বাংলা সংস্কৃতিতে সিলেট বিভাগের অবদানের কথা লিখে বা বলে শেষ করা যাবে না।
সিলেটের প্রকৃতির পরতে পরতে যেনো মিশে আছে সাহিত্যের উপাদান।
বিশেষ করে গানের জগতে সিলেটকে লোকগানের প্রাণকেন্দ্র বলা হয়।
এখানেই জন্ম সৈয়দ শাহনুর,হাসন রাজা,রাধা রমন,শীতালং ফকির,
আরকুম শাহ,দুর্বিন শাহ,শাহ আব্দুল করিম,ক্বারী আমীর উদ্দিনের মত সংগীত জগতের মহান সাধকদের।
বলা হয়ে থাকে সিলেটের পরিবেশ গানের জন্য উপযোগী তাই প্রত্যক সিলেটিরাই গানের প্রতি দরদি।
সিলেটের অনেক গান স্থান করে নিয়েছে আর্ন্তজাতিক বিশ্বের পরিমন্ডল।
যেমন
সাধের লাউ বানাইলো মোরে বৈরাগী ।
সোহাগ চাঁদ বদনি ধনি নাচোতো দেখি।
আমি রবো না রবো না গৃহে, বন্ধু বিনে প্রাণ বাঁচে না।
আগে কি সুন্দর দিন কাঁটাইতাম ।
লোকে বলে বলে রে ঘর বাড়ি ভালা নায় আমার।
ভুমর কইয়ো গিয়া ....... ইত্যাদি।
ওই রকম একটা বিখ্যাত জনপ্রিয় গান লীলাবালি।
ওই গান শুনেন নি এই রকম বাঙ্গালি আছে বলে মনে হয় না।
মূলত বিয়ে বাড়িতে লীলাবালি গানের সমাদর হিন্দু ,মুসলিম উভয় সমাজে।
অথচ আমরা অনেকেই জানিনা গানের ইতিহাস ।
এই জনপ্রিয় গানটির জনক কে সেই ব্যাপারে নির্ভুল কোন তত্ত্ব নেই।
কেউ কেউ মনে করেন গানটা রাধা রমনের।কারন গানটা ধামাইল প্রকৃতির
অর্থ্যাৎ বিয়ে বাড়িতে ছেলে মেয়েদের ধামাইল নাচের সাথে গানটা গাওয়া হতো।
আর গানের মধ্যে ধামাইল গানের জনক শ্রী রাধা রমনের সুরের প্রভাব পরিলক্ষিত।
তবে অধিকাংশ পন্ডিনদের মতে লীলাবালি গানটি সিলেট অঞ্চলের প্রচলিত গান।
যা যুগ যুগ ধরে চলে এসেছে ।
সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় লিখিত হওয়ায় আজকাল অনেকেই গানের শব্দে কিছু পরিবর্তন করে গান।
এটা দোষের কিছু নয়।তবে সুর বিকৃত করার হিরিক কলকাতায় লক্ষনীয়ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে যা গানের প্রতি অভক্তির স্বরুপ।
লীলাবালি লীলাবালি গানটার কথার মধ্যেই প্রমাণ আছে, এটি সিলেট অঞ্চলের গান।
যেমন 'আইছইন লীলাবালি থমকি থমকি, বইছইন লীলাবালি ভালা গো।
এই যে, আইছইন, বইছইন, ভালা --এ শব্দগুলি সিলেটের আঞ্চলিক ভাষার শব্দ।
ময়মনসিংহে আইছুইন বলা হয়।
ছুইন এবং ছইন এখানে পার্থক্য আছে।
তাছাড়া বাকী শব্দ উচ্চারনেও সিলেটি উচ্চারনেই গাওয়া হয়।
উদাহরণঃকান, নাক, ... শব্দ উচ্চারনে খান, নাখ উচ্চারিত হয়।
এ গানের প্রথম লাইনের একটি শব্দ নিয়ে বেশ ভুল প্রচার হয়েছে অনেক জায়গায়।
এমনকি সিনেমাতেও।
লীলাবালি, লীলাবালি ...... যুবতী সইগো এই খালি জায়গাতে কি হবে ?
