অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার একসপ্তাহ পরে নিকোলাস আর আলেকজান্ড্রার বিয়ে হলো, দিনটা নিকোলাসের মায়ের জন্মদিন ছিল তাই প্রটোকল অনুযায়ী শোকপ্রকাশ খানিকটা শিথিল করা গিয়েছিল । পরিবারের মহিলারা আলিক্সকে সাজালেন পুরনো ধাঁচের একটা রুপার ব্রোকেডের পোশাকে । তারপরে সম্রাজ্ঞী মারিয়া আলিক্সের মাথায় পরালেন কনের মুকুট । সেখান থেকে তাঁরা হেঁটে গেলেন শীত প্রাসাদে, সেখানে অশ্বারোহী হুসার সৈনিকের উর্দি পরে নিকোলাস অপেক্ষা করেছিলেন । জ্বলন্ত মোমবাতি হাতে বিয়ে করলেন তাঁরা, কোনো অভার্থ্যনা বা পানভোজনের বন্দোবস্ত ছিল না, হানিমুনেরও কোনো কথা ওঠেনি । তাঁরা সোজা মারিয়ার আনিচকভ প্রাসাদে ফিরে এলেন স্বামী-স্ত্রী হিসেবে ।
অনেক কিছুই গোলমাল হয়েছিল তাঁদের জীবনে । কিন্তু বিয়েটা না, সেটা ছিল একেবারে আদর্শ ভিক্টোরিয়ান পরিণয়, টিকে ছিল তাঁদের জীবনের একেবারে শেষ দিন পর্যন্ত ।
প্রথম শীতটা তাঁরা আনিচকভ প্রাসাদে কাটিয়েছিলেন । পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যের অধীশ্বর নিকোলাস, সেখানের একটা ছোট বৈঠকখানা থেকে সাম্রাজ্যের সমস্ত কাগজপত্র দেখতেন, পাশের শোবার ঘরে নতুন সম্রাজ্ঞী আলিক্স রুশভাষা মকশো করতেন । খাওয়ার টেবিলে সম্রাট-মাতা মারিয়া অত্যন্ত উদার হাতে নিকোলাসকে পরামর্শ দিতেন । ব্যাপারটা যে আলিক্সের পছন্দ হচ্ছে না সেটা তিনি আমলেই আনতেন না ।
শোক পর্ব শেষ হতেই মারিয়া আবার তাঁর উৎসবের হৈ-হুল্লোড়ে মেতে উঠেছিলেন । রুশ দরবারের রেওয়াজ অনুযায়ী সম্রাট-মাতা, সম্রাট-পত্নীর থেকে বেশী মর্যাদা পাবেন । দেখা যেত মহামুল্যবান হীরে-জহরতে শোভিত হয়ে সম্রাজ্ঞী মারিয়া ছেলে নিকোলাসের হাত ধরে চলেছেন । আর পিছনে কোনো গ্র্যান্ড ডিউকের হাত ধরে গোমড়া মুখে আলেকজান্ড্রা । বউ-শ্বাশুড়ির বিবাদ শিগগীরই তুঙ্গে উঠল ।
মারিয়া বুঝেই উঠতে পারতেন না কেন আলিক্স শ্বাশুড়ির ভুমিকায় অসন্তুষ্ট হচ্ছে । হীরে-জহরতের ব্যাবহার নিয়ে ঝগড়াটা লাগল এর পরে । কিছু কিছু মহামুল্যবান রত্ন পাথর ছিল রোমানভ পরিবারে যেগুলো কেবল জারিৎসারাই ব্যাবহার করতেন বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে । কিন্তু সেরকম একটা উপলক্ষ্যে সেগুলো চাইতেই মারিয়া জানালেন সেগুলো তিনি দেবেন না । চটে গিয়ে আলিক্স জানালেন সেগুলোর দরকার নেই তাঁর । একটা কেলেংকারি ঘটার আগেই অবশ্য মারিয়া সেসব অলংকারের উপর দাবী ছাড়লেন ।
তবে মারিয়া কোপেনহেগেনে বাপের বাড়িতে যেতে গৃহবিবাদ কিছুটা কমে এল । এবং জানা গেল আলিক্স অন্তস্বত্বা । সুতরাং সেইন্ট পিটার্সবুর্গ ছেড়ে পনেরো মাইল দূরে জারস্কোয়ে সেলোতে নিকোলাস আর আলেকজান্ড্রা তাঁদের নতুন বাড়ি (বা প্রাসাদ) সাজাতে লাগলেন । শুনে মারিয়া বিরাট এক চিঠি লিখলেন । মনে হলো সব মনোমালিন্য মিটমাট হয়ে গেছে ।
তাঁরা আশা করেছিলেন অন্তত প্রথম সন্তানটি ছেলে-জারেভিচ হবে । কিন্তু অত্যন্ত একটা প্রসবের পরে জন্ম নিল প্রথমা কন্যা ওলগা নিকোলায়েভনা । সেটা নিয়ে খুব একটা ভাবলেন না তাঁরা এখনো অনেক সময়ে আছে ছেলে জন্ম দেবার !
