১৯০৩ সালের দিকে রুশ-জাপান বিরোধ দানা বেঁধে উঠল আবার । জাপান সবে চীনে আরেকটা বড় রকমের যুদ্ধ শেষ করে এনেছে । কোরিয়ান উপদ্বীপ বা মাঞ্চুরিয়ান উপদ্বীপ কোনোখানেই জাপান আর দশ বছর আগের মতো কোনো ছাড় দিতে রাজি ছিল না ।
অবশ্য জাপানের পিছনে ব্রিটেনের পরোক্ষ মদদ ছিল । রুশ সম্রাট ভিক্টোরিয়ার নাত-জামাই হলে কী হবে সাম্রাজ্যের স্বার্থ তো তা বলে ছাড় দেয়া যায় না! জাপান বলতে গেলে তখন ব্রিটেনের হয়ে একটা প্রক্সি যুদ্ধের সুচনা করল । ব্রিটিশের হাতে তখন ছিল চীনের হংকং সহ অনেক বানিজ্যিক সুবিধা বা কনসেশান, ভারতীয় উপমহাদেশ ও আফ্রিকার অনেকটা জায়গা ।
দক্ষিন আফ্রিকা যা আদতে ডাচদের রাজ্য ছিল, ব্রিটেন যথেষ্ট ছলে বলে কৌশলে ঊনিশশতকের মাঝামাঝি সময়ে বাগাতে পেরেছিল । সোনা ও হীরের দেশের আগের ঔপনেবেশিক ওলন্দাজরা ( যারা নিজেদের আফ্রিকানার বা বোয়ার বলতো) ইংরেজের উপর বিশেষ প্রীত ছিল না । তাই তারা ঊনিশ শতকের শেষ দিকে ইংরেজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার পরিকল্পনা আঁটতে থাকে ।
এবং দক্ষিন আফ্রিকার বোয়াররা প্রায় নিরস্ত্র অবস্থায় বিদ্রোহ ঘোষনা করে বসে বিংশ শতাব্দী শুরু হবার সাথে সাথে--যুদ্ধটা ইতিহাসে বোয়ার যুদ্ধ বলেই পরিচিত । দক্ষিন আফ্রিকা ছিল সুয়েজের মতোই ভারতবর্ষে যাবার একটা খুব গুরুত্বপুর্ণ সমুদ্র পথ । ব্রিটিশ সিংহ বিস্তর কাঠ খড় পুড়িয়ে এ বিদ্রোহ দমন করতে পেরেছিল ১৯০২ সালের দিকে ।
এর মধ্যে ভিক্টোরিয়ার আরেক নাতি দ্বিতীয় ভিলহেল্ম বোয়ার পক্ষে বেশ কিছু বিবৃতি দিয়ে বসেন যা নানীর দেশের লোকদের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা বেশ কমিয়ে দেয় (নামিবিয়া, তাঞ্জানিয়া আর উগান্ডা তখন জার্মান উপনিবেশ ছিল. অর্থাৎ দক্ষিন আফ্রিকার ব্রিটিশ প্রভাবমুক্ত হলে সেখানে জার্মান প্রভাব স্বয়ংক্রিয় ভাবেই বেড়ে যেত) । মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী তখন দক্ষিন আফ্রিকায় ছিলেন, তাঁর আত্বজীবনীতে এসবের কাননিক বিবরণ আছে ।
ব্রিটিশের আরেকটা দুঃস্বপ্ন ছিল রুশ সাম্রাজ্য হিন্দুকুশ প্রবতমালা পার হয়ে হয় ভারতবর্ষে হাত বাড়াবে অথবা সাইবেরিয়ার ওদিকটা থেকে চীনে প্রভাব বলয় বিস্তার করবে । পুর্ব ইউরোপে স্লাভ জাতি অধ্যুষিত এলাকায় রুশ প্রভাব বিস্তারও ব্রিটিশের রাতের ঘুম নষ্ট করার আরেকটা কারন ।
যে জন্য উদীয়মান জাপানের সাথে সে সময়ে ভাল সম্পর্ক বজায় রেখেছিল ব্রিটিশ । যদিও জাপান যে কত অল্প সমবের মধ্যে কতটা শক্তিশালী হয়ে উঠবে তা ব্রিটেন আগে জানলে বোধহয় আরেকটু ক, সাহায্য করতো ! ১৯০২ সালে জাপান আর ব্রিটেন একটা মৈত্রীচুক্তি করে যার একমাত্র উদ্দেশ্যই ছিল প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে রুশ প্রভাব খর্ব করা ।
ব্রিটেনের রাজকীয় নৌবাহিনীর সাথে জাপানের সম্পর্ক ছিল যথেষ্ট অমায়িক । বিশ শতকের গোড়ার দিকে ব্রিটেনে তৈরী হচ্ছিল জাপানের অনেক গুলো যুদ্ধজাহাজ । যার মধ্যে একটা ছিল "মিকাসা" সে যুগের তুলনায় ছিল যুগান্তকারী ভাবে আধুনিক।
মিকাসা বানানো হয়েছিল রয়্যাল নেভির ম্যাজেস্টিক ক্লাস যুদ্ধজাহাজকে মডেল করে । ওজন ছিল ১৫ ১৪০ টন ও ১৮ নট গতিতে চলতে পারতো । চারটা বারো ইঞ্চি কামান, চোদ্দটা ছয় ইঞ্চি কামান ও বিশটা তিন ইঞ্চি কামান ছিল জাহাজটাতে । আর বর্ম হিসেবে জাহাজটা মোড়ানো হয়েছিল জার্মানীর ক্রুপ কোম্পানির ইস্পাতের পাত দিয়ে । জাহাজটা ছিল জাপানী নৌ প্রধান, অ্যাডমিরাল হেইহাচিরো তোগোর নিজ্স্ব জাহাজ--বা ফ্ল্যাগ শিপ । সে যুগের সেরা যুদ্ধ জাহাজ ।
এখন যা চীনের লিওয়াদং উপদ্বীপ তখন তাই মাঞ্চুরিয়ার উপদ্বীপ বলে পরিচিত ছিল । এবং এখনকার দালিয়ান বন্দরটির কাছেই পোর্ট আর্থার বন্দরটি অবস্থিত । ১৮৫৯ সালের দিকে আফিমের যুদ্ধের সময়ে একটা আঘাত প্রাপ্ত ব্রিটিশ রণতরী এখানে একটি মাছধরা গ্রামে এসে ভেড়ে । জাহাজের কমান্ডারের নাম আর্থার হওয়াতে এটি পোর্ট আর্থার হিসেবে রাতারাতি পোর্ট আর্থার হিসেবে মানচিত্রে নাম করে ফেলে । রুশরাও সেই নামটাই ব্যাবহার করতো ।
আগেই বলেছি ১৮৯৫ সালের দিকে জোর খাটিয়ে রাশিয়া এ বন্দরটি কব্জা করে । তার পর থেকেই তারা একে শক্তিশালী করার চেষ্টায় ব্যাস্ত ছিল । কোরিয়া ছিল নাম কা ওয়াস্তে স্বাধীন ও রুশ-চীন ও জাপান এই ত্রিশক্তির বলয়ের অধীন । শুরুতে জাপানের কৌশল ছিল মাঞ্চুরিয়ার উপর জাপান দাবী ছেড়ে দেবে যদি রাশিয়া কোরিয়ার উপর দাবী ছেড়ে দেয় ।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে অক্টোবর, ২০০৭ সকাল ৮:৪২