তবে শুধু নিকোলাসের জন্যই যে তাঁদের চিন্তা ছিল তা নয় । নিজেদের পারিবারিক ভবিষ্যতও তাঁরা ভাবছিলেন । রাজাদের বিয়ে মানে সিংহাসনের ভবিষ্যত দাবীদারের পথ নিষ্পন্ন করা । তাঁরা জনগনের মালিক হতে পারেন কিন্তু কিছু কিছু কাজ করতে তাঁদের নিজের বলতে খুব কমই স্বাধীনতা ছিল ।
আসলে নিকোলাসের বাবাও ভাবেন নি যে তিনি সম্রাট হবেন । সেই জন্য দ্বিতীয় আলেকজান্ডার, তৃতীয় আলেকজান্ডারের শিক্ষা দীক্ষার জন্য তেমন একটা গা করেন নি । তাঁকে স্রেফ একজন গ্র্যান্ড ডিউক পর্যায় কাজ করার মত শিক্ষা দেয়া হয়েছিল । আর নিকোলাসের বড় ভাই খুব ছোটবেলায় মারা না গেলে নিকোলাসও সিংহাসনের দাবিদার হতে পারতেন না । এই সব সে যুগে ছিল খুব প্রচলিত একটা ব্যাপার ।
মানুষের আয়ু ছিল কম, রাজা-রাজড়ারাও অল্পবয়সে দুম করে দুনিয়ার পাট চুকিয়ে চলে যেতেন ডিপথেরিয়া-কলেরা-টাইফয়ডের মতো অসুখে । তাই বর্তমান তৃতীয় বিশ্বের লোকদের মত বিয়ে ও (পুত্র) সন্তান পাগল ছিলেন তাঁরা । সন্তান থাকা মানে সিংহাসন ও নানান সম্পত্তি ও খেতাবের উপর দাবিদাওয়া পোক্ত হওয়া ।
মাতিলদাকে যে বিয়ে করা যাবে না সেটা শুরুতেই নিকি বুঝেছিল । অভিজাত পরিবারের, নিদের পক্ষঢ ডিউকের কন্যা সম্রাটের জন্য উপযুক্ত সঙ্গী । কনের পরিবারের সাথে আবার রাশিয়ার পুর্ব শত্রুতা থাকলে চলবে না । কনেকে অর্থোডক্স ধর্মে দীক্ষান্তর নিতে হবে, এবং এই বিয়েতে যেন রাশিয়া যৌতুক হিসেবে কিছু 'কৌশলগত মিত্র' পায় শ্বশুরবাড়ির দেশে । সেক্ষেত্রে পছন্দ করার স্বাধীনতা কমে যাচ্ছে স্বাভাবিকভাবেই ।
নিকোলাসের যখন ষোলোবছর বয়স, তখন কাজিন সের্গেইএর বিয়েতে যোগ দিতে গিয়ে বারো বছরের একটি সোনালীচুলো কিশোরীর সাথে দেখা হয় তার । জানা যায় যে সে হচ্ছে সের্গেইএর কনে জার্মানীর হেস-ডার্মস্টাটের গ্র্যান্ড ডিউকের কন্যা প্রিন্সেস এলার বোন, প্রিন্সেস আলিক্স, বা অ্যালিকি । ভিক্টোরিয়ার মেয়ে প্রিন্সেস বিয়াট্রিস, আলিক্সের মা । আলিক্সকে মহামুল্য একটা ব্রুচ উপহার দিয়েছিল কিশোর নিকোলাস । আলিক্স সেটা হাতে নিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে আবার নিকোলাসের হাতে গুঁজে দেয় । দেখে ভারী রাগ হয়েছিল নিকি, মেয়েকে পটানো তো সহজ নয় !