অবশেষে আনুষ্ঠানিক শোক পালনের একবছর পুরো হলো । আনুষ্ঠানিকভাবে নিকোলাসের অভিষেকের সময় হয়ে এলো । এরকম একটা ব্যাপার কোনো অবস্থাতেই পশ্চিমা ভাবধারার সেইন্ট পিটার্সবু্র্গে অনুষ্ঠিত হতে পারে না । মস্কোই হচ্ছে অভিষেকের জায়গা । তবে নিয়ম হচ্ছে অভিষেকের ঠিক আগের দিন পর্যন্ত নতুন সম্রাট মস্কোতে পা রাখতে পারবেন না । নিকোলাস আর আলেকজান্ড্রা তাই শহরের সীমানার ঠিক বাইরে একটা আশ্রমে জায়গা নিলেন সেখানে তাঁরা প্রার্থনা আর উপবাসে সময় কাটাচ্ছিলেন ।
অভিষেকের দিন পুরো চার মাইল পথ দুই সারিতে সৈন্যরা দাঁড়িয়ে ছিল জনতার ভীড় ঠেকাতে । । সোনালী শিরস্ত্রাণ পরা ইম্পেরিয়াল গার্ডরা ছিল সবার সামনে তারপরে ছিল কসাকরা, তাদের পিছনে একটা শাদা ঘোড়ায় চড়ে নিকোলাস মস্কোতে প্রবেশ করলেন । পিছনে একটা খোলা কোচগাড়িতে করে এলেন সম্রাট মাতা মারিয়া তারপরে আলিক্স, তারপরে গ্র্যান্ড ডিউকের দল, তারপরে অন্যান্য অভিজাতের দল, তারপরে দরবারের কর্মচারীরা । তারপরে এল সম্রাটের নিজস্ব অর্কেস্ট্রা, এবং আরো সৈন্য সামন্ত । একটা বাড়ির ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে নিকির পুরনো প্রেমিকা মাতিলদা ক্সেচেসিনস্কায়া, পুরো শোভাযাত্রাটাই দেখছিলেন ।
পরদিন খুব ভোরে উঠলেন তাঁরা । আলিক্সের চুল যখন একজন হেয়ারড্রেসার বাঁধছে তখন পাশে একটা টুলে বসে নিকি, আলিক্সের কর্তব্য বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন । বেশ কয়েকবার মুকুট পরানোর মহড়া নেয়া হলো । এবং তা করতে গিয়ে আলেক্জান্ড্রার মাথা জখম হলো খানিকটা । কারন মুকুটটার নীচে একটা হীরে চিরুনী মতো জিনিস ছিল চুলে আটকানোর জন্য । সেটা সোজা মাথার চামড়া ভেদ করে সেঁধিয়ে গিয়েছিল ।
অভিষেক হলো মস্কোর উস্পেনস্কি ক্যাথিড্রালে । কয়েক হাজার মোমবাতির আলো পড়ে স্বর্ণখচিত বেদী ঝলসাচ্ছিল । সমস্ত হোমড়া-চোমড়ারা বসে ছিলেন গির্জা আলো করে । অভিষেক চলল পুরো পাঁচ ঘণ্টা ধরে এবং একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল । গির্জার মাঝের পথ ধরে যখণ নিকোলাস হেঁটে যাচ্ছিলেন তখন তাঁর কাঁধ থেকে অর্ডার অভ সেইন্ট অ্যান্ড্রু এর স্মারক চেইনটা ছিল তা খুলে মাটিতে পড়ে গেল । খুব কাছের লোকেরাই সেটা খেয়াল করেছিল এবং তাদেরকে শপথ করিয়ে নেয়া হলো যে এব্যাপারে তাঁরা কখনো মুখ খুলবেন না । এরপরে নয় পাউন্ড ওজনের জারের মুকুট পরিয়ে দেয়া হলো নিকোলাসের মাথায় ।
