এই দুই সম্রাট আবার সম্পর্কে জ্ঞাতি ভাই ছিলেন । আলিক্সের মতো ভিলহেল্ম ভিক্টোরিয়ার আপন মেয়ের ঘরের নাতি । রাণী ভিক্টোরিয়া তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যাটিকে প্রাশিয়ার যুবরাজ ওতৃতীয় ফ্রিডরিখের (ইংরেজিতে ফ্রেডারিক) কাছে বিয়ে দিয়েছিলেন । এতে অবশ্য রাজকীয় প্রটোকল খুব ক্ষুন্ন হয় নি ।
জন্মগতভাবে জ্যেষ্ঠতা সবসময় মেয়েদের সিংহাসনের দাবীদার করতো না (সপ্তম এডওয়ার্ড আসলে ভিক্টোরিয়ার দ্বিতীয় পুত্র) । ভিক্টোরিয়ার কন্যা (তাঁর নামও আবার ভিক্টোরিয়া!) কন্যা যখন জার্মানীতে শ্বশুর বাড়িতে আসেন তখন তাঁর শ্বশ্বুর সম্রাট প্রথম ভিলহেল্ম ফ্রিডরিখ প্রাশিয়ার সম্রাট ।
শ্বশুর সাহেব অষ্টাদশ শতকে জন্মেছিলেন । এবং মার্শাল ব্ল্যুখারের বাহিনীর হয়ে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন অল্পবয়সে । ১৮৩০ আর ১৮৪৭ এর বিপ্লব তাঁর জীবদ্দশাতেই হয়েছে । সে সময় জার্মানী বলে কোনো দেশ অবশ্য ছিল না । প্রাশিয়ার রাজারাই জার্মান রাজ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী । প্রধানমন্ত্রী বিসমার্কের কুটনীতি ও নানাবিধ ধড়িবাজির ফলে তাঁরা প্রায় সমস্ত জার্মানভাষী অঞ্চলের উপর কর্তৃত্ব আরোপ করেন (অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ার সাম্রাজ্য আর সুইজারল্যান্ড বাদে) ।
১৮৭০ সালে পুরনো প্রতিদ্বন্দ্বী ফ্রান্সকে হারানো প্রাশিয়ার জন্য সোনায় সোহাগা হয়েছে বলা যায় । ১৮৭১ সালে বিসমার্কের পরামর্শে প্রাশিয়ার প্রথম ভিলহেল্ম নিজেকে প্রাশিয়ার রাজা ও জার্মানীর সম্রাট ঘোষনা করেন ।
ভিলহেল্ম পুত্র ও ভিক্টোরিয়া জামাতা ফ্রিডরিখ বা তৃতীয় ফ্রিডরিখ অতীব সজ্জন ব্যাক্তি বলে ইউরোপময় সুবিদিত ছিলেন । তবে তাঁকে সিংহাসনে বসার জন্য সাতান্ন বছর বসে থাকতে হয়েছিল । নব্বই বছর বয়সে তাঁর বাবা পরলোক গমন করেন ১৮৮৮ সালের ৯ ই মার্চ । বিধিবাম, মসনদে মাত্র নিরানব্বই কর্মদিবস তিনি আসীন ছিলেন । এবং এর মধ্যে প্রত্যেকটি দিনই প্রাণঘাতী ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করে কেটেছে । কিন্তু তার আগের বছর নভেম্বর মাসেই ফ্রিডরিখের ল্যারিংক্সের ক্যান্সার ধরা পড়ে
