বাংলাদেশের নয় বরং পুরো বাংলার জাতীয় কবি ছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
তিনি সেই কবি যার কবি হওয়ার পিছনে পরিবার, সমাজ, পরিবেশ কখনই পক্ষপাতি ছিলো না।
কারো সাহায্যে কিংবা গোলামী করে জীবনে মহান হন নাই ।
মহান হয়েছেন আপন শক্তিতে।
তাইতো এখনো চরম অবহেলিত নজরুল তার জন্মভূমিতে।
কারন কলকাতার বাঙ্গালীরা নজরুলকে রবীন্দ্রনাথের প্রতিপক্ষ মনে করে যার কারনে
তারা নজরুলকে তাদের আলোচনায় বেশী স্থান দিতে চায় না।
কবিগুরু রবী ঠাকুর নিজেও নজরুলের প্রতিভা দেখে অবাক হয়েছিলেন।বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তার বসন্ত গীতিনাট্য গ্রন্থটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন।তিনি জানতেন থাকে যদি কেউ পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যায় তাহলে সে কেবলি নজরুল।রবী ঠাকুরের ভাগ্য ভালো কারন নজরুল জীবনের শেষের প্রায় ৩ যুগ মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন যার কারনে সেই সময় বেঁচে থাকা অথবা মারা যাওয়ার মধ্যে তেমন তফাৎ ছিলো না।
বিশ্বকবি রবী ঠাকুর কবিগুরু এতে কারো কোন আপত্তি থাকাটা বোকামী তবে তিনি সম্মানের পূজারী ছিলেন।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশদের পক্ষে ছিলেন কিনা, তা নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে। তবে ব্রিটিশ বিরোধী কথা বলতে রবীন্দ্রনাথকে কখনো শোনা যায়নি। ব্রিটিশরা রবীন্দ্রনাথের উপর বেশ খুশিই ছিল। সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একদিকে ব্রিটিশদের অধীনে জমিদারী করেছেন, অন্যদিকে নজরুল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লিখে বার-বার জেল খেটেছেন।
নজরুল সত্যিকারের বাংলার কবি, তিনি সম্পদ বা টাকার কাছে নিজের লেখা বিক্রি করেননি।
রবী ঠাকুর কখনই দুই বাংলা এক হওয়ার পক্ষে ছিলেন না অথচ যুবক নজরুল ছিলেন তার বিপরীত।
যার কারনে তার কবিতা বাজেয়াপ্ত হয় তাকে কারাগারে যেতে হয়।কিন্তু কোন কিছুই নজরুলকে তার পথ থেকে সরাতে পারেনি।
রবী ঠাকুরের বিশ্বকবি হওয়ার জন্য তার লিখাই যথেষ্ট ছিলো কিন্তু তা না করে অন্যের লিখাকে রবী ঠাকুরের নামে প্রকাশ কি প্রকার ভদ্রতা।
‘একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী' নজরুলের ‘‘গানের মালা’’ গ্রন্থের সাঁইত্রিশ নম্বর গান এটি। গানের ওপরে সুরের উল্লেখ আছে বেহাগ মিশ্র-কাওয়ালী। এতো কিছুর পরও গানটি রবীন্দ্র সঙ্গীতের ঝুলিতে ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। রবীন্দ্র সঙ্গীত হিসাবে গাওয়াও হয় নজরুলের এই গানটি।
নজরুল জীবিত অবস্থায় তার অনেক গান রবী ঠাকুরের গান বলে চালিয়ে দেয়ার বিরোধীতা করেছিলেন।
আমাদের জাতীয় সংগীত রবী ঠাকুরের নিজের তৈরি করা সুর ছিলো না, তবে কথাগুলা হয়তো তাঁর ছিলো।অথচ রবী ঠাকুর ঐ গানের ইতিকথায় একবিন্দুও আলোকপাত করেননি সোনার বাংলা গানের প্রকৃত আসল ইতিহাস।আজ কাল অনেকেই জানেন আমার সোনার বাংলা গানটার সুর এবং কথা নকল করেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ কুষ্টিয়ার বাউল হারকানাথ দাশের আমি কোথায় পাবো তারে গান থেকে।
তা ছাড়া অনেক রবীন্দ্রভক্তরা
ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা
তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা
ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।
এই গানটিকেও রবীন্দ্রনাথের বলে চালিয়ে দেন অথচ এই গানের আসল রূপকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ।
রবী ঠাকুর বিশ্ব কবি থাকে অসম্মান করাটা নজরুলপ্রীতি হতে পারে না।তাকে অসম্মান করার জন্য এই লিখাটা নয় বরং কিছু রবীন্দ্রভক্ত যারা নজরুলকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন তাদের জন্যই লিখা।
নজরুল পূর্বেও অবহেলিত ছিলেন এখনো অবহেলিত।আমরা সত্যিই অভাগা জাতি।সম্মানীদের সম্মান দিতে ব্যর্থ ।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন
# বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি,
আমি নেতা হতে আসিনি-
আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম,
প্রেম পেতে এসেছিলাম #
কাজী মোতাহার হোসেনের কাছে লেখা কবি নজরুলের একটি চিঠির কয়েকটি লাইন দিলাম ।
সুন্দরের অবহেলা আমি সইতে পারি না বন্ধু, তাই এতো জ্বালা। ভিক্ষে যদি কেউ তোমার কাছে চাইতেই আসে অদৃষ্টের বিরম্বনায়, তাহলে তাকে ভিক্ষা নাই দাও, কুকুর লেলিয়ে দিও না। আঘাত করবার একটা সীমা আছে। সেটাকে অতিক্রম করলে আঘাত অসুন্দর হয়ে আসে। আর তক্ষুণি তার নাম হয় অবমাননা।
ছেলেবেলা থেকে পথে পথে মানুষ আমি। যে স্নেহে যে প্রেমে বুক ভরে ওঠে কাঁনায় কাঁনায় তা কখনো কোথাও পাই নি আমি। এবার চিঠির উত্তর দিতে বড্ড দেরী হয়ে গেলো। না জানি কতো উদ্বিগ্ব হয়েছো। কি করি বন্ধু, শরীরটা এতো বেশী বেয়াড়া আর হয়নি কখনো। অষুধ খেতে প্রবৃত্তি হয়না।
আমায় সবচেয়ে অবাক করে নিশুতি রাতের তারা। তুমি হয়তো অবাক হবে, আমি আকাশের প্রায় সব তারাগুলোকে চিনি। তাদের সত্যিকারের নাম জানিনে। কিন্তু তাদের প্রত্যেকের নামকরণ করেছি আমার ইচ্ছেমতো। সেই কতোরকম মিষ্টি মিষ্টি নাম, শুনলে তুমি হাসবে। কোন তারা কোন ঋতূতে কোন দিকে উদয় হয় সব বলে দিতে পারি। জেলের ভেতর যখন সলিটারি সেলে বন্ধ ছিলাম তখন গরমে ঘুম হতো না। সারারাত জেগে কেবল তারার উদয়াস্ত দেখতাম। তাদের গতিপথে আমার চোখের জল বুলিয়ে দিয়ে বলতাম, বন্ধু, ওগো আমার নাম না জানা বন্ধু, আমার এই চোখের জলের পিচ্ছিল পথটি ধরে তুমি চলে যাও অস্তপারের পানে। আমি শুধু চুপটি করে দেখি। হাতে থাকতো হাতকড়া। দেয়ালের সঙ্গে বাধা চোখের জলের রেখা আঁকাই থাকতো মুখে, বুকে। আচ্ছা বন্ধু, ক'ফোটা রক্ত দিয়ে এক ফোঁটা চোখের জল হয় তোমাদের বিজ্ঞানে বলতে পারে? এখন শুধু কেবলই জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করে, যার উত্তর নেই, মিমাংসা নেই, সেইসব জিজ্ঞাসা।
যেদিন আমি ঐ দূরের তারার দেশে চলে যাবো, সেদিন তাকে বলো, এই চিঠি দেখিয়ে, সে যেন দু'ফোটা অশ্রুর দর্পন দেয় শুধু আমার নামে। হয়তো আমি সেদিন খুশীতে উল্কা ফুল হয়ে তার নোটন খোঁপায় ঝড়ে পড়বো। তাকে বলো বন্ধু, তার কাছে আমার আর চাওয়ার কিছুই নেই। আমি পেয়েছি, তাকে পেয়েছি, আমার বুকের রক্তে, চোখের জলে। আমি তার উদ্দেশ্যে আমার শান্ত স্নিগ্ধ অন্তরের পরিপূর্ণ চিত্তের একটি সশ্রদ্ধ নমস্কার রেখে গেলাম। আমি যেন শুনতে পাই, সে আমারে সর্বান্তকরণে ক্ষমা করেছে। ফুলের কাঁটা ভুলে গিয়ে তার উর্ধ্বে ফুলের কথাই যেন সে মনে রাখে।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ১২:৫২