বাইজান্টাইন দু'মাথা ঈগল খচিত আলখেল্লা গায় দিয়ে অভিষিক্ত সম্রাট ও সম্রাজ্ঞী গির্জা ত্যাগ করলেন । সার বাঁধা কামান থেকে তোপধ্বনি করা হলো, মস্কোর সব গির্জার ঘন্টা বাজতে লাগল, ক্রেমলিনের ঘণ্টা অবশ্য সব ঘণ্টার আওয়াজকে ছাপিয়ে গেল । সে রাতে সাত হাজার লোককে ক্রেমলিনে নেশভোজে আপ্যায়িত করা হয়েছিল । সেখানে জাঁকালো পোশাক আশাক পরা লোকজনের ভীড়ে খুব সাধারন চাষীর পোশাক পরা কিছু লোকও ছিল । তারা সব ইভান সুসানিন নামে এক ভৃত্যের বংশধর । তিনশো বছর আগে সুসানিন আক্রমণকারী পোলিশ সৈন্যদের অত্যাচারেরমুখেও বলে দেয়নি প্রথম রোমানভ জার মিখাইল কোথায় লুকিয়ে আছেন । এরপর থেকে সমস্ত অভিষেকেই সুসানিনের বংশধরদের ডাক পড়ে ভোজে ।
সে দিন বিকেল থেকেই মস্কো ক্রেমলিনের হলঘরে অতিথিদের এক এক করে স্বাগত জানাচ্ছিলেন নিকোলাস আর আলেকজান্ড্রা । নয় পাউন্ড মুকুটের ভারে (প্রায় চার কেজির উপরে) নিকোলাস মাথা ব্যাথা হচ্ছিলো সাংঘাতিক কিন্তু ট্র্যাডিশন তো অভিষেকের দিন ভাঙ্গা যায় না ! অভিজাত অভ্যাগতরা রাতের নাচের আসর পর্যন্ত ছিলেন, তাঁরা জাঁকজমক তো কিন্তু সে রাতে রাজ পরিবারের মণি-মানিক্যএর বহর দেখে তাঁদেরও চোখ ট্যাঁরা হয়ে গিয়েছিল । নিকোলাসের বোন জেনিয়া আর আলেকজান্ড্রার বোন এলিজাবেথ (এলা নামেই বেশী পরিচিত) তো আগাগোড়াই মহামুল্য পান্নায় ঢাকা ছিলেন, নিকোলাস একটা ব্রোঞ্জের কলার পরেছিলেন তাতে ঝাঁকে ঝাঁকে হীরে বসানো ছিল ।
বড় দুর্ঘটনাটা ঘটল পরের দিন ।
পরদিন মস্কোর সাধারন লোকদের গণহারে আপ্যায়িত করার কথা ছিল । এসব কাজের জন্য শহরের খোদিনকা মাঠটাকেই (খোদিনস্কোয়ে পোলে) ব্যাবহার করা হতো । পরবর্তীকালে এখান থেকে রাশিয়ার প্রথম এরোপ্লেন উড়বে ও এয়ারপোর্ট তৈরী হবে । মাঠটা আবার সে সময়ে সৈন্যদের মহড়ার জন্যও ব্যাবহার করা হতো, সেজন্য আড়াআড়িভাবে মাঠটা জুড়ে কাটা হয়েছিল অনেকগুলো ট্রেঞ্চ । সেগুলোর উপরে কাঠের পাটাতন ফেলে সমান করে শামিয়ানা টাঙ্গানো হয়েছিল । কয়েকশো বা হাজার ব্যারেল বিয়ার আনা হয়েছিল আপ্যায়নের অংশ হিসেবে । । বলা হয়েছিল সম্রাটের প্রতীক ছাপ মারা এনামেলের মগও নাকি সেই কাঙ্গালী ভোজে বিনামুল্যে বিলি করা হবে !