বড় যুবতী বলা হচ্ছে আজকাল। শব্দটা বড় নয়, ভরা যুবতী হবে।
যেমন ভরা যৌবন আমরা বলি। যাই হোক এটি একটি সিলেটের প্রচলিত বিয়ের গান।
লক্ষনীয়, এই গানের প্রথম অংশ একটু হালকা চটুল সূরে গাওয়া হয়, শেষ অংশ ধীর লয়ে লম্বা টানে গাওয়া হয়।
মনে হবে, বর আসার পূর্বে সখীরা আনন্দ করছে প্রথম অংশে।
আর দ্বিতীয় অংশে ধীরে ধীরে বিদায়ের করুণ সূরে গাইছে।
বেশ মজার তাইনা ।
হুমায়ূন আহমেদ স্যার লীলাবালী গানের ব্যাপারে বলেছিলেন বিয়ের গান হিসেবে ‘লীলাবালি লীলাবালি’ গানটি প্রায়ই গীত হয়।আমাদের ছবি ‘দুই দুয়ারী’ তেও গানটি ব্যবহার করা হয়েছে। গানটি গাওয়া হয়-
“লীলাবালি লীলাবালি
বড় যুবতী সই গো
কী দিয়া সাজাইমু তোরে ?”
গানের কথায় ভুল আছে। ‘বড় যুবতী’ হবে না, হবে ‘বর অযুবাতি’ । এর অর্থ- বর আসছে।
আমার ভুলের কারনে এখন অন্যরাও ভুল করছেন।
শেষে দেখা যাবে ভুলটাই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। আদি ভুলের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
আসলে এটা হুমায়ুন স্যারের একান্তই ব্যক্তিগত মত।
কারন সিলেটের কোন অতিথ পুস্তিকায় এই ব্যাপারে কোন সমর্থন পাওয়া যায় নি।
যেহেতু এই গান একটি লোকজ গান। পল্লীর মানুষের গান।
তাই এর কিছু কথার পরিবর্তন হওয়া স্বাভাবিক। এখানে আমি গানের কথা লিখে দিচ্ছি।
তবে এখন এর থেকে ভিন্ন ভাবে, চরনের আগ পিছ করে,
আঞ্চলিক ভাষার অসুদ্ধ উচ্চারন অথবা সুদ্ধ ভাষার মিশ্রনে গাওয়া হয়ে থাকে।
আমরা কাঊকে ভুল বলবো না।একে বলবো - কথান্তর বা ভিন্ন পাঠ।
( লীলাবালি গানটি নিন্মরূপ )
লীলাবালি লীলাবালি
বড় যুবতী সই গো
কি দিয়া সাজাইমু তোরে।।
হাত চাইয়া বালা দিমু , মতিয়া লাগাইয়া সইগো
কি দিয়া সাজাইমু তোরে।।
কানো চাইয়া কানফুল দিমু, পান্না লাগাইয়া সইগো
কি দিয়া সাজাইমু তোরে।।
নাক চাইয়া কেশর দিমু ,চুনিয়া লাগাইয়া সই গো
কি দিয়া সাজাইমু তোরে।।
গলা চাইয়া মালা দিমু, ফুতিয়া লাগাইয়া সই গো
কি দিয়া সাজাইমু তোরে।।
পিন্দন চাইয়া শাড়ি দিমু, ওড়না লাগাইয়া সই গো
কি দিয়া সাজাইমু তোরে।।
মাথা চাইয়া টিকা দিমু জড়োয়া লাগাইয়া সই গো
কি দিয়া সাজাইমু তোরে।।
পাও চাইয়া পাঝর দিমু, ঘুঙ্গর ও লাগাইয়া সইগো
কি দিয়া সাজাইমু তোরে।।
আইছৈন লীলাবালী থমকি থমকি
বইছৈন লীলাবালী ভালা গো
না জানি কুন ইস্কে লীলাবালী
ঘুন ঘুন সদা মাতৈন গো।
লীলাবালী লীলাবালী ভরা যুবতী সই গো
কি দিয়া সাজাইমু তোরে।
নাকর কেশরী কানের পাশা
বইছৈন লীলাবালী ভালা গো
মাথার শিতাপাটি গায়ের উড়না
বইছৈন লীলাবালী ভালা গো
লীলাবালি লীলাবালি
বড় যুবতী সই গো
কি দিয়া সাজাইমু তোরে।।
(বর্তমানে গানের চরনগুলোর আগ পিছ করে গাওয়া হয়)
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১০:১৩