অনেক ব্যাপারেই তাঁরা বহুমত পোষন করতেন, তবে তার মধ্যে প্রধান ছিল মার্ক্সিয় তত্বকে কীভাবে বাস্তবের সাথে মেলাবেন । যেহেতু মার্ক্স মুলতঃ শিল্পপ্রধান পশ্চিম ইউরোপ বা আমেরিকাকেই সমাজতন্ত্র বিকাশের মডেল হিসেবে ধরেছিলেন, এবং মার্ক্সীয় দর্শনের একটা বড় উপজীব্য বিষয় হচ্ছে সমাজের দীর্ঘানূক্রমিক বিবর্তন । শিকারজীবিরা পশুচারী হয়েছে, তা থেকে তারা কৃষিজীবিতার পর্যায় অতিক্রম বানিজ্যিক যুগ পার হয়ে শিল্পায়নের দিকে এগিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি । এইখানে অনগ্রসর, পশ্চাদপদ রুশ সমাজের অবস্থানটা ঠিক কোথায়?
তাঁরা কী রাশিয়াকে শিল্পোন্নত হয়ে ওঠার সুযোগ দেবেন? নাকি এখনই কৃষককে সমাজের ভিত্তি ধরে এগিয়ে যাবেন? মার্ক্সীয় তাত্বিকদের একাংশ শহুরে শ্রমিককেই 'প্রোলেতারিয়েতের অগ্রপথিক' হিসেবে ধরেছেন । তাঁরা কী সমস্ত জনগনকে তাঁদের কাছে টানবেন? নাকি পার্টি হবে পেশাদার হার্ডকোর বিপ্লবীদের নিয়ে ? আরো একটা কথা ক্ষমতা দখলের কৌশলই বা তাঁরা কী ভাবে নির্ধারন করবেন?
উনিশশো সালেই জার্মানীর লাইপসিগ থেকে 'ইস্ক্রা' নামের বিখ্যাত পত্রিকাটি বের হতে শুরু করে । তবে এটাও আরো অনেক বিপ্লবী লিটল ম্যাগাজিনের একটা । মিউনিখ, লন্ডন আর জেনিভা থেকেও সেটার অনেক সংস্করণ ছাপা হবে । প্রথম দিকে এটার দায়িত্বে ছিলেন লেনিন আর ইলিয়া মার্তভ ।
কিন্তু মাঝখানে সম্পাদনা পরিষদের সাথে মতবিরোধ দেখা দিলে লেনিন ইস্ক্রা থেকে চলে যান ১৯০৩ সালে । এ সময়েই পরবাসী রুশ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে ভাঙ্গনটা প্রথম প্রকট ভাবে দেখা গেল । যার রেশ একশো বছর পরেও ঐতিহাসিকভাবে অনুভুত হচ্ছে ।
১৯০৩ সালের অগাস্ট মাসে ব্রাসেলস আর লন্ডনে রুশ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের কংগ্রেস বসল । এখানেই লেনিন , পার্টির সদস্যপদ কেবল পেশাদার কর্মীদের জন্য উন্মুক্ত রাকার প্রস্তাব দিলেন । লেনিনের খুব অন্তরঙ্গ বন্ধু ইলিয়া মার্তভ এ ব্যাপারে একমত হলেন যে পার্টির একেবারে ভিত্তিভুমি পেশাদার বিপ্লবীদের দিয়েই গঠিত হতে হবে কিন্তু তিনি এটাও জোর দিলেন পার্টির সদস্য পদ সকলের জন্যই উন্মুক্ত থাকা প্রয়োজন, এমন কী সমমনা দলগুলোর সাথেও সাযুজ্য থাকা প্রয়োজন ।
প্রথমে তাদের এই বিরোধটা একেবারেই সাধারন বলে মনে হয়ে ছিল । কিন্তু ফাটলটা ক্রমেই বেড়ে গেল । গেওর্গি প্লেখানভ শুরুতে লেনিনের সাথেই ছিলেন, কিন্তু তিনিও আবার পক্ষত্যাগ করলেন । দু' দলের নাম হলো বলশেভিক (সংখ্যাগুরু) বা কট্টরপন্থী আর মেনশেভিক (সংখ্যালঘু) বা উদারপন্থী ।
আরো কিছু কারন অবশ্যই ছিল যার মধ্যে একটা ছিল ইস্ক্রার পরিচালনা পরিষদে কে থাকবে সেই বিতর্ক । ওই সময়েই লেনিন তার "কী করতে হবে ?" (চতো দেলাত?) নামের রচনাটা লেখেন । ওই নামে নিকোলাই চের্নিশেফস্কির একটা উপন্যাস আছে অবশ্য এবং উপন্যাসটি রুশ বিপ্লবীদের অনেককই বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ করেছে বলা যায় ।
লেনিন যেটা বলে চেয়েছিলেন যে যথেষ্ট কট্টরপন্থী একটা পার্টি না থাকলে শ্রমিক শ্রেণি ট্রেড ইউনিয়ন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে । সুতরাং কেবল একটা প্রকৃত বিপ্লবী দলই পারে ' বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র' আমদানী করতে ।
