আজকাল কোন গান জনপ্রিয় হয়ে গেলে সেই গানের গীতিকারও সুরকার হয়ে যান অনেকেই।
আসল গান হয় বিলুপ্ত নকল গানের ভিড়ে।
অনেক শিল্পিরা গান গায় অথচ গীতিকারের ধার ধারে না।
একজন গীতিকার কত কষ্ট করে একটা গান লিখলো হয়তো একটি গান লিখতে রাতের পর রাত চলে যায়।
অথচ শিল্পী এবং সুরকাররা গানের বারটা বাজিয়ে ছারে।
ইচ্ছে মতো গানের লাইনের সংযোজন, কর্তন করে।
গান শুনলে বুঝার উপায় নেই গানের আসল গীতিকার কে ?
আর যদি গীতিকার বেশ পুরোনো দিনের হন তাইলেতো কথাই নেই
ঘরে ঘরে সেই গানের দাবীদার।ওই রকম একটি বহুল জনপ্রিয় গান
এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া
এত যত্নে গড়িয়াছ সাঁই।।
সেই রেডিওর যুগ থেকে গানটি পৌঁছেছে বাংলার ঘরে ঘরে।
তবে আসল রূপে নয় নকল রূপে।যা আমরা শুনেছি তা আমাদের শুনার ভুল ছিলো না
বরং কিছু মানুষের প্রচার ভুল ছিলো।
যদি বলি গানটির গীতিকার সুরকার কে ছিলেন
তাইলে নিশ্চিত ভাবে বলা যায় শতকে একজন ও বলতে পারবে না।
গানটিকে সর্বশেষ জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে শ্রদ্ধেয় আব্দুল আলিমের ভূমিকা অপরিসীম।
তবে সম্মান রেখেই বলতেছি তিনি গানের চরনগুলোর ইষৎ পরিবর্তন করে গেয়েছেন
যা এই গুনীর কাছ থেকে আমরা আশা করি নি।
সব থেকে বড় কথা হলো তিনি এই গানটিকে সংগ্রহ হিসাবে উল্লেখ করেছেন।
গানে গীতিকারের নাম বাদ দিয়ে।
অথচ এই গানের গীতিকার কোন ফুটি মাছ নয় যে তার নাম গোপন রাখলেই গোপন থাকবে।
তিনিতো ছিলেন বাউল সাধকদেরও সাধক বাউল কবি রশিদ উদ্দিন।
যিনি নেত্রকোনা জেলায় জন্মগ্রহন করেন ১৮৮৯ সালে।
এই গানটি তৎকালীন সময় অনেক বাউল কবি গেয়েছেন যাদের মধ্যে তার শিষ্যরাও ছিলেন।
যেমন বাউল উকিল মুন্সি,জালাল উদ্দিন খাঁ,শাহ আব্দুল করিম,মজিদ তালুকদার সহ অনেকেই।
তাঁরা প্রত্যকেই গানটাকে রশিদ উদ্দিনের বলেছেন।
উকিল মুন্সি বয়সের দিক দিয়ে রশিদ উদ্দিনের বড় হলেও তাঁর মাধ্যমেই বাউল জগতে প্রবেশ ।
বাউল কবি রশিদ উদ্দিনের গান বেশ দরদ দিয়ে গান বাংলাদেশের আরেক মহান শিল্পী বারী ছিদ্দিকি।
কথা প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলতেছি তা হলো * আমার সুয়া চান পাখি * গানটা হুমায়ুন আহমেদ স্যার
তার চলচিত্রে ব্যাবহার করেছেন অথচ রশিদ উদ্দিনের নাম বাদ দিয়ে।
আবার অনেক লোক সঙ্গীত গবেষকেরা গানটাকে উকিল মুন্সির বলে চালিয়ে দেন।
কিন্তু আসল সত্য গানটা বাউল সাধক রশিদ উদ্দিনের।
এই মহান বাউল সাধক ১৯৬৪ সালে ইন্তেকাল করেন।তাঁর রচিত গানের সংখ্যা কয়েক হাজার।
রশিদ উদ্দিনের মৃত্যুর পর
এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া
এত যত্নে গড়িয়াছ সাঁই।।
গানের গীতিকার ও সুরকার হিসাবে আরেকজনের নাম প্রচার হয় তিনি ওস্তাদ মমতাজ আলী খান।আমার যতটুকু ধারনা তিনিই মনে হয় গানের চরন গুলোর এতবেশী কর্তন করেছেন।গানের চরন কেটে দিয়ে ইচ্ছেমত কেউ নিজের মত সংযোজন করলে গীতিকার হওয়া গেলে ঘরে ঘরে গীতিকার পাওয়া যেতো।যাই হোক আমরা কাউকে মহান করতে গিয়ে কাউকে ছোট করতে চাই না।তাই প্রতিটা গান যেনো সঠিকভাবে গীত হয় এবং সঠিক গীতিকার ও সুরকার যেনো সঠিক সম্মানটুকু পায়।
* গানের আসল বাণী *
এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া
এত যত্নে গড়িয়াছ সাঁই।।
কার সঙ্গে যুক্তি করে গড়িলে সংসার
বেদেরগঞ্জে গিয়া আমি পাইলাম না কিনার
তুমি সাকার, তুমি নিরাকার
তুমি বিনে আর কেহ নাই।।
ছায়াবাজি কইরে বানাইয়া মানুষ
যেমনি চালাও তেমনি চলে
পুতুলের কী দোষ
তোমার হাত ছেড়ে দিলে থামিয়া যাই।।
তুমি ধর্ম, তুমি কর্ম, তুমি কর্ণকার
তোমার কর্ম তুমি কর, কেন আমরা গোনাহগার
তোমার ইচ্ছায় চলিছে সংসার
তুমি খাওয়াইলে, আমরা খাই ।।
তুমি বেহেস্তী, তুমি দোজখী, তুমি ভালো মন্দো
তুমি ফুল,তুমি ভ্রমর
তুমি তাতে গন্ধ
তোমার আমার এই সম্বন্ধ দেশ বিদেশে ঘুড়ে বেড়াই।।
তুমি কখনো সিংহাসনে ধরি রাজ বেশ
কখনো ভিখারী সেজে ভ্রম নানান দেশ
তোমার রূপের পাইলাম না শেষ
জায়গা কইরাছ কোন ঠাঁই।।
রশিদ উদ্দিন বলে তোমার পাপ পূণ্যের ভার
তোমার কর্মের তুমি আবার করিবে বিচার
তোমার বেহেস্ত চাইনা,দোযখ ডরাই না
কেবল আমি তোমারে চাই।।
* গানটির পরিবর্তীত রূপ *
এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া
এত যত্নে গড়াইয়াছেন সাঁই।।
ছায়া বাজী পুতুল রূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি
পুতুলের কি দোষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি।
তুমি খাওয়াইলে আমি খাই আল্লাহ।
তুমি বেস্ত তুমি দোজখ তুমি ভাল মন্দ
তুমি ফুল তুমি ফল তুমি তাতে গন্ধ।
আমার মনে এই আনন্দ।
কেবল আল্লাহ তোমায় চাই আমি।
তুমি হাকিম হইয়া হুকুম কর পুলিশ হইয়া ধর
সর্প হইয়া দংশন কর ওঝা হইয়া ঝাড়
তুমি বাঁচাও তুমি মার।
তুমি বীনে কেহ নাই আল্লাহ,
তুমি বীনে কেহ নাই।।
গানটি যেহেতু পরিবর্তীত রূপেই অধিক জনপ্রিয় তাই অনুরুধ করবো
গানটি গাওয়ার সময় গীতিকারকে ভুলে যাবেন না।
এবং গীতিকারের নাম বাদ দিবেন না।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে অক্টোবর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:২৬