এবং ধারনা করা যায় যখন সেসব স্যুভেনির মগভর্তি ঘোড়ার গাড়িগুলোর সব একেক করে মাঠের আরেক প্রান্তে জড় এসে পৌঁছাচ্ছিল তখন সেই ভোরবেলাতেই প্রায় পাঁচলাখের মতো মানুষ সেখানে বিনা-পয়সার গণভোজে এসে অপেক্ষা করছিল (কেউ কেউ তখনই মাতাল!) ।
অশুভ গুজবটা ছড়িয়ে পড়ল মাঠময়, কেবল যারা সবার আগে থাকবে তারাই নাকি মাগনা বিয়ারে গলা ভেজাতে পারবে!
ব্যাস পড়ি কী মরি বলে দৌড়াতে শুরু করল হাজার হাজার মানুষ, কিছু লোক অবশ্য না বুঝেই দৌড়েছিল । জাঁদরেল কসাক রক্ষীরা পর্যন্ত কিছু করতে পারল না এই উন্মত্ত জনতার স্রোতের সামনে । মড় মড় করে ভেঙ্গে পড়তে লাগল ট্রেঞ্চের উপরে পাতা পাটতনগুলো, যারা পরিখায় পড়ল, তাদের উপর আবার হুমড়ি খেয়ে পড়তে লাগল তাদের পিছনে থাকা মানুষগুলো । আর মহিলা আর অল্পবয়সীরা পিষ্ট হতে থাকল সব জায়গাতে । যখন হুল্লোড় থামল দেখা গেল খোদিনকা মাঠ যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে গেছে । ছ'সাতশো মানুষ মরে পড়ে আছে ট্রেঞ্চগুলো জুড়ে, কয়েক হাজার আহত । সেদিন দুপুরে মস্কোর সবকটা হাসপাতাল আর মর্গ ভরে উঠল হতাহতের মিছিলে ।
নিকোলাস যখন শুনলেন কী হয়েছে তখন মুখ ফস্কে বলে ফেলেছিলেন 'এর চেয়ে তো আমার সম্রাট না হওয়াই ভাল ছিল!' এবং তাঁকে যখন জানানো হলো আজরাতে ফরাসী রাষ্ট্রদুত আরেকটি নৈশভোজ ও নাচের আসরের আয়োজন করেছেন, তখণ তিনি বললেন তিনি আজ কোনো মঠে গিয়ে সারাদিন প্রায়শ্চিত্তের জন্য উপবাস আর প্রার্থনা করবেন । কিন্তু নিকোলাসের মুরুব্বীরা বোঝালেন এতে একটা 'নিছক দুর্ঘটনাকে' বেশী গুরুত্ব দেয়া হবে । আর ফ্রান্স, রাশিয়ার খুবই গুরুত্বপুর্ণ মিত্র, তাকে কী এরকম কারনে 'চটানো' ঠিক হবে?
নিকোলাস নাচের আসরে গেলেন, এবং শাসনকালের প্রথম বড় ভুলটা করলেন । 'রোম যখন পুড়ছিল তখন নিরো তখন বেহালা বাজাচ্ছিলেন (বাঁশি নয়!) ।' ঐতিহাসিকরা বলেন প্রবাদটা নাকি সত্যই নয়, বদমাশ নিরো নাকি তখন রোমের অনেক দূরে ছিলেন । কিন্তু আসল কথাটা হচ্ছে মানুষ কী মনে করে তাই । মস্কোর হাসপাতালে যখন হাজার হাজার লোক কাতরাচ্ছে তখন তাঁরা নৈশভোজ ও বল নাচে যোগ দিয়েছেন কথাটা পরদিন সকালেই ছড়িয়ে পড়ল । আলেকজান্ড্রা কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছিলেন এবং অনুষ্ঠান একেবারেই জমেনি ।
অনেক রুশই ভাবল এরকম একটা দুর্ঘটনা দিয়ে শুরু হলো বলে নিকোলাসের শাসন আমলটা খুব ভাল যাবে না, লক্ষণ সব অশুভ! আর আরো একটা জিনিস জানা গেল যে তরুন জার এবং তাঁর বিয়ে করে আনা 'জার্মান মেয়েমানুষ' টা খুবই হৃদয়হীণ ও অবিবেচক । এমন বিপর্যয়ের পরেও তারা পান-ভোজন-নাচে ব্যাস্ত থাকে!
শুধু গণতন্ত্রে নয় স্বৈরতন্ত্রেও মানুষের কী ভাবে সেটা কিন্তু খুব গুরত্বপুর্ন!