ডাক পড়ল সে যুগের সেরা নাক-কান ও গলা বিশেষজ্ঞ, ব্রিটিশ ডাক্তার স্যার মোরেল ম্যাকেঞ্জির পরীক্ষায় । ম্যাকেঞ্জি, ফ্রিডরিখের গলা থেকে খানিকটা টিস্যু তুলে পরীক্ষা করে বললেন 'এ খুব সম্ভবত ক্যান্সার নয়,' এবং অপারেশান করে ল্যারিংক্স কেটে ফেলে দেবার বিরোধিতা করলেন তিনি । এই নিয়ে ফ্রিডরিখের জার্মান চিকিৎসক, বের্গমান আর ফিরখোভের খানিকটা মতবিরোধ দেখা দিলো স্যার ম্যাকেঞ্জির ।
ব্যাপারটা নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই ডাক্তারদের (এবং পারিষদদের মধ্যে) খানিকটা হাউকাউ লেগে গেল । জার্মান-ব্রিটিশের প্রতিদ্বন্দীতা (যদিও ফ্রিডরিখ ব্রিটিশ মহারাণীর জামাতা) আছেই, তার সাথে আরো যোগ হয়েছিল ক্যান্সারের মতো নিরাময় অযোগ্য কোনো রোগ নিয়ে কেউ নতুন বর্ধিত জার্মান সাম্রাজ্যের সিংহাসনে বসতে পারবে কি না ।
ফ্রিডরিখ যদি সিংহাসনে বসতে না পারেন বা উত্তরাধিকার ত্যাগে বাধ্য হন তাহলে নিঃসন্দেহে তাঁর পুত্র ভিলহেল্ম বসবেন মসনদে । এটা পরবর্তীকালে খুব পরিস্কার হয়ে উঠেছিল যে চিকিৎসক দের একটা বড় অংশ রাজনৈতিক ঘোঁট পাকানোর শরিক ছিলেন ।
ব্যাপারটা পরিস্কার হলো যখন ফ্রিডরিখের মৃত্যুর পরে জার্মান চিকিৎসকরা একটা 'প্রাক্তন সম্রাটের অসুস্থতা' বলে একটা শ্বেতপত্র ধাঁচের রিপোর্ট প্রকাশ করে ফেললেন । স্যার ম্যাকেঞ্জি বা পিছিয়ে থাকবেন কেন? তিনিও একটা পাল্টা বই ছেপে ফেললেন, এবং সেজন্য রোগীর গোপন ও ব্যাক্তিগত তথ্য প্রকাশের জন্য রয়্যাল কলেজ অভ সার্জন কর্তৃক ধাতানি খেলেন ।
মোদ্দা কথা হলো এই যে তৃতীয় ফ্রিডরিখে দুঃখজনক মৃত্যুর পরে তাঁর জেদী ও উচ্চভিলাষী পুত্র ঊনত্রিশ বছর বয়স্ক ফ্রিডরিখ ভিলহেল্ম দ্বিতীয় ভিলহেল্ম নাম নিয়ে ১৫ ই জুন ১৮৮৮ সালে গদিতে বসলেন । ঘটনাটা পৃথবীর ইতিহাসে সাংঘাতিক প্রভাব ফেলবে সোয়া শতাব্দী পরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সুচনায় । ঐতিহাসিকদের অনেকেরই ধারনা তৃতীয় ফ্রিডরিখ বেঁচে থাকলে তিনি জার্মানীকে উচ্চভিলাষী, সাম্রাজ্যবাদী সামরিকীকরণের পথে হাঁটতেন না । অন্তত তাঁর কর্মকান্ড চিঠিপত্র থেকে তাঁকে শান্ত মেজাজের দূরদৃষ্টি সম্পন্ন শাসক বলেই মনে হয় ।
আর এই দ্বিতীয় ভিলহেল্মই হচ্ছেন নিকির কাজিন "ভিলি" !