সে যাইহোক , আজব দেশের অ্যালিসের (আলিক্স, অ্যালিসের জার্মান উচ্চারণ) মতোই মেয়েটা নিকির মাথার মধ্যে রয়ে গেল । মাঝে মাঝেই বাপ মাকে সে জ্বালাতো 'বিয়ে করলে আলিক্সকেই করব!' বলে । শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতেন তৃতীয় আলেকজান্ডার আর মারিয়া ফিওদরভনা । আলিক্সকে তাঁরা দেখেছেন এবং পুত্রবধু হিসেবে মোটেই পছন্দ করেননি । ভিক্টোরিয়ার নাতনি হতে পারে সে, কিন্তু সে একেবারে মফস্বলের রাজকুমারী (হেস-ডার্মস্টাট, জার্মানির সবচেয়ে ক্ষুদে করদ রাজ্যগুলোর একটা ছিল), আর না সেটাও না । মেয়েটা উমম..কী বলে...মাথা..ঠিক তাও নয় মানে একটু হিস্টিরিয়ার ছোঁয়া আছে ।
আলিক্সের চলন-বলনও ঠিক সুবিধার নয় । খুব বেশী ইন্ট্রোভার্ট, ভয়াবহ ফরাসী উচ্চারন (সে সময়ে রুশদেশের ও ইউরোপের অনেক দেশেরই রইস আদমীরা ফরাসীতে বাতচিত করতেন), পোশাক-আশাকের উপর খুব ভাল ধারনা নেই (কোনো প্রিন্সেস, ফ্যাশন দুরস্ত হবেন না সেটা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ) । নিন্দুকেরা বলে থাকে আলিক্স নাকি খুব অহংকারীও! লাজুক লোককে সবাই ভুল বোঝে, বিশেষ করে যখন তার উপর অনেক সামাজিক দায়িত্ব থাকে ।
তৃতীয় আলেকজান্ডার, ছেলের জন্য ফ্রান্সের সিংহাসন চ্যুত রাজার কন্যা ইলেনকে বাছাই করেছিলেন । কিন্তু ফরাসী প্রিন্সেস ধর্মান্তরে ক্যাথোলিক বিশ্বাস ত্যাগ করতে না চাওয়াতে সম্পর্ক ভেঙ্গে গেল । এর পরে । এরপরে প্রাশিয়ার প্রিন্সেস মার্গারেট, (ভিক্টোরিয়ার আরো একটি নাতনি) সাথে সম্বন্ধ এল, নিকোলাস জানালো এ বিয়ে করার চেয়ে সন্ন্যাসী হওয়াটা তার জন্য অনেক বেশী পছন্দের । সুতরাং আবারো আলিক্স ।
অষ্টাদশ শতকের আগে প্রায় সমস্ত রুশ জার তাঁদের নিজেদের দেশের অভিজাত সম্প্রদায় (বয়ার) থেকে কনে বেছেছেন । বিদেশী 'ধর্মচ্যুত' দের মধ্যে নিজেদের সম্বনধ খোঁজেননি । পিটারই প্রথম নিজের ছেলের জন্য জার্মানির ব্রুন্সভিক-ভোলফেনবুটেল বংশের প্রিন্সেস শার্লটকে পছন্দ করেন । তারপর কালে কালে অনেক জার্মান রাজকুমারী এসেছেন রোমানভ রাজবংশের পুত্রবধু হিসেবে । দু'জন অবশ্যই নিজেরাই সম্রাজ্ঞী বনে গেছেন ।
তখন জার্মানী শতধা বিভক্ত ছিল ছোট-বড় নানান রাজ্যে । প্রাশিয়া (প্রয়সেন) অবশ্য একটা উল্লেখ করা মত রাষ্ট্র ছিল তবে তখনো তা রাশিয়ার প্রতি হুমকি হয়ে ওঠেনি । ফরাসীরা রুশদের খুব একটা পাত্তা দিত না আর ফরাসী বিপ্লবের পর তাদের নিজেদের গদিই এমন টলমলে হয়ে যায় যে ফরাসী বংশে বিয়ে করে খুব একটা ফায়দা ছিল না ।
আর জার্মানদের সাথে দুনিয়ার রাজা-রাজড়ার আত্বীয়তা ছিল । ১৭১২ সালে ইংল্যান্ডের রানী অ্যান, নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেলে তাঁর এক দূর সম্পর্কের আত্বীয় জার্মানির হ্যানোভারের ডিউক, জর্জ (গিওর্গ) কে এনে সিংহাসনে বসায় । ফলে লতাপাতায় অনেক ক্ষুদে জার্মান রাজকুমার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যেতে থাকেন ।