাকে কঠিন কঠিন প্রশ্ন করছেন ইমপিডেন্স ডাম্পিং, রেজনিং নিয়ে আর আমি উলটপালট উত্তর দিয়ে চলছি।এখনও বৃষ্টি ঝমঝম করে পড়ছে,এখনো আকাশে ছাইরাঙ্গা আধার।ওদিকে ২৭ তম জৈষ্ঠে দেখা পাওয়া প্রেম আমাকে মূঢ় করে রেখেছে।
“ঠিক আছে, আপনাকে আসলে খারাপ লাগেনাই।আপনি বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়ে দেখতে পারেন।আমার প্যারেন্টস যদি রাজী থাকেন আমি একটা থট দেব"”।
এইবার আমি সার্থক লুল হাসি দিলাম।কারণ আমি সফল হয়েছি।ঠিক সেই সময় আমাদের অবাক করে দিয়ে একটা সি.এন.জি এসে আমাদের কাছে দাঁড়ায় এবং মোলায়েম কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “কোথা যাবেন স্যার”?
সি.এন.জিওয়ালার হাসি আমার কাছে তখন জর্জ ক্লুনির হাসির থেকেও মধুর লাগলো।আমি মেয়েটিকে যার নাম পরে জেনেছিলাম নাইরী তাকে নিয়ে মতিঝিলের দিকে রওনা দিলাম।এক বছর আগে এই দিনে আমার মত বোকাসোকা একটি লোক আধ ঘন্টার মাঝে একটি ডাক্তারী পড়া মেয়েকে পটিয়ে সারা রাস্তা হাত ধরে মতিঝিল যাত্রা করে।
আমার মা নাইরীকে খুব পছন্দ করেছিলো।নাইরী আমার মা বাবার সাথে সবচেয়ে বেশি গল্প করে তার অতীত প্রেমের অভিজ্ঞতা নিয়ে।কোন একদিন সে আমার মাকে জানায়(যা আমি লুকিয়ে লুকিয়ে শুনে ফেলি), “মা বুঝলেন, আপনার ছেলে যেইদিন আমাকে অফার দেয় আমি ওইদিন একটা ব্রেক আপ করে আসছি।বান্ধবীদের জিদ করে বলে আসছি আর প্রেম করবোনা।সরাসরি বিয়ে।আপনার ছেলে কত ভাগ্যবান দেখছেন।”
আমার মা জিজ্ঞেস করেছিলো, “তুমি কি ভাগ্যবতী”
“মা আমি পৃথিবীর ৩জন ভাগ্যবতী স্ত্রীর মধ্যে একজন।আপনার ছেলেকে সারাদিন আমি যা-তা বলি কিন্তু সে কোনদিন একটা রা করেনাই।”
“বাকী দুটো কে মা?”
“আপনি আর আমার মা”
আমি সেদিন বাথরুমে যেয়ে আবেগের বশে দুই ফোটা অশ্রু বিসর্জন করেছিলাম।
এতকিছু আজ আপনাদেরকে জানালাম কারণ আজকে আমাদের সেই অবিশ্বাস্য বৃষ্টিস্নাত দিনটির বর্ষপুর্তি।আমি জানি কেহ সেদিনের কথোপকথন বিশ্বাস করতে চাইবেন না।আমিও সেদিনের পরে আর বিশ্বাস করিনি।বাংলা সিনেমার গরু নাকি গাছে উঠতে পারে।আমার ওইদিনের গল্প যাকে বলি সেই বলে, আমার গল্পের গরু নাকি পাখা ঝাপটিয়ে আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে বললেও বেশি গাঁজাখুরি শোনাবেনা।
সেদিনের পর মাত্র ১ মাসের মধ্যে আমাদের বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো।আমি সারারাত ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম।সে অবশ্য আরামে ঘুমিয়ে কাটিয়েছিলো।এই এক বছর সে আমাকে বহু যন্ত্রনা দিয়েছে কিন্তু কোনদিন মনে কোন আঘাত দেয়নি।তাকে কখনো আমি কাদতে দেখিনি শুধু একদিন ছাড়া যেদিন আমাদের অনন্ত মারা যায়।
অনন্ত আমাদের প্রথম স্বপ্নশিশুর নাম।জন্মের দুঘন্টার মধ্যেই সে মারা যায়।নাইরী যখন জানতে পারলো অনন্ত বেঁচে নেই ও চুপ করে উপরে তাকিয়ে ছিলো।আমিও একটুও কাদিনি।এরপর যখন আমরা বাসায় ফিরে আসি সেদিন রাতে হঠাৎ ওর হাতের স্পর্শ পাই কাধে।জেগে উঠে বসলে ও আমার দিকে অসহায় হয়ে তাকিয়ে বলে “অনন্ত নাই”। আমি সারারাত ওকে ধরে ছিলাম।মেয়েটি কাঁদলো, সারাটি রাত কাঁদলো।আমি বাঁধা দেইনি, সান্তনাও দেইনি।
আমি ঘুমাতে যাবার আগে একটি নিয়ম সবসময় অনুসরণ করি।আমি একবার ওর হাত ধরে বলি, “তোমাকে ভালোবাসি"”।এখনো পর্যন্ত এর ব্যতিক্রম হয়নি।
লেখক : ড়ৎশড়
একটি কপি-পেস্ট প্রযোজনা।