আঠারোশো উনষাট সালে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার এই প্রথম নাতিটির জন্ম । জন্মটি ছিল জটিল এক সিজারিয়ান বার্থ, কর্তব্য ডাক্তারের ফর্সেপের টানে ভিলহেল্মের বাঁ হাতটা প্রায় অচল হয়ে যায় । অচল ও কুঁকড়ে যাওয়া হাতটি ভিলহেল্ম বিশেষ ভাবে বানানো একটা পকেটে লুকিয়ে রাখতেন । নাকে রনীচের পেল্লাই গোঁফটাও হতে পারে নষ্ট হাতটা থেকে নজর ফেরানোর কৌশল । দ্বিতীয় ভিলহেল্মের যতগুলি অফিশিয়াল ছবি আছে তার কোনোটাতেই হয় বামহাতটা ভাল করে দেখা যায় না, অথবা বাঁ হাতটা কায়দা করে কোনো ছড়ি তরবারীর বাঁটে রাখা ।
অবশ্য ডানহাতে প্রচন্ড শক্তি রাখতেন জার্মান সম্রাট । যে সব অধীনস্থদের সম্রাটের সাথে করমর্দন করার দুর্ভাগ্য হয়েছে তাঁরাই বলেছেন আক্ষরিক অর্থেই বজ্রমুষ্ঠি ছিল সম্রাটের । হাতের আংটিগুলো আবার উল্টো করে মানে পাথরগুলো নীচের দিকে দিয়ে পরতেন সম্রাট যাতে হাড়ে হাড়ে হাতের চাপ টের পাওয়া যায় !
ভিলহেল্ম তাঁর কাজিনের সাথে ইংরেজিতেই লেখতে । চিঠির নীচে সই থাকতো "Your Dear Cousin Willy" . নিকিও একই ভাবে চিঠিতে স্বাক্ষর করতেন । দুনিয়াদারী সম্বন্ধে খানিকটা অজ্ঞ জ্ঞাতি ভাইটিকে নানান বিপদজনক পরামর্শ দিয়েছিলেন ভিলহেল্ম । বয়সে প্রায় নয় বছর বড় হওয়াতে মুরুব্বিয়ানা ফলাতে বেশ সুবিধা ছিল ভিলির । এগুলোর মধ্যে ছিল 'পীত বিপদ' বা ইয়েলো পেরিল সম্বন্ধে রাশিয়াকে 'সতর্ক' করা ।
'পীত' হচ্ছে এশিয়ানরা, বিশেষ করে চীন ও জাপানীদের উদ্দেশ্য করে বলা । হুঁশিয়ার না হলে এশিয়ানরা পুরো দুনিয়াটা গিলে ফেলবে । এবং এ ব্যাপারে অর্থাৎ পীত বিপদের হাত সভ্য ইউরোপকে বাঁচানোর ক্ষেত্রে রাশিয়ার একটী পবিত্র কর্তব্য আছে । আশা করা যায় কাজিন নিকি এ ব্যাপারে অবগত আছেন । একবার ভিলহেল্ম, নিকিকে একটা তৈলচিত্র পাঠালেন যাতে নিকি আর ভিলির ছবি আঁকা ছিল ।
ভিলহেল্ম লোহার বর্ম পরে দাঁড়িয়ে আছেন, নীচে বাইজান্টাইন আলখেল্লা পরা উবু হয়ে বসে থাকা নিকি প্রশংসা ও সমভ্রমের সাথে তাকিয়ে আছেন ভিলির দিকে, তাঁদের পিছনে সমুদ্রের দৃশ্য; সেখানে অনেকগুলো যুদ্ধজাহাজ ভেসে যাচ্ছে । ছবির সাথে একটা চিঠিও দিয়েছিলেন তাতে বিস্তারিত ব্যাখ্যা ছিল । নিকিকে তিনি 'প্রশান্ত মহাসাগরের অ্যাডমিরাল' মনে করেন আর নিজেকে আটলান্টিকের নৌ সেনাপতি, ছবিটা তারই প্রতিকৃতি । জাপানের দিকে নজর রাখতে হবে, আবার মনে করিয়ে দিলেন ভিলহেল্ম ।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে অক্টোবর, ২০০৭ সকাল ৮:৫৬