এশিয়ান মুল ভুখন্ডে উত্তর-পূবের তটরেখা যদি আমরা ভালো করে খেয়াল করি তাহলে দেখবো কয়েকটি উপদ্বীপ প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে বিস্তৃত। সবচেয়ে উত্তরের উপদ্বীপটি অবশ্যই রুশ সাইবেরিয়ার আগ্নেয়গিরি সমৃদ্ধ কামচাৎকা উপদ্বীপ । তারপরের সবচেয়ে বড় উপদ্বীপটি হচ্ছে কোরিয়ান উপদ্বীপ । প্রায় বাহাত্তর হাজার বর্গমাইল জুড়ে বিস্তৃত কোরিয়ান উপদ্বীপ, ঊঈনিশ শতকের শেষ ভাগে আনাম, তিব্বতের মতই চীনের একটা করদ রাজ্য ছিল । চীনে তখন রাজত্ব করতেন মাঞ্চু বংশদ্ভুত চিং রাজবংশ ।
কোরিয়ান উপদ্বীপে এটাই জাপানের প্রথম আক্রমণ নয় । ষোড়শ শতকের শেষ দিকে জাপান বেশ কয়েকবার কব্জা করার চেষ্টা করেছে কোরিয়াকে । একবার তো এক জাপানী সেনাপতি হাজার হাজার কোরিয়ান বন্দীর নাক-কান কেটে কেটে এনে জাপানী কিয়োতো শহরের কাছে একটা ঢিবি বানিয়েছিলেন (!) । যে ঢিবির নাম 'মিমিজুকা' । তবে ১৫৯৮ সালের মধ্যেই জাপানের আক্রমণের গতি শ্লথ হয়ে একেবারে নিস্তেজ হয়ে যায় । তার কারন কিছুটা কোরিয়ানদের অভিনব রণকৌশল আর চীনের মিং সম্রাটদের সরাসরি হস্তক্ষেপ । মিং রা বুজকতে পেরেছিলেন জাপানকে এশিয়াতে পা রাখতে দিলে চীনের প্রান্তিক রাজ্যগুলোর অবস্থা টলে উঠবে । তিনশো বছর পরে আবারো একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো ।
কিন্তু এবার কোরিয়ার আর জাপানের শিল্প-প্রযুক্তিতে আকাশ-পাতাল প্রভেদ । জাপান, প্রাশিয়ান বাহিনি কর্তৃক প্রশিক্ষিত হয়ে আধুনিক যুদ্ধ কৌশল সম্বন্ধে সম্পুর্ণ ওয়াকিফহাল আর কোরিয়া তখনো প্রায় মধ্যযুগে পড়ে আছে । ১৮৭৬ সালে জাপানীরা কোরিবার উপরে বৈষম্য মুলক গাংহোয়া চুক্তি চাপিয়ে দেয় । ১৮৮৪ সালে তারা চীনপন্থী কোরিয়ান সরকারকে উৎখাত করে গায়ের জোরে । ১৮৯২ সালে কোরিয়ার চাষীরা বিদ্রোহ করে অত্যাচারী জমিদার আর শাসকদের বিরুদ্ধে , বিদ্রোহীরা নিজেরদের বাহিনীকে বলতো 'তোংশাক বাহিনী'।
চীন আর জাপান (কোরিয়া তখন দুই শক্তির মধ্যে বলা যায় যৌথ ভাবে শাসিত হচ্ছিল ) এদের দমন করতে বাহিনী পাঠনোর উদ্যোগ নেয়ার আগেই তোংশাকদের বিদ্রোহ স্তমিত হবে আসে । ১৮৯৪ সালের ৮ ই জুন জাপানী নৌ-সেনারা প্রথম কোরিয়ান উপদ্বীপে সরাসরি অভিযান চালায় । প্রথম দফায় হাজার পাঁচেক সৈন্য নেমেছিল । বিদ্রোহ দমনের অজুহাতে কোরিয়াতে সৈন্য পাঠানো উদ্দেশ্য আসলে ছিল চীনের কর্তৃত্ব যেটুকু আছে সেটাকেও খর্ব করে ফেলা ।
জুলাই মাসে আরো শেন্য এবং বলা যায় তৎকালীন জাপানী নৌবাহিনীর প্রায় সমস্ত যুদ্ধজাহাজ এসে ঘাঁটি গাড়ে কোরিয়াতে । সেপ্টেম্বরের পনেরো তারিখে জাপানী বাহিনী (এখন উত্তর কোরিয়ার রাজধানী) পিয়ং ইয়ং এর গ্যারিসন থেকে চীনা বাহিনীকে পরাস্ত করে অবশিষ্ট বাহিনীকে বের করে দেয় । পিয়ং ইয়ং এর পরাজয়ের খবর শুনে চীনারা কোরিয়া থেকে তাদের অবশিষ্ট সৈন্য প্রত্যাহার করে ইয়ালু নদীর তীরে তাদের প্রতিরক্ষা মুলক ব্যাব্স্থা গড়ে তুলতে থাকে ।