১৯০৩ সালের কংগ্রেসটা ব্রাসেলসে শুরু হলেও বেলজিয়ান পুলিশ ডেলিগেটদের একটা বড় অংশকে বেলজিয়াম থেকে বহিস্কার করলে তাঁরা সব লন্ডনে জড় হন । এই সময়ে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের একটা বড় বা উল্লেখ্যযোগ্য অংশ ছিল ইহুদী ট্রেড ইউনিয়ন বা 'বুন্ডিস্ট' রা ।
একটা কথা অবশ্য মনে রাখতেই হবে এইসব জার বিরোধী বা পুঁজিবাদ বিরোধিতায় ইহুদীদের ভুমিকাটা ছিল উল্লেখযোগ্য । নিপীড়িত সংখ্যালঘু হিসেবে যে কোনো বিপ্লবী কর্মকান্ডে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহন বা ভুমিকা থাকবে এটা খুব অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার নয় ।
কংগ্রেসের ভোটাভুটিতে লেনিনের হার্ডলাইনার দের পক্ষেই বুন্ডিস্ট দের একটা বড় অংশের ভোট পড়ে । তবে সম্প্রদায়গত দৃষ্টিভঙ্গী থেকে এটাকে বিচার করলে ভুল হবে । কারন লেনিনের প্রতিপক্ষদের ইলিয়া মার্তভ (আসল নাম ইউলি ওসিপোভিচ সেদেরবাউম) ও লিওন ত্রতস্কি (লিওন দাভিদোভিচ ব্রনস্তাইন) ও ও অন্তত জন্মসুত্রে ইহুদী ছিলেন ! বুন্ডিস্টদের ভোটেই 'বলশেভিক' বা সংখ্যাগুরু নাম নেয় হার্ডলাইনাররা । বাস্তবে তাদের সংখ্যাটা অত বেশি ছিল না ।
সে যুগের ইংরেজি প্রকাশনায় বলশেভিকদের 'ম্যাক্সিমালিস্ট' আর মেনশেভিকদের 'মিনিমালিস্ট' বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে বেশ কিছু জায়গায় । আসলে দুটো নামই খানিকটা বিভ্রান্তিকর ও ভুল । বলশেভিকরা শুরুতে সংখ্যায় কম ছিল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত তাদের সংখ্যাটা বলা যায় স্থিতিশীল ছিল । তারপরে বেড়ে যায় । সত্যি বলতে কী সতেরো সালের বিপ্লবের পরে এসব শব্দের অর্থই পুরো পাল্টে গেছে বলা চলে ।
এ সব অবশ্য সমস্ত প্রবাসী আন্দলনের অবশ্যাম্ভাবী ফল । বিদেশের মাটিতে, তাও এতো গুলো ভিন্ন দেশে বসে পার্টি চালাতে গেলে আরো ভাঙন মনে হয় প্রাপ্য ছিল । আদর্শিক শুচিবায়ুতার কথা না হয় নাই বললাম ।
কিন্তু এসব ভাঙনের চেয়ে তাঁরা যে ব্যাপারটা আরো বেশি ভয় করতেন সেটা হচ্ছে পার্টির ভিতরে জারের গুপ্ত পুলিশ বা 'ওখ্রানা' র অনুপ্রবেশ । ডানপন্থী-বামপন্থী, উগ্রপন্থী-নরমপন্থী সবার উপরেউই কড়া নজরদারীর ব্যাবস্থা রেখেছিল রুশ সরকার । বেশ কিছু টাকা খাওয়া এজেন্ট এগুলোর মধ্যে যাকে বলে সেঁধিয়ে গিয়েছিল অত্যন্ত সফলভাবে । জারের বেশ কিছু পেটোয়া সংস্থাও ছিল যারা বিপ্লবের নাম ভাঁড়িয়ে বিভেদ আর কেলেংকারী ঘটাতো ।
এসব কিছুর প্রধান ছিলেন কর্নেল সের্গেই জুবাতভ (১৮৬৪-১৯১৭) । জুবাতভ অল্প বয়সে আবার বিপ্লবী ছিলেন , পরে কোর্তা বদল করেন । জুবাতভের একটা গুন ছিল যে মাঝে মাঝে তিনি ইন্টারোগেশনের সময়ে বিপ্লবীদের ডাবল এজেন্ট হিসেবে কাজ করাতে রাজী করাতে পারতেন ।
এবং তিনি সত্যিই বিশ্বাস করতেন যে শুধু নিপীড়নে মানুষের বিপ্লব দমন করা যাবে না । সরকারপন্থী কিছু ট্রেড ইউনিয়ন থাকলে তারা অনেকটা ক্ষোভ প্রশমন করতে পারবে । বিপ্লবী মহলে জুবাতভের ইউনিয়নগুলোর নাম হয় 'পুলিশ ইউনিয়ন' ।