ডিসেম্বরের দিকে জাপানী সৈন্যরা কোরিয়ান উপদ্বীপ পার হয়ে মাঞ্চুরিয়ার ভিতরে লুশুংকাউ (পোর্ট আর্থার) দখল করে ফেলে । এবং শোনা যায় কয়েক হাজার বেসামরিক লোককে ১৮৯৪ সালের শেষ দিকে এই পোর্ট আর্থারে জাপানী সৈন্যরা হত্যা করে । এই শহরটির বর্তমান নাম হচ্ছে দালিয়ান । আর উপদ্বীপটির বর্তমান নাম লিয়াওদং উপদ্বীপ ।
পুরো লড়াইটাই সবগুলো ইউরোপীয় ও আমেরিকানরা খুব মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছিল । রুশদের স্বার্থটা অবশ্য এর মধ্যে সবচেয়ে তীব্র । রাশিয়ানরা সবসময়েই প্রশান্ত মহাসাগরে একটা বরফ মুক্ত এলাকায় কিছু বন্দর দখলের পাঁয়তারায় ছিল ।কোরিয়াতো বটেই জাপান যুদ্ধজয়ের ফসল হিসেবে পুর্ব মাঞ্চুরিয়া উপদ্বীপটিও হাতিয়ে নেবার পাঁয়তারা কষছিলো (শিমোনোসেকির চুক্তি নামে চীনের সাথে একটা একতরফা চুক্তিও হয়ে গেছিল কাগজে-কলমে)এমন সময় ফ্রান্স-রাশিয়া আর জার্মানী এ ত্রি-শক্তি বাগড়া দিলো । উপদ্বীপ স্হ পোর্ট আরথার বন্দরটা ছেড়ে দিতে হলো রাশিয়ার কাছে ।
জাপানীরা কোরিয়ান উপদ্বীপে ঘাঁটি গেড়ে বসায় তাদের এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের বিশেষ ব্যাঘাত ঘটেছিল । রুশরা সময় নষ্ট না করে পুর্ব মাঞ্চুরিয়ার পোর্ট আর্থার (লু শুং কাউ) একটা নৌ ঘাঁটি বসানোর কাজে লেগে পড়ল । এবং সে জন্য হার্বিন থেকে মুকদেন পর্যন্ত একটা রেললাইন বসানোর তোড়জোড়ও শুরু হয়ে গেল জোর কদমে । বছর দুই বাদে মানে ১৮৯৬ সালে রাশিয়া, চীনের উপর চাপ প্রয়োগ করে একটা ইজারার চুক্তিও করে ফেলল ।
উদীয়মান সুর্যের দেশের উদীয়মান নেতারা বিশেষ করে সমর নায়কেরা ব্যাপারটা মোটেই ভাল চোখে দেখেন নি । স্বার্থে আঘাত লেগেছে এরকম কটুভাব ছাড়াও নেপোয়ে দই মেরে দেয়াতে জাপানীরা ভীষন অপমানিত বোধ করছিল (হাজার হোক চীনকে লড়াইতে হারিয়ে ও জায়গার দখল নিয়েছিল ওরা!) । এতে প্রমানিত হলো এখনো জাপানের উপর খবরদারী করার ক্ষমতা আছে ইউরোপীয় শক্তিগুলোর । এরকম অবস্থা চিরকাল থাকবে না এই প্রতিজ্ঞা নিবে বিপুল বিক্রমে যুদ্ধজাহাজ বানাতে লেগে গেল জাপানীরা । নৌ-শক্তির উপরে কোনো শক্তি নেই তার প্রমান সব জায়গাতে পাওয়া যাচ্ছে । যেহেতু তখনও ভারী যুদ্ধজাহাজ বানানোর কৌশল জাপানের আয়ত্ব হয় নি সুতরাং ইউরোপে ফরমাশ দিয়ে বানানো হলো জাহাজগুলো । সবচেয়ে বেশী অর্ডার পেল বিলাতের ভিকার্স কোম্পানি ।
তখন ১৮৯৪-১৮৯৫ সালে যাই মনে হোক, আসলে আখেরে সাংঘাতিক মুল্য দিতে রাশিয়াকে এর